মঙ্গলবার, ১ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

ভাসানীর স্যান্ডউইচ খাওয়া এবং গয়েশ্বরের শাহি ভোজ

মহিউদ্দিন খান মোহন

ভাসানীর স্যান্ডউইচ খাওয়া এবং গয়েশ্বরের শাহি ভোজ

১৯৭২ সাল। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন চিকিৎসার জন্য লন্ডনে। দুই মাসের অধিককাল সেখানে ছিলেন। তিনি বিদেশে থাকাকালে ৩ সেপ্টেম্বর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি একটি জনসভা করে পল্টন ময়দানে। সে সময় চাল-ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম ক্রমাগত বাড়ছিল। কেউ কেউ দেশে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করছিলেন। মূলত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদ এবং তা নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারকে সতর্ক করে দিতেই ওই জনসভার আয়োজন করা হয়েছিল। দলের সভাপতি মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে জনসভা শেষে তাঁরই নির্দেশে শুরু হয় ‘ভুখামিছিল’। মিছিলের মূল স্লোগান ছিল- ‘কেউ খাবে, কেউ খাবে না, তা হবে না, তা হবে না’।

মওলানা ভাসানী সেই মিছিলের নেতৃত্ব দেন। তাঁর নেতৃত্বে সেই বিশাল মিছিল গিয়ে পৌঁছে তৎকালীন গণভবনের (বর্তমান সুগন্ধা) সামনে। গণভবনে সে সময় অবস্থান করছিলেন অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদসহ সিনিয়র নেতারা। তাঁরা অপেক্ষা করছিলেন হুজুরের জন্য। মওলানা ভাসানী মিছিলসহ সেখানে পৌঁছালে তাঁকে যথাযথ সম্মান জানিয়ে ভিতরে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর সঙ্গে ছিলেন কাজী জাফর আহমদ, হায়দর আকবর খান রনো ও রাশেদ খান মেনন। মওলানা ভাসানী দেশের খাদ্যাভাব এবং আসন্ন দুর্ভিক্ষ নিয়ে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে কথা বলেন এবং ন্যাপের পক্ষ থেকে একটি স্মারকলিপি তুলে দেন। এ সময় অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী মিষ্টি ও স্যান্ডউইচ দিয়ে মওলানা ভাসানীকে আপ্যায়ন করেন। উপস্থিত ফটোসাংবাদিকরা সে ছবি তুলে নেন। পরদিন তা দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলাসহ প্রধান পত্রিকাগুলোর প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয়। ওই ছবি প্রকাশিত হলে মওলানা ভাসানীকে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। বিরুদ্ধবাদী পত্রিকাগুলো এই বলে সমালোচনা করে যে, বাইরে হাজার হাজার ভুখা মানুষকে রেখে তিনি কীভাবে সরকারের দেওয়া স্যান্ডউইচ খেলেন? মওলানা ভাসানী অবশ্য সেসব সমালোচনার কোনো প্রতি উত্তর করেননি। সম্ভবত তিনি পরে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন, কাজটি ঠিক হয়নি এবং তা তাঁর ভাবমূর্তিতে কিছুটা হলেও আঘাত করেছে। সে সময় আমি অষ্টম শ্রেণির ছাত্র এবং ওই বছরই ৩ জুন অনুষ্ঠিত সম্মেলনের মাধ্যমে গঠিত শ্রীনগর থানা (মুন্সীগঞ্জ) বাংলাদেশ বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হয়েছি। পরদিন পত্রিকায় ছবি দেখে তা নিয়ে আলাপ করলাম সংগঠনের দফতর সম্পাদক আমার মামাতো ভাই রিয়াজউদ্দিন আহমদের (শাহ আলম) সঙ্গে। তিনি বললেন, বাদল দা এলে তার সঙ্গে কথা বলতে হবে। বাদল দা মানে আমার বড় ভাই গিয়াসউদ্দিন খান বাদল তখন ন্যাপের কেন্দ্রীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, হুজুর হয়তো সরল মনেই খেয়েছেন। তবে এটা নিয়েও যে পলিটিক্স হতে পারে সেটাই বিস্ময়ের ব্যাপার। আমরা কেন তাঁর খাওয়াটা দেখব? আমরা দেখব তিনি এ দেশের লাখ লাখ নিরন্ন মানুষের ন্যায্য দাবির পক্ষে কী ভূমিকা রাখলেন সেটা। আমরা আর কথা বাড়াইনি। তা ছাড়া রাজনীতির ‘আদর্শ লিপি’ পড়া অবস্থায় এর উচ্চমার্গীয় বিষয়ে মাথা ঘামানোর সাহসও পাইনি। তবে আমার আজও মনে হয় হুজুর সেদিন স্যান্ডউইচ না খেলেও পারতেন।

৫০ বছর পরে সেই ঘটনাটি মনে পড়ল গেল ২৯ জুলাই রাজধানীতে ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনার খবর দেখে। সেদিন ছিল বিএনপি আহূত ঢাকার প্রবেশপথে অবস্থান কর্মসূচি। আগের দিন ‘মহাসমাবেশ’ থেকে ওই কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছিল। নেতাদের নির্দেশ ছিল, যারা মহাসমাবেশে যোগ দিয়েছেন তারা অন্তত ১০ দিন ঢাকায় থেকে সরকারের পতন ঘটাতে ভূমিকা রাখবেন। বলা হয়েছিল, মহাসমাবেশে অংশ নেওয়া প্রতিটি নেতা-কর্মীকে পরদিন ঢাকার প্রবেশপথে অবস্থান নিতে হবে। স্পট দেওয়া হয়েছিল যাত্রাবাড়ী, নয়াবাজার, গাবতলী এবং উত্তরার আবদুল্লাহপুর। তবে সমাবেশে যে পরিমাণ লোকসমাগম হয়েছিল তার এক দশমাংশও পরদিনের অবস্থান কর্মসূচিতে অংশ নেয়নি। আমি আমার পরিচিত বেশ কয়েকজনকে ফোন করে জানতে চেয়েছিলাম তারা কে কোন স্পটে রয়েছেন। তাদের কেউ বলেছেন, তিনি গ্রামের বাড়িতে, কেউ বলেছেন অফিসে, আবার কেউ বলেছেন বাসায় মহররমের খিচুড়ি খাচ্ছেন। বুঝে গেলাম এ কর্মসূচির পরিণতি কী হবে।

দীর্ঘদিন পর বিএনপি একটি অ্যাকশনধর্মী কর্মসূচি দিয়েছিল। ফলে কমবেশি সবারই আশঙ্কা ছিল না জানি কী ঘটে! এ কর্মসূচিই চলমান রাজনীতিকে সহিংসতায় নিয়ে যায় কি না এ শঙ্কাও ছিল। তাই সকাল থেকেই টেলিভিশন খুলে বসে ছিলেন অনেকে। সংবাদদাতাদের লাইভ রিপোর্টিং থেকে প্রতি মুহূর্তের ঘটনাবলি জানা যাচ্ছিল। দুপুরে খবরে জানা গেল প্রায় প্রতিটি স্পটে পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ হয়েছে। এরই মধ্যে ধোলাইখাল এলাকায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায়ের আহত এবং সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুস সালাম আজাদের গ্রেফতার হওয়ার সচিত্র খবর প্রচারিত হলো। ইটের আঘাতে মাথার বাঁ দিকে থেকে রক্ত ঝরছিল গয়েশ্বর রায়ের। টিভি ফুটেজে আরও দেখা গেল তিনি রাস্তায় পড়ে গেছেন এবং কয়েকজন পুলিশ তাকে ঘিরে রেখেছে। এহেন দৃশ্য সংগত কারণেই সবাইকে ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ করেছে। একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদের এভাবে রাস্তায় আহত হয়ে পড়ে থাকা মোটেও প্রত্যাশিত নয়। পরে পুলিশের গাড়িতে গয়েশ্বর বাবুকে নিয়ে যাওয়া হয় ডিবি কার্যালয়ে। খবরে বলা হলো, সেখানে তাঁকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে পুলিশ বাসায় পৌঁছে দিয়েছে। এরই মধ্যে সামাজিক মাধ্যমে তোলপাড় করা একটি ছবি ছড়িয়ে পড়ল। দেখা গেল মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা গয়েশ্বরচন্দ্র রায় বসে আছেন একটি সেক্রেটারিয়েট টেবিলের পাশে। দেয়ালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অফিশিয়াল পোর্ট্রটে শোভা পাচ্ছে। আর খবরের কাগজ বিছানো টেবিলে সাজানো রয়েছে হরেকরকম সুস্বাদু খাবার। জানা গেল সেসব খাবার আনা হয়েছে পাঁচ তারকা হোটেল সোনারগাঁও থেকে। গয়েশ্বর বাবুকে এ আপ্যায়ন করেছেন ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদ। খুবই আন্তরিক পরিবেশে খাওয়াদাওয়া করেছেন গয়েশ্বরচন্দ্র রায়। সকালে পুলিশের পিটুনি খাওয়ার পর যে ক্ষোভের অভিব্যক্তি তাঁর চোখেমুখে থাকার কথা তখন তার চিহ্নও ছিল না। বরং ডিবিপ্রধান হারুন সাহেব যখন গয়েশ্বর বাবুর প্লেটে খাবার তুলে দিচ্ছিলেন তখন তিনি তা আন্তরিকভাবেই গ্রহণ করছেন।

এ ছবি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পরে নানাজন নানা মন্তব্য করতে থাকেন। কেউ কেউ একে রাজনৈতিক শিষ্টাচার এবং সম্প্রীতি-সৌহার্দ্যরে উদাহরণ বলে মন্তব্য করেছেন। কেউ বলেছেন এটা ‘গরু মেরে জুতা দান’ প্রবাদের উদাহরণ। আবার অনেকে এটাকে ডিবিপ্রধানের নাটক বলেও অভিহিত করেন। কেউ বলেছেন, জোর করে হয়তো খাওয়ানো হয়েছে। যদিও এ বিষয়ে গয়েশ্বরচন্দ্র রায় জোরাজুরির কোনো কথা বলেননি। তবে যারা বলছেন এটা সাজানো নাটক, তারা ভুলে যাচ্ছেন, সেই নাটকে অন্যতম একজন অভিনেতা গয়েশ্বর বাবু নিজে। তা ছাড়া তিনি তো দুধের শিশু নন যে তাঁকে জোর করে খাওয়ানো সম্ভব। তিনি যদি বলতেন, যে পুলিশ আমাকে রাস্তায় ফেলে পিটিয়েছে, তাদের দেওয়া খাবার আমি খাব না, তাহলে কার সাধ্যি ছিল তাঁকে এক ফোঁটা জল খাওয়ায়? কিন্তু তিনি সহাস্যবদনে হৃষ্টচিত্তেই শাহিখানা গ্রহণ করেছেন। অনেকের মনেই প্রশ্ন জেগেছে, গয়েশ্বর বাবু যখন ডিবিপ্রধানের খাস মেহমান হিসেবে সাদরে আপ্যায়িত হচ্ছিলেন, তখন কি তাঁর রাস্তায় রেখে যাওয়া কর্মীদের কথা মনে পড়েছিল? যারা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে আহত হয়েছিল, গ্রেফতার হয়েছিল তাদের কথা কি তাঁর স্মরণে ছিল?

এ লেখা যখন লিখছি তখন ফোন এলো এক পুরনো সহকর্মীর কাছ থেকে। তাঁর প্রশ্ন- যে নেতা পাঁচ তারকা হোটেলের সামান্য খাবারের লোভ সামলাতে পারেন না, সেই নেতা যদি সরকারের তরফ থেকে আরও বড় কোনো অফার পান, তাহলে কী হবে? বললাম, কী আর হবে, তিনি কবিগুরুর গান- ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে’ গাইতে গাইতে চলতে শুরু করবেন। আকাশবাতাস বিদীর্ণ করা একটি অট্টহাসি দিয়ে সহকর্মী বললেন, তা যা বলেছেন দাদা! অন্যদিকে গাবতলীতে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন বিএনপি নেতা আমান উল্লাহ আমান। তাঁকেও পুলিশ গাড়িতে করে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে খাবার ও ফলমূল পাঠানো হয়েছে অসুস্থ নেতার জন্য। প্রধানমন্ত্রীর সেই উপহার আমানকে এতটাই কৃতার্থ করেছে যে তিনি প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদও জানিয়েছেন। কেউ কিছু পাঠালে তা গ্রহণ করে ধন্যবাদ জানানো শিষ্টাচার সন্দেহ নেই। সেদিক দিয়ে আমান ঠিকই করেছেন। তবে কথা একটাই- এটাও যদি সরকারের পরিকল্পিত নাটক হয়ে থাকে সেই নাটকে কেন অভিনয় করলেন তাঁরা? পরে একটি ভিডিও ক্লিপে দেখা গেল আমান অস্ফুট কণ্ঠে বলছেন, তাঁকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে খাবার ও ফলমূলের ছবি তুলে তা ভাইরাল করা হয়েছে। কিন্তু আমার মতো অনেকেই সেই ভিডিও ক্লিপটি দেখেছেন, যেটিতে আমান প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ দিচ্ছিলেন।

গয়েশ্বর চন্দ্র রায় এবং আমান উল্লাহ আমান যখন আলোচনার শীর্ষে তখন আরেকটি প্রশ্ন বিএনপি নেতা-কর্মীদের ভীষণভাবে তাড়িত করছে। সমাবেশের পর নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল সবাইকে পরদিন অবস্থান কর্মসূচিতে অংশ নিতে এবং শীর্ষ নেতারা তাতে নেতৃত্ব দেবেন। কিন্তু গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আমান উল্লাহ আমান আর আবদুস সালাম আজাদ ছাড়া তেমন কোনো বড় নেতাকে মাঠে দেখা যায়নি। এমনকি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সেদিন কোথায় ছিলেন তা-ও জানা যায়নি। যদিও সন্ধ্যায় তাঁকে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করতে দেখা গেছে।

অথচ এ কর্মসূচিটি নাকি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশেই ঘোষণা করা হয়েছিল। এমন একটি কর্মসূচিতে শীর্ষ নেতাদের অনুপস্থিতি সংগত কারণেই আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নিয়ে মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মনে সংশয় সৃষ্টি করবে সন্দেহ নেই। বিশেষ করে মহাসমাবেশ ও অবস্থান ধর্মঘটের মতো গরম কর্মসূচির পর জেলা ও মহানগরে বিক্ষোভ সমাবেশের মতো নরম কর্মসূচি (৩১ জুলাই পালিত) আন্দোলনের ঢেউ জাগাতে পারবে কি না তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। অবশ্য মহাসচিব মির্জা আলমগীর বলেছেন পরে আবার এক দফা আন্দোলনের কর্মসূচি দেওয়া হবে। তবে সেই কর্মসূচি কতটা সফল হবে, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। যে দলের নেতারা সরকারের পুলিশ বাহিনীর হাতে লাঞ্ছিত হওয়ার পর তাদের আপ্যায়ন প্রত্যাখ্যান করার হিম্মত রাখেন না, তাঁরা কর্মীদের ‘আপসহীন’ হওয়ার আহ্বান জানাবেন কোন মুখে?

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক

সর্বশেষ খবর