বুধবার, ২ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

কম্বোডিয়ার নির্বাচন পরিপ্রেক্ষিত বাংলাদেশ

শহীদুল্লাহ ফরায়জী

কম্বোডিয়ার নির্বাচন পরিপ্রেক্ষিত বাংলাদেশ

কিংডম অব কম্বোডিয়ায় নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে, আর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে নির্বাচন আসন্ন। কম্বোডিয়ায় রাজনৈতিক উত্তরাধিকার নির্ধারণ হয়েছে, বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দলের উত্তরাধিকার প্রশ্নটি অমীমাংসিত রয়েছে। দুই দেশের নির্বাচন ও উত্তরাধিকার নির্ধারণের নীতিগত প্রশ্নে সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা। 

সম্প্রতি কম্বোডিয়ার সাধারণ নির্বাচনে একতরফাভাবে প্রধানমন্ত্রী হুন সেনের দল আবারও ভূমিধস বিজয় লাভ করেছে।  শক্তিশালী বিরোধী দল ছাড়া, প্রতিযোগিতা ছাড়া, প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়া নির্বাচনটি বিশ্বব্যাপী ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর দল কম্বোডিয়ান পিপলস পার্টি (সিপিপি) নির্বাচনী দৌড়ে একাই লড়েছে, একাই নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করেছে। বিগত তিন দশক ধরে গণতন্ত্রকে সংকুচিত করে, প্রতিপক্ষকে নিপীড়ন-নির্যাতনের জাঁতাকলে পিষ্ট করে প্রধানমন্ত্রী দৃশ্যত বিরোধী দলকে প্রতিযোগিতার বাইরে ঠেলে দিয়েছেন। ফলে নির্বাচনে প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করতে হয়নি। কম্বোডিয়ার এবারের সাধারণ নির্বাচনে মেরুদন্ডহীন, গণবিচ্ছিন্ন ১৭টি দল অংশগ্রহণ করে। যারা ২০১৮ সালের নির্বাচনে একটি আসনও পায়নি। সুতরাং প্রধানমন্ত্রী হুন সেনের দল জনগণের সম্মতি ও প্রতিযোগিতাবিহীন ভূমিধস বিজয়ের হাস্যকর সামর্থ্য অর্জন করে। হুন সেন ক্ষমতায় রয়েছেন ৩৮ বছর ধরে। প্রায় সারা বিশ্বই এ দীর্ঘদিনের ক্ষমতাকে ধোঁকাবাজির মডেল হিসেবে বিবেচনা করছে। দুই মাস আগে প্রধান বিরোধী দল ক্যান্ডেল লাইট পার্টিকে নিবন্ধন সংক্রান্ত কাগজপত্রের ঘাটতি দেখিয়ে, আইনের কৌশলে নিষিদ্ধ করে নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্য করে তোলে। অর্থাৎ ক্যান্ডেল লাইট পার্টির নির্বাচনে অংশগ্রহণ করাকে অবৈধ ঘোষণা করেছে।

গত বছর স্থানীয় নির্বাচনে যারা সরকারের প্রচন্ড ভয়ভীতি প্রদর্শন, ভোট জালিয়াতি, হুমকি-ধমকি উপেক্ষা করেও ২২% ভোট পায়। তাদেরই নিষিদ্ধ ও অবৈধ ঘোষণা করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া কোনোক্রমেই গ্রহণীয় হতে পারে না।

এশিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি ‘গণতান্ত্রিক স্বৈরশাসক’ হুন সেন ১৯৮৫ সাল থেকে ক্ষমতা ধরে রেখেছেন। ফ্যাসিবাদ-নাৎসিবাদকে যেভাবে চিহ্নিত করা যায় এটাকেও ‘নির্বাচিত স্বৈরাচার’ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। ক্ষমতা ধরে রাখার এসব অগণতান্ত্রিক কৌশল কেবলই গণতন্ত্রের ধ্বংস ডেকে আনে। বিরোধী দলের ওপর জেল, জুলুম, মামলা, কারণে-অকারণে গ্রেফতার ও কঠোর ব্যবস্থা প্রয়োগ, সামরিক বাহিনী, পুলিশসহ রাষ্ট্রের প্রশাসনকে হাতের মুঠোয় রেখে হুন সেন অপকীর্তির ওপর নির্ভর করে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করছেন। এমনকি দেশের আদালতকেও ব্যবহার করছেন ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে। এর ধারাবাহিকতায় এবারের নির্বাচনেও কম্বোডিয়ান পিপলস পার্টি ১২৫ আসনের পার্লামেন্টে জিতেছে ১২০ আসনে আর সরকারের পাতানো বিরোধী দল ফানসিনপেক পার্টি পেয়েছে পাঁচটি আসন।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এ দেশটি টানা ৩৮ বছর নিয়ন্ত্রণ করছেন জনসংযোগ বিচ্ছিন্ন নির্বাচনী মডেলের স্বৈরশাসক প্রধানমন্ত্রী হুন সেন। কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রীর বয়স এখন ৭০ বছর। তাই তিনি ২০২১ সালেই ক্ষমতা হস্তান্তরের লক্ষ্যে সর্বসম্মতভাবে ভবিষ্যতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর বড় ছেলে বর্তমান সেনাপ্রধান হুন মানেটকে মনোনীত করেছেন। এতে রাজনৈতিক উত্তরাধিকার নির্বাচনে জল্পনা-কল্পনার অবসান হয়েছে। ভাবী প্রধানমন্ত্রী হুন মানেটের বয়স এখন ৪৫ বছর। কর্তৃত্ববাদী শাসনের আদর্শই হচ্ছে রাষ্ট্রযন্ত্রকে পদ্ধতিগতভাবে শাসকদের ইচ্ছা পূরণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা।

অতীতের একনায়কতান্ত্রিক শাসনের পথ অনুসরণ করে হুন সেন ক্ষমতার ব্যক্তিগতকরণ সম্পন্ন করেছেন। গত ৩৮ বছর ধরে পরিবার ও আত্মীয়দের রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন পর্যায়ে নিয়োগ দান, নিরাপত্তা ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ, নিজস্ব বলয়ে আধাসামরিক বাহিনী গঠন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় একচেটিয়া কর্তৃত্ব- কম্বোডিয়ায় সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। তাঁর দল ১৯৭৯ সাল থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এ দেশটি শাসন করছে। জনপ্রিয় বিরোধী দল- যারা সরকারের পতন ঘটাতে পারে তাদের কাল্পনিক অভিযোগে নিষিদ্ধ করা, বল প্রয়োগে বিক্ষোভ দমন করা, নাগরিক অধিকার, রাজনৈতিক অধিকার খর্বকরণ, সুশীল সমাজকে সীমিতকরণ এবং গণমাধ্যমকে কঠোর নিয়ন্ত্রণ করে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার পথ প্রশস্ত করাই আছে। হুন সেন ২৭ জুলাই বুধবার, জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে পদত্যাগ করেছেন ছেলের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য।

কিংডম অব কম্বোডিয়ার সংবিধানের preamble বলা  হয়েছে : ‘একটি মহান সভ্যতার উত্তরাধিকারসমৃদ্ধ, শক্তিশালী এবং গৌরবময় জাতির যার প্রতিপত্তি বিকিরণ করে একটি হীরার ন্যায়। দুর্ভোগ এবং ধ্বংস সহ্য করে এবং দুই দশক সময় ধরে মর্মান্তিক অবনতির পর কম্বোডিয়া জেগে ওঠে এবং জাতীয় ঐক্য সুদৃঢ় করার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। কম্বোডিয়ার ভূখ- রক্ষা এবং সংরক্ষণ, এর মূল্যবান সার্বভৌমত্ব এবং আঙ্কর সভ্যতার মর্যাদা রক্ষা করা ও বহুদলীয় উদার গণতান্ত্রিক শাসনের প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে কম্বোডিয়াকে একটি ‘শান্তির দ্বীপে’ পুনরুদ্ধার করা। মানবাধিকার, আইনের প্রতি শ্রদ্ধা, জাতির ভাগ্যের দায়িত্ব এবং উন্নয়ন, সমৃদ্ধি ও গৌরবের অগ্রযাত্রায় শামিল থাকা’। কিন্তু কম্বোডিয়া আজকের বিশ্ব ব্যবস্থায় কর্তৃত্ববাদী আদর্শের এক মডেলে রূপান্তিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী হুন সেন সর্বশেষ প্রহসনমূলক ও জালিয়াতিপূর্ণ একটি সাধারণ নির্বাচন সম্পন্ন করেছেন। ক্ষমতার এবং রাজনৈতিক উত্তরাধিকার নির্বাচনের প্রশ্নে সিরিয়ার হাফিজ আল আসাদ, কঙ্গোর লরেন্ট কাবিলা এবং উত্তর কোরিয়ার কিম জং উনের মতো কম্বোডিয়ার হুন সেন একই পথ বেছে নিয়েছেন। এ রুদ্ধদ্বার গণতন্ত্র বা নির্বাচনী স্বৈরতন্ত্র অব্যাহত থাকায় বিশ্ব রাজনীতির চাপের মুখে পড়েছে দেশটি। জবাবদিহিহীন শাসনব্যবস্থার ভয়াবহ ক্ষতি এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদের লুণ্ঠনে কম্বোডিয়ার সংকটের গভীরতা ও ব্যাপ্তি এ পরিসরে আলোচনা করা সম্ভব নয়।

কম্বোডিয়ার নিরিখে গণতন্ত্রের সংকটের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের একটি চালচিত্র বিশ্লেষণ করা যায়। আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের প্রকৃতি এবং মাত্রা বহুমুখী। প্রকৃত ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের চেয়ে সাজানো নির্বাচন, আমাদের নৈতিকতায় অনুপ্রবেশ করেছে। ফলে নির্বাহী বিভাগ হয়ে পড়েছে ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার। বাংলাদেশের বাস্তবতায়- বিরোধী দল বিএনপির নেতাদের বিরুদ্ধে আগুন সন্ত্রাসসহ পুরনো বা নতুন গায়েবি মামলা চালু করার একটি পদক্ষেপ নিলেই বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখার সুযোগ সৃষ্টি হবে। নির্বাচনকালে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার গঠনের দাবি সরকার খারিজ করে দিলেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপিসহ বিরোধী দলের অংশগ্রহণের সব পথ রুদ্ধ হয়ে পড়বে। সংবিধানের দোহাই দিয়ে ২০১৪ এবং ২০১৮-এর মতো ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত এবং স্বাধীনতা বিরোধী আখ্যায়িত করে নির্বাচনকে এককভাবে জয়লাভের উপায় হিসেবে সরকার ব্যবহার করতে পারে। আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সরকারের রাজনৈতিক বক্তব্যে প্রমাণ হয়- বিরোধী দলের চলমান আন্দোলনকে উপেক্ষা করে বাংলাদেশে আরেকটা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার নির্বাচনের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হতে পারে। এতে সমাজের বিভাজন আরও গভীর ও প্রসারিত হবে এবং স্থিতিশীলতায় বড় ধরনের হুমকি তৈরি করবে।

ক্ষমতাসীন সরকার ক্ষমতা ধরে রাখার প্রশ্নে বিরল দৃষ্টান্তের অধিকারী। তারা কোনোক্রমেই বিরোধী দলের রাজনীতি নিষিদ্ধ করবে না; পুরোপুরি নির্মূলও করবে না। নির্বাচন   বর্জন বা প্রতিহত করার ঘোষণাকেও আইনগতভাবে নিষিদ্ধ করবে না।

সাংবিধানিকভাবে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করবে না। নিয়ন্ত্রণ করবে তবে সকাল-বিকাল পত্রিকা বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ডিক্লারেশন বাতিল করবে না। বিএনপি, গণতন্ত্র মঞ্চ, বামজোট এবং ইসলামী দলসমূহের নির্বাচন বর্জনের সুবাদে প্রতিযোগিতাহীন নির্বাচনে জালিয়াতি করার প্রয়োজন পড়বে না। তারা প্রমাণ হিসেবে হাজির করবে- দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়। গণতন্ত্র যে মৃত্যুবরণ করেনি তার জন্য সরকারি দল বড় বিজয় মিছিলের আয়োজন করবে। নির্বাহী বিভাগ সাংবিধানিক নির্দেশ মোতাবেক নির্বাচনকে সহযোগিতা করেছে বলে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব সংস্থা বা ব্যক্তিকে সংবিধানের রক্ষক ও সমর্থক হিসাবে ‘শুদ্ধাচার’ পদক দেবে। নির্বাচনকেন্দ্রিক জটিলতার সহজ সমাধান করে ফেলার জন্য সরকার পরম তৃপ্তির সঙ্গে আত্মতুষ্টি প্রকাশ করবে। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে, বৈশ্বিক বড় বড় শক্তির আকাক্সক্ষার সঙ্গে সংঘর্ষের কারণে- ভূরাজনীতিতে দেশ চরম সংকটে পড়তে পারে।

নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতিতে কম্বোডিয়াকে গণতন্ত্র হত্যার বৈধতা না দেওয়ার বৈশ্বিক প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কম্বোডিয়ায় ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে রাজনৈতিক উত্তরাধিকার নির্ধারণের প্রশ্নটি আবার সামনে চলে আসছে।

বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন দলের উত্তরাধিকার নির্ধারণের বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হিসেবে বিবেচনা করতে হচ্ছে। এ দেশের ইতিহাসে অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ক্ষমতার উত্তরাধিকার নির্ধারণ বিদ্যমান বাস্তবতায় অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। এ প্রশ্নে দলের অভ্যন্তরে বা জাতীয় রাজনীতির পরিসরে কোনো পর্যালোচনা দেখা যায় না। জনগণের কাছেও তা রহস্যের অবগুণ্ঠনে আবৃত আছে। এ নিয়ে অতীত ইতিহাসের শিক্ষা বা সাক্ষ্য থেকে একটি বাস্তব পর্যালোচনা উপস্থাপন করছি।

বিশ্ব এবং উপমহাদেশের রাজনৈতিক ধারাবাহিকতায় পরিবারের মধ্য থেকে রাজনৈতিক উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ও হচ্ছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর মেয়ে ইন্দিরা গান্ধী ও তাঁর ছেলে রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর মেয়ে বেনজির ভুট্টোও প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন।  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তাঁর কন্যাও প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি ছিলেন, তাঁর স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াও প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। ঐতিহ্যগতভাবে পরিবার থেকে রাজনৈতিক উত্তরাধিকার নির্ধারণই বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

 

লেখক : গীতিকবি

[email protected]

সর্বশেষ খবর