বুধবার, ২ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা
স্মরণ

বিচারপতি সৈয়দ এ বি মাহমুদ হোসেন জনস্বার্থ রক্ষায় সচেষ্ট ছিলেন

ড. কামাল হোসেন

বিচারপতি সৈয়দ এ বি মাহমুদ হোসেন জনস্বার্থ রক্ষায় সচেষ্ট ছিলেন

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠার পর বিচারপতি সৈয়দ এ বি মাহমুদ হোসেন ছিলেন দ্বিতীয় প্রধান বিচারপতি। পরবর্তীতে গণপরিষদে সংবিধান গৃহীত হলে সুপ্রিম কোর্ট যখন আনুষ্ঠানিকভাবে সংবিধানের অভিভাবক হিসেবে আবির্ভূত হয় তখন বিচারপতি সৈয়দ এ বি মাহমুদ হোসেন ১৮ নভেম্বর ১৯৭৫ সাল থেকে ৩১ জানুয়ারি ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করেন।

পূর্ব পাকিস্তান হাই কোর্টের সহকারী কৌঁসুলি (Assistant Government Pleader) হিসেবে তিনি সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা অর্জনে সক্ষম হন। তিনি ১৯৬৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানের অ্যাডভোকেট জেনারেল ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি ১৮ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে হাই কোর্ট ডিভিশনে বিচারপতি নিযুক্ত হন। তিনি মর্যাদা সম্পন্ন দেওয়ানি আইনজীবী হিসেবে সবার শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন।

প্রধান বিচারপতি হিসেবে তার প্রদত্ত অধিকাংশ রায় ছিল সাংবিধানিক আইন সংশ্লিষ্ট। তিনি সর্বদা আইনের শাসন, সামাজিক মূল্যবোধ ও সাধারণ মানুষকে ন্যায় বিচার প্রদানের ওপর গুরুত্বারোপ করতেন। প্রধান বিচারপতি হিসেবে অভিষিক্ত হওয়ার পর তাঁর সংবর্ধনার জবাবে বুদ্ধিদীপ্ত দিক-নির্দেশনা দিয়ে তিনি বলেন, “যে সমাজ মানবিক মূল্যবোধ সম্পর্কে সচেতন, সেখানেই কেবল আইনের শাসনের পূর্ণ বিকাশ ঘটে। সে কারণে ছোটদের প্রতি ভালোবাসা, বড়দের প্রতি সম্মান, সমবয়সীদের প্রতি সহমর্মিতার মনোভাব থাকা প্রয়োজন।”

তিনি সর্বদা জনস্বার্থ রক্ষায় সচেষ্ট ছিলেন এবং সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কষ্টের প্রতি সংবেদনশীল ছিলেন। তিনি তাঁর অসংখ্য যুক্তিনিষ্ঠ ও সুচিন্তিত রায়ের মাধ্যমে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করেছেন। আইনের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ পূর্ণাঙ্গ রায় প্রদান করেছেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বাংলাদেশ ক্ষুদ্র শিল্প করপোরেশন, ঢাকা বনাম মাহবুব হোসেন চৌধুরী (২৯ ডিএলআর সুপ্রিম কোর্ট-৪১) যাতে তাঁর সিদ্ধান্ত ছিল “বিধিবদ্ধ সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ যেমন প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা, কর্মচারী নন তদ্রুপ তাদের মালিক শ্রমিক সম্পর্কের ভিত্তিতেও বিবেচনা করা যাবে না। কিন্তু তাদের চাকরি আইনের দ্বারা পরিচালিত হবে এবং তাদের শুনানির সুযোগ না দিয়ে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা যাবে না।”

তাঁর অন্য একটি উল্লেখযোগ্য রায়ে মেসার্স ইপি ল্যাম্পস লি., ঢাকা বনাম পাকিস্তানও অন্যান্য মামলায় (২৭ ডিএলআর আপিল বিভাগ ১৪৭) তিনি বলেন, “সরকারের প্রতি নোটিস জারি না করে অ্যাটর্নি জেনারেলের ওপর নোটিস জারি করায় আপিল এবেট (Abate) হবে, এটি একটি কৌশলগত (Technical) যুক্তি, যা অবশ্যই রক্ষণীয় নয়।”

তিনি সব সময় প্রতিটি মানুষের অধিকারের কথা চিন্তা করতেন। ১৯৭৬ সালে জাতিসংঘ আয়োজিত একটি গবেষণা ও পরিকল্পনা কর্মসূচিতে ফারাক্কা বাঁধ নিয়ে আলোচনার সময় বিচারপতি সৈয়দ এ বি মাহমুদ হোসেন পরিষ্কার ভাষায় বলেন, “আমাদের হৃদয়ের গভীরের অনুভূতি যদি প্রকাশ করি, তবে আমরা কখনই জনগণকে ভিটেমাটি থেকে বঞ্চিত করার চিন্তা যেমন করতে পারি না, তেমনি কাউকে প্রাকৃতিক সম্পদ ভোগ করা থেকে বঞ্চিত করতে পারি না। আর কাউকে প্রাকৃতিক পানি ভোগের সুবিধা থেকে বঞ্চিত করার তো প্রশ্নই ওঠে না।” প্রধান বিচারপতি হিসেবে কর্মরত থাকাকালীন তিনি আইনের শাসন ও আইনগত সহায়তা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে জোর দিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে বিচারপতি সৈয়দ এ বি মাহমুদ হোসেন বলেন, “আমাদের মতো গরিব দেশে উপযুক্ত আইনগত সহায়তা ব্যবস্থা ব্যতীত আইনের শাসনের গুরুত্ব অকার্যকর বলে গণ্য হবে।” বিচারপতি সৈয়দ এ বি মাহমুদ হোসেন মনে করতেন বিচার বিভাগের সফলতার ও জনগণের প্রতি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় আইনজীবীদের ভূমিকা অপরিসীম। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিচার বিভাগ, যেটি আইনের শাসনের রক্ষক, “তাঁর সফলতার জন্য আইনজীবীদের সহযোগিতা জরুরি। শুধু ত্যাগী আইনজীবীদের সহযোগিতায় বিচার বিভাগ তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারে। তিনি আইনজীবীদের সব সময় মনে করিয়ে দিতেন, সমাজের প্রতি ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে আইনজীবীদের পেশাগত দায়িত্ব রয়েছে। তাঁর মতে ন্যায়বিচার অর্জন ও প্রতিষ্ঠা করতে আইনজীবীগণ জনগণকে নেতৃত্ব দেবেন।”

লেখক : সংবিধান প্রণেতা ও রাজনীতিক

সর্বশেষ খবর