বৃহস্পতিবার, ৩ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

ভারতের মণিপুরে দুই নারীকে নগ্ন করে অপমান

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

ভারতের মণিপুরে দুই নারীকে নগ্ন করে অপমান

দেশে দেশে মধ্যযুগের বর্বরতা আমরা শুনেছি। ইতিহাসে পড়েছি। সেই বর্বরতা ভারতের অঙ্গরাজ্য মণিপুরকে গ্রাস করেছে। ঘটনার সূত্রপাত হওয়ার ৬০ দিনের মাথায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী প্যারিসে সওদা করতে গিয়েছিলেন। তাঁর  সেখানে থাকার দিনই প্যারিসে বসেছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্ট। ওই পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে অধিকাংশ সদস্যই একবিংশ শতাব্দীতে ভারতের মতো একটি গণতান্ত্রিক দেশে এ ঘটনার শুধু নিন্দাই করেনি, মোদিকে ধিক্কার জানিয়ে তাঁরা প্রস্তাব নিয়েছিল। ভারতের নতুন বিরোধী জোট আইএনডিআইএ (ইন্ডিয়া) এ ব্যাপারে বারবার মোদির বিবৃতি দাবি করেছে সংসদের ভিতরে। মোদির উত্তর আমি বিবৃতি দেব না। অন্যদিকে বিবৃতির দাবিতে অনড় সব বিরোধী দল। মোদি তাঁর দলের সংসদীয় বৈঠকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, আমরা বিজেপি-আরএসএস বিরোধীদের কোনো অভিযোগের জবাব দেব না। মোদি এদের মুজাহিদীন বলে উল্লেখ করে বলেছেন, এরা দেশভক্ত নয়। মোদি তাঁর দলের সাংসদদের সামনে বক্তৃতা করার পর সংসদের বাইরে দাঁড়িয়ে রাহুল গান্ধী তাঁকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলেছেন, সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধীদের কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ করা হচ্ছে, তা কাগজে লেখা যায় না।

রাজ্যসভায় বিরোধী দলের নেতা কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে সংসদের বাইরে দাঁড়িয়ে বলেছেন, ব্রিটিশরা প্রথমে ইস্ট ইন্ডিয়া দখল করে। মোদি তাঁদের অনুসরণ করে উত্তর-পূর্ব ভারত দখল করতে চাইছে। এর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এক বিজেপি নেতা তথা চিটকান্ডের দালালকে। সরকারি সূত্রে যে তথ্য পাওয়া যায়, সে তথ্য বারবার উঠে এসেছে ইইউ পার্লামেন্টেও। ইইউ পার্লামেন্টে অভিযোগ করা হয়, মণিপুরে প্রায় ২ হাজার গির্জা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সাধারণ মানুষের বাড়ি পোড়ানো হয়েছে সাড়ে ৩ হাজার। আর কতশত মানুষ মারা গেছে তা নিয়েও মণিপুরের আরএসএস-বিজেপি কোনো কথা বলতে চায় না। ওইদিকে মণিপুর-মিজোরাম সীমান্তে আজ পর্যন্ত আশ্রয়ের সন্ধানে প্রায় সাড়ে ৩০ হাজার মানুষ বসে আছেন। তাঁদের খাদ্য, বস্ত্র, ওষুধ নেই। এই নিরাশ্রয়ী মানুষগুলোর ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়েছে প্রতিবেশী রাজ্য মিজোরাম। এ ব্যাপারে তাঁরা দিল্লির কাছে টাকা চেয়েও প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। মোদির জেদ মণিপুরের পরিস্থিতি নিয়ে সংসদের কোনো কক্ষেই মুখ খুলবেন না। আর বিরোধীদেরও দাবি- প্রধানমন্ত্রীকে এ ব্যাপারে বিবৃতি দিতেই হবে।

মণিপুর নিয়ে নরেন্দ্র মোদি সরকারের বিরুদ্ধে ক্রমশ সুর চড়াচ্ছে বিরোধী শিবির। লোকসভায় সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব এনেছে বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’। পরে রাজ্যসভাতেও এমন প্রস্তাব আনা হতে পারে বলে খবর।

দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে গোষ্ঠী সংঘর্ষে উত্তপ্ত মণিপুর। সম্প্রতি মণিপুরে দুই নারীকে বিবস্ত্র করে ঘোরানো এবং গণধর্ষণের ঘটনার কথা প্রকাশ্যে এসেছে। একটি ভিডিও প্রকাশ্যে এসেছে সামাজিক মাধ্যমে। এ ঘটনাকে ঘিরে নতুন করে তেঁতে রয়েছে জাতীয় রাজনীতি। ৭৮ দিন মৌন থাকার পর মণিপুর নিয়ে মুখ খোলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি বলেছেন, ‘এ ঘটনা যে কোনো সভ্যসমাজের লজ্জা। তবে তাতে ক্ষোভের প্রশমন যে ঘটেনি, তা বিরোধীদের বিক্ষোভেই স্পষ্ট। মণিপুরের ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতির দাবিতে সরব বিরোধীরা। এ নিয়ে গত কয়েক দিন অচল সংসদের বর্ষাকালীন অধিবেশন। সংসদের উভয় কক্ষের অধিবেশন শুরু হওয়ার পর মণিপুর নিয়ে আলোচনা এবং প্রধানমন্ত্রীর জবাব চেয়ে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন বিরোধীরা। সরকার আলোচনায় রাজি বলে জানান প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং এবং সংসদীয় মন্ত্রী প্রহ্লাদ জোশী। তাঁরা এও বলেন, বিরোধীরা আলোচনা চাইছেন না বলেই অধিবেশন ভেস্তে দিচ্ছেন। বিরোধী-বিক্ষোভ সামাল দিতে আসরে নামেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তিনি বলেন, “সরকার মণিপুর নিয়ে আলোচনায় রাজি। বুঝতে পারছি না, বিরোধীরা কেন আলোচনা করতে চাইছেন না। মণিপুরের হিংসা নিয়ে দেশের মানুষের সত্য জানার অধিকার রয়েছে।” তবে শাহের মন্তব্যে বিরোধীদের বিক্ষোভ থামেনি। স্পিকার ওম বিড়লা জানান, “এ নিয়ে উত্তর দিলে তা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীই দেবেন।’ মণিপুরে হিংসার ঘটনার সঙ্গে যেহেতু আইনশৃঙ্খলার বিষয়টি জড়িত, তাই এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে শাহই যা বলার বলবেন। বিরোধীরা সংসদের বাইরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছেন। বিরোধীদের এহেন বিক্ষোভের আবহে বিজেপির সংসদীয় দলের সঙ্গে মোদির বৈঠক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

মণিপুরের কাংপোকপিতে কুকি সম্প্রদায়ের দুই নারীকে নগ্ন করে হাঁটানোর একটি ভয়ংকর ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর যৌন নিপীড়নের বেশ কয়েকটি ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে। বিভিন্ন অ্যাসোসিয়েশন দাবি করেছে, ৩ মে মণিপুরে হিংসা শুরু হওয়ার পর থেকে তিন মাসে অন্তত সাত কুকি-জোমি নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। যদিও মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং দাবি করেছেন, ধর্ষণের শুধু একটি ঘটনাই রিপোর্ট করা হয়েছে। “খুন, অগ্নিসংযোগ এবং দাঙ্গার অভিযোগসহ রাজ্যজুড়ে নথিভুক্ত ৬ হাজার ৬৮টি এফআইআরের মধ্যে ধর্ষণের একটি ঘটনা পাওয়া গেছে,” বীরেন সিং এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন। ৩ মে মণিপুরে জাতিগত হিংসা শুরু হওয়ার পর থেকে ১৬০ জনেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন।

২০০২ সালের গুজরাট গণহত্যার সঙ্গে তুলনায় চলে আসছে আজকের মণিপুর। সিপিআই (এম) সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি প্রশ্ন তুললেন, “সে জন্যই কি সংসদের মুখোমুখি হচ্ছেন না প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি? যিনি ২০০২-এর গণহত্যার সময় ছিলেন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী।

ইয়েচুরি বলেছেন, “প্রধানমন্ত্রী সংসদে বিবৃতি দিতে রাজি হচ্ছেন না, সংসদে বিরোধীরা প্রতিবাদে মুখর। সংসদ চলছে না। মোদি সরকারকে সংসদের কাছে জবাবদিহি করতে হবে।” মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং নিজে আদিবাসী কুকিদের অনুপ্রবেশকারী বলে এসেছেন দীর্ঘদিন। সংখ্যাগুরু মেইতেই জনগোষ্ঠীর দুষ্কৃতি বাহিনী যখন তান্ডব চালাচ্ছে, নীরব থেকেছে প্রশাসন। বিবস্ত্র করে হাঁটিয়ে পরে ধর্ষণের যে ঘটনাটি ছড়িয়েছে, সেখানেই আক্রান্ত কুকি পরিবারের সদস্যরা এ অভিযোগ তুলছেন। পুলিশই তাঁদের উন্মত্ত বাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছিল। ৩ মে থেকে সংঘর্ষে প্রতিদিন রক্তাক্ত হয়েছে মণিপুর। কার্যকরী কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কেন্দ্রে আসীন মোদি সরকারও। বস্তুত এই ভিডিও সামনে আসার আগে, একটি কথাও বলেননি প্রধানমন্ত্রী। অথচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্সে গিয়ে ভাষণ দিয়েছেন মোদিই।

মণিপুরের ঘটনা ভয়াবহ। একটি বা দুটি নয়। হঠাৎ করেও হয়নি। ৩ মে থেকে মানুষের জীবন, নারীদের সম্মান, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিপন্ন। বন্ধ করে রাখতে হচ্ছে ইন্টারনেট। প্রধানমন্ত্রী কেন বিশদে বিবৃতি দেবেন না? কেন বিশদে আলোচনা করতে দিতে রাজি নয় সরকার?

বিজেপি এবং কেন্দ্রে তাঁদের মন্ত্রীদের বক্তব্যের পাল্টা এমনই প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধীরা। এদিন লোকসভায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বিরোধীদের দায়ী করেন সংসদে অচলাবস্থার জন্য। পরপর তিন দিন হয়নি লোকসভা অধিবেশনে কোনো আলোচনা। শাহ বলেছেন, “আমি আলোচনার জন্য তৈরি। বিরোধীরা আলোচনা করতে দিতে রাজি নয় কেন বুঝতে পারছি না। সেই সুরেই লোকসভার অধ্যক্ষ ওম বিড়লা বলেছেন, “সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী আলোচনায় রাজি আছেন। তারপরও সংসদ চলতে না দেওয়া অনুচিত।’’

সরকারের বক্তব্যকে মেনে নিচ্ছেন না বিরোধীরা। কংগ্রেসের অন্যতম সাধারণ সম্পাদক জয়রাম রমেশও সরব হয়েছেন। তিনি বলেছেন, “বিরোধী ‘ইন্ডিয়া’র সব দলই প্রতিবাদে শামিল হয়েছে। সংসদ ভবনে গান্ধী মূর্তির সামনে বসেছে অবস্থানে। আসলে ভারত এবং মণিপুরের জনতার অনুভূতিই প্রকাশ করছে বিরোধীরা। প্রধানমন্ত্রী কেন বিশদে বিবৃতি দেবেন না। কোনো একটি মন্ত্রকের মন্ত্রীর বিষয় নয়, মণিপুরের অবস্থা ভয়ংকর।’’

রমেশ বলেছেন, “প্রধানমন্ত্রী আসলে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। জনতা চাইছে সংসদে বিশদে আলোচনা হোক, যন্ত্রণা প্রকাশিত হোক দেশের সংসদে। তিনি বারবার নিজের দায় অন্যের ওপর ঠেলে দেন, অন্যকে দায়ী করেন। মূল ঘটনা থেকে নজর অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেন। এই কৌশল চলবে না।’’

বিরোধীরা বলছেন, সংসদ পরিচালনার ২৬৭ ধারায় করতে হবে আলোচনা। সরকার বলছে, ১৭৬ ধারায় আলোচনা হলে রাজি, সেক্ষেত্রে আধা ঘণ্টা মাত্র চলবে আলোচনা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিবৃতি দেবেন। সরকারের মনোভাবের কড়া নিন্দা করেছেন রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা এবং কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে। তিনি বলেছেন, “২৬৭ ধারায় বিশদে আলোচনা করা যায়, প্রয়োজনে পরদিনও আলোচনা করা যায়। ভোট করারও সুযোগ থাকে। তাতে সরকার রাজি হবে না কেন। মণিপুরের ঘটনা অন্য কোনো কিছুর সঙ্গে তুলনা করা যায় না। সরকার পালাতে পারবে না।’’

দুই নারীকে বিবস্ত্র করে হাঁটানোর ঘটনায় যখন তোলপাড় মণিপুর, তখনই উত্তর-পূর্বের এ রাজ্যটিতে পড়শি দেশ থেকে লোক ঢুকছে বলে অভিযোগ করে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মণিপুর সরকার। মিয়ানমার থেকে গত কয়েক দিনে অনেকেই কাঁটাতার পেরিয়ে ভারতে অনুপ্রবেশ করেছেন। মণিপুরেও এসেছেন অনেকে। সীমান্তের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আসাম রাইফেলসের কাছে এ বিষয়ে রিপোর্ট তলব করেছে মণিপুর সরকার।

                লেখক : ভারতীয় সিনিয়র সাংবাদিক

সর্বশেষ খবর