বৃহস্পতিবার, ৩ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

কানাডা ভ্রমণ : কিছু অভিজ্ঞতা

তপন কুমার ঘোষ

কানাডা ভ্রমণ : কিছু অভিজ্ঞতা

গত ৮ জুলাই ২০২৩ কানাডার মাটিতে প্রথম পা রাখি। কানাডা ভ্রমণ এই প্রথম হলেও এর আগে দুবার যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণের সুযোগ আমার হয়েছিল। প্রথমবার ১৯৯৩ সালে। সেবার আমরা ২০ জন বাংলাদেশি ব্যাংকার টেনেসি ও নিউইয়র্কে ছয় মাসব্যাপী একটি প্রশিক্ষণ কোর্সে অংশগ্রহণ করেছিলাম। যুক্তরাষ্ট্র সরকার প্রশিক্ষণের যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করেছিল। দ্বিতীয়বার ২০২১ সালে, করোনাকালে। এটি ছিল ব্যক্তিগত ভ্রমণ।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের সুপরিসর এয়ারক্রাফট ‘ড্রিমলাইনার’ নির্ধারিত সময়ের ঘণ্টাখানেক আগেই মধ্যাহ্নে টরন্টো পিয়ারসন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। ঢাকা-টরন্টো রুটে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস সরাসরি চলাচল করে সপ্তাহে দুই দিন। শনি ও মঙ্গলবার। তুরস্কের রাজধানী ইস্তাম্বুলে কিছু সময়ের জন্য যাত্রাবিরতি দেয়। কিন্তু সেখানে যাত্রীদের নামতে বারণ। বিমানের এ সার্ভিসটা জনপ্রিয়তা পেয়েছে। কলকাতা থেকেও যাত্রীরা ঢাকা হয়ে এ রুটে চলাচল করে থাকেন। আমার পাশের সিটের সহযাত্রী যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। থাকেন মিশিগানের ডেট্রয়েট সিটিতে। তিনি জানালেন, টরন্টো বিমানবন্দর থেকে সরাসরি যাবেন সীমান্তে। সড়কপথে। ইউএস সীমান্তে তাঁর ছেলে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করবে।

টরন্টো বিমানবন্দরে নামার পর অনলাইনে একটি ফরম পূরণ করতে হলো। সাধারণ কিছু তথ্য চাওয়া হয়েছে। অনেকগুলো বুথ। ফরম পূরণে সহায়তা করার জন্য কয়েকজন কর্মী ঘোরাফেরা করছেন। প্রয়োজনে সহায়তা করতে এগিয়ে আসছেন। ইমিগ্রেশন ডেস্কের কর্মকর্তা জানতে চাইলেন, কী উদ্দেশে কানাডায় এসেছি এবং কোথায়, কতদিন অবস্থান করব। টরন্টো বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে বেরিয়েই দেখি আমার জন্য অপেক্ষা করছেন চিন্ময় দাস শুভ্র। আমার আত্মীয়। চিন্ময় ঢাকায় একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে আকর্ষণীয় বেতনে চাকরি করতেন। একসময় তার মাথায় কানাডায় স্থায়ী হওয়ার ভূত চেপে বসে। লোভনীয় চাকরি ছেড়ে পিআর ভিসায় চলে আসেন কানাডায়। ২০০৬ সালে। এটা ছিল তাঁর জন্য কঠিন সিদ্ধান্ত। এখানে আসার পর অন্য ১০ জনের মতোই শুরু হয় জীবন সংগ্রাম। সেই সংগ্রামে চিন্ময় জয়ী হয়েছেন, এটা বলতে হবে। সন্ধ্যার পর নিজের গাড়িতে করে আমাকে নিয়ে ঘুরতে বের হন চিন্ময়। টরন্টো সিটি তাঁর নখদর্পণে। অন্টারিও লেক, ডাউন টাউন, টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ঘুরে আমরা যখন ঘরে ফিরে আসি তখন মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে। চিন্ময়ের বাড়িতে রাতযাপন শেষে পরদিন বিকালে হ্যালিফ্যাক্সের ফ্লাইট ধরব। ঘণ্টা দুয়েকের জার্নি।

চিন্ময়ের মনে একটা দুঃখবোধ আছে, যা সে কখনো ভুলতে পারে না। কানাডা আসার তিন বছর পর তাঁর মা প্রয়াত হন। ছোটকালে বাবাকে হারিয়েছেন। অনেক কষ্ট করে মা তাদের মানুষ করেছেন। কিন্তু মায়ের মৃত্যুর সময় পাশে থাকতে পারেননি। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ওই সময় দেশে যেতে পারেননি নানা সমস্যার কারণে। তাঁর দুঃখ, মায়ের জন্য তেমন কিছুই করার সুযোগ পাননি। চিন্ময়ের সহধর্মিণী কৃষ্ণা দাস বললেন, ‘প্রবাসে অনেকেই এ কষ্ট বয়ে নিয়ে চলেছেন। প্রিয়জন বিয়োগের খবর শোনার পর মন চাইলেও দেশে যেতে পারেন না অনেকে। কাজ থেকে ছুটি, সন্তানদের স্কুল, এয়ারলাইনসের টিকিট, টিকিটের উচ্চমূল্য- এসব বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তখন দূর দেশে বসে অসহায়ের মতো নীরবে চোখের জল ফেলা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। এটাই প্রবাস জীবনের কঠিন বাস্তবতা!’ তিনি আরও বললেন, প্রবাসে অনেক কিছু বিসর্জন দিতে হয়। এ জন্যই বলা হয়, প্রবাসে নিয়ম নাস্তি। এখানে জীবন নতুন করে শুরু করতে হয়। অসীম ধৈর্য দরকার হয়। কেউ পারে, কেউ পারে না। আয়েশি জীবনযাপন! কল্পনাও করা যায় না।

আমার দ্বিতীয় গন্তব্য হ্যালিফ্যাক্স, নোভা স্কোশিয়া প্রদেশের রাজধানী। নোভা স্কোশিয়া কানাডার পূর্ব উপকূলসংলগ্ন একটি দ্বীপ। আমার ছেলে স্বাগত ঘোষ প্রাদেশিক সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগে চাকরি করে। পরদিন এয়ার কানাডার ফ্লাইট নির্ধারিত সময়ে হ্যালিফ্যাক্সে অবতরণ করে। বিমানবন্দরে আমাকে রিসিভ করতে এসেছে স্বাগত। হ্যালিফ্যাক্স পরিচ্ছন্ন শহর। নিরিবিলি। ছবির মতো সুন্দর। সুশৃঙ্খলভাবে যানবাহনগুলো গন্তব্যে ছুটে চলেছে। দেখার ও শেখার আছে অনেক কিছু!

কানাডা শীতের দেশ। শীতের মাসগুলোতে মাইনাস ১৫ থেকে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা এখানে খুবই স্বাভাবিক। কোথাও কোথাও তাপমাত্রা মাইনাস ৩০ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে যায়। শীতের দেশ হলেও এখানে সারা বছর শীত থাকে না। এখন সামার সিজন চলছে। হ্যালিফ্যাক্সে এখন দিন অনেক বড়। সকাল ৬টা নাগাদ সূর্য ওঠে। অস্ত যায় সন্ধ্যা ৯টার দিকে। তাপমাত্রা এখন সহনীয়। জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে ১৫ থেকে ৩০ ডিগ্রির মধ্যে তাপমাত্রা ওঠানামা করছে। কানাডায় আছে ছয়টি ‘টাইম জোন’। এগুলো হচ্ছে- নিউফাউন্ডল্যান্ড টাইম জোন, আটলান্টিক টাইম জোন, ইস্টার্ন টাইম জোন, সেন্ট্রাল টাইম জোন, মাউন্টেন টাইম জোন ও প্যাসিফিক টাইম জোন। পূর্ব থেকে পশ্চিম উপকূল বরাবর ঘড়ির কাঁটা পেছাতে থাকে। অর্থাৎ সময় কমতে থাকে। পূর্ব উপকূলের হ্যালিফ্যাক্সে যখন দুপুর ১২টা, পশ্চিম উপকূলের ভ্যাঙ্কুভারে তখন সকাল ৮টা। বহু সংস্কৃতির দেশ কানাডা। কানাডা অভিবাসীদের আকর্ষণীয় গন্তব্য হয়ে উঠেছে। পুত্রবধূ অদিতি পুরকায়স্থ সিলেটের মেয়ে। বিয়ের পর পিআর ভিসা নিয়ে কানাডায় এসেছে ২০২০ সালে। অদিতির কথায়, ‘এখানকার মানুষজন খুবই বন্ধুভাবাপন্ন। পথে-ঘাটে কেউ বিপদে পড়লে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসেন অনেকেই।’  অপরকে সম্মান করা ও প্রয়োজনে সাহায্যের জন্য এগিয়ে যাওয়ার যে কালচার এ দেশে গড়ে উঠেছে, অদিতির কাছে সেটা সবচেয়ে ভালো লেগেছে। এটাই তো মানবতা! এটার চর্চা হোক সবখানে, সব দেশে।

                লেখক : সাবেক উপ-ব্যবস্থাপনা                 পরিচালক, জনতা ব্যাংক লিমিটেড

সর্বশেষ খবর