শনিবার, ৫ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

কার্বন নিঃসরণ কমাবে বায়োচার

শাইখ সিরাজ

কার্বন নিঃসরণ কমাবে বায়োচার

প্রতিনিয়তই মানুষ টের পাচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। চিরচেনা পৃথিবীর ঋতুবৈচিত্র্যে গ্রীষ্ম যেমন হয়ে উঠছে নিদারুণ উত্তাপের, বর্ষায়ও ঠিক মিলছে না কাক্সিক্ষত বৃষ্টি। আবার অসময়ের ভারী বৃষ্টিতে দুরূহ হয়ে উঠছে বানভাসি মানুষের জীবন। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবী আক্রান্ত হচ্ছে সাইক্লোন, বন্যা, খরা অথবা লবণাক্ততার মতো নানা দুর্যোগে। এ দুর্যোগের অন্যতম নিয়ামক গ্রিনহাউস গ্যাস।

গ্রিনহাউস গ্যাস তাপ ধরে রাখার কারণে পৃথিবীতে আসা সূর্যরশ্মি যে তাপ উৎপন্ন করে তা পৃথিবীর বাইরে যেতে পারে না। ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের এই সমস্যা প্রতিরোধ করতেই কৃষিতে এক বৈপ্লবিক সংযোজন হতে পারে বায়োচার প্রযুক্তি। যেটি মাটির গুণগত মান ঠিক রেখে কৃষিকাজে ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখার মাধ্যমে পৃথিবীর তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখতে ভূমিকা রাখতে পারে।

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. শামীম মিয়ার নেতৃত্বে একদল শিক্ষার্থী কাজ করছে বায়োচার নিয়ে। অধ্যাপক শামীম মিয়া দীর্ঘদিন ধরে বায়োচার নিয়ে গবেষণা করছেন। নেদারল্যান্ডসের ভাগিনিংগেন ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স ও অস্ট্রেলিয়ার সিডনি ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করার সময় থেকে বায়োচার নিয়ে গবেষণার কাজে যুক্ত তিনি। মাস ছয়েক আগে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োচার নিয়ে তাদের গবেষণা কার্যক্রম দেখার সুযোগ হয়েছিল। সে সময় কৃষিতত্ত্ব বিভাগের ল্যাবরেটরিতে চলছিল বায়োচার নিয়ে বহুমুখী গবেষণা। অধ্যাপক শামীম বায়োচার বিষয়টি খুব সহজভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। তিনি বললেন, ‘গ্রিনহাউস গ্যাসের অন্যতম উপাদান কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস। একসময় ধারণা করা হতো, বেশি গাছ লাগালে গাছ বায়ু থেকে কার্বন গ্রহণ করার ফলে বাতাসে কার্বনের পরিমাণ কমে যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা যায়, গাছ বায়ুমন্ডল থেকে যে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে একটা নির্দিষ্ট সময় পর তার সমপরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড বায়ুমন্ডলে ছেড়ে দেয়। অর্থাৎ শুধু গাছ লাগানোর মাধ্যমে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের সমাধান সম্ভব নয়। কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই গবেষণায় বিকল্প একটি প্রস্তাব করা হয়। এতে বলা হয়, গাছের মধ্যে থাকা বায়ুমন্ডলের কার্বনকে পাইরোলাইসিস প্রক্রিয়ায় রূপান্তরিত করে মাটিতে প্রয়োগ করা। পাইরোলাইসিস প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত এই কার্বনকে বলা হয় বায়োচার।

অর্থাৎ বায়োচার হলো বিভিন্ন জৈব পদার্থ। যেমন- কাঠ, কাঠের গুঁড়া, জৈব আবর্জনা ইত্যাদিকে অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে তাপ প্রয়োগের মাধ্যমে উৎপাদিত এক ধরনের কয়লা। অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে তাপ প্রয়োগের ফলে জৈব পদার্থগুলো সরল অ্যারোমেটিক বেনজিনযুক্ত জৈব যৌগে পরিণত হয়। যেহেতু মাটির অণুজীবগুলো অ্যারোমেটিক বেনজিনযুক্ত জৈব যৌগগুলোকে সহজে ভাঙতে পারে না, তাই বায়োচার মাটিতে প্রয়োগ করলে এটি দীর্ঘ সময় প্রায় ১০০ বছর থেকে ১০০০ বছর পর্যন্ত মাটিতে থেকে যায়। এটি সাধারণত কার্বন স্থায়িত্বকরণ নামে পরিচিত। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বায়ুমন্ডলের কার্বনকে দীর্ঘ সময়ের জন্য মাটিতে স্থায়ীকরণ করে জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করা সম্ভব।’

মাটিতে বায়োচার প্রয়োগে তিন ধরনের উপকার পাওয়ার কথা বলছেন গবেষকরা। এক, মাটির গুণাগুণ বৃদ্ধির ফলে ফসলের উৎপাদন বাড়ে শতকরা ১০ থেকে ১৫ ভাগ। দুই, সারের অপচয় রোধ করা যায় শতকরা ৪০ থেকে ৬০ ভাগ, এতে উৎপাদন খরচ কমে। তিন, জলবায়ু পরিবর্তনের নিয়ামক গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ কমানো সম্ভব। বায়োচার লবণাক্ততার ওপর কতটুকু প্রভাব ফেলে তা নিয়ে গবেষণা করছেন কৃষিতত্ত্ব বিভাগের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান মিথু। কথা হলো তার সঙ্গে। তিনি দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম অর্থকরী ফসল মুগডাল লবণাক্ত মাটিতে চাষের ক্ষেত্রে বায়োচার কী রকম ভূমিকা রাখতে পারে তা ব্যাখ্যা করে দেখালেন। বিভিন্ন মাত্রার লবণযুক্ত মাটিতে বিভিন্ন মাত্রায় বায়োচার প্রয়োগ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। তিনি মুগডাল গাছ দেখিয়ে বললেন, ‘সাধারণত লবণাক্ততার পরিমাণ ৮ ডেসিএম বা তার বেশি হলে সে মাটিতে গাছ টিকে থাকে না। কিন্তু বায়োচার প্রয়োগ করার ফলে সেই লবণাক্ত মাটিতে দিব্যি মুগডালের গাছগুলো বেঁচে আছে।’ বোঝা গেল মাটিতে বায়োচার প্রয়োগের ফলে মাটির লবণাক্ততাও প্রশমিত হয়।

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে মালয়েশিয়ার একটি প্রকল্প নিয়ে কাজ করছিলেন গবেষক হাসিব মোহাম্মদ তুষার। তিনি বললেন, মালয়েশিয়ার মাটি মূলত অ্যাসিডিক। সেই মাটিতে বায়োচার প্রয়োগ করে কীভাবে ভালো ভুট্টা চাষ করা যায়, তা নিয়েই মূলত গবেষণা করছেন তিনি। তার গবেষণার তিনটি স্তরের দুটি সম্পন্ন হয়েছে সফলভাবেই।

কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এস এম মাহবুব আলম ১৩ ধরনের বায়োচার দেখালেন। তিনি বললেন, বায়োচারের সঙ্গে রাসায়নিক সারের মিশ্রণে স্বাভাবিকের তুলনায় সার কম প্রয়োগ করলেও ভালো ফলন পাওয়া সম্ভব।

বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে বিশ্বজুড়ে সার সংকট। গবেষকরা নানাভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছেন রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমিয়ে আনার পাশাপাশি এর অপচয় রোধ করতে। বায়োচারের মাধ্যমে সারের ব্যবহার মাত্রা কমিয়ে আনা গেলে বিষয়টি এদিক দিয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। ল্যাবরেটরির একপাশে ইটভাটার কয়লা থেকে কম খরচে হিউমিক অ্যাসিড তৈরির কাজ করছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়টির দুই শিক্ষার্থী উত্তম বিশ্বাস আর সোনিয়া আক্তার। তারা জানালেন, বাজারে যে হিউমিক অ্যাসিড কিনতে সাড়ে ৩০০ টাকা খরচ হয়, তা তারা ১৫ টাকার কয়লা থেকে উৎপাদন করতে পারছেন। বায়োচার থেকে কীভাবে বায়ো ফার্টিলাইজার তৈরি করা যায় সে বিষয়ে কাজ করছিলেন আরও দুই শিক্ষার্থী শাহরিয়ার ও নিশাত। তাদের সঙ্গে কথা শেষে দেখতে গেলাম কীভাবে বায়োচার তৈরি করা হয়। বিশেষ ধরনের এক চুল্লিতে অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে পোড়ানো হচ্ছে জৈব বর্জ্য। এই পোড়ানো অবশিষ্টাংশই হবে বায়োচার।

এবার মাঠপর্যায়ে তাদের গবেষণার ফলাফল দেখার পালা। মাঠে ধানের প্লটে একেক মাত্রায় একেক বায়োচার ও সারের মিশ্রণ প্রয়োগ করা হয়েছে। অধ্যাপক শামীম মিয়া দেখালেন বায়োচার প্রয়োগে ফসল তুলনামূলক ভালো হয়েছে। তার গবেষণায় দেখা গেছে, সাধারণ ইউরিয়া সারের তুলনায় বায়োচার সমৃদ্ধ নাইট্রোজেন সার শতকরা ১৫-২০ ভাগ বেশি কার্যকর। আমাদের দেশে ফসলে যে নাইট্রোজেন সার প্রয়োগ করা হয় তার ৭০ ভাগই বায়ু ও পরিবেশের মাধ্যমে সিস্টেম লস হয়ে যায়। একই সঙ্গে সরকার প্রতি বছর ইউরিয়া সারে হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে। এক্ষেত্রে বায়োচার সমৃদ্ধ নাইট্রোজেন সার ব্যবহারে যেমন আমাদের অর্থনৈতিক চাপ কমানো সম্ভব, একই সঙ্গে আমদানিনির্ভরতাও অনেকাংশে হ্রাস করা যেতে পারে। আবার জৈব বর্জ্য থেকে এমন উপকারী কিছু পাওয়া গেলে তা হতে পারে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ভালো একটি উদ্যোগ। বিশেষ করে শহর-নগরে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে যথেষ্ট সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে নগর কর্তৃপক্ষকে। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় এ পদক্ষেপগুলো আমাদের এগিয়ে রাখবে- সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। ফলে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায় থেকে এ গবেষণা উদ্যোগগুলোর বিকাশে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব  

[email protected]

সর্বশেষ খবর