শনিবার, ৫ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

ই-সিগারেট না পারমাণবিক বোমা!

অরূপরতন চৌধুরী

ই-সিগারেট না পারমাণবিক বোমা!

বিশ্বজুড়ে তামাকের বিরুদ্ধে যখন সাড়া জাগানো গণসচেতনতা গড়ে উঠছে, ঠিক তখনই তামাক কোম্পানিগুলোও আটঘাট বেঁধে নেমেছে কীভাবে মানুষকে বিভ্রান্তিতে ফেলে বিকল্প উপায়ে তামাকের নেশায় বুঁদ করে রাখা যায়। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোতেই তাদের তীক্ষ নজর। তামাকের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে তাই বাজারে এনেছে প্রযুক্তিনির্ভর ই-সিগারেট, ভেপ, হিটেট টোব্যাকো প্রোডাক্টস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বর্তমানে বাজারে ১৬ হাজার ধরনের স্বাদ/গন্ধযুক্ত ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টস পাওয়া যায়।

বস্তুত ই-সিগারেট একটি কৃত্রিম সিগারেট যা আগুন ধরানো ছাড়াই টান দিলে ধোঁয়া বের হয়। এর মধ্যে রয়েছে নিকোটিন, প্রোপাইলিন, গ্লাইকল ও ভেষজ গ্লিসারিন ছাড়াও নানান ধরনের ফ্লেভার। এই ই-সিগারেট থেকে ধোঁয়া টানার সঙ্গে নিকোটিন বের হয়ে আসে যা আসক্তিকর।

এই নিকোটিন অন্যান্য তামাকের নিকোটিনের মতো ক্যান্সার তৈরি করে। ই-সিগারেট যে সম্পূর্ণভাবে দূষণ বা ঝুঁকিমুক্ত তা কোনো বিজ্ঞানীই বলছেন না। এ ই-সিগারেটের ধোঁয়া থেকে যে সমস্ত রাসায়নিক পদার্থ বেরিয়ে আসে তা অন্যান্য স্বাভাবিক তামাকজাত দ্রব্যের মধ্যেও রয়েছে, তাই এর ক্ষতিকর প্রভাব আসল সিগারেটের চেয়ে কম নয়। এর বিষাক্ত পদার্থ মানুষের শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। ই-সিগারেট নেশা উদ্দীপক এবং মাদকাসক্ত করে। এই ক্ষতিকর দ্রব্য ব্যবহারে নিকোটিন আসক্তি জন্মায়, যা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। ই-সিগারেট নিরাপদ নয়, সতর্ক করে দিয়ে যা ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছে স্বাস্থ্য খাতের বৈশ্বিক অভিভাবক ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এর ক্ষতিকারক দিকগুলো নিয়ে অনেক গবেষণা হচ্ছে। প্রায় সব গবেষণায়ই নেতিবাচক দিকগুলো উঠে আসছে।

যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের রচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা বলেছেন, ই-সিগারেট থেকে নির্গত ক্ষতিকর ফ্রি র‌্যাডিকলস ফুসফুসের কোষগুলোতে বিষক্রিয়া সৃষ্টি করে, এর হিটিং এলিমেন্ট সক্রিয় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ বিষক্রিয়ার পথ সুগম হয়। এই হিটিং এলিমেন্ট একটি তরল দ্রবণকে (ই-লিকুইড বা জুস) এরোসলে রূপান্তরিত করে। এর ফলে যে বাষ্প নিঃশ্বাসের মধ্য দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে তার মধ্যে বিভিন্ন হেভি মেটাল ও ন্যানোপার্টিকলসের রূপে বিবিধ কার্সিনোজেনিক পদার্থ থাকে। এই কার্সিনোজেনিক পদর্থাগুলো সরাসরি ফুসফুস, রক্ত প্রবাহ ও শরীরের অন্যান্য কোষেও আক্রমণ করে। ফলে রোগাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেকাংশে বেশি। তা ছাড়াও মানবদেহে ই-সিগারেট এর প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণ হলো, ই-সিগারেটের মধ্যে আছে কিছু ক্যান্সার উৎপাদনকারী ও বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ যেমন, ফরমাল-ডিহাইড এবং এসিটেল-ডিহাইড ইত্যাদি পদার্থ থাকে।

জাপানে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ই-সিগারেট সাধারণ সিগারেটের চেয়ে ১০ গুণ বেশি ক্ষতিকর! ভেপ, ই-সিগারেট ব্যবহারকারীরা স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, সাডেন কার্ডিয়াক ডেথের শিকার হতে পারেন। যেহেতু এসব ডিভাইসনির্ভর সিগারেটেও নিকোটিন রয়েছে, সেহেতু এর ব্যবহারকারীদের শরীরে উচ্চ রক্তচাপ এবং কোলেস্টেরলের ভারসাম্যহীনতা তৈরি হতে পারে। যা হৃদযন্ত্রকে অকার্যকর করে দেয়। জার্নাল অব আমেরিকান কলেজ অব কার্ডিওলজির এক গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ই-সিগারেটে ব্যবহৃত তরল রক্তনালির কোষ অকার্যকর করে, যা থেকে হৃদরোগের সৃষ্টি হয়। ভেপ, ই-সিগারেট ব্যবহারে স্ট্রোকের ঝুঁকি ৭১ শতাংশ, হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ে ৫৯ শতাংশ! যা বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। শিশু ও গর্ভবতী মায়েদের জন্য মারাত্মক বিপজ্জনক ই-সিগারেটের নিকোটিন। ভেপ, ই-সিগারেট বা হিটেট টোব্যাকো প্রোডাক্টসমূহ প্রযুক্তিনির্ভর। বেশ কয়েকটি ইলেকট্রনিক্স পার্টসের মাধ্যমে এগুলো কার্যকারিতা পায়, যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ‘ব্যাটারি’। ই-সিগারেটে ব্যবহৃত হয় শক্তিশালী ব্যাটারি, যা দিয়ে তাপ উৎপন্ন করা হয়। এই ব্যাটারির বিস্ফোরণ হয়ে এর ব্যবহারকারীর মারাত্মক ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। এমন ঘটনাও ঘটেছে নিকট অতীতে। ২০১৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা রাজ্যের সেন্ট পিটার্সবার্গে ই-সিগারেট বিস্ফোরিত হয়ে টলম্যাজ ডি’ইলা নামে ৩৮ বছর বয়সী একজন নিহত হয়েছেন। ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে উইলিয়াম ব্রাউন নামে ২৪ বছর বয়সী এক তরুণ মৃত্যুবরণ করে ভেপ বিস্ফোরিত হয়ে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, উইলিয়াম ব্রাউন ই-সিগারেটটি ঠোঁটে নেওয়া মাত্রই এর ভিতরে থাকা ব্যাটারিটি বিস্ফোরিত হয়। ঘটনার সময় গাড়িতে বসে ছিলেন তিনি। বিস্ফোরণের জোর এতটাই ছিল যে, গাড়ির ভিতরের ধাতব অংশগুলো টুকরা টুকরা হয়ে তার মুখে, মাথার খুলিতে ও ঘাড়ে আঘাত করে।  এতে গুরুত্বপূর্ণ একটি ধমনি কেটে গিয়ে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এ ছাড়া হাজারোর্ধ্ব মানুষ আহত হয়েছেন ই-সিগারেট, ভেপ সেবন করতে গিয়ে। সুতরাং, ফ্যাশন হিসেবে আমাদের দেশে যে তরুণরা পকেটে ই-সিগারেট, ভেপ বহন ও সেবন করছেন, তারা যে কোনো মুহূর্তে কঠিন দুর্ঘটনার শিকার হতে পারেন, এতে শুধু আপনি একা নন, বিপদগ্রস্ত হতে পারে আশপাশের মানুষও।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক, (একুশে পদকপ্রাপ্ত শব্দসৈনিক, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা (মানস)।

Email: [email protected]

সর্বশেষ খবর