মাত্র সাড়ে তিন বছর একটি জাতির জন্য, দেশের জন্য বড় কোনো সময় ছিল না। সদ্যস্বাধীন দেশটি তিনি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি চেয়েছিলেন উন্নত বিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় একটা আত্মমর্যাদাশীল জাতি তৈরি করতে। উন্নয়ন-সমৃদ্ধিতে সবাইকে চমকে দিতে। একটা দেশের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে সারা বিশ্বে তাঁর আলাদা মর্যাদা ছিল। বিশাল দেহের মানুষটি হেঁটে গেলে মাটি কেঁেপ উঠত। বিশ্বনেতারা তাঁকে জড়িয়ে ধরতেন। বলতেন, তুমি পেরেছ একটি জাতি, দেশ তৈরি করতে। তোমাকে স্যালুট। কেউ ভাবতেও পারেননি মাত্র সাড়ে তিন বছরে ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের কাছে সবকিছু পরাজিত হবে। দেশি-বিদেশি খুনিদের একটি গ্রুপ ছিল সামনে। আরেকটি গ্রুপ সব করছিল আড়ালে থেকে। সব রহস্য এখনো বের হয়নি। পরিষ্কার হয়নি দেশবাসীর সামনে অনেক কিছু। জানা যায়নি কেন আগাম তথ্য জানাতে ব্যর্থ হয়েছিল রাষ্ট্রীয় সব গোয়েন্দা সংস্থা। কেন রাষ্ট্রপতিকে রক্ষা করতে পারেনি রাষ্ট্রের সব বাহিনী। অনেকে শুধু রক্ষীবাহিনীর ওপর দোষ চাপিয়ে নিজেদের আড়াল করেন। ব্যর্থতার দায় সবাইকে নিতে হবে। এমনকি হত্যার প্রতিবাদ করতে না পারার ব্যর্থতা আওয়ামী লীগকেও নিতে হবে।
ভবিষ্যতে এ নিয়ে আরও অনেক গবেষণা হবে। ৩ ও ৭ নভেম্বর অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থান নিয়ে অনেকে তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন। অনেক কিছু ছিল নিজেদের অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার লড়াই। ইতিহাস ঘাঁটলে শুধুই কালো অধ্যায় আর ব্যর্থতা বেরিয়ে আসে। কর্নেল জামিল ছাড়া জীবন উৎসর্গ করতে একজনকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি। বরং সেনা কর্মকর্তারা ব্যস্ত হয়ে ওঠেন পরিস্থিতি সামাল দিতে। আর আওয়ামী লীগ নেতারা সকালেই নিজের বাড়ি থেকে সটকে পড়েন জীবন বাঁচাতে। লে. কর্নেল হামিদের বই পড়লে অনেক বাস্তবতা বেরিয়ে আসে। এ এল খতিব, অ্যান্থনি মাসকারেনহাস অনেক কঠিন সত্য লিখে গেছেন। রক্ষীবাহিনীর আনোয়ারুল আলম শহীদ, সরোয়ার হোসেন মোল্লা নিজেদের ব্যর্থতার কথা জানিয়েছেন। পাশাপাশি লিখেছেন, বলেছেন অন্যদের ব্যর্থতার কথাও। তাঁরা কারও কাছ থেকে কোনো নির্দেশ পাননি। নিজেদের বাহিনীপ্রধানও কেন তখন বিদেশে, তা জানেন না। দিনভর নেতাদের কাছে যান তাঁরা। সবাই নিজেকে রক্ষায় ব্যস্ত। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অধিকারী সেনা কর্মকর্তারা রক্ষীবাহিনীকে গুটিয়ে নিতে ব্যয় করেছেন ১৫ আগস্টের সারাটি দিন। অসহায়, ব্যর্থ সেনাপ্রধান সবাইকে নির্দেশ দিয়েছেন। কেউই তাঁর কথা শোনেনি। মানবসভ্যতার ইতিহাসে এমন সব নিষ্ঠুর করুণ ঘটনা ঘটেছিল, যা নজিরবিহীন।
ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে পড়ে থাকল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লাশ! কেউ এগিয়ে গেল না। খুনিরা ভোরে চলে যাওয়ার পর কেউ এসে উঁকিও মারল না। চিৎকার করে বলল না, আওয়ামী লীগ, বাকশাল কর্মীরা বেরিয়ে আস। ছাত্রলীগ, যুবলীগ আস, দেখ তোমাদের জাতির পিতাকে ওরা খুন করেছে। রেহাই দেয়নি বঙ্গমাতা, শিশু রাসেলসহ কাউকে। নীরব কষ্টে অনেক কর্মী অপেক্ষায় ছিল একটি ডাকের। একটি আহ্বানের। ঢাকার নির্ধারিত কিছু এলাকা ছিল খুনিদের নিয়ন্ত্রণে। তখনো দেশে সামরিক শাসন জারি হয়নি। সারা দেশে সেনাবাহিনী নামেনি। পুলিশ ও অন্য বাহিনী ছিল হতভম্ব, নির্দেশবিহীন। খুনিদের গোলাবিহীন ট্যাংক দুটি রক্ষীবাহিনীর হেডকোয়ার্টার্সের সামনে দাঁড়িয়ে। টার্গেট ভীতি তৈরি করা। তারা প্রতিপক্ষ হিসেবে নিয়েছিল রক্ষীবাহিনীকে। তার পরও সদর দফতরে প্রবেশে কাউকে বাধা দেয়নি। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর, মিরপুর রোড, বেতার ভবন, টেলিভিশন ভবন ও শাহবাগে ছিল খুনিদের পাহারা। বিচ্ছিন্নভাবে ট্যাংক ও খুনিদের পাহারা থাকলেও ঢাকার বাকি অঞ্চল ছিল মুক্ত। সারা দেশে বাধা দেওয়ার কেউ ছিল না। খুনিদের ভিতরেই আতঙ্ক ছিল। তারা ভেবেছিল![](/assets/archive/images/Print-Edition/2023/08.August/06-08-2023/Bd-pratidin-06-08-23-F-23.jpg)
১৪ আগস্ট রাতে শেখ কামাল গিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতির পিতার অনুষ্ঠান। তিনি দেখলেন সারা দেশ থেকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা জমায়েত হয়েছে। আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মীও ক্যাম্পাসে। তিনি সন্তোষ প্রকাশ করে বাড়ি ফিরলেন। সবাইকে সতর্ক থাকতে বললেন জাসদের গণবাহিনী ও সিরাজ সিকদারের সর্বহারা সম্পর্কে। তাদের অস্ত্রধারীদের সম্পর্কে। একই রাতে কাদের সিদ্দিকী বের হয়েছিলেন। তিনি পিজি হাসপাতালে অসুস্থ মাকে দেখতে যান। হঠাৎ ’৭১ সালের এই যোদ্ধার কাছে কোনো কিছু স্বাভাবিক মনে হলো না। তিনি দেখলেন রাস্তায় ট্যাংক। অজ্ঞাত আশঙ্কায় নিজের গাড়ি চালিয়ে মতিঝিল গিয়েও একটা ট্যাংক দেখলেন। তিনি ধানমন্ডি ৩২ নম্বর গেলেন। সব বললেন। নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিতরা বললেন, বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন। তাই বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সে রাতে কাদের সিদ্দিকীর ভালো ঘুম হলো না। ভোরে ঘুমানোর পর ছোটবোন ডেকে তুলল। জানাল জাতির পিতা আর নেই!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জমায়েত ছিল দলীয় কর্মীদের। ঢাকায় ছিলেন সদ্যনিয়োগপ্রাপ্ত জেলা গভর্নররা। তাঁরা ঢাকা এসেছিলেন ২১ দিনের প্রশিক্ষণের জন্য। ২১ জুলাই প্রশিক্ষণ শুরু হয়। ১ সেপ্টেম্বর থেকে গভর্নররা দায়িত্ব নেবেন। দেশকে এগিয়ে নিতে জেলাভিত্তিক উন্নয়নের সমন্বয় করতে বঙ্গবন্ধু সব জেলায় একজন করে গভর্নর নিয়োগ দিয়েছিলেন। ১৫ আগস্ট তাঁদের প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার কথা। তাঁরাও ঢাকায় ছিলেন। বর্বর নিষ্ঠুর হত্যার পর তাঁরাও সবাই নিজের জেলায় একটা ফোন করতে পারতেন। নির্দেশ দিতে পারতেন প্রতিরোধ ও প্রতিবাদের। বলতে পারতেন, সবাই মিছিল নিয়ে বেরিয়ে পড়। চলে আস ঢাকায়। এক কাদের সিদ্দিকী ছাড়া কেউই কোনো পদক্ষেপ নিলেন না। বঙ্গবন্ধু হত্যার কথা শুনে আওয়ামী লীগ নেতারা বের হলেন, কাপুরুষের ভূমিকা নিলেন সবাই। দেশের উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীদের অনেকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে চলে গেলেন নিরাপদ আশ্রয়ে। অন্য নেতাদের অবস্থানও একই ছিল। জাতির পিতার মৃত্যুতে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ শোকে নির্বাক। তারা অপেক্ষায় ছিল। ভেবেছিল একটা ডাক আসবে। কিছু মানুষ সেদিন সাহস করলেই বদলে যেত সবকিছু। হত্যার বিচারের জন্য আমাদের দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হতো না। বাংলাদেশ তখনই ঘুরে দাঁড়াত।
বড় কষ্ট হয়। দুঃখ হয়। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির পাশেই ছিল বিডিআর সদর দফতর। তখন বিডিআরপ্রধান ছিলেন মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান। ১৯৯২ সালে দৈনিক ভোরের কাগজে তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। তখন ভোরের কাগজে কাজ করতাম। এই লোকটি ১৯৮৬ ও ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচন করেন। তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম, ১৫ আগস্ট ভোরে কোথায় ছিলেন? বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর তিনি কীভাবে পান? জবাবে বলেন, খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠি। বাড়িতে শেভ করছিলাম। তখন রেডিওতে খবরটি শুনি। জাতির পিতাকে রক্ষা করার জন্য কোনো ফোন কি পাননি? অথবা নিজ থেকে কোনো তাগিদ অনুভব করেননি? জবাবে তিনি দাবি করেন অনেকের সঙ্গে কথা বলেছেন। পরে সেনা সদরের বৈঠকে গিয়েছিলেন। বাস্তবে বঙ্গবন্ধু ও জেনারেল শফিউল্লাহ তাঁকে ফোন করেছিলেন। অনুরোধ করেছিলেন দ্রুত বিডিআর পাঠাতে। তিনি কোনো ব্যবস্থা নেননি। পিলখানা থেকে বিডিআর বের হলে খুনিরা কিছুই করতে পারত না। বিডিআরপ্রধান শুধু ব্যর্থ ছিলেন না, তাঁর ভূমিকাও ছিল রহস্যময়। রক্ষীবাহিনীর অস্ত্র তখন রাতে রাখা হতো পিলখানা বিডিআর সদর দফতরে। অস্ত্র রাখার জন্য রক্ষীবাহিনীর নিজস্ব কোনো কোত বা অস্ত্রাগার ছিল না। এ কারণে বিডিআর সদর দফতরে অস্ত্র রাখত তারা। ১৫ আগস্ট সকালে রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তারা সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁদের অস্ত্র নিয়ে আসবেন। রক্ষীবাহিনীর ভারপ্রাপ্ত প্রধান আবুল হাসান খান ফোন করেন জেনারেল খলিলুর রহমানকে। তিনি কোনো অস্ত্র ফেরত দেননি। বিকালে খন্দকার মোশতাক চিফ অব দ্য ডিফেন্স স্টাফ নিয়োগ দেন খলিলুর রহমানকে। জেনারেল ওসমানীকে করেন নিরাপত্তা উপদেষ্টা। এটা কীসের পুরস্কার ছিল? তার পরও খলিলুর রহমান আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নেন! ভোট করেন। অদ্ভুত সব কান্ডকারখানা। ভাবলে গা এখনো শিউরে ওঠে।
১৫ আগস্ট রক্ষীবাহিনীর দুই কর্মকর্তা সরোয়ার মোল্লা ও আনোয়ারুল আলম শহীদকে বঙ্গভবনে ডেকে নেন সিজিএস খালেদ মোশাররফ। তাঁরা দেখলেন ভারতের হামলার আশঙ্কার কথা বলছেন খালেদ মোশাররফ। তিনি হামলা প্রতিরোধে অপারেশন কক্ষ স্থাপন করছেন। জেনারেল ওসমানী সবার সঙ্গে কথা বলছেন। বঙ্গভবনে খুনি ফারুক-রশীদরা ব্যস্ত। তারা বিভিন্ন নির্দেশ-আদেশ দিচ্ছেন। তাদের সঙ্গে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন আরও অনেক কর্মকর্তা। আমিন আহমেদ চৌধুরী রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিবের দায়িত্ব নেন। বঙ্গভবনের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেন লে. কর্নেল এম এ মতিন। জিয়াউর রহমান বারবার বৈঠক করছেন বিডিআরপ্রধান খলিলুর রহমান, পুলিশপ্রধান এ কে নুরুল ইসলাম ও ব্রিগেডিয়ার মশহুরুল হকের সঙ্গে। আনোয়ারুল আলম শহীদ সেদিনের ঘটনা নিয়ে বলেছেন, বঙ্গভবনে কেবলই কথা হচ্ছে ভারতীয় হামলা নিয়ে। কোথাও নির্দেশ দিতে দেখলাম না সীমান্তে সেনা মোতায়েন করার। জিয়াউর রহমান রক্ষীবাহিনীর দুই কর্মকর্তার কাছে জানতে চান তোফায়েল আহমেদ কি রক্ষীবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ে? জবাবে তাঁরা মাথা নাড়তেই জিয়াউর রহমান আবার বলেন, তাঁকে আটক করার জন্য পুলিশের এসবির কর্মকর্তা আবদুস সালামকে পাঠানো হয়েছে। তোমরা তাঁকে সহায়তা করবে। আবদুস সালাম রক্ষীবাহিনীর অফিস থেকে তোফায়েল আহমেদকে আটক করে গাড়িতে তোলেন। আর কোনো নির্দেশ না থাকায় ঢাকা শহর ঘুরিয়ে পরে তাঁর বাড়িতে রেখে আসেন।
কর্নেল সরোয়ার মোল্লা বললেন, সেনাবাহিনীর মনোভাব ছিল রক্ষীবাহিনীর বিরুদ্ধে। যে কর্মকর্তাদের আমাদের পক্ষের মনে করতাম, তাঁরা পরামর্শ দিলেন যেন চুপ থাকি। বাড়াবাড়ি না করি। রক্ষীবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ের সামনে ট্যাংক। রক্ষীবাহিনীর বেশির ভাগ সদস্য সাভার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তারা বারবার সেনাপ্রধানের সঙ্গে কথা বলেন। রক্ষীবাহিনীর প্রধান নুরুজ্জামান ১২ আগস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান। সে সময় তিনি কেন আমেরিকা গেলেন? তাঁকে কারা পাঠানোর সুপারিশ করেছিলেন? প্রশ্ন অনেক। উত্তর নেই। তাঁর অনুপস্থিতিতে মেজর আবুল হাসান খান ভারপ্রাপ্ত পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন। সেনাবাহিনীর ওপর সেনাপ্রধান শফিউল্লাহর কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। উপসেনাপ্রধান ছিলেন জিয়াউর রহমান। চিফ অব দ্য জেনারেল স্টাফ খালেদ মোশাররফ। আর ৪৬ ডিভিশনের দায়িত্বে শাফায়েত জামিল। তাঁদের নিজেদের ভিতরে অভ্যন্তরীণ বিরোধ ছিল। ক্ষমতার লড়াই ছিল। দুর্বল চিত্তের শফিউল্লাহকে কেউই মানতেন না। পাত্তাও দিতেন না।
সিজিএস খালেদ মোশাররফ ফোন করেন রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তা আনোয়ারুল আলম শহীদ ও সরোয়ার মোল্লাকে। তাঁদেরকে জানান দুজনের একজনকে রেডিও স্টেশনে যেতে হবে। তিনি আরও জানান, সেনাপ্রধান কে এম শফিউল্লাহ, বিমানবাহিনী প্রধান এ কে খন্দকার, নৌবাহিনী প্রধান এম এইচ খান, পুলিশপ্রধান এ কে নুরুল ইসলাম ও বিডিআরপ্রধান খলিলুর রহমান খুনি সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করবেন। রক্ষীবাহিনীও যেন যায়। সরোয়ার ও শহীদ তাকে জানান তাঁদের বাহিনীপ্রধান কর্নেল নুরুজ্জামান দেশের বাইরে। তাঁর কাছ থেকে কোনো নির্দেশ না পেলে তাঁরা যেতে পারেন না। আবুল হাসান ভারপ্রাপ্ত প্রধানের দায়িত্বে। কিছুক্ষণ পর আবার ফোন করেন খালেদ মোশাররফ। এবার বললেন, সরোয়ার ও শহীদ যেন রেডিও স্টেশনে যান। এটা সেনা সদরের সিদ্ধান্ত। তাঁদের কথা বলতে না দিয়েই তিনি ফোন রেখে দেন। রেডিও স্টেশন যান রক্ষীবাহিনীর দুই কর্মকর্তা। তাঁরা সেখানে গিয়ে দেখেন মোশতাক ও তাহের উদ্দিন ঠাকুর বসে আছেন। ডালিমসহ আরও কিছু খুনি অস্ত্রহাতে ঘোরাঘুরি করছে। এভাবে সেদিন সব বাহিনীর সদস্য খুনি সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করল!
রেডিও স্টেশন থেকে বের হয়ে সরোয়ার ও শহীদ তাঁদের অফিসে এলেন। তাঁরা ফোন করলেন আবদুর রাজ্জাককে। জানানো হলো, রাজ্জাক ভাই বাড়িতে নেই। তারপর তাঁরা ফোন করলেন তোফায়েল আহমেদকে। তাঁকে অনুরোধ করলেন রক্ষীবাহিনী সদর দফতরে আসতে। তোফায়েল আহমেদ রক্ষীবাহিনী অফিসে আসতে সম্মত হলেন। রক্ষীবাহিনীর লিডার দীপক কুমার হালদারকে পাঠানো হয় তোফায়েল আহমেদকে নিয়ে আসতে। তোফায়েল আহমেদ রক্ষীবাহিনী অফিসে এলেন। তখনো তিনি অনেক কিছু জানতেন না। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার কথা শুনে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়লেন। তাঁকে সান্ত্বনা দিলেন রক্ষীবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তারপর আনোয়ারুল আলম শহীদ ও সরোয়ার মোল্লার অনুরোধে তোফায়েল আহমেদ রক্ষীবাহিনী অফিসে বসে ফোন করলেন সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ, দলের সিনিয়র মন্ত্রী ও নেতাদের। সরোয়ার মোল্লা জানান, কারও কাছ থেকে কোনো সাড়া পেলেন না তোফায়েল আহমেদ। কেউ সম্মত হলেন না বের হতে। অসহায় অবস্থান নিয়ে তোফায়েল তাকালেন রক্ষীবাহিনীর দুই কর্মকর্তার দিকে। তারপর আবার কাঁদলেন। বসে থাকলেন চেয়ারে। তিনি বললেন, আমি এখানেই থাকি। তোমরা যেভাবে বলবে কাজ করব।
এদিকে একই সময়ে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা লে. কর্নেল আমিন আহমেদ চৌধুরী সাভার রক্ষীবাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যান। তিনি সেখানকার একজন ভারতীয় প্রশিক্ষক মেজর বালা রেডিউকে আটক করে ঢাকায় নিয়ে আসেন। পরে তাঁকে রেখে যান রক্ষীবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ে। কার নির্দেশে জয়দেবপুরে কর্মরত আমিন আহমেদ চৌধুরী এ কাজ করেছিলেন তা আজও রহস্যাবৃত। পরে বালা রেডিউ রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তাদের অনুরোধ করেন তাঁকে ভারতীয় হাইকমিশনে পাঠিয়ে দিতে। রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তারা তা-ই করেন। আর বিকালে খুনি সরকারের প্রেসিডেন্টের সামরিক সচিবের দায়িত্ব নেন আমিন আহমেদ চৌধুরী। কী অদ্ভুত সব সমীকরণ! প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব ছিলেন তখন রুহুল কুদ্দুস, প্রধানমন্ত্রীর সচিব ছিলেন আবদুর রহিম। মন্ত্রিপরিষদ সচিব ছিলেন এইচ টি ইমাম। তাঁরা কেউই রাষ্ট্রপতিকে রক্ষা করতে তাঁদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। এইচ টি ইমাম খুনি সরকারের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন!
রাষ্ট্রপতিকে রক্ষা করতে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ব্যর্থতা ছিল নজিরবিহীন। উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, ক্ষমতার মসনদে বসে কী করেছিলেন? মোশতাক ও তার দোসররা শপথ নেওয়ার আগ পর্যন্ত তাঁরা দায়িত্বে ছিলেন। তাঁদের কাজ কী ছিল? সবাই অসহায়ের মতো আত্মসমর্পণ করলেন। অনেকে যোগ দিলেন মোশতাকের মন্ত্রিসভায়। ফণিভূষণ মজুমদার তখন হাসপাতালে ছিলেন। তাঁকে খুনি সেনারা যখন শপথ নিতে হাসপাতাল থেকে নিয়ে যান সেখানে বাধা দিয়েছিলেন কবি জসীমউদ্দদীন। বলেছিলেন, মানুষটা বাঁচবে না। ফণিভূষণ, আবু সাঈদ চৌধুরীসহ কয়েকজনকে মোশতাক নিয়েছিলেন নিজের স্বার্থে। দেখাতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু নেই। বাকি সব ঠিক আছে। জীবনের অর্ধেক কবরে যাওয়ার মুহূর্তে এই বয়োবৃদ্ধরা গিয়েছিলেন জীবন বাঁচানোর তাগিদে। আবার অনেকে ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে। জাতির পিতাকে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিতদের মধ্যে কর্নেল জামিল ছাড়া আর কেউ জীবন দেননি। কেউ প্রতিরোধে যাননি। নিরাপত্তার দায়িত্ব পালনকারীরা ব্যর্থ হয়েছিলেন। তার পরও তাঁদের পরিবার-পরিজন অনেকেই গত ১৫ বছরে পুরস্কার পেয়েছে। এমনকি সরাসরি সেনাবাহিনীর ভিতরে আলাদা বিদ্রোহী সেনা তৈরিকারী কর্নেল তাহেরের পরিবারও পুরস্কার থেকে বাদ যায়নি।
বঙ্গবন্ধু একবারও ভাবেননি তাঁকে কোনো বাঙালি হত্যা করতে পারে। পাকিস্তানিরা তাঁকে হত্যার চেষ্টা করেছিল। সাহস পায়নি। মৃত্যুর আগে বঙ্গবন্ধু সবাইকে ফোন করেন। সেনাবাহিনী, রক্ষীবাহিনী, পুলিশ, বিডিআর, রাজনীতিবিদ কেউই বাদ ছিল না। বঙ্গবন্ধুকে ভোরে শেখ মণি ফোনে জানান, রক্ষীবাহিনী তাঁর বাড়িতে কালো পোশাক পরে হামলা করেছে। বঙ্গবন্ধু ফোন করেন রক্ষীবাহিনীর আনোয়ারুল আলম শহীদকে। বঙ্গবন্ধু ফোনে তাঁকে বলেন, মণির (শেখ মণি) বাসায় কালো পোশাকধারী কারা যেন হামলা করেছে। একটু দেখ। শহীদ জাতির পিতাকে বলেন, স্যার আমি দেখছি। একটু পর তোফায়েল আহমেদও ফোন করেন আনোয়ারুল আলম ও সরোয়ার মোল্লাকে। বললেন, মণি ভাইয়ের বাড়িতে হামলা করেছে রক্ষীবাহিনীর একটি গ্রুপ। তোমরা এখনই দেখ। বঙ্গবন্ধুর ফোন পেয়ে জেনারেল শফিউল্লাহ ৪৬ ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়েত জামিলকে বারবার ফোন করে পাননি। সেনাপ্রধান তাঁর অধীনস্থ সবচেয়ে ক্ষমতাবান কর্মকর্তাকে পান না, কী অদ্ভুত! এরপর তিনি জিয়াউর রহমান ও খালেদ মোশাররফকে ফোন করেন। সকালে জিয়াউর রহমান, সিজিএস খালেদ মোশাররফ, ডিজিএফআই-প্রধান আবদুর রউফকে নিয়ে অসহায় সেনাপ্রধান বৈঠক করেন। সেনাপ্রধানের সামনে সবাই আলাপ করলেন সাংবিধানিক ধারা নিয়ে। বঙ্গবন্ধু শেষ মুহূর্তে তাঁর বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক সহযোগীকেও ফোন করেন। তাঁরা কেউ সরাসরি এগিয়ে যাননি। কর্মীদের কোনো নির্দেশ দেননি। সকালে রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তারা সৈয়দ নজরুল ইসলামের বাড়িতে যান। গিয়ে জানতে পারেন ভোরে তিনি এক আত্মীয়ের সঙ্গে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছেন। তাঁকে তারা খুঁজে পাননি। মনসুর আলীর বাড়ি গিয়ে জানেন তিনিও বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছেন একান্ত সচিবের সঙ্গে। রক্ষীবাহিনীর ভারপ্রাপ্ত পরিচালক আবুল হাসান খান ফোন করেন বিডিআরপ্রধান মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানকে। বারবার অনুরোধ করেন তাঁদের পিলখানায় রক্ষিত অস্ত্র-গোলাবারুদ ফেরত দিতে। তাঁরা ডেপুটি লিডার হাফিজ উদ্দিনকে অস্ত্র আনতে পাঠিয়েছেন পিলখানায়। খলিলুর রহমান অস্ত্র দেননি। তিনি হাফিজ উদ্দিনকে পিলখানায় প্রবেশ করতে দেননি। সাভারে রক্ষীবাহিনীর দুটি ব্যাটালিয়ন ছিল। বেশির ভাগ কোম্পানি ঢাকার বাইরে বিভিন্ন মহকুমা ও জেলায় নিয়োজিত ছিল অস্ত্র উদ্ধারে। কেঁদেছিলেন তাঁরা। দুজন সাধারণ সেপাই সাভারে আত্মহত্যা করেন। সেনাবাহিনীতে বঙ্গবন্ধুর সমর্থক সেনা কর্মকর্তারা কোনো লড়াই চাননি নিজেদের ভিতরে। রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তারা যোগাযোগ করেন তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে। তিনি বলেন, তোমরা উপরাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বল। তাঁরা বললেন, যোগাযোগ করেছি। তাঁরা বাসা ছেড়ে চলে গেছেন। তখন তাজউদ্দীন আহমদ ভেঙে পড়েন। ডিজিএফআইয়ের ঢাকা ডিটাচমেন্ট কমান্ডার ছিলেন মেজর জিয়াউদ্দিন আহমেদ। তিনি রক্ষীবাহিনীর অফিসে আসেন। সরোয়ার মোল্লা ও আনোয়ারুল আলম শহীদকে সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁকে পাঠিয়েছেন সিজিএস খালেদ মোশাররফ। জিয়াউদ্দিনের গাড়িতে চড়ে তাঁরা ৪৬ ব্রিগেডে গেলেন। ব্রিগেড কমান্ডারের রুমে তাঁরা প্রবেশ করলেন। ব্রিগেড কমান্ডারের চেয়ারে খালেদ মোশাররফ। পাশে শাফায়েত জামিল। ৩০ থেকে ৩৫ জন অফিসার দাঁড়িয়ে। তাঁদের খালেদ মোশাররফ নির্দেশ দিচ্ছেন। কোনো নির্দেশ খুনিদের উৎখাতের ছিল না। তাঁরা চিন্তিত দেশের অস্তিত্ব নিয়ে। সরোয়ার মোল্লা ও আনোয়ারুল আলম শহীদ বলেছেন, আমরা ভেবেছিলাম তিনি আমাদের নিয়ে প্রতিরোধে নামবেন। তেমন নির্দেশ দেবেন। কিন্তু তা করেননি।
১৫ আগস্ট একটা দিন কেটে গেল দায়িত্ববানদের সিদ্ধান্তহীনতায় আর খুনিদের উল্লাসনৃত্যে। চক্রান্তকারীরা ব্যস্ত ছিল শিয়ালচোখে সবকিছু সামলে ওঠার তৎপরতায়। আওয়ামী লীগ নেতারা কাপুরুষতা দেখিয়েছেন সারা দেশে। ইতিহাসের ভয়াবহতার প্রতিবাদ, প্রতিরোধ কেউই করলেন না। সেনাবাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন গুটিকয় খুনির বিরুদ্ধে সেদিন কেউই রুখে দাঁড়ালেন না। সবাই ব্যস্ত ছিলেন নানামুখী হিসাবনিকাশে আর নিজেদের রক্ষায়। লে. কর্নেল হামিদ লিখেছেন কীভাবে ৩২ নম্বরে পড়ে থাকা জাতির পিতা ও তাঁর পরিবারের লাশগুলো পড়ে ছিল। তাঁরা তালিকা করে দাফনের ব্যবস্থা করেন। দলের কোনো নেতা, সিভিল প্রশাসনের শীর্ষ বা নবীন কর্মকর্তার কেউই আসেননি, যাননি ৩২ নম্বরে। অথচ এক দিন আগেও সবাই ব্যস্ত ছিলেন এই পরিবারটির সঙ্গে একটু সাক্ষাৎ ও আনুকূল্য পাওয়ার আশায়!
লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন