রবিবার, ৬ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

করোনার আদলে ডেঙ্গুর থাবা

অধ্যাপক মালেকা আক্তার চৌধুরী

করোনার আদলে ডেঙ্গুর থাবা

‘ডেঙ্গু’ নামের এক ভাইরাস জনজীবনকে অন্ধগলিতে ঠেলে দিচ্ছে। দিন দিন ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মাঝে ডেঙ্গু আতঙ্ক অভিন্ন বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব এস এম নাজিয়া সুলতানা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক কান্তা বিশ্বাসের মৃত্যুতে দেশবাসীর শোক যেন পাথুরে মূর্তিতে পরিণত হয়েছে। তাঁরা দুজনই ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সারা দেশে আক্রান্তের সংখ্যা ৬২ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এ বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যু ৩০০ ছাড়িয়েছে। হাসপাতালের হিসাবের বাইরে মৃতের সংখ্যা যে রয়েছে তা সহজে অনুমেয়।

খুব ছোটবেলা থেকেই ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া, কালাজ্বরের নাম শুনে এসেছি। চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানবসমাজ পরিচিত হয়েছে নতুন নতুন রোগের সঙ্গে। ডেঙ্গুর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই চলেছে সাধারণ মানুষ। ধীরে ধীরে সময়ের সঙ্গে ডেঙ্গু ভয়ংকর থেকে ভয়ংকরতর হয়েছে। কিন্তু আমাদের চেতনার জগৎ জাগ্রত হয়নি। আমরা সাবধান হইনি। ভাবটা এমন, এ আর নতুন কী! স্বাভাবিক জীবনাচরণের আয়েশি ছন্দের ভিতরে করোনা এলো মহাপ্রলয়ের ডঙ্কা বাজিয়ে। বিশ্ববাসী চিরচেনা পৃথিবীর এমন ভয়াবহ রূপ প্রত্যক্ষ করবে স্বপ্নেও ভাবেনি। যুগে যুগে, শতকে শতকে মহামারি, দুর্যোগ-দুর্বিপাক হানা দিয়েছে মাটির পৃথিবীতে। তাই বলে একবিংশ শতাব্দীর শুরুতেই বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উৎকর্ষ যেখানে মানবসভ্যতাকে ঈর্ষণীয় পর্যায়ে নিয়ে গেছে, স্যাটেলাইটের যুগে প্রবেশ করে বাসযোগ্য গ্রহটিকে হাতের মুঠোয় পুরে নিয়েছে চিন্তাশীল মানুষ; সেখানে সর্বগ্রাসী অণুজীব ন্যানোমিটার ব্যাসার্ধের করোনা দাপিয়ে কাঁপিয়ে পুরো বিশ্বটাকে শ্মশানে পরিণত করে লন্ডভন্ড করে দিয়ে গেল; এই তো ক’ দিন আগেই। সেই ক্ষতচিহ্ন মানব জাতি আজও বহন করে চলেছে হৃদয়ে-মননে -মানসে, অর্থনীতিতে, রাজনীতিতে, শিক্ষানীতিতে, চিকিৎসাবিজ্ঞানে, বৈশ্বিক নীতির স্তরে স্তরে অস্থিমজ্জায়। চোখ মেললেই লাশের সারি, কান পাতলেই আহাজারি। জীবনকে জীবন থেকে বহুদূরে আতঙ্কের অনিশ্চিত এক রাক্ষসপুরীতে ডুবিয়ে দিয়েছিল। বাঘের ভয় নয়, কাছে থাকা মানুষটিকেই মানুষ ভয় পেয়ে দূরে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল। দগদগে ক্ষত আজও বহন করে চলেছি নিভৃত মনের গহিনে। কোথা থেকে কী হয়ে গেল, নিজের ঘরখানা পুড়ে ছারখার করে দিয়ে চলে গেলেন সবচেয়ে প্রিয় মানুষটি।

নিস্তরঙ্গ শুনসান পথের দিকে তাকিয়ে সারা রাত জেগে লিখতাম আর চেয়ে চেয়ে রাস্তার নেড়িকুকুরগুলোর অবাধ বিচরণ দেখতাম। থমকে যাওয়া রাতের হাহাকারের মাঝে জ্বলজ্বলে চাঁদের লুকোচুরি মনকে উদাস করে তুলত। সেই দিনও তো গত হয়েছে। মানুষ নিজেকে বদলাবে বলে যে প্রতিজ্ঞা করেছিল তাও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অবলীলায় ভুলতে ভুলতে আরও বেপরোয়া আত্মবাদী হয়েছে। হয়েছে ভোগবাদীও। এখন পত্রিকার পাতায় পাতায় ডেঙ্গুর সদর্প পদচারণ। ডেঙ্গু এবার সমস্যা নয়, সংকটে, উদ্বেগে নয় আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। খুব দূরে নয়, কাছের মানুষও ভুগছে, মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিকগুলোয় চিন্তাক্লিষ্ট অপেক্ষমাণ মানুষের উপচে পড়া ভিড়। মৃতের সংখ্যা হুহু করে বেড়েই চলেছে। চিকিৎসকরা সেবা দিতে বেসামাল। বেডে, ফ্লোরে, করিডোরে সর্বত্রই রোগী আর রোগী। গত দেড় সপ্তাহের চিত্রই বলে দেয় কতটা ভয়ংকর রূপে ডেঙ্গু হানা দিয়েছে। সরকারি হিসাবের বাইরেও রয়েছে অসংখ্য আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। এরই মাঝে একশ্রেণির ক্লিনিক মালিক, ওষুধ বিক্রেতা অতি প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জামের দাম বাড়িয়ে দিয়ে রোগী এবং রোগীর অসহায় পরিবারকে জিম্মি করে নিয়েছে। শহর, বন্দর, নগর, উপশহর এমনকি গ্রামেও ডেঙ্গু ভয়াবহ রূপ নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে।

মিউটেশনে ধরন পাল্টাচ্ছে করোনার মতো ডেঙ্গুও। অবস্থাদৃষ্টে ডেঙ্গুকে এখন আর মৌসুমি রোগ বলার কোনো সুযোগ থাকছে না। বরং মশাবাহিত রোগ যেমন ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া, চিকুনগুনিয়ার অবাধ বিস্তার মানুষকে প্রতিনিয়ত মৃত্যুঝুঁকিতে ফেলছে। ঘরে বাইরে, কর্মস্থলে আতঙ্কিত মানুষ এক ধরনের স্নায়বিক ও মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের মোকাবিলা করে দিন কাটিয়ে যাচ্ছে। ডেঙ্গুর শক সিনড্রোমে আক্রান্ত হয়ে বহু মূল্যবান প্রাণ ঝরে পড়ছে অকালে। দেখা যাচ্ছে, আগে দুবার, তিনবার যারা এ ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে তারাই শক সিনড্রোমের ঝুঁকিতে পড়ছে অধিক হারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ডেঙ্গুর এমন ভয়াবহ অবস্থা আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় ভয়াবহই নয়, বরং মহামারি ঘোষণার পর্যায়ে রয়েছে।

বিশ্ববাস্তবতা বড় কঠিন। সমস্যা আর সংকটের আবর্তে পুরো পৃথিবী ঘুরপাক খেলেও অর্জন আর উন্নয়ন থেমে থাকেনি। একদিকে নগরায়ণের বিস্তার অন্যদিকে শিল্পায়নের প্রভাবে প্রচুর বসতবাড়ি ও স্থাপনা তৈরি হচ্ছে। কথায় বলে, আলোর নিচেই অন্ধকার বসত গড়ে। এমন বাস্তবতায় নির্মাণাধীন স্থাপনা ও বসতবাড়ির আশপাশে অব্যবহার্য খানাখন্দ, কাদাজলে অলক্ষেই এডিস মশার লার্ভা বেড়ে উঠছে। তা ছাড়া গ্রামগঞ্জে পুকুর, ডোবা, নালা, বদ্ধজলাশয়ে অবলীলায় এডিসের বংশ বিস্তার হচ্ছে এবং রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। অব্যবহার্য তৈজসপত্র, ডাবের খোসা, ফুলের টবসহ পরিষ্কার পানিতেও ডেঙ্গু মশার জীবনচক্র সম্পন্ন হচ্ছে।

প্রতি বছরই মে’র শেষাংশ থেকে শুরু করে বেশ ক’মাস চলে ডেঙ্গুর তান্ডব। এ তো নিয়মিত চিত্র। কিন্তু আমাদের বোধের জগৎটা বড়ই ভোঁতা। মৌসুম শেষ তো, বাঁচা গেল আর হবে না! এবার নাকে তেল দিয়ে ঘুমাও। ডেঙ্গু ঠেকাতে এডিস মশা নিধনের উদ্যোগ নিতে হবে। এ ব্যাপারে সরকার কিংবা দুই সিটি করপোরেশনই নয়; সাধারণ মানুষ, স্কুল-কলেজ-মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এডিস মশার প্রজনন, প্রজননস্থলের বৈচিত্র্যময় জীবনচক্র জেনে সমূলে নির্মূল করতে হবে। বছরভর ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত রোগের প্রচার চালিয়ে জনমনে সচেতনতা জাগিয়ে তুলতে হবে। মশা মারায় নিতে হবে দূরদর্শী সমন্বিত পরিকল্পনা, কৌশলগত চিন্তার বিকাশ ঘটিয়ে করোনার আদলে ডেঙ্গু মহামারি থেকে জাতিকে রক্ষা করা এখন সময়ের দাবি।

 

লেখক : সম্পাদক, শিক্ষক পরিষদ সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা

সর্বশেষ খবর