বৃহস্পতিবার, ১০ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

নির্বাচনী রোল মডেল ও আমরা

অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ

নির্বাচনী রোল মডেল ও আমরা

১. রাজনৈতিক দল এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পরস্পরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। রাজনৈতিক দলকে গণতন্ত্রের ভিত্তিরূপে গণ্য করা হয়। রাজনৈতিক দল গণতান্ত্রিক পদ্ধতির অন্যতম, বলতে গেলে প্রধানতম দিক। বহুদলীয় রাষ্ট্রব্যবস্থায় সম অধিকারের পারস্পরিক স্বীকৃতি, মর্যাদা ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক যার ভিত্তি আস্থা ও বিশ্বাস। রাষ্ট্রশক্তি প্রয়োগকারী ক্ষমতার মূর্ত প্রতীক রূপে যখন ব্যবহৃত হতে থাকে, তখন রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও দলীয় ব্যবস্থাপনা তাকে রশি টেনে ধরবে। তা না হলে জনগণের অভিপ্রায় গণতন্ত্র, ভোটাধিকার, মৌলিক ও মানবিক অধিকার বিপন্ন হয়ে পড়ে। বাংলাদেশ সংবিধানে জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠার পরম অভিব্যক্তিরূপে জনগণের ইচ্ছাই চূড়ান্ত। এ ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে গণতান্ত্রিক ধারায় সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে। রাষ্ট্রতত্ত্বে গণসমর্থন লাভের জন্য রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন উপায়ে মতাদর্শ ও নির্বাচনকালীন প্রতিশ্র“তি প্রদান করে। প্রতিশ্র“তিগুলো সার্বিক ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত এবং তৃণমূল পর্যন্ত প্রয়োগ হচ্ছে কি না তা দেখভাল করার দায়দায়িত্ব রাজনৈতিক দলের। দলকে জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। কারণ রাজনৈতিক দলগুলো জনমত গঠন করে, ভোট সংগ্রহ করে। সেই ভোটের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সরকার গঠন করে। রাষ্ট্রতত্ত্বের এ ধারণায় দার্শনিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা সংসদীয় গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দল ও সরকারকে দুটি পৃথক সত্তায় বিভাজিত করেছেন।

২. পৃথিবীর যেসব দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র চালু আছে, অধিকাংশ দেশে দল ও সরকারের প্রধান এক ব্যক্তি হন না। বাংলাদেশেও এর উদাহরণ রয়েছে। ১৯৭৪ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দলের সভাপতির পদ ত্যাগ করে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের সভাপতি হয়েছিলেন এ এইচ এম কামারুজ্জামান। বর্তমানে ভারতের বিজেপির সভাপতি জগৎ প্রকাশ নাড্ডা, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সরকার ও দলের প্রধান একই ব্যক্তি হলে কে কার কাছে জবাবদিহি করবে? এক ব্যক্তির হাতে দল ও সরকার প্রধানের দায়িত্ব থাকলে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়, রাষ্ট্র কর্তৃত্ববাদী শাসনের দিকে ধাবিত হয়। গণতন্ত্র মুমূর্ষু হয়ে পড়ে। আইনের শাসন থাকে না, শাসন করার জন্য আইন তৈরি হয়। সাংবিধানিক সংস্থাগুলো অকার্যকর করে রাখা হয়। দুর্নীতি ও দুঃশাসনের রাজত্ব কায়েম হয়।

৩. সংসদীয় শাসন-পদ্ধতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হলো সুষ্ঠু নির্বাচন। জনগণ পার্লামেন্টের ক্ষমতার মূল উৎস। ব্রিটেনে ১৯৫৭ সালের অ্যাক্ট মোতাবেক সরকারি, বেসরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা বা সরকারি অর্থে লগ্নিকৃত সংস্থার সভ্য এবং কমন্স সভায় ইংল্যান্ডের লর্ড উপাধিধারী ব্যক্তি নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন না। ব্রিটেনে গণতন্ত্র শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন নয়; দলীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতায়ই আইন ও নীতি প্রণীত হয় না, বরং আইনে জনমতের প্রতিফলন ঘটানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা হয় নানারকম প্রতিষ্ঠিত ও প্রথাগত সৃজনশীল উপায়ে।

৪. ব্রিটেনে নির্বাচন ঘোষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাউস অব কমন্স ভেঙে যায়। সংসদ সদস্য পদ বিলুপ্ত হয়। প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীরা তখন জনপ্রতিনিধি নন, বিধায় তারা ক্ষমতায় থাকেন না। প্রাপ্ত সব সুযোগসুবিধা পরিত্যাগ করতে হয়। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সহকর্মীদের নিয়ে অনুষ্ঠান করলে আইন ভঙ্গ হয়। আইন ভঙ্গের জন্য প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে পুলিশ জরিমানা করেছিল। যুক্তরাজ্যের ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিট কিংবা চেকারসে প্রধানমন্ত্রীর বাগানবাড়িতে দলীয় সভা, পার্লামেন্টারি বোর্ড, কিংবা কোনো কমিটির সভা, ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে অসদাচরণ হিসেবে বিবেচ্য। টনি ব্লেয়ার প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে একটি মাত্র অ্যাটাচি ব্যাগ হাতে নিয়ে ভাড়া করা ট্যাক্সিতে স্বগৃহে গমন করেন তার দৃষ্টান্ত আছে। করদাতার অর্থ বা রাষ্ট্রীয় সম্পদ কোনো দল বা ব্যক্তির রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের কোনো অবকাশ নেই।

৫. ব্রিটেনে নির্বাচন তফসিল ঘোষিত হওয়ার আগেই আমলাদের দ্রুততম সময়ে বিরোধী দলগুলোর চাহিদামতো তথ্য সরবরাহ বাধ্যতামূলক। সরকারি কর্মচারীরা জনগণের সেবক। যারা মেধা ও দক্ষতার ভিত্তিতে নিয়োগ পান, তাদের হাত-পা আইনকানুনে বাঁধা। দক্ষতা, যোগ্যতা ও নিরপেক্ষতায় তারা মর্যাদাবান।

৬. নির্বাচনবিষয়ক আইন, বিধিবিধান আলোচনা ও সমঝোতার ভিত্তিতে তৈরি হয়, একতরফাভাবে নয়। সব দলের মধ্যে সংলাপ ও সমঝোতার ভিত্তিতেই পার্লামেন্টে সিদ্ধান্ত নিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যুক্তরাজ্যের সংবিধানের ২০ (৭) অনুযায়ী নির্বাচনকালীন রাজনৈতিক সরকারের তত্ত্বাবধায়ক চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বিরোধীদের প্রতি শ্রদ্ধা, সম অধিকারের স্বীকৃতি, সংযত আচরণ এবং প্রশাসন ও নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষ ভূমিকা। প্রশাসনের নিরপেক্ষতার নীতি রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রে পালনীয়। ৩১(৫) অনুচ্ছেদে পার্লামেন্টের সময়সীমা পাঁচ বছর বেঁধে দেওয়া আছে। ৩২(৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, পার্লামেন্টে নির্বাচিত সদস্যসংখ্যা ৬৫১, যারা সর্বজনীন ভোটাধিকারের মাধ্যমে নির্বাচিত হন। ৩৩ অনুচ্ছেদ রাজনৈতিক দল নিবন্ধিত হতে হবে এমন কথা বলে না। নির্বাচনে দলীয় প্রভাব খাটানো বা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কোনো অবকাশ এতে নেই। বেসরকারি বা বাণিজ্যিক রেডিও-টিভিকেও সব দলের প্রতি সমসুযোগ প্রদানের বাধ্যবাধকতা আরোপিত থাকে। এসব কারণে ব্রিটেন সংসদীয় গণতন্ত্র ও নির্বাচনের রোল মডেল।

৭. বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ব্রিটেনের এসব আইন, নিয়মনীতি, ঐতিহ্য ও প্রথা কোনটা কতটুকু বাস্তবায়িত হয়? বাংলাদেশে সংসদ বহাল থাকে। প্রধানমন্ত্রী স্বপদে থাকেন। সরকারি বাড়ি, গাড়িসহ সব সুযোগসুবিধা পেয়ে থাকেন। রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বস্তরে দলীয়করণের প্রতিযোগিতা আমাদের এমন অবস্থায় নিয়ে গেছে যে সততা, নিষ্ঠা, দক্ষতা ও নিরপেক্ষতা সব বিলীন হয়ে গেছে।

৮. বাংলাদেশের আইন, বিধিবিধান মোতাবেক জানমাল-দেহ ও জনজীবনের নিরাপত্তাবিধানের দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো মূলত রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রের পক্ষে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে পুলিশ, বিডিআর, র‌্যাব, আনসার বাহিনী এবং বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাকে এসব দায়িত্ব পালনের জন্য রাষ্ট্র থেকে বেতন-ভাতা, সুযোগসুবিধা দেওয়া হয়। সংবিধান অনুযায়ী তারা জনগণের সেবক হিসেবে কাজ করবেন। একই সঙ্গে তারা শান্তিপূর্ণ সমাবেশ, জনসভা, শোভাযাত্রায় যোগদান করা এবং রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে সম অধিকার নিশ্চিত করবেন। এর বিপরীতে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সরাসরি প্রশ্রয়ে ক্ষমতাসীন দল শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ ও মিছিলে হামলা করেছে। পুলিশ নির্বাক। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শপথ ভঙ্গ করে দন্ডনীয় অপরাধ করে চলেছে বলে প্রতীয়মান। জাতিসংঘের তরফ থেকে পুলিশের প্রতি ‘অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ না করার’ আহ্বান জানানো কি গৌরবের, না লজ্জার?

৯. প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের সরকারপ্রধান। তিনি রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বেতন-ভাতা, সুযোগসুবিধা পান। ২ আগস্ট রংপুরে তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে গেলেন। মন্ত্রী, আমলা, যানবাহনসহ। কয়েকটি প্রকল্প উদ্বোধন করলেন। এটা তিনি করতেই পারেন। জনসভায় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সরাসরি আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কার জন্য ভোটপ্রার্থনা, জনগণকে ভোট দেওয়ার জন্য শপথ করালেন। প্রধানমন্ত্রীর পদে বসে জনগণের ট্যাক্সের টাকায় একটি দলের পক্ষে এ ধরনের নির্বাচনী প্রচার করতে পারেন কি?

১০. খসড়া সংবিধান রচনার সময় মুক্তিযুদ্ধের উন্মাদনায় জাতির ঐক্যবদ্ধ অঙ্গীকার ও মহৎ দর্শনগুলো আমরা লিপিবদ্ধ করেছিলাম। আজ সেসব দর্শন ও মূল্যবোধ নিখোঁজ। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো এমনকি স্বাধীন নির্বাচন কমিশনকে আমরা অন্ধ, বধির ও ক্ষমতাহীন করে রেখেছি। দেশের বিরাজমান সংকট সমাধানের দায় ও দায়িত্ব প্রধানত সরকারের। পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের পরিবেশ তৈরি করার দায়িত্ব ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের। সব দল ও জোটের সঙ্গে সংলাপ ও সমঝোতার ভিত্তিতে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠান দেশবাসীর পরম আকাক্সক্ষা।

লেখক : ১৯৭২ সালের খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য ও সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী

সর্বশেষ খবর