বৃহস্পতিবার, ১০ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

রুখতে হবে মানব পাচার

প্রিন্সিপাল এম এইচ খান মঞ্জু

রুখতে হবে মানব পাচার

একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকার আশায় কিংবা একটু উন্নত জীবনের প্রত্যাশায় মানুষ অপেক্ষাকৃত উন্নত দেশগুলোয় পাড়ি জমায়। কিন্তু বৈধভাবে যাওয়ার সুযোগ হয় খুব কম মানুষের। আর এ সুযোগটাই নেয় দালাল বা প্রতারক শ্রেণি। ভালো চাকরি, লোভনীয় সুযোগসুবিধার কথা বলে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের আকৃষ্ট করে। তারপর টাকাপয়সা হাতিয়ে নিয়ে তাদের ঠেলে দেয় ভয়ংকর বিপদের মুখে। জীবনও দিতে হয় অনেককে। মাদক ব্যবসা ও অস্ত্র পাচারের পর মানব পাচার হচ্ছে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অপরাধমূলক কার্যক্রম। মানব পাচারের সঙ্গে প্রথম দুটি অপরাধও প্রায়ই জড়িয়ে থাকে।

২০১৪ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে শুধু ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ৬ লাখের বেশি অভিবাসনপ্রত্যাশী ইউরোপে প্রবেশ করেছে। এ সময়ে প্রায় ১৫ হাজার অভিবাসনপ্রত্যাশীর মৃত্যু হয়েছে। ব্যাপক সংখ্যায় অভিবাসনপ্রত্যাশীর আগমনে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নানা রকম সংকট তৈরি হচ্ছে। তাই সাম্প্রতিক সময়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অভিবাসনবিরোধী তৎপরতা শুরু হয়েছে। মানব পাচার বন্ধে বাংলাদেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে।

মানব পাচার প্রতিরোধে ভালো করছে বাংলাদেশ। কিন্তু এটি বন্ধে এবং ভুক্তভোগীদের সহায়তার জন্য আরও অনেক করণীয় আছে বলে মনে করে যুক্তরাষ্ট্র। এজন্য পাচারকারীদের আরও কঠোর শাস্তি, মানব পাচার ট্রাইব্যুনালের সক্ষমতা বৃদ্ধিসহ ১০ দফা সুপারিশ করেছে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

ওয়াশিংটন থেকে স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রকাশিত ‘মানব পাচার রিপোর্ট ২০২৩’-এ এসব সুপারিশ করা হয়। গত বছরের মতো এবারও বাংলাদেশের অবস্থান টিয়ার ২-এ (দ্বিতীয় স্তর)। এর আগে ২০২০ সালে টিয়ার ২ ওয়াচলিস্ট থেকে টিয়ার ২-এ উন্নীত হয় বাংলাদেশ।

‘ইউএস ট্রাফিকিং ইন পারসন্স (টিআইপি)’ শীর্ষক প্রতিবেদনে ১০ দফা সুপারিশে প্রথমটিতে মানব পাচার অপরাধের তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া আরও ভালো করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। মার্কিন বিবেচনায় অপরাধীদের শুধু অর্থদন্ড নয়, একই সঙ্গে কঠোর কারাদন্ড দিতে হবে মানব পাচার প্রতিরোধে। মানব পাচারের ভুক্তভোগীদের চিহ্নিত করার সুপারিশের পাশাপাশি ট্রাইব্যুনালের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সরকারকে পদক্ষেপ নিতে বলেছে যুক্তরাষ্ট্র। ভুক্তভোগীদের জন্য সেবা বৃদ্ধি, যেসব কোম্পানি বিদেশে লোক পাঠায় বা দালালের ওপর নজরদারি বাড়ানো, যাতে তারা কাউকে প্রতারিত করতে বা বেশি অর্থ নিতে না পারে তার প্রতি আরও নজর দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার মানব পাচার বন্ধের লক্ষ্যে উল্লেখযোগ্য চেষ্টা চালিয়েছে। মানব পাচার বন্ধে পাচারকারীদের বিচারের আওতায় আনা, রোহিঙ্গা পাচারের ঘটনার তদন্তে প্রথমবারের মতো গুরুত্বারোপ এবং সরকারি রিক্রুটিং এজেন্সির বিদেশে লোক পাঠানোর ক্ষেত্রে ফি কমানোর দিকে নজর দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।

তবে অবৈধ অভিবাসনের কারণে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে মানব পাচার বন্ধ করতে হলে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়া পাচারকারীদের নেটওয়ার্ক ভাঙতে হবে। তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। আর সে কাজটি করতে হবে স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকেই।

মাদক নিয়ন্ত্রণ ও অপরাধ প্রতিরোধে কাজ করা জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনওডিসি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত প্রথম জাতীয় মানব পাচার বিষয়ক গবেষণায় দেখা যায়, মানব পাচারের শিকার মানুষের বেশির ভাগই অত্যন্ত গরিব এবং জীবিকার তাগিদে এ পথে পা দেয়।

বৈধভাবে বিদেশ যেতে অনেক অর্থ খরচ হয়। পাচারকারীরা দরিদ্র মানুষকে কোনো টাকাপয়সা ছাড়াই বিদেশে নিয়ে যায় চাকরি দেওয়ার নাম করে। এর আগে ইউএনওডিসির ২০২০ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ৫১ শতাংশ মানুষ জীবিকার প্রয়োজনে পাচারকারীদের ফাঁদে পা দেয়। বাংলাদেশ থেকে যেসব দেশে বেশি মানুষ পাচার হয় সেগুলো হলো পূর্ব আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ। পাচার হওয়া মানুষগুলো সেখানে কেবল দুর্বিষহ জীবনযাপন করতে বাধ্য হয় তা-ই নয়, অনেকে জিম্মিও হয়ে পড়ে। দেশের স্বজনদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করে পাচারকারীরা। তারা মেয়েদের যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করতে বাধ্য করে। মার্কিন প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ সাফল্যের কারণে মানব পাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশকে দুই ধাপ উন্নীত করা হয়েছে। মানব পাচারের কিছু মূল হোতাকে চিহ্নিত ও গ্রেফতার করা হয়েছে। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ সরকার মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ভালো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে এবং পাচারের শিকার অনেককে উদ্ধারও করতে পেরেছে।

মানব পাচারের মতো ঘৃণ্য অপরাধ প্রতিরোধের দায়িত্ব মূলত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। বিমান, নৌ কিংবা সড়ক পথে যাতে কেউ পাচার করতে না পারে, সেজন্য সীমান্তরক্ষীদের সদা সতর্ক থাকতে হবে। আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে মানব পাচারের বিরুদ্ধে গড়ে তুলতে হবে সামাজিক সচেতনতাও। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, মানব পাচারের ঘটনায় আসামি ধরা পড়লেও বিচার হয় না। শাস্তি পায় না। আমরা যদি পাচারকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারি, মানব পাচার চলতেই থাকবে।

 

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও প্রিন্সিপাল, এম এইচ খান ডিগ্রি কলেজ, গোপালগঞ্জ

সর্বশেষ খবর