শিরোনাম
শুক্রবার, ১১ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

হে শান্তিহারা মানুষ! কামেল মুর্শিদ থেকে নাও অন্তরের প্রসাধনী

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

হে শান্তিহারা মানুষ! কামেল মুর্শিদ থেকে নাও অন্তরের প্রসাধনী

দুনিয়াজুড়ে রঙের মেলা বসেছে। সে মেলায় এক আজব প্রাণী মানুষ। পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণী তার আপন রঙে রঙিন। একমাত্র মানুষই তার ব্যতিক্রম। নিজের রং ছেড়ে সে পরের রং ধারণে ব্যস্ত। কালো চায় শাদা হতে। শাদা চায় আরও শাদা হতে। এই যে মানুষ নিজের রং লুকাতে এত ব্যস্ত এর শেষ কোথায়? সম্প্রতি খবরে দেখলাম জাপানের এক লোক কুকুর সেজে রাস্তায় হেঁটে বেড়াচ্ছে। অন্যরা রং বদলায়, সে নিজের জাতই বদলে ফেলেছে। আসলে এই যে বর্ণচোরা হওয়ার খেলা এটা কোনো সুস্থ মানুষের কাজ না। নিজের রং বদলে সং সাজার এতসব বাহারি আয়োজন দেখে লালন ফকির দুনিয়াটাকে পাগলের মেলা বলেছিলেন। আসলেই তো পাগলের মেলা। মানুষ বাদে পৃথিবীর আর কোনো প্রাণী আপন রূপ লুকানোর জন্য অত্যাধুনিক পারলার খুলে বসেছে এমনটি কখনো শুনেছে কেউ? কুকুর-শূকর কি নিজেকে আরও ফর্সা দেখাতে কসমেটিকসের ওপর হামলে পড়েছে কখনো? বাঘ-সিংহ, ময়ূর-কাক তারা নিজেদের সুন্দর রূপ নিয়েই সুখী। তাদের প্রয়োজন নেই কোনো পারলার, দরকার পড়ে না মেকআপ। কিন্তু বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ বাংলাদেশের অবস্থা শুনলে চোখ কপালে উঠবে খোদ ইহুদি-খ্রিস্টানদেরও। এ দেশের প্রতিটি অলিগলিতে এখন পারলারের ছড়াছড়ি। প্রতিটি মোড়ে মোড়ে কসমেটিকসের পসরা।

নিজের রূপ লুকানোর এ প্রবণতা এসেছে ব্যবসায়ীদের মাথা থেকে। নয়তো মানুষ খাবার কেনার চেয়ে প্রসাধনী কেনার জন্য কেন এত মরিয়া হবে? খোঁজ নিলে দেখা যাবে, আমাদের ঘরগুলোতে খাবার নিয়ে এখন আর ঝগড়া হয় না। ঝগড়া হয় উচ্চাভিলাষী প্রসাধনী কিনে দেওয়া না দেওয়া নিয়ে। আরও মর্মান্তিক বিষয় হলো- দামি প্রসাধনী কেনার জন্য এখনকার ছেলেমেয়েরা অবলীলায় ভয়ংকর রকম অপরাধ করতেও পিছপা হয় না। বিজ্ঞাপনগুলো আমাদের দেখায় অমুক প্রসাধনী মাখলে সফলতা চলে আসে, আসে নারী-বাড়ি সবই। আমরা এতটাই বোকা যে, বিজ্ঞাপনের মিথ্যাকে সত্য মনে করে সেই প্রসাধনীর জন্য নিজের পকেটের পয়সা খরচ করছি অকাতরে। আমাদের বোকামির কারণেই আজ আমরা পিছিয়ে আছি।

তাহলে কি আমরা প্রসাধনী ব্যবহার করব না? অবশ্যই করব। তবে সেটা যেন মাত্রা ছাড়িয়ে না যায়। একটা কথা আছে- খাওয়ার জন্য বাঁচা আর বাঁচার জন্য খাওয়া দুটি কিন্তু এক বিষয় নয়। তেমনি সৌন্দর্যের জন্য প্রসাধনী ব্যবহার করা আর প্রসাধনী ব্যবহার করে নিজের রূপ লুকানোও এক কথা নয়। আল্লাহ প্রদত্ত নিজের রূপ লুকানোর বাড়াবাড়ি চর্চাকে আমরা নিরুৎসাহিত করি। এর কারণ হলো- এ ধরনের বেহুদা কাজের কারণে ব্যক্তির দুনিয়া ও আখেরাতের জীবন দুটিই ধ্বংস হয়ে যায়। ব্যক্তি যখন নিজের বাইরের রূপ নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকে তখন সে নিজের ভিতরের রূপের ব্যাপারে বেখবর হয়ে পড়ে। আর একজন ভিতরের ব্যাপারে বেহুঁশ ব্যক্তি পরিবার ও সামাজের জন্য কতটা মারাত্মক তা আজ আর বলার অপেক্ষা রাখে না। একটা জাতির অধিকাংশ মানুষ যখন ভিতরের ব্যাপারে বেখবর থাকে তখন ওই জাতির জীবনে কী ভীষণ অশান্তি নেমে আসে তা জানতে আজ আর পশ্চিমা দুনিয়ায় নয়, আমাদের ঘরগুলোর দিকে তাকালেই যথেষ্ট হবে। আমাদের পরিবারগুলোতে শান্তি নেই। সন্তান বাবা-মাকে সম্মান করে না, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রেম-ভালোবাসা নেই, ভাই-বোনের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেছে, বন্ধু-আত্মীয়রা আমানতদারিতার পরিচয় দিতে পারছে না। এসবই আসলে ভিতরের রূপ সম্পর্কে বেখবর থাকারই ফল।

ইমাম গাজ্জালি (রহ.) তাঁর একজন মস্ত বড় আলেম ছাত্রকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘সাবধান! নিজের বাইরের রূপ নিয়ে পড়ে থেকো না। ভিতর জগতের সৌন্দর্য বাড়াও।’ একজন আলেমের জন্য যদি এমন উপদেশ হয় তাহলে আমরা যারা সাধারণ মানুষ আমাদের জন্য ভিতর জগৎ আলোকিত করা কত জরুরি তা সহজেই বোঝা যায়। ইঞ্জিল শরিফে হজরত ঈসা (আ.) চমৎকার একটি কথা বলেছেন। ইমাম গাজ্জালি তাঁর রিসালা গ্রন্থে ঈসা (আ.)-এর হাদিসটি উল্লেখ করেছেন এভাবে- ঈসা (আ.) বলেন, ‘মানুষ যখন মারা যায় তখন তাকে কবরে নেওয়ার আগ পর্যন্ত যতটুকু সময় থাকে ওই সময়ের মধ্যে আল্লাহতায়ালা তাকে অন্তত ৪০টি বিষয়ে প্রশ্ন করেন। আল্লাহর কসম! তাকে প্রথম প্রশ্ন করা হয় তার ভিতর জগতের সৌন্দর্য নিয়ে। আল্লাহ বলেন, বান্দা! তুমি বছরের পর বছর নিজের বাইরের রূপ নিয়ে ব্যস্ত ছিলে। কীভাবে নিজের চামড়াকে আরও শাদা দেখায়, আরও আকর্ষণীয় লাগে- এ প্রচেষ্টায় জীবন অতিবাহিত করেছ। কিন্তু তুমি কি তোমার ভিতর জগৎ আলোকিত করার চেষ্টা করেছ? প্রতি মুহূর্তেই আমার পক্ষ থেকে তোমাকে সতর্ক করা হয়েছে। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে তোমাকে বোঝানো হয়েছে মহান আল্লাহর রহমতে তুমি বেঁচে আছ। তোমাকে বোঝানো হয়েছে- আল্লাহকে পাওয়ার জন্য ভিতর জগৎ আলোকিত করার কোনো বিকল্প নেই। তখন কেন তুমি সতর্ক হলে না। নাকি ওই সময় নিজেকে বোবা ও অন্ধ বানিয়ে রেখেছ?’ হে পাঠক! আজ সর্বগ্রাসী যে হতাশা-অশান্তি আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে তা শুধু ভিতর জগৎ বাদ দিয়ে বাইরের রূপ নিয়ে পড়ে থাকারই ফল। আসুন! আমরা ভিতর জগতের সৌন্দর্য বাড়ানোর চেষ্টা করি। কামেল মুর্শিদের কাছে বায়াত নিয়ে দুনিয়া-আখেরাত মঙ্গলময় করি। আল্লাহ আমাদের বোঝার তৌফিক দিন। আমিন।

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি পীরসাহেব, আউলিয়ানগর

সর্বশেষ খবর