শনিবার, ১২ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

কম্বোডিয়ায় মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ও ইতিহাসের আয়না

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

কম্বোডিয়ায় মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ও ইতিহাসের আয়না

২৩ জুলাই ২০২৩ তারিখে ইন্দোচীন উপদ্বীপ অঞ্চল তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম আকর্ষণীয় দেশ কম্বোডিয়ার জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়ে গেল। তবে সমালোচকদের দৃষ্টিতে নির্বাচনের আবরণে এটি ছিল ‘রাজ্যাভিষেক’। কারণ নির্বাচনে বিগত ৩৮ বছর ধরে ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা কম্বোডিয়ান পিপলস পার্টি (সিপিপি) ১২৫টি আসনের মধ্যে ১২০টিতে অনায়াসে ও প্রত্যাশিতভাবেই জয়ী হয়। বাকি পাঁচটিতে জয়ী হয় ফানসিপিক (সংক্ষিপ্ত নাম)। নির্বাচনে জয়ী হওয়ার নেপথ্যে উচ্চারিত হয় সিপিপি নেতা হুন সেনের নাম, যিনি ১৯৯৭ সালে ষড়যন্ত্র ও অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে ক্ষমতায় আসেন। ষড়যন্ত্র ও অভ্যুত্থানের সময় সিপিপি এবং ফানসিপিকের অনুগত সৈন্যদের মাঝে সংঘাত হয়। তখন সিপিপির পক্ষে থাকা সৈন্যদের সঙ্গে ফানসিপিকের সৈন্যরা কুলিয়ে উঠতে না পারায় পরাজয় মেনে পিছু হটে। আর পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে ফানসিপিকের নেতা ও রাজপুত্র রানারিধ বিদেশে পাড়ি জমান।  ইন্দোনেশিয়া ও সিঙ্গাপুর ঘুরে ২০২১ সালে চিকিৎসারত অবস্থায় ফ্রান্সে তার মৃত্যু ঘটে।

হুন সেনের বিরুদ্ধে অন্যতম অভিযোগ, তিনি বিচার বিভাগের ওপর প্রভাব খাটিয়ে কম্বোডিয়ায় অন্যতম রাজনৈতিক শক্তি ‘কম্বোডিয়া ন্যাশনাল রেসকিউ পার্টি’কে ২০১৮ সালে নিষিদ্ধ করেন এবং বলা চলে একদলীয় শাসন চালু করেন। নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী ১৮টি দলের মধ্যে একমাত্র ‘ক্যান্ডেল লাইট পার্টি’ কিছুটা হলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সক্ষম ছিল। কিন্তু নিবন্ধনসংক্রান্ত ত্রুটি দেখিয়ে এ দলটিকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া হয়নি। ফলে মোটামুটি ফাঁকা মাঠেই গোল দিয়েছেন হুন সেন ও তার দল সিপিপি। তবে মূল বিরোধী দলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণে বাধা প্রদান, সংবিধানের চেতনাকে ক্ষুণ্ণ করা, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজকে হুমকি প্রদান ও হয়রানি করা, সর্বোপরি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে ব্যর্থ হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনের একদিন পর অর্থাৎ ২৪ জুলাই ২০২৩ তারিখে কম্বোডিয়ার ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। সেই সঙ্গে কিছু বৈদেশিক সহায়তা কর্মসূচিও স্থগিত ঘোষণা করে। ২৩ জুলাই রবিবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর বহু দেশের কর্মকর্তারা সাপ্তাহিক ছুটি উপভোগ করছিলেন বলেই ধারণা করা যায়। তাই বলা চলে মার্কিন এ সিদ্ধান্ত আগেই নেওয়া ছিল এবং এর ঘোষণাটুকু বাকি ছিল, যা পরদিন ২৪ জুলাই দেওয়া হয়। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার দুই দিন পরই প্রায় ৩৮ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা হুন সেন গণমাধ্যমকে জানান, আগস্ট মাসে ছেলে হুন মানেতের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে পদত্যাগ করবেন তিনি। তবে তিনি দলীয় পদের শীর্ষে থাকার ফলে বস্তুত তার হাতেই ক্ষমতা থাকবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

কম্বোডিয়ায় মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি নির্বাচনের পাঁচ দিন আগে অর্থাৎ ১৮ জুলাই ২০২৩ তারিখেই অনুমান করে ভয়েস অব আমেরিকা। এই বার্তা সংস্থার মতে, মার্কিন আইনপ্রণেতাদের (সিনেটর) একটি অংশ কম্বোডিয়ার কর্তৃত্ববাদী সরকারপ্রধানের বিরুদ্ধে জনগণের রাজনৈতিক অধিকার হরণের পাশাপাশি চীনের সঙ্গে অতিমাত্রায় সখ্যের বিষয়টিও তুলে ধরে। ফ্লোরিডা থেকে নির্বাচিত রিপাবলিকান সিনেটর মার্কো রুবিও এবং নিউজার্সি থেকে নির্বাচিত ডেমোক্র্যাট সিনেটর ক্রিস স্মিথ প্রকাশ্যে বলেন যে, তারা মনে করেন কম্বোডিয়া চীনের দিকে অতিমাত্রায় ঝুঁকে পড়েছে। তাই ১৮ জুলাইয়ের নিষেধাজ্ঞা তাদের ওপরও বর্তাবে যারা এমন অবকাঠামো নির্মাণের সঙ্গে জড়িত, যেসব অবকাঠামো পরবর্তীতে চীনের সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগীদের কাজে লাগবে। (সূত্র : ভয়েস অব আমেরিকা)। উল্লেখ্য, কম্বোডিয়ায় থাইল্যান্ড উপসাগরের তীর ঘেঁষে চীন ‘রিম নেভাল বেইজ’ নামক নৌ স্থাপনা ও অন্যান্য অবকাঠামো গড়ে তোলে। এই স্থাপনা নির্মাণে জড়িত কিছু সামরিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে আমেরিকা তাদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। সিনেটর রুবিও মনে করেন, কম্বোডিয়ায় দীর্ঘদিন কর্তৃত্ববাদী শাসন থাকার কারণেই চীনের মতো সর্বগ্রাসী দেশ সেদেশে এভাবে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে। অপর সিনেটর স্মিথের মতো আমেরিকার এমন আইনি পদক্ষেপ একদিকে কম্বোডিয়ার রাজনৈতিক সংঘাত ও মতভেদ প্রশমিত করবে, অন্যদিকে এর ফলে চীন তথা চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের দখলদারিত্ব ও বিশ্ব শাসনের মনোভাবকে দমন করবে। কম্বোডিয়ায় আমেরিকার উৎপাত এটাই প্রথম নয়। ষাট ও সত্তর দশকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের নামে ভিয়েতনাম ও পার্শ্ববর্তী কম্বোডিয়া ও লাউসের ওপর ব্যাপক বোমাবর্ষণ করে আমেরিকা। নাপাম বোমা নিক্ষেপ করে আগুন ধরিয়ে দেয় গ্রাম, গঞ্জ ও জনপদে। শুধু কম্বোডিয়াতেই ভিয়েতনামি গেরিলাদের গোপন ক্যাম্প ধ্বংসের নামে ১৯৭০ সালের এপ্রিলে তথা এক মাসে আমেরিকার বি ফিফটি টু বোমারু বিমানগুলো ৩৬৩০টি ফ্লাইট পরিচালনা করে ১ লাখ ১০ হাজার টন বোমা নিক্ষেপ করে। (সূত্র : দি হিস্ট্রি)।

এতে গ্রামের পর গ্রাম ধ্বংস হয় ও বহু নিরীহ কম্বোডিয়ানের করুণ মৃত্যু ঘটে। কম্বোডিয়ার মার্কিনিদের এই ধ্বংসযজ্ঞ প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও তাঁর প্রশাসন সংসদে ও জনসম্মুখে প্রকাশ হতে দেননি। কারণ দাফতরিকভাবে কম্বোডিয়া ছিল নিরপেক্ষ দেশ। তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার তাঁর ‘এন্ডিং দি ভিয়েতনাম ওয়ার’ বইতে লিখেছেন, ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত সময় কম্বোডিয়ায় মার্কিনিদের বোমাবর্ষণের ফলে ৫০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল বলে তাঁকে জানিয়েছিলেন তাঁর অফিসের কর্মকর্তারা। ওয়ার্ল্ড পিস ফাউন্ডেশনের গবেষণায় এ সংখ্যা আড়াই লাখ বলে প্রমাণিত হয়। দুঃখের বিষয় তখন কম্বোডিয়ায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। আজ কম্বোডিয়ার প্রেক্ষাপটে সেই মানবাধিকারের প্রশ্নটিও বড় হয়ে উঠেছে আমেরিকার কাছে। সাধু! সাধু! সাধু!

কম্বোডিয়া নিয়ে বহু বাংলাদেশির নানা রকম স্মৃতি রয়েছে। ১৯৯২ সালের এপ্রিলে ৮৫০ জন বাংলাদেশি সেনাসদস্য জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী হিসেবে কম্বোডিয়ায় যোগ দেয় এবং ১৯৯৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করে। দীর্ঘদিনের সংঘাত ও রাজনৈতিক বিভক্তি মেটাতে ১৯৯৩ সালের ২৩ ও ২৮ মে জাতিসংঘের অধীনে কম্বোডিয়ায় সাধারণ নির্বাচন হয়। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করে এ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে অনন্য সাফল্য দেখিয়েছিল বাংলাদেশি সেনারা। জাতিসংঘসহ বিশ্বের বহু নামিদামি পত্র-পত্রিকা ও জার্নাল বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিল তখন। ৩০ বছর আগের সেই স্মৃতি মনে পড়ে গেল আজ আমেরিকার মাটিতে বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন জাতিসংঘের অধীনে করার প্রশ্ন ওঠার পরিপ্রেক্ষিতে! বাংলাদেশে একটি নির্বাচন অচিরেই হবে। আমার ধারণামতে, নির্বাচনটি হবে ২০২৪ সালে। কারণ আওয়ামী লীগ ১৯৭০, ১৯৯৬, ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ অর্থাৎ শেষে জোড় সংখ্যা থাকা বছরগুলোতে নির্বাচনে জয়লাভ করেছিল। আর হেরেছিল ১৯৯১ ও ২০০১ সালে, অর্থাৎ যেসব বছরের শেষে বিজোড় সংখ্যা ছিল। তবে নির্বাচনে কারা কীভাবে অংশগ্রহণ করবে, এটিই বড় প্রশ্ন। হয়তো নির্বাচনে সব দলই অংশগ্রহণ করবে কিংবা আওয়ামী লীগসহ ১৪ দল ও অন্যান্য কিছু দলের খন্ডিত অংশগ্রহণ করবে। কিন্তু কম্বোডিয়ার সাম্প্রতিক ঘটনাবলির আলোকে প্রশ্ন হলো-তারপর?

লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

email: [email protected]

সর্বশেষ খবর