শনিবার, ১২ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

সমুদ্রকন্যা মালদ্বীপে কৃষিচেষ্টা

শাইখ সিরাজ

সমুদ্রকন্যা মালদ্বীপে কৃষিচেষ্টা

যতদূর চোখ যায় নীল জলরাশি। সমুদ্র যেন সীমান্তে মিশেছে নীল আকাশের সঙ্গে। বলছি মালদ্বীপের কথা। গত নভেম্বরে ভারত মহাসাগরের বুকে জেগে থাকা দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপের কিছু কৃষি কার্যক্রম দেখে আসার সুযোগ হয়। আমরা একটা বড় স্পিডবোটে মালদ্বীপের দ্বিতীয় বৃহত্তম দ্বীপশহর আড্ডুর হিথাদু থেকে ১৭ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত মিদু ও হুলুমিদু দ্বীপে যাচ্ছিলাম। হিথাদু থেকে মিদু পর্যন্ত প্রতি ঘণ্টায় ঘণ্টায় স্পিডবোট যায়। ধারক দল ছাড়াও সঙ্গে ছিলেন মালদ্বীপ প্রবাসী ব্যবসায়ী ও শিক্ষা উদ্যোক্তা আহমেদ মোত্তাকী এবং বাংলাদেশ থেকে আসা দুই কৃষিবিদ ড. মাহফুজ ও সাইফুর রহমান।

বিশাল সমুদ্র, তীরহীন। মনে মনে ভয় করছিল উত্তাল হয়ে উঠে কি না! তবে আশ্বস্ত হলাম জেনে যে, বিষুব অঞ্চলে অবস্থিত বলে ভারত মহাসাগরের দিকে সমুদ্রের জলরাশি স্থির ও শান্ত। মিনিট পনেরোর মাঝে আমরা পৌঁছে গেলাম মিদুতে। মিদু থেকে গাড়ি করে মিনিট দুয়েকের পথ হুলুমিদু। পুরো দ্বীপটিতে বাড়িঘর বেশ সাজানো-গোছানো। তবে গরম ছিল প্রচ-। প্রখর সূর্যের তাপ।

সমুদ্রের মাছ আর পর্যটনই মালদ্বীপের অর্থনীতির মূল খাত। কিন্তু করোনা-পরবর্তী পৃথিবী বুঝতে শুরু করেছে যে কোনো সংকটে টিকে থাকতে নিজেদের খাদ্য নিজেদেরই উৎপাদন করতে হবে। তাই মালদ্বীপের মতো সমুদ্র উত্থিত লবণাক্ত বালুমাটির দেশও ঝুঁকেছে কৃষির দিকে। কৃষি নিয়ে নানামুখী কার্যক্রম তারা গ্রহণ করেছে। কৃষি উদ্যোক্তাদেরও উৎসাহিত করছে নানাভাবে। হুলুমিদুতে নীল সমুদ্রের তীরে দুই কক্ষের গ্রিন হাউস। সেখানে অন্যরকম এক কৃষির আয়োজন। চলছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির চাষাবাদ। অটোপট সিস্টেমে গড়ে তোলা খামারটি দেখভাল করছেন মালদ্বীপের দুই উদ্যোক্তা। তাদের একজন হাসান শাহিদ। অন্য জনের নাম রামজি। তিনি আরেক শহরে ব্যস্ত থাকায় আমাদের কথা হয় হাসান শাহিদের সঙ্গে। হাসান শাহিদ জানালেন তাদের এই কার্যক্রমটিতে তথ্য, কৌশল ও কারিগরি সহযোগিতা দিচ্ছে স্থানীয় একটি এনজিও, মালদ্বীপের মৎস্য ও কৃষি মন্ত্রণালয় এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা। নেটহাউসে ঢোকার আগে হাসান শাহিদ ব্যাখ্যা করলেন কীভাবে কাজ করে অটোপট সিস্টেম।

অটোপট সিস্টেম মূলত মাটিহীন চাষ ব্যবস্থা। হাইড্রোপনিক পদ্ধতির আধুনিক রূপ। আরও সাশ্রয়ী ও নিরাপদ। এতে কোনো বিদ্যুৎ খরচ নেই। বড় একটি ট্যাংকে রাখা হয় গাছের প্রয়োজনীয় পুষ্টিকণা মিশ্রিত সেচের পানি। ট্যাংকটির সঙ্গে পাইপ দিয়ে যুক্ত রাখা হয় বিশেষ পাত্র। যে পাত্রে গাছের চারা প্রয়োজনীয় পানি গ্রহণ করে বেড়ে ওঠে। গাছের যতটুকু সেচ প্রয়োজন ততটুকু পানিই পাইপ থেকে পাত্রটির মধ্যবর্তী একটি জায়গায় এসে জমা হয়। তখন একটি বাল্ব পানির প্রবেশপথ বন্ধ করে দেয়। জমা পানিটুকু গাছ গ্রহণ করে নিলে পুনরায় বাল্বটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে অর্থাৎ আপনাআপনি খুলে যায়, আবারও সেচের পানি জমা হয় এবং যতক্ষণ পর্যন্ত এই পানি গাছ শোষণ না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত পানি আসার পথটি বন্ধ থাকে। এতে পানির রিইসাইকেল হয় না। ফলে একটা গাছের সংস্পর্শ লাগা পানি অন্য গাছে যায় না। প্রতিটি গাছ একই পাইপে কিন্তু আলাদা আলাদা যুক্ত থাকে। এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে কোনো একটি গাছ রোগাক্রান্ত হলে, সেটি অন্য গাছকে সংক্রমিত করতে পারে না।

নেটহাউসে শতভাগ জৈব নিরাপত্তার কথা ভাবতে হচ্ছে, তাই প্রবেশের আগে আমরা জুতা খুলে নিলাম। হাসান শাহিদ তার অটোপট প্রযুক্তির খামার ঘুরিয়ে দেখালেন। এখানে একুশ দিন বয়সের শসাগাছগুলো ইতোমধ্যে ফুল-ফলে ভরে উঠেছে।

শাহিদ একটা অটোপট খুলে দেখিয়ে বললেন, ‘দেখুন। গাছের শেকড়গুলো। কোনো মাটি বা কোকোপিট নেই। এটাকে বলে মিডিয়ালেস।’ জানতে চাইলাম, নিশ্চয়ই এই সেচের পানিতে সার বা পুষ্টিকণা মিশিয়ে দিয়েছেন? শাহিদ নিশ্চিত করলেন, সেচের পানির সঙ্গেই গাছের প্রয়োজনীয় সব পুষ্টিকণা মিশিয়ে দিচ্ছেন। অপচয় হচ্ছে না বলে পরিমাণে খুব কম লাগে।

মনে পড়ে হাইড্রোপনিক চাষাবাদ প্রথম দেখেছিলাম জাপানের পাসোনা টুতে। গত বছর নেদারল্যান্ডসের ওয়ার্ল্ড হর্টিসেন্টার দেখেছিলাম হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে গ্রিন হাউসে টমেটো চাষ। কাতারের স্ট্রবেরি চাষের চিত্রও আমি তুলে ধরেছি। আমাদের দেশে প্যারামাউন্ট গ্রুপের হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে তরমুজ চাষ দেখেছি। দেখেছি ত্রিশালের সেনবাড়ীতে সৌরভ গ্রুপের হাইড্রোপনিক চাষাবাদ। তবে অটোপট সিস্টেম সেগুলোর চেয়ে অনেকটা আলাদা। এই অটোপট সিস্টেমের একেকটি বক্সে দুটি করে গাছ লাগানো আছে। প্রতিটি বক্সের জন্য খরচ পড়েছে ৩৫ থেকে ৪০ মার্কিন ডলার। অর্থাৎ প্রায় ৪ হাজার টাকার মতো। উদ্যোক্তা বলছেন, প্রাথমিকভাবে বিনিয়োগ বেশি হলেও দীর্ঘস্থায়ী এ সিস্টেমে উৎপাদন খরচ কমে যায় অনেকখানি।

শাহিদ জানালেন, প্রতিটি গাছ থেকে এক ফলনে ৪ কেজি করে শসা পাওয়া যায়। ফলন তুলতে সময় লাগে ৭০ দিন। দুটি গ্রিন হাউসে মোট ৫ হাজার বর্গফুট জায়গায় গাছ আছে প্রতি গ্রিন হাউসে ৫০০টি করে মোট ১০০০টি। প্রতিটি গাছ থেকে ৭০ দিনে ৪ কেজি করে শসা পাওয়া যায়। মোট ৪০০০ কেজি। প্রযুক্তির কৃষিমানেই সরল অঙ্কের কৃষি। এখানে উৎপাদন খরচ থেকে মোট উৎপাদন সবই হিসাব করা।

শাহিদের কাছে জানতে চাইলাম, আপনার কি মনে হয় না এটা খুব ব্যয়বহুল? তিনি বললেন, ‘না’। যেখানে ফসলই ফলত না, সেখানে চাষাবাদ হচ্ছে, এটা বড় কথা। সিস্টেম স্থাপনটা ব্যয়বহুল হলেও উৎপাদন খরচ কিন্তু একেবারে কম। তারপর এখানে সবকিছুরই ব্যবহার সীমিত। সেচ কম লাগছে, সার কম লাগছে, এমনকি জমিও কম লাগছে। দেখুন এখানে আড়াই হাজার বর্গফুট জায়গায়, ঊর্ধ্বমুখী ফসল চাষ হচ্ছে। ৫০০ শসার গাছ আছে। ফলে উৎপাদন খরচ কম। প্রাথমিক বিনিয়োগটা হয়তো বেশি। কিন্তু স্থায়ী পদ্ধতি হওয়ায় পরবর্তীতে কিন্তু খরচ নেই বললেই চলে।’ মালদ্বীপে লাখ লাখ পর্যটকের ভিড় তাদের খাবার চাহিদায় থাকে তাজা শসা থেকে শুরু করে নানারকম সবজি। ফলে খুব সহজেই উৎপাদিত ফসল বিক্রি হয়ে যাচ্ছে রিসোর্টগুলোতে।

শাহিদ খুব আনন্দিত এই প্রযুক্তি পেয়ে। আগামী মৌসুমে তারা আরও ৬ হাজার গাছ লাগানোর পরিকল্পনা নিয়েছে। ছয়টি গ্রিন হাউসে ফসল ফলানো হবে। ইতোমধ্যে তারা হিসাব করে ফেলেছে প্রতি সপ্তাহে দুই টন করে শসা পাবে সেখান থেকে। আর পুরোটাই থাকছে অর্গানিক। যা ইউরোপ আমেরিকার পর্যটকদের কাছে খুব চাহিদাপূর্ণ। প্রিয় পাঠক, পথ পথিক তৈরি করে না। পথিকই খুঁজে নেয় পথের সন্ধান। প্রযুক্তির কল্যাণে এখন সমুদ্রের বুকে নুড়ি-পাথর আর বালুকাময় তটেও চলছে কৃষির সফল চেষ্টা। আজকের দিনে নিজের খাদ্য নিজে উৎপাদনের তাগিদ অনুভব করছে প্রতিটি বিশ্ব নাগরিক। আমরা চাই জলবায়ু পরিবর্তনের আগ্রাসন থেকে শুরু করে যাবতীয় দুর্যোগ ও সংকটে অনিশ্চয়তায় খাদ্যের সুনিশ্চিত জোগান। এক্ষেত্রে অটোপট সিস্টেম নগরকৃষি তথা ছাদকৃষিরও অনুষঙ্গ হয়ে উঠতে পারে। পাশাপাশি খাদ্য নিরাপত্তায় ও নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে আমাদের দেশীয় প্রেক্ষাপটে এ প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে হতে পারে গবেষণাও। 

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব  

[email protected]

সর্বশেষ খবর