শনিবার, ১২ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

‘আওয়ামী লীগ বনাম আমি লীগ’

প্রভাষ আমিন

‘আওয়ামী লীগ বনাম আমি লীগ’

বাংলাদেশে এখন সক্রিয় ও নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পুরনো আওয়ামী লীগ। শুধু বয়সে পুরনো বলেই নয়, আদর্শ, গুরুত্ব, অবদান- সব বিবেচনায়ই আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারী রাজনৈতিক সংগঠন। শুধু বাংলাদেশ নয়, এ উপমহাদেশ, এমনকি বিশ্বেও প্রভাব বিস্তারী সংগঠনের তালিকা করলে তাতে ঠাঁই পাবে আওয়ামী লীগ। ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে বারবার ভেঙেছে আওয়ামী লীগ, চেষ্টা হয়েছে ধ্বংসের।  কিন্তু ধ্বংসস্তূপ থেকে বারবার উঠে দাঁড়িয়েছে, লড়াই করেছে। বাংলাদেশের ২৩ বছরের মুক্তিসংগ্রাম এবং ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। পরে বঙ্গবন্ধু ও জাতির জনক হওয়া শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বেই বিকশিত হয়েছে আওয়ামী লীগ। গত ৪২ বছর ধরে সেই সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয় মেয়াদে দেশ শাসন করছে। এই তিন মেয়াদে বাংলাদেশের অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে। সত্যি বলতে বাংলাদেশ বদলে গেছে। বাংলাদেশের এই অভাবনীয় উন্নতির সময়েই কঠিন সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগ।

আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় শক্তি তৃণমূলে বিস্তৃত তাদের সাংগঠনিক কাঠামো। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার সময় দেশের বাইরে থাকায় বেঁচে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। ছয় বছর উদ্বাস্তু জীবনযাপন শেষে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের হাল ধরেছিলেন শেখ হাসিনা। ১৫ আগস্ট ষড়যন্ত্রকারীরা শুধু সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে, ধ্বংস করতে চেয়েছিল আওয়ামী লীগকেও। শেখ হাসিনা দেশে ফিরে যে আওয়ামী লীগের হাল ধরতে পেরেছিলেন, সেটা এই তৃণমূলে ছড়িয়ে থাকা সংগঠন এবং ত্যাগী নেতাদের কারণেই। দেশে ফিরে শেখ হাসিনাকে অনেকগুলো লড়াই একসঙ্গে চালাতে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস করে বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানানোর ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে। গণতন্ত্রকে সামরিকতন্ত্রের কবল থেকে উদ্ধার করতে লড়তে হয়েছে। পিছিয়ে পড়া বাংলাদেশকে উন্নত ও সমৃদ্ধশালী করতে লড়তে হয়েছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে দেশকে মুক্ত করতে লড়তে হয়েছে। এই লড়াইয়ে তাঁর পাশে ছিল আওয়ামী লীগ।

আওয়ামী লীগ বরাবরই নির্বাচনী রাজনীতিতে বিশ্বাস করে। এমনকি একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বের ম্যান্ডেটও আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ’৭০-এর নির্বাচনে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা হয়েছে। সেই প্রবল প্রতিকূল সময়েও ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে ৩৯ আসন লাভ করে আওয়ামী লীগ। এরপর যত নির্বাচনে অংশ নিয়েছে আওয়ামী লীগ, সব নির্বাচনেই তাদের ভোট বেড়েছে। তবে টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ আরেকটি নির্বাচনের সামনে দাঁড়িয়ে কঠিন সংকটের মুখে পড়েছে। সে সংকট সরকারের নয় দলের। সে আলোচনায় পরে আসছি।

এখন বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে নানা কথা হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা এখনই ভেঙে পড়েছে, ব্যাপারটা তেমন নয়। এটা বাংলাদেশের পুরনো ব্যামো। হুন্ডা, গুন্ডা, ডান্ডা; নির্বাচন ঠান্ডা- এই ছড়া একসময় ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল। জিয়াউর রহমানের আমলে হ্যাঁ-না ভোট, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, এরশাদের আমলে ’৮৬ ও ’৮৮-এর সংসদ নির্বাচন, খালেদা জিয়ার আমলে ’৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির একতরফা নির্বাচন-খারাপ নির্বাচনের তালিকা অনেক লম্বা। এ তালিকায় যুক্ত হয়েছে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনও। বিএনপি অংশ না নেওয়ায় ২০১৪ সালের নির্বাচনটি হয়েছে একতরফা। সেই নির্বাচনে ভোটারও কম ছিল, প্রার্থীও কম ছিল। এ কারণে নির্বাচনের আগেই সরকার গঠন করার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে গিয়েছিল আওয়ামী লীগ। ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ে আইনগত সমস্যা না হলেও নৈতিক প্রশ্ন ওঠে। তবে প্রশ্নে ২০১৪ সালকেও ছাড়িয়ে যায়, ২০১৮ সাল। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে নির্বাচনে এলেও বিএনপি আসন পায় মাত্র ছয়টি। বিএনপি সেবার নিজেদের নিবন্ধন রক্ষা করতে নির্বাচনে এসেছিল। জয়ের লক্ষ্য তাদের ছিল না। তাই আসন সংখ্যার চেয়েও ভোটের ধরন, সংখ্যা, আগের রাতে ভোট করার অভিযোগ-২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে দেশে-বিদেশে ব্যাপক সংশয় তৈরি করে। আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ঐতিহ্যে ২০১৮ সালের নির্বাচন এক অমোচনীয় কলঙ্ক। এর কলঙ্কের দায় কিছুটা হলেও কমানোর একটাই উপায়- একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। দেশে-বিদেশে এখন এই আকাক্সক্ষা প্রবল হয়েছে। দেশি-বিদেশি চাপে হোক আর বিবেকের চাপে হোক; আওয়ামী লীগ একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে বদ্ধপরিকর। দলীয় সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেক দিন ধরেই বিভিন্ন দলীয় ফোরামে আগামীতে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হওয়ার তাগিদ দিচ্ছেন।

এই অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের সামনে দাঁড়িয়েই কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে আওয়ামী লীগ। এই চ্যালেঞ্জ যতটা না বাইরের, তার চেয়ে বেশি ভিতরের। পরপর দুটি নির্বাচনে অনায়াসে জয় পেয়ে যাওয়ায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে এক ধরনের রিল্যাক্স ভাব এসে গেছে। নানান সুযোগ-সুবিধা পেয়ে তাদের গায়ে চর্বি জমে গেছে, সেই লড়াকু মনোভাব যেন নেই আর। সবচেয়ে বড় কথা হলো, টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা এবং সহজে জয় পেয়ে যাওয়া তাদের আরও বেশি জনবিচ্ছিন্ন করেছে। স্থানীয় নেতাদের নানাবিধ অপকর্ম ক্ষুব্ধ করেছে মানুষকে। জনগণের সঙ্গে তো নয়ই, এমনকি মাঠপর্যায়ের কর্মীদের সঙ্গেও নেতাদের যোগাযোগ নেই। শেখ হাসিনার সরকার দেশকে যতটা এগিয়েছে, সংগঠন তার সঙ্গে পাল্লা দিতে তো দিতে পারেইনি। বরং উল্টো সংগঠন আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষমতার স্রোতে অনেক পানি যেমন এসেছে, এসেছে অনেক কচুরিপানাও। সেই কচুরিপানায় এখন নৌকার অগ্রযাত্রা আটকে যাওয়ার দশা। একটা শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কতটা লড়াই করতে পারবে, শঙ্কা সেটা নিয়েই। আগেই বলেছি আওয়ামী লীগের চ্যালেঞ্জ যতটা না বাইরে, তার চেয়ে বেশি ঘরে। অন্তর্কোন্দলে বিপর্যস্ত আওয়ামী লীগ। একটা বড় সংগঠনে কোন্দল থাকেই। তবে টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার সুবাদে আওয়ামী লীগের কোন্দল এখন ঘরে ঘরে। একটা কথা বলা হয়, আওয়ামী লীগ হওয়া যায় না, আওয়ামী লীগ হয়ে জন্মাতে হয়। সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম যেমনটি বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ একটি অনুভূতির নাম, তেমন অনুভূতির ছোঁয়া এখনকার নয়া আওয়ামী লীগারদের মধ্যে পাওয়াই যায় না। ক্ষমতার গন্ধে ঝাঁকে ঝাঁকে আসা হাইব্রিডরা এখনো আওয়ামী লীগার হয়ে উঠতে পারেননি। হাইব্রিডদের ভিড়ে তৃণমূলের ত্যাগীরা এখন কোণঠাসা।

তবে আওয়ামী লীগ তাদের এই আসল সমস্যাটা চিহ্নিত করতে পেরেছে। গত ৬ জুলাই গণভবনে অনুষ্ঠিত বিশেষ বর্ধিত সভায় দলের ঐক্যের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যাকেই মনোনয়ন দেওয়া হবে, তার পেছনে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার শপথ করিয়েছেন আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা। বর্ধিত সভায় সারা দেশের তৃণমূলের নেতারা অংশ নিয়েছেন। বক্তব্য রেখেছেন ৪৩ জন। প্রায় সবার বক্তব্যেই ছিল দলীয় কোন্দলের বিষয়টি। শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নামতে হলে মনোনয়নে ব্যাপক পরিবর্তন আনার দাবিও এসেছে বিশেষ বর্ধিত সভায়। জনবিচ্ছিন্ন, অজনপ্রিয় নেতারা বাদ পড়েতে পারেন আগামী নির্বাচনে। ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনেও ছয় মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীসহ ৪৯ জন সংসদ সদস্য মনোনয়নবঞ্চিত হয়েছিলেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বাদ পড়েছিলেন ৫৬ জন। আগামী নির্বাচনে এ সংখ্যাটা আরও বাড়তে পারে। বরিশাল সিটি করপোরেশন এবং ঢাকা-১৭ আসনের মনোনয়ন দিয়ে আওয়ামী লীগ আসলে সারা দেশে একটা বার্তা দিয়েছে। আগামী নির্বাচনে স্বচ্ছ ভাবমূর্তির নেতাদের সামনে আনলে লড়াই কিছুটা সহজ হবে। তবে মনোনয়ন বদলালেই কোন্দল মিটে যাবে না। বরং তা নতুন মাত্রা পাবে।

প্রতিটি আসনেই আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতা আছেন বেশ কয়েকজন। সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে এসেছিল এ প্রশ্নটিও। কৌশলী শেখ হাসিনা বলেছেন, প্রার্থী হতে ইচ্ছুক এমন অনেকের মধ্য থেকে যোগ্য ব্যক্তিকেই বেছে নেওয়া হবে। নির্বাচনে প্রার্থীর বিষয়ে আমরা শত ফুল ফুটতে দেওয়ার পক্ষে। শত ফুল ফুটতে দিন, যে ফুলটি সব থেকে সুন্দর সেটি আমি বেছে নেব। আওয়ামী লীগের বিশেষ বর্ধিত সভায় প্রসঙ্গটি তোলেন সম্প্রতি গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেয়েও কোন্দলের কারণে হেরে যাওয়া আজমত উল্লা খান। তিনি দলীয় প্রধানের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আপনি শত ফুল ফোটাতে চেয়েছেন। কিন্তু ফুল ফুটতে চাইলে বড় ফুলের গাছটাই কেটে দেয়া হয়।’ আক্ষেপ করে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লা খান বলেন, অনেকেই অন্যকে ‘সাইজ’ করার রাজনীতি করে। এটা বন্ধ করতে হবে।

আওয়ামী লীগের অবস্থাটা হয়েছে রাজার দুধের পুকুরের মতো। রাজা দুধের পুকুর বানাতে চেয়েছিলেন। প্রজাদের বলেছিলেন সবাই যেন এক পাত্র দুধ নিয়ে আসে। কিন্তু সবাই ভাবল, অন্যরা তো দুধ নেবে, আমি না হয় পানিই নিই। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল সবাই পানিই এনেছে। তাই পানির পুকুরই হয়েছে, দুধের পুকুর আর হয়নি। সারা দেশে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মী আছেন, যারা শেখ হাসিনা বললে জীবন দিতে প্রস্তুত। কিন্তু সেই তিনিই নিজ আসনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের জন্য জান দিয়ে খাটবেন। বিষয়টি শেখ হাসিনারও অজানা নয়। বর্ধিত সভায়ও তিনি বলেছেন, ‘অনেকে মনোনয়ন না পেয়ে দলের হয়ে কাজ করে না। তারা মনে করে একটা আসন না পেলে কী হবে? বাকি আসন তো পাওয়া যাবে। ক্ষমতায় তো দল যাবেই। প্রার্থীকে হারিয়ে নিজেদের ক্ষমতা দেখায় অনেকে।  এভাবে ক্ষমতা দেখাতে গিয়ে দলকে ক্ষমতা হারাতে হয়।’ শেখ হাসিনা আক্ষেপ করে বলেন, এলাকায় সংসদ সদস্য ও নেতাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হয়। ওপরে থুতু ফেললে নিজের গায়েই পড়ে। যাকে খাটো করার চেষ্টা হচ্ছে, তিনি খাটো হলে দলই খাটো হবে। আর নৌকার ভোট কমবে।

বিশেষ বর্ধিত সভায় যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহীদুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় দ্বন্দ্ব আছে। আজ আমাদের দল দুই ভাগে বিভক্ত- একটা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, আরেকটা আমি লীগ।’ সব জায়গায় আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিরা আলাদা করে নিজেদের একটা সাম্রাজ্য বানিয়েছেন। নির্বাচনের আগে এই ‘আমি লীগ’কে আওয়ামী লীগ বানাতে না পারলে সরকারের ১৪ বছরের অনেক অর্জনই বিসর্জনে যেতে পারে।

                লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক

সর্বশেষ খবর