সোমবার, ১৪ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

লন্ডনে ১৯৭৫ : ১৫ আগস্ট

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

লন্ডনে ১৯৭৫ : ১৫ আগস্ট

প্রতি বছরই আগস্ট মাস আবির্ভূত হয় প্রকৃতির নিয়ম অনুসরণ করে। সেই মাসটি এলেই একদিকে যেমন শোকের সাগরে নিমজ্জিত হয়ে যায় বাঙালি জাতি, অন্যদিকে তাদের মনে অনিশ্চিত ভয় বাসা বাঁধে। ১৯৭৫ সালের সেই আগস্ট মাসেই এমন এক কালজয়ী মহামানবকে কিছু নরপিশাচ হত্যা করেছিল যিনি বাংলাদেশ এবং ভারতীয় উপমহাদেশের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্ববন্ধুতে পরিণত হয়েছিলেন।  বিশেষ তিনটি ঘটনা প্রমাণ করে যে, তিনি বিশ্ববন্ধুর মর্যাদা লাভ করেছিলেন।

একটি ঘটেছিল ১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে, যেখানে উপস্থিত হলে বঙ্গবন্ধুকে একনজর দেখার জন্য সেই জোটের বিশ্ব কাঁপানো নেতৃবৃন্দ হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলেন।  তাদের মধ্যে ছিলেন আলজেরীয় নেতা হুরারি বোমেদিন, ফিদেল ক্যাস্ট্রো, যুগোস্লাভ নেতা জোসেফ টিটো, তাঞ্জানিয়ার নায়ারেয়ার, সাদ্দাম হোসেনসহ এমন সব নেতৃবৃন্দ যারা সে সময়ে গোটা বিশ্বের ভাগ্য নির্ধারণ করতেন। অন্যটি ঘটেছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার দিন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। সেদিনই বিশ্ব নেতৃবৃন্দ শোক এবং খুনিদের বিরুদ্ধে ঘৃণার বাণী উচ্চারণ করে যে কথাগুলো ব্যক্ত করেছিলেন, তা থেকেই পরিষ্কার যে, তারা বঙ্গবন্ধুকে বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের ত্রাণকর্তা তথা বিশ্ববন্ধু হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। যাদের ভাষ্য বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য তাদের মধ্যে ছিলেন- নোবেল বিজয়ী জার্মান নেতা উইলি ব্রান্ট, নোবেল বিজয়ী আইরিশ নেতা শোন ম্যাকব্রাইট, ফিদেল ক্যাস্ট্রো, ইন্দিরা গান্ধী, নায়ারেয়ার, সাদ্দাম হোসেন, বোমেদিন, ব্রিটিশ নেতৃবৃন্দ, সোভিয়েত নেতৃবৃন্দ, ওয়ারস চুক্তিভুক্ত দেশগুলোর নেতাগণ। উইলি ব্রান্ট বলেছিলেন, এরপর বাঙালিদের বিশ্বাস করা কঠিন। এমনকি বঙ্গবন্ধুর অজাতশত্রু ড. হেনরি কিসিঞ্জারও উল্লেখ করেছিলেন যে, “শেখ মুজিবের মতো সাহসী নেতা হয়তো এশিয়া মহাদেশে আর জন্মাবে না।” আরেকটি পরিস্থিতির কথা উল্লেখ না করলেই নয় যেটি দৃশ্যমান হয়েছিল ১৯৭২-এর ৮ জানুয়ারি। সেদিন বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডনে পৌঁছলে বিরোধীদলীয় নেতা হেরল্ড উইলসনসহ যুক্তরাজ্যের সংসদের উভয় পরিষদের কমবেশি ৬০ ভাগ সদস্য বিশ্ব রাজনীতির এই দিকপালকে শ্রদ্ধা জানাতে তাঁর হোটেলে উপস্থিত হয়েছিলেন। একই দিন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাডওয়ার্ড হিথ স্কটল্যান্ডে তার যাত্রা স্থগিত করে লন্ডনে ফিরে এসেছিলেন সন্ধ্যায় তার বাসভবনে বঙ্গবন্ধুকে সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য। উল্লেখ্য, সেদিনও  বাংলাদেশ যুক্তরাজ্য সরকারের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত মর্যাদাভুক্ত ছিল না। স্বীকৃতি পায়নি এমন একটি দেশের নেতাকে এহেন রাজকীয় সংবর্ধনা দেওয়ার নজির ব্রিটিশ ইতিহাসে আর নেই। তদুপরি তৃতীয় বিশ্বের কোনো নেতাকে ব্রিটিশ সরকার এবং রাজনীতিবিদরা কখনো এ ধরনের লাল কার্পেট সংবর্ধনা প্রদান করেনি। ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভাষণ দিতে গেলেও তাঁকে দেখার জন্য বহু বিশ্ব নেতা অপেক্ষমাণ ছিলেন। বিশ্ববন্ধু তকমা বাঙালি জাতির জনক এমনিতেই অর্জন করেননি, বিশ্বের নির্যাতিত মানুষের মুক্তির জন্য, মঙ্গলের জন্য তাঁর গগনবিদারী দাবি এবং কর্মকান্ডই তাঁকে সে গৌরবে ভূষিত করেছিল। প্যালেস্টাইনের নির্যাতিত জনগণের পক্ষে তিনি যেমন দাঁড়িয়ে ছিলেন, তেমনি সোচ্চার ছিলেন ভিয়েতনামি মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে (বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্বে)। দক্ষিণ আফ্রিকার মুক্তিযুদ্ধরত দেশগুলোর জন্যও তিনি ছিলেন একইভাবে সোচ্চার। জাতিসংঘে ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভাষণদানকালে তাঁর সেই ঐতিহাসিক কথা, যা ছিল এই যে বিশ্ব দুই ভাগে বিভক্ত, শোষিত এবং শোষক, তিনি শোষিতের পক্ষে, পৃথিবীর সব মানুষের মনে তুলেছিল ভক্তি আর শ্রদ্ধার ঢেউ। ভয় বলে কোনো কথা তাঁর অভিধানে ছিল না। তাঁকে হত্যা করার জন্য সে সময়ে নিক্সন-কিসিঞ্জার-ভুট্টোর নেতৃত্বে যে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র দানা বেঁধেছিল, তার পেছনে অন্যতম কারণ ছিল সাম্রাজ্যবাদীদের এই ভয় যে, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের অন্যতম নেতা হিসেবে তিনি সাম্রাজ্যবাদের কবর রচনা করতে উদ্যোগী হবেন। বঙ্গবন্ধু বিশ্বময় অস্ত্র প্রতিযোগিতা এবং পরমাণু অস্ত্র ভান্ডার শূন্য করার জন্য দাবি তুলে বলতেন, অস্ত্র প্রতিযোগিতায় অর্থের অপচয় না করলে পৃথিবীর সব অঞ্চল থেকে দুর্ভিক্ষ, দারিদ্র্য আর হাহাকার দূর করা যাবে, চিকিৎসা ক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নয়ন সম্ভব হতে পারে।

বঙ্গবন্ধু বিশ্ববন্ধু ছিলেন বিধায় ১৫ আগস্ট দিনটি শুধু বাংলাদেশের জন্যই কলঙ্কিত দিন নয়, এটি গোটা বিশ্বের জন্যই ঘৃণ্য দিনগুলোর একটি। বিশ্ব সভায় অন্যান্য কৃষ্ণ দিনগুলোর মধ্যে রয়েছে ১৫ এপ্রিল অর্থাৎ আব্রাহাম লিংকন হত্যার দিন, ৬ ও ৯ আগস্ট যেদিন হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে আনবিক বোমা নিক্ষেপ করে কয়েক লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল, ৩০ জানুয়ারি মহাত্মা গান্ধী হত্যার দিন, ১৭ জানুয়ারি, যেদিন কঙ্গোর জাতীয়তাবাদী নেতা প্যাট্রিস লুমুম্বাকে হত্যা করা হয়েছিল, ১৮ সেপ্টেম্বর যেদিন জাতিসংঘ মহাসচিব ডাগ হেমারশোল্ডকে বিমান ধ্বংস করে হত্যা করা হয়েছিল, ৯ অক্টোবর যেদিন ল্যাটিন আমেরিকান বিপ্লবী চে গুয়েভারাকে হত্যা করা হয়েছিল, ২২ নভেম্বর, যেদিন জন কেনেডিকে হত্যা করা হয়েছিল, ৪ এপ্রিল যেদিন আপসহীন মানবাধিকার নেতা মার্টিন লুথার কিংকে হত্যা করা হয়েছিল, ৩১ অক্টোবর, যেদিন ইন্দিরা গান্ধীকে হত্যা করা হয়েছিল।

বঙ্গবন্ধুর হত্যার সেই নারকীয় দিনটিতে আমি লন্ডনে ছিলাম, পাঠ্যরত। সেদিনের বেদনাবিধুর স্মৃতি আজও তাড়া করছে। সেই দিনটির কথা উল্লেখ করতে গেলে, সত্যের স্বার্থে এমন অনেকের নামই বলতে হয়, যাদের জড়িত থাকার কথা অনেকেই জানেন না। আমার এই লেখাতেই সে নামগুলো চলে আসবে।

আমি আমার স্ত্রীসহ লন্ডন শহরের ওভাল এলাকার একটি ফ্ল্যাটে বাস করতাম। আমার স্ত্রী তখন বিবিসি বাংলা বিভাগে চাকরিরত ছিল। পাশের একটি ফ্ল্যাটে স্ত্রীসহ বাস করতেন ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিঞা। তিনি ছিলেন একজন অবিভক্ত পাকিস্তানপন্থি লোক, যে কারণে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকেরা তার থেকে দূরত্ব বজায় রাখতেন। তিনি অনেক সময় আমাদের সভায় এসে গেলেও তাকে সন্দেহের চোখে দেখে বর্জন করা হতো। যাই হোক ১৫ তারিখ সূর্যোদয়ের বহু আগে আশপাশের ফ্ল্যাটগুলোতে চেঁচামেচির কারণে ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর মর্মান্তিক দুঃসংবাদটি পেয়ে খেই হারিয়ে ফেলেছিলাম। বেশ কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে জানতে পেরেছিলাম যে, খবরটি প্রথম এসেছে সে সময়ের লন্ডনের জনমত পত্রিকার মালিক/সম্পাদক প্রয়াত ওয়ালি আশরাফের কাছ থেকে। তিনি এত শিগগির খবরটি কীভাবে পেয়েছিলেন, সে প্রশ্নের জবাব কখনো পাওয়া যায়নি। তবে তিনি নিজেকে খন্দকার মোশতাকের ভাতিজা বলে দাবি করতেন। ভাতিজা না হলেও মোশতাকের সঙ্গে তার একটা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল। মোশতাকের স্ত্রী লন্ডনে চিকিৎসার জন্য গেলে, ওয়ালি আশরাফের বাড়িতেই থেকেছিলেন। তাছাড়া বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে, যে হত্যা মামলায় মোশতাককেও আসামি করা হয়েছিল, ওয়ালি আশরাফ প্রথম মোশতাক সৃষ্ট রাজনৈতিক দল এবং পরে বিএনপির সদস্য হয়ে কুমিল্লা জেলার বাঞ্ছারামপুর থেকে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকাকালেই ষড়যন্ত্রের অভিযোগে যে পাঁচজন বাঙালির নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছিল, ওয়ালি আশরাফ তাদের একজন ছিলেন। এসব কারণে অনেকেরই ধারণা, তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যা ষড়যন্ত্রের কথা মোশতাক থেকে আগেই জানতেন, আর তাই হত্যার সংবাদটি তিনি সঙ্গে সঙ্গেই পেয়েছিলেন। তাদের এই ধারণা অমূলক নয়।

খবরটি পাওয়ার মুহূর্ত থেকেই ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিঞার প্রলয় নৃত্য সবার মনে ঘৃণার উদ্রেক ঘটিয়েছিল। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন আরও দুই পাকিস্তানপন্থি বাঙালি, নুরুল হক এবং আবদুল্লা ফারুক। এ দুজন আইনের ছাত্র হলেও কখনো পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি। ঘুম ভাঙার পর থেকেই টেলিভিশন খোলা রেখেছিলাম। তখন সর্বসাকুল্যে মাত্র তিনটি টেলিভিশন চ্যানেল ছিল। ভোর ৬টার দিকে দেখলাম ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিঞা, নুরুল হক এবং আবদুল্লা ফারুক লন্ডনের বাংলাদেশ দূতাবাসে প্রবেশ করে প্রথমে বঙ্গবন্ধুর ছবি পদদলিত করে পরে দুজন ঊর্ধ্বতন কূটনীতিক নুরুল মোমেন খান (মিহির) এবং এম আর আক্তার মুকুলকে মারধর করছে। টেলিভিশনের রিপোর্টাররা বেশ উৎসাহের সঙ্গেই সেই পৈশাচিক ঘটনার ছবি তুলে সরাসরি প্রচার করছিলেন। কোনো পুলিশই দূতাবাস রক্ষার জন্য বা আক্রমণকারীদের গ্রেফতার করতে বা থামাতে দূতাবাসের ধারেকাছেও যাননি। সে সময়ের হাইকমিশনার সৈয়দ আবদুস সুলতান দূতাবাসের মূল ফটক খুলে ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিঞা গংদের প্রবেশের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।

ঘণ্টাখানেক পরে টেলিভিশনের পর্দায় দেখা গেল সেই হাইকমিশনার সৈয়দ আবদুস সুলতানকে। তিনি বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিব’ বহু অপকীর্তি করেছেন। যে ব্যক্তি মাত্র একদিন আগ পর্যন্ত ‘বঙ্গবন্ধু’ বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলতেন, মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর তিনি ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি ভুলে গিয়ে ‘শেখ মুজিব’ বলা শুরু করলেন। তার কথায় আমি অবাক হয়নি, বরং বঙ্গবন্ধুর ভুল সিদ্ধান্তের কথাই মনে করেছি। সেই সৈয়দ আবদুস সুলতান বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার বছর তিনেক আগেই পাকিস্তানের জনক মোহাম্মদ আলি জিন্নার প্রশংসায়, ‘তরুণের জিন্না’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখে এক নির্ভুল পাকিস্তানপ্রেমী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু একইভাবে সরল মনে বিশ্বাস করেছিলেন মোশতাক, শাহ মোয়াজ্জেম, ওবায়দুর রহমান, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, মাহবুবুল আলম চাষী, এনএসআইয়ের প্রধান সফদার, খাদ্য সচিব আবদুল মোমেন খান, জিয়াউর রহমান গংদের।

আমি তখন যুক্তরাজ্য ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সহসভাপতি এবং যুক্তরাজ্যের বাংলাদেশ ছাত্র সংস্থার সাধারণ সম্পাদক। তাই আমার এবং যুক্তরাজ্য ছাত্রলীগের অন্য নেতৃবৃন্দের ওপর দায়িত্ব পড়েছিল ঘৃণা প্রকাশের জন্য সভা ডাকার, যা আমি দুই দিন পরে করেছিলাম। সেই সভাসহ অন্যান্য সভায় হাজির হওয়ার জন্য তখন অক্সফোর্ডে অবস্থানরত ড. কামাল হোসেনকে বহুবার ফোন করার পরেও তিনি আসেননি, বরং একপর্যায়ে আমাদের ফোন ধরা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ড. কামাল হোসেন কেন বঙ্গবন্ধুর হত্যার আগেভাগে বিলেতে পাড়ি জমিয়েছিলেন, সে প্রশ্নের জবাবও পাওয়া যায়নি। কেন্দ্রীয় লন্ডনের রেড লায়ন স্কোয়ারে অবস্থিত কনওয়ে হলে অনুষ্ঠিত এক প্রতিবাদ/শোক সভায় বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। আমার ডাকা ছাত্র সংস্থার সভা ভঙ্গ করার জন্য এমন অনেকেই আক্রমণ চালিয়েছিলেন, যারা দুই দিন আগেও ‘বঙ্গবন্ধু’ বলে পাগল হয়ে যেতেন। তবে আক্রমণকারীদের অধিক সংখ্যকই ছিলেন তারা, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ায় যাদের বুকে রক্তক্ষরণ হয়েছিল, যাদের অনেকেই পরবর্তীকালে জিয়াউর রহমানের ছত্রছায়ায় একত্রিত হয়ে বিএনপি নামক দলে অংশ নিয়ে মন্ত্রী, এমপি হয়েছিলেন, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিঞাসহ।

তবে পরবর্তীকালে বিএনপিতে যোগ দিয়ে মন্ত্রী হলেও সেই দিন ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন এবং ব্যারিস্টার আমিনুল হক বঙ্গবন্ধু বিরোধী কিছু করেননি বা বলেননি, বরং বঙ্গবন্ধু হত্যার নিন্দাই করেছিলেন। উল্লেখ্য যে, এ দুজন, ৭১-এ বিলেতভিত্তিক মুক্তি আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছিলেন, আর ড. খন্দকার মোশাররফের ভূমিকা তো ছিল অনবদ্য, যার জন্য বছরখানেক আগে তার নাম প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্ত হয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকান্ডে যারা হতভম্ভ এবং মারাত্মকভাবে মর্মাহত হয়েছিলেন, তাদের অন্যতম ছিলেন একুশে ফেব্রুয়ারি গানের রচয়িতা প্রয়াত আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার কয়েক দিনের মাথায় লন্ডন থেকে ‘বাংলার ডাক’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন, যেটি ছিল সারা পৃথিবীতে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদের জন্য প্রথম মুখপাত্র। গাফ্ফার ভাইয়ের সঙ্গে ছিলেন প্রয়াত এম আর আক্তার মুকুল এবং বিশিষ্ট বঙ্গবন্ধু গবেষক, বহু বইয়ের লেখক, প্রয়াত আবদুল মতিন, ’৭১ সালের লন্ডনভিত্তিক স্বাধীনতা আন্দোলনে যার অনন্য ভূমিকা ছিল। আমার প্রয়াত স্ত্রী, লায়লা চৌধুরীর ওপর দায়িত্ব পড়েছিল পত্রিকাটি টাইপ করার। সে সময়ে আধুনিক টাইপ যন্ত্র ছিল না, ছিল মুনির অপটিমা নামক সেকেলে এক টাইপ মেশিন। আমার স্ত্রী তখন বিবিসি বাংলা বিভাগে কর্মরত থাকায় সে মুনির অপটিমা মেশিনে টাইপ করার পারদর্শিতা অর্জন করেছিল। আমার দায়িত্ব ছিল আমার স্ত্রীর টাইপ করা কাগজ গাফ্ফার ভাইয়ের কাছে পৌঁছানো এবং সংবাদ সংগ্রহ করা। মুনির অপটিমা যন্ত্রটি দিয়েছিলেন যুক্তরাজ্যে বসবাসরত অতি জ্যেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব, প্রয়াত তসাদ্দুক আহমেদ। অতি প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে প্রকাশিত এবং প্রচারিত গাফ্ফার ভাইয়ের বাংলার ডাক পত্রিকা সেই দিনগুলোতে বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াতে এবং বঙ্গবন্ধুর মহত্ত্ব প্রচারে অকল্পনীয় ভূমিকা রেখেছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যায় জিয়াউর রহমানের ভূমিকার কথা অনেক বছর পরে সবাই জেনেছে। অথচ গাফ্ফার ভাই বাংলার ডাকের প্রথম সংখ্যায়ই উল্লেখ করেছিলেন যে, হত্যাকান্ডে এবং ষড়যন্ত্রে জিয়া-মোশতাক জড়িত ছিল। তাঁর ধারণার ভিত্তির ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছিলেন, “সময়ই এটা প্রমাণ করবে।” আজও ক্ষমতাসীন দলে বহু সৈয়দ আবদুস সুলতান ঢুকে পড়েছে। তাদের অবশ্যই চিহ্নিত করে ত্যাজ্য করতে হবে।

হত্যাকান্ডের পূর্বের সময়গুলো

লন্ডন শহর সব সময়ই পাকিস্তানপন্থিদের স্বর্গরাজ্য হিসেবে পরিচিত ছিল।  এটা বলা ভুল হবে না যে, বহু ষড়যন্ত্রের সূতিকাগার ছিল লন্ডন নগরী।১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালীন যেসব বাঙালি মুক্তিযুদ্ধের তথা বাংলাদেশের অভ্যুত্থানের বিরোধী ছিলেন, দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর তারা নেমে যায় নতুন ষড়যন্ত্রে। তৈরি করে “প্রবাসী পূর্ব পাকিস্তান সরকার” নাম দিয়ে এক সংস্থা। এর প্রধান ব্যারিস্টার আব্বাস আলিকে বলা হয় “প্রবাসে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের প্রধানমন্ত্রী।” অন্যান্যের মধ্যে ছিলেন ব্যারিস্টার আব্বাস আলির ছোট ভাই ব্যারিস্টার আজাহার আলি, ছিলেন আর একজন কট্টর পাকিস্তানপন্থি ব্যারিস্টার রাজ্জাক মোল্লা। তাদের উৎসাহ প্রদান করত পাকিস্তানের ভুট্টোর নেতৃত্বের সরকার, লন্ডনে পাকিস্তানি দূতাবাসের মাধ্যমে। তাছাড়া ছিলেন “পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার” কমিটি নামের এক সংগঠনের তথাকথিত আহ্বায়ক, পাকিস্তানে পলাতক রাজাকার শিরোমণি, যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজম, ৭১-এ যার নির্দেশে বহু বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছিল। পাতি নেতাদের মধ্যে ছিলেন বিলেতে পালিয়ে যাওয়া আবদুর রাজ্জাক, যে সেখানে গিয়ে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করে ব্যারিস্টার হতে পেরেছিলেন, যে পরবর্তীতে ব্যারিস্টার রাজ্জাক হিসেবে যুদ্ধাপরাধীদের মামলায় তাদের পক্ষে আইনজীবী হয়েছিলেন, কিন্তু পরে ’৭১ সালের গণহত্যায় তারও ভূমিকা ছিল এহেন তথ্য ফুটে এলে তিনি যুদ্ধাপরাধী মামলায় তার ভূমিকা শেষ হওয়ার আগেই আবার লন্ডন পালিয়ে যান।

’৭১-এর অন্য যেসব রাজাকার পালিয়ে গিয়েছিলেন, যথা- শাহ আজিজ, সোলেমান, কর্নেল মোস্তাফিজ, মান্নান, জুলমত আলী খান গংরাও উৎসাহদাতাদের তালিকায় ছিলেন। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন এয়ার ভাইস মার্শাল তোয়াবও। দেশমুক্ত হওয়ার প্রাক্কালে পালিয়ে যাওয়া অবাঙালি মোহসিন রশিদও (বর্তমানে অ্যাডভোকেট) উৎসাহ দানকারী পাতিনেতাদের অন্যতম ছিলেন। তারা পাকিস্তানি অর্থ সহায়তায় একটি সাপ্তাহিক পত্রিকাও প্রকাশ করতেন।

’৭৩ সালে এক ষড়যন্ত্র ধরা পড়লে বাংলাদেশ সরকার পাঁচজন বাঙালির নাগরিকত্ব বাতিল করেছিল, যাদের মধ্যে ছিলেন জনমত সম্পাদক ওয়ালি আশরাফ, লন্ডনে পিএইচডির জন্য গবেষণারত মিজানুর রহমান শেলি, যিনি ভুট্টোর পিএস ছিলেন, যাকে ভুট্টোই লন্ডনে পাঠিয়েছিলেন (তবে মিজানুর রহমান শেলির অন্য ভাইয়েরা মুক্তিযুদ্ধের এবং বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই ছিলেন)। ব্যবসায়ী আবেদুর রহমান এবং আরও দুজন সেই তালিকায় ছিলেন। সেই ষড়যন্ত্র প্রকাশ্যে আসার পর অনেকেই সন্দেহ করছিলেন আরও জঘন্য কিছু ঘটতে যাচ্ছে। তথাকথিত “প্রবাসী পূর্ব পাকিস্তান সরকারের” সদস্যগণের মূল কাজ ছিল বাঙালিদের মধ্যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের তত্ত্ব এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিরোধী প্রচারণা চালিয়ে জাতির জনক এবং বাংলাদেশকে অজনপ্রিয় করে তোলা। প্রথম দিকে তাদের সাড়ায় তেমন একটা লোক না হলেও পরবর্তীতে লোক জমায়েত বেড়েছিল, যার বড় কারণ ছিল পয়সা বিতরণ। তাদের বড় স্লোগান ছিল বাংলাদেশ সৃষ্টি করেছে ভারত এবং ইন্দিরা গান্ধী। তারা এ ব্যাপারে ধর্মকেও ব্যবহার করতেন, বলতেন বাংলাদেশে ইসলাম ধর্ম থাকবে না, মসজিদে আজান হবে না, হবে উলুধ্বনি। যেসব কথা পরবর্তীকালে খালেদা জিয়া বলে বেড়াতেন। কয়েকজন বাঙালি কূটনীতিক, যারা শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান দূতাবাসেই চাকরিরত ছিলেন, তারাও তথাকথিত “প্রবাসী পূর্ব পাকিস্তান সরকারকে” উসকানি দিতেন, আর্থিক সাহায্য দিতেন, যাদের মধ্যে ছিলেন লন্ডনে পাকিস্তান দূতাবাসে কর্মরত উপ-হাইকমিশনার সলিমুজ্জামান, সেই দূতাবাসেই শেষ পর্যন্ত কর্মরত এক ইকোনমিক মিনিস্টার এহসানুল কবিরসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশে কর্মরত কজন বাঙালি কূটনীতিক।

অত্যন্ত দুঃখজনক এবং অবিশ্বাস্যভাবে বিবিসি বাংলা বিভাগের সেরাজুর রহমানও পাকিস্তানিদের কাফেলায় যোগ দিয়েছিলেন। সেরাজুর রহমান মুক্তিযুদ্ধকালীন ৯ মাস সময়ে মুক্তি আন্দোলনের পক্ষে অসামান্য অবদান রেখেছিলেন। কিন্তু দেশ মুক্ত হওয়ার পর তিনি বঙ্গবন্ধুর কাছে আবদার করেছিলেন বাংলাদেশ বেতারের মহাপরিচালকের পদটি তাকে দেওয়ার জন্য। এটা স্বীকার করতেই হবে যে, বাংলাদেশ বেতারের মহাপরিচালক হওয়ার সব যোগ্যতাই তার ছিল। কিন্তু তার ¯œাতক ডিগ্রি ছিল না বিধায় সরকারি গেজেটেড পোস্টের জন্য তিনি অযোগ্য ছিলেন। সেই পদটি না পাওয়ার পরই সেরাজুর রহমান বিগড়ে গিয়ে বঙ্গবন্ধুবিরোধী ভূমিকায় নেমে গিয়েছিলেন। তাছাড়া তার ছোট ভাই, লন্ডনে প্র্যাকটিসরত একজন বিশেষজ্ঞ চক্ষু চিকিৎসক ছিলেন খোন্দকার মোশতাকের ভাইয়ের মেয়ের স্বামী। সে সময়ে খোন্দকার মোশতাকের বেশ কয়েকজন নিকটজনও লন্ডনে বসবাসরত ছিলেন, যারাও গোপনে বঙ্গবন্ধু বিরোধীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন।

দেশ মুক্ত হওয়ার প্রাক্কালে বেশ কিছু পাকিস্তানপ্রেমী সাংবাদিকও লন্ডনে পালিয়ে গিয়ে বসতি গড়েছিলেন। তারাও বঙ্গবন্ধু বিরোধী চক্রের তালিকায় নাম লেখিয়েছিলেন। লন্ডনে পালিয়ে যাওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন পাকিস্তানপ্রেমীও ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন এক প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক ওসমান গণি, অধ্যাপক মোহর আলীসহ উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও কয়েকজন অধ্যাপকও। উল্লেখ্য, অধ্যাপক ওসমান গণি ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি লন্ডনের ক্লারিজেস হোটেলে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎও করেছিলেন কিন্তু পরে হোটেল থেকে বেরোনোর পর রাস্তায় উপস্থিত খোন্দকার মোশাররফ (তখন পিএইচডি গবেষণারত এবং ছাত্রলীগ নেতা ছিলেন) ওসমান গণিকে দেখিয়ে দিলে উপস্থিত জনগণ অধ্যাপক ওসমান গণিকে উত্তম-মধ্যম দিয়েছিলেন। এরপর তিনি আর বঙ্গবন্ধুর ধারেকাছে যেতে সাহস করেননি। তার পুত্র ড. ওসমান ফারুক পরে বিএনপি সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য হয়েছিলেন। খোন্দকার মোশতাকের দ্বিতীয় স্ত্রীর আগের ঘরের পুত্র রশিদ আহমেদ খান, ওরফে টিপু মোশতাকের বদান্যতায় আগেই বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরি পেয়েছিলেন। তিনিও গোপনে বঙ্গবন্ধুবিরোধী চক্রের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে গোপন সংবাদ প্রেরণ করতেন। পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর তাকে বরখাস্ত করা হয়েছিল, তখন তিনি নিউইয়র্কে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুবিরোধী এবং বাংলাদেশবিরোধী অধ্যাপকদের মধ্যে যার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, তিনি ছিলেন গোলাম ওয়াহেদ, সংক্ষেপে জি, ডব্লু, চৌধুরী, যিনি পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের একত্রিত হয়ে কনফেডারেশন গঠনের অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন।  পরে দেশ পাকিস্তান সৈন্যমুক্ত হলে লন্ডনে পালিয়ে গিয়ে সেখানে রয়েল ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্স-এ অধ্যাপনা শুরু করেন এবং পাশাপাশি লন্ডনের বঙ্গবন্ধুবিরোধী মোর্চা, তথা বাংলাদেশকে পাকিস্তানে ফিরিয়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে হাত মেলান।

আর এক পাকিস্তানপ্রেমী অধ্যাপক সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন, যিনি ’৭১ সালে পাকিস্তানি গণহত্যাকারীদের দ্বারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হয়ে পরে দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন।  ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমার সুযোগে কারামুক্ত হয়ে দেশের বাইরে চলে গিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং বঙ্গবন্ধুবিরোধীদের জোটে অংশ নিয়েছিলেন। অধ্যাপক মোহর আলীও দালাল আইনে গ্রেফতার হয়ে পরে বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমায় কারামুক্ত হয়ে দেশ থেকে পালিয়ে বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুবিরোধী চক্রের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধু হত্যার নেপথ্যের কুশীলবদের পরিচয় বের করার জন্য যে তদন্ত কমিশন গঠন করবে বলে সরকার ঘোষণা দিয়েছে, যুক্তরাজ্যে বসে যেসব কুচক্রী ষড়যন্ত্রে অংশ নিয়েছিল তাদের পরিচয় উদঘাটন করাও সেই কমিশনের উচিত হবে বলে আমি মনে করি।

 

লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি

সর্বশেষ খবর