সোমবার, ১৪ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

পীর ও শাসক হজরত খানজাহান আলী (রহ.)

অপূর্ব আজাদ

হজরত খান জাহান আলী (রহ.)  একজন প্রখ্যাত সুফি সাধক। যিনি পীর হিসেবে সারা দেশে পরিচিত। বৃহত্তর যশোর ও খুলনা জেলার অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত এলাকার আঞ্চলিক শাসক ছিলেন তিনি। তিনি খান জাহান আলী  (রহ.) নামে সমধিক পরিচিত। তাঁর উপাধি ছিল ‘উলুগ খান’ ও ‘খান-ই-আযম’। তিনি পনেরো শতকের প্রথমার্ধে খলিফাতাবাদে অর্থাৎ আজকের বাগেরহাটে শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। ইলিয়াসশাহী বংশের  নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহ (১৪৩৫-১৪৫৯) গৌড়ের সুলতান ছিলেন।

খান জাহান দিল্লির তুগলক সুলতানদের অধীনে একজন আমির ছিলেন। সম্ভবত তিনি ১৩৯৮ সালে তৈমুরের দিল্লি আক্রমণের (১৩৯৮ খ্রি.) পরপরই বাংলায় আসেন। তিনি প্রথমে দিল্লির সুলতানের এবং পরবর্তী সময়ে বাংলার সুলতানের নিকট থেকে সুন্দরবন বনাঞ্চল জায়গির লাভ করেন। সুন্দরবন এলাকায় গভীর বন কেটে সেখানে তিনি জনবসতি গড়ে তোলেন। অচিরেই তাঁর দুই নায়েব বুরহান খান ও ফতেহ খানের অক্লান্ত পরিশ্রমে খুলনা জেলার বয়রা থানাধীন মসজিদকুড় এবং কপোতাক্ষ নদের পূর্ব তীরবর্তী সন্নিহিত এলাকা বাসোপযোগী করে তোলা হয়। স্থানীয় জনশ্রুতি মতে, খান জাহান বৃহত্তর যশোর ও খুলনা জেলার অংশে প্রথম মুসলিম বসতি গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর সমাধিসৌধের ফলকে উৎকীর্ণ ‘উলুগ খান’ ও ‘খান-ই-আযম’ উপাধি থেকে প্রতীয়মান হয় যে, খান জাহান নিছক একজন স্বাধীন সৈনিক ছিলেন না, বরং খুব সম্ভবত তিনি গৌড়ের সুলতানের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেছিলেন। তিনি নড়াইলের উত্তরে নলদি পর্যন্ত বিস্তৃত খলিফতাবাদ পরগনা শাসন করতেন। খান জাহান ছিলেন একজন প্রখ্যাত নির্মাতা। তিনি বৃহত্তর যশোর ও খুলনা জেলায় কয়েকটি শহর প্রতিষ্ঠা, মসজিদ, মাদরাসা, সরাইখানা, মহাসড়ক ও সেতু নির্মাণ এবং বহুসংখ্যক দিঘি খনন করেন। তাঁর দুর্গবেষ্টিত সুরক্ষিত রাজধানী শহর খলিফাতাবাদ  ছাড়াও তিনি মারুলি কসবা, পৈগ্রাম কসবা ও বারো বাজার এ তিনটি শহর প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বাগেরহাট থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত একটি মহাসড়ক, সামন্তসেনা থেকে বাঁধখালি পর্যন্ত বিশ মাইল দীর্ঘ সড়ক এবং শুভবারা থেকে খুলনার দৌলতপুর পর্যন্ত বিস্তৃত অপর একটি সড়ক নির্মাণ করেন বলেও শোনা যায়। খান জাহানের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য স্থাপত্যকীর্তি বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ (আনু. ১৪৫০), মসজিদকুড় গ্রামের মসজিদকুড় মসজিদ (আনু. ১৪৫০), বাগেরহাটের নিকটে স্বীয় সমাধিসৌধ (১৪৫৯) এবং তৎসংলগ্ন এক গম্বুজ মসজিদ। তাঁর খননকৃত বহুসংখ্যক দিঘি ও পুকুরের মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য হচ্ছে তাঁর সমাধির নিকটস্থ খাঞ্জালি দিঘি (খান জাহান আলী দিঘি, ১৪৫০) এবং ষাটগম্বুজ মসজিদের পশ্চিমে অবস্থিত ঘোড়া দিঘি (পরিমাপ ১৫০০´ দ্ধ ৭৫০´)। খান জাহান তাঁর নির্মিত ইমারতে এক নতুন স্থাপত্য রীতির প্রবর্তন করেন। তাঁর নামানুসারে এটি ‘খান জাহানি রীতি’ নামে পরিচিত। বৃহত্তর খুলনা, যশোর ও বরিশাল জেলায় কিছুসংখ্যক ইমারতে খান জাহানি রীতির প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়। সম্ভবত গৌড় সুলতানের একজন পদস্থ কর্মকর্তা হয়েও খান জাহান তাঁর নির্মিত ইমারতে দিল্লির তুগলক স্থাপত্যের প্রতি অনুরাগ প্রদর্শন করেছেন। এর থেকে তুগলক স্থাপত্যরীতির সঙ্গে তাঁর পরিচয়ের এবং সম্ভবত তুগলক প্রশাসনের সঙ্গে প্রথম জীবনে তাঁর সম্পৃক্ততার যথেষ্ট প্রমাণ মেলে।  খানজাহান ১৪৫৯ সালের ২৫ অক্টোবর  অর্থাৎ ৮৬৩ হিজরির ২৭ জিলহজ ইন্তেকাল করেন এবং তাঁর নিজের তৈরি সৌধে সমাহিত হন। লোকে তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করে এবং অসংখ্য লোক তাঁর মাজার জেয়ারত করে। চৈত্র মাসে চাঁদের শুক্লপক্ষে তাঁর দরগাহ প্রাঙ্গণে বার্ষিক ওরস ও মেলা অনুষ্ঠিত হয়। একজন সুফি সাধক হিসেবে বৃহত্তর খুলনা ও যশোর জেলার মানুষের মনে খান জাহান আলী যে প্রভাব বিস্তার করেছেন তা ছয় শ বছর পরও অমলিন।     

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর