মঙ্গলবার, ১৫ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

অভিশপ্ত ১৫ আগস্ট

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

অভিশপ্ত ১৫ আগস্ট

মনে হয় আমাদের জীবনে দুঃখকষ্টের দিন বড় বেশি তাড়াতাড়ি আসে। সুখের দিনের চাইতে দুঃখের দিন বেদনার দিন মানুষকে বড় বেশি জ্বালাতন করে। জীবনের সবকিছু ছিন্নভিন্ন ওলটপালট হয়ে যাওয়া দিন ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫। জাতি হারিয়েছে তার ঠিকানা আর আমাদের চলার পথ দুর্গম, কণ্টকাকীর্ণ হয়ে গেছে। কিন্তু আমি হারিয়েছি প্রায় সবকিছু। প্রাণ ছাড়া দেহ খুব বেশি সময় সচল থাকে না। কিন্তু সেই কবে ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেই আমার প্রাণপাখি উড়ে গেছে। শুধু আমার একা হলে কথা ছিল না। কেন যেন সেই কবে ’৬০-’৬২ সাল থেকে আমরা একইভাবে নির্যাতিত-নিষ্পেষিত হয়েছি। ষাটের দশকের পুরোটাই ছিল লতিফ ভাইয়ের জন্য। লতিফ ভাই জেলে যেতেন আবার ফিরে আসতেন। লতিফ ভাইয়ের সঙ্গে বাবা মৌলভী মুহাম্মদ আবদুল আলী সিদ্দিকী একইভাবে আইয়ুব-মোনায়েমের চক্ষুশূল হয়েছিলেন। কতবার যে জেলে গেছেন, এমনকি তাঁর মোক্তারি লাইসেন্স বাতিল হয়েছিল। আগে বিচারব্যবস্থায় উকিল-মোক্তার ছিল। পরে সবাইকে উকিল মানে অ্যাডভোকেট বানানো হয়। টাঙ্গাইল জেলায় একমাত্র বাবা আবদুল আলী সিদ্দিকী নিজেকে উকিল হিসেবে স্বীকার করেননি। মোক্তারি পরীক্ষা দিয়ে পাস করে টাঙ্গাইল কোর্টে প্র্যাকটিস করতেন। জেলা সদর ময়মনসিংহেও মাঝেমধ্যে যেতেন। একটা শিশু হত্যা মামলায়, নুরুন্নাহার নামে এক মহিলার মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামির পক্ষে ময়মনসিংহ জজ কোর্টে গিয়েছিলেন। প্রেয়ার দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জজ সাহেব বলেছিলেন, ‘আপনি লোয়ার কোর্ট থেকে এসেছেন। আসামির একটি দুই-আড়াই বছরের বাচ্চা আছে। তার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি ১০ বছর সাজা দিয়ে দিতে পারি। আপনি অযথা কোর্টের সময় নষ্ট করবেন না।’ বাবা বলেছিলেন, ‘কোর্ট ফি দিয়ে আবেদন করেছি। নিশ্চয় কিছু তো শুনবেন।’ জজ সাহেব বলেছিলেন, ‘আমি রায় পড়ে দেখেছি। এখানে বলার তেমন জায়গা নেই। সব পরিষ্কার।’ আবার বাবা বলেছিলেন, ‘মাই লর্ড, আপনার হাতে কলম আছে, কাগজ আছে। কিন্তু আপনি তো যা খুশি তা লিখতে পারবেন না। আমি যা বলব আপনি তাই লিখবেন। আমি যে আইন দেখাব তাই আপনি দেখবেন। এখানে আপনার কিছু করার নেই।’ জজ সাহেব বিরক্ত হয়েছিলেন। রেগে গিয়ে বলেছিলেন, ‘অযথাই আপনি আসামির শাস্তি বাড়াবেন। কোনো লাভ হবে না।’ তার পরও বাবার চাপাচাপিতে ১০ কার্যদিবস শুনানির জন্য ধার্য করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত কোনো সাক্ষী ভালোভাবে সাক্ষ্য দিতে পারেনি। যিনি এফআই নিয়েছিলেন সেই পুলিশ অফিসার শেষ পর্যন্ত কোর্টে দাঁড়িয়ে তার বাবার নামও শুদ্ধ করে বলতে পারেননি। যে কারণে শেষ পর্যন্ত জজ সাহেব আসামি নুরুন্নাহারকে বেকসুর খালাস দিয়েছিলেন। সেটা একেবারেই ভিন্ন প্রসঙ্গ। আইয়ুব-মোনায়েমের মোসাহেব টাঙ্গাইলের এসডিও জি এম কাদরীর অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে আমাদের, আমার পরিবারের। ’৭৫-এও আমি একা ক্ষতিগ্রস্ত হলে কিছু বলার ছিল না। আজাদ-মুরাদ ছিল সব থেকে ছোট, বাবুল-বেলাল একটু বড়। শুধু রহিমার বিয়ে হয়েছিল। শুশু-শাহানারা বেশ ছোট। বাবা-মাসহ বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী এবং ভাবি লায়লা সিদ্দিকী বংশের প্রথম সন্তান রিয়া সিদ্দিকীকে নিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সবাই কষ্ট করেছেন, সবার জীবন ওলটপালট হয়ে গেছে। কিন্তু নানা কারণে আমরা সব সময়ই ‘শত্রু’ বলে বিবেচিত হয়েছি। ’৭৫-এর ২১ আগস্ট ঢাকা ছেড়েছিলাম সম্পূর্ণ এক কাপড়ে। তেমন কোনো টাকাপয়সাও ছিল না। ২-৩ হাজার কাগজের টাকা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়েছিলাম। ধানমন্ডি ১৯ নম্বর রোডে আর এ গণির বাড়িতে ছিলাম দুই বা তিন দিন। তখন মাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছিল। খুব সম্ভবত ২১ আগস্ট বিকালে আজাদ-মুরাদকে নিয়ে মা গিয়েছিলেন আর এ গণির বাড়িতে। মাকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিলাম। চোখের পানি বাঁধ মানছিল না। মার কাপড় ভিজে গিয়েছিল আমার দুই চোখের পানিতে। মা বলেছিলেন, ‘বজ্র, তুই এখনো ঘরে বসে আছিস। খুনিরা তোকে পেলে মেরে ফেলবে। ঘরের ভিতর থেকে ধরে নিয়ে তোকে মেরে ফেললে আমি কাঁদতে পারব না। তাই রাস্তায় বেরিয়ে যা, প্রতিবাদ কর। সেখানে তুই যদি মারাও যাস আমি বলতে পারব, আমি কাঁদতে পারব। তাই মা হিসেবে আমার কান্নার সুযোগটুকু নষ্ট করিস না।’ মা আরও বলেছিলেন, ‘খোদার ঘরে বিলম্ব হয়, কিন্তু খোদার ঘর অন্ধকার নয়।’ পরদিনই আমি বেরিয়ে গিয়েছিলাম। অনেক কষ্টে কামারের চর, ডোবার চর, ঝগড়ার চর, বকশীগঞ্জ হয়ে জামালপুরের তন্তর সীমান্ত দিয়ে ভারতে গিয়েছিলাম। সেখানে অনেক কিছু হয়েছে। দুই-আড়াই বছর প্রতিরোধ চলেছে।

ঢাকা ত্যাগের আগে ছোট্ট একটি লিফলেট ছেপেছিলাম। তাতে লেখা ছিল, ‘খুনিরা কামাল-জামাল-রাসেল বঙ্গবন্ধুর এই তিন সন্তানকে হত্যা করতে পারলেও তাকে নির্বংশ করতে পারেনি। আমি কাদের সিদ্দিকী জাতির পিতার চতুর্থ সন্তান। যতদিন দেহে আছে প্রাণ বঙ্গবন্ধুর হত্যার বদলা নেবই নেব।’ দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার একটা প্রতীকী বিচার হয়েছে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে বঙ্গবন্ধু হত্যার কলকাঠি যারা নেড়েছে তাদের কোনো বিচার হয়নি, খোঁজাই হয়নি। আমরা কেমন যেন হয়ে গেছি। কেউ গভীরে ঢুকতে চাই না। যাদের শাস্তি হওয়ার কথা তারা পুরস্কৃত হয়, যাদের পুরস্কৃত হওয়ার কথা তারা হয় নিন্দিত। এটাই চলছে বহুদিন। আর ব্যক্তি পর্যায়ে আমার বিড়ম্বনার শেষ নেই। মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, যুদ্ধ শেষে পিতার পায়ের সামনে অস্ত্র বিছিয়ে দিয়েছিলাম। তিনি যতদিন বেঁচেছিলেন সঠিক মর্যাদা পেয়েছি। কিন্তু তার মৃত্যুর পর ১৬ বছর নির্বাসনে থাকা, সেখান থেকে দেশে ফিরে জেল-জুলুম ভোগ করেছি। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হারাবার পর সব সময় বুকটা হাহাকার করত, কবে যাব, কবে পিতার কবর দেখতে পাব। দেশে ফিরেছিলাম ’৯০ সালের ১৬ ডিসেম্বর। আমি অত জনসমাগম ওর আগে খুব একটা দেখিনি। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ওর আগে এবং পরে কখনো অত মানুষের জমায়েত দেখেনি। ১৮ ডিসেম্বর গিয়েছিলাম টুঙ্গিপাড়ায়। আমার কাছে তেমন টাকাপয়সা ছিল না। কিছু টাকা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বোন শেখ হাসিনা দিয়েছিলেন আর কিছু দিয়েছিল অন্যরা। সঙ্গে লোক ছিল প্রায় ৩০০। সেবার নির্মলেন্দু গুণসহ আরও অনেক গুণী গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফিরে ৩০ ডিসেম্বর সিলেট হযরত শাহজালাল (রহ.), হযরত শাহ পরান (রহ.)-এর মাজারে গিয়েছিলাম। পরদিন সিলেট থেকে ঢাকার পথ ধরেছিলাম। রাস্তায় রাস্তায় ছিল গণজমায়েত। হাজার হাজার লাখো লোক জমায়েত হয়েছিল। তার মধ্যে শ্রীমঙ্গল ও নরসিংদী জমায়েত হয়েছিল অভাবনীয়। কয়েক লাখ লোক হয়েছিল এ দুই জমায়েতে। মানুষের মধ্যে একটা সাড়া পড়েছিল। সবাই খুবই ভালোবাসা দিয়েছে। এরপর ফরিদপুর-যশোর-খুলনা-রাজশাহীর পথে বেরিয়েছিলাম। প্রথম রাতযাপন করেছিলাম মানিকগঞ্জে। পরদিন ফরিদপুর। তার পরদিন ঝিনাইদহ। ১৭ জানুয়ারি ’৯১ ঝিনাইদহ থেকে আমাকে গ্রেফতার করা হয়। আমি একজনকেও চিনতাম না বলে ঝিনাইদহ আওয়ামী লীগের সভাপতি আইয়ুব হোসেনকে সাক্ষী হিসেবে ডেকে আনতে বলেছিলাম। তারা তা এনেছিল। সরকারি লোকজনকে শনাক্ত করলে তাদের সঙ্গে আমি যশোর কারাগার পর্যন্ত গিয়েছিলাম। প্রথমত নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করেছিল। পরে একটি সামরিক আদালতের পুরনো মামলায় জালিয়াতি করে আমাকে সাজাপ্রাপ্ত আসামি দেখানো হয়েছে। সামরিক সেই মামলায় আমার বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীসহ সাতজন আসামি ছিলেন। তারা সাতজনই একসময় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ছিলেন। একজন আসামির নাম জিআর বই থেকে ঘষে উঠিয়ে সেখানে আমার নাম ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যেহেতু সেই মামলার সব আসামি একসময় একসঙ্গে ঢাকা জেলে ছিলেন। আমি সেখান থেকে সার্টিফাই তালিকা উঠিয়ে ছিলাম। ড. কামাল হোসেন এবং ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম যখন মামলাটি হাই কোর্টে তোলেন তখন কোর্ট থেকে বলা হয়, কাদের সিদ্দিকীকে এখন আর দেশরক্ষা আইনে বন্দি রাখা হয়নি। তাকে একটি সাজাপ্রাপ্ত মামলায় রাখা হয়েছে এবং কোর্ট এও বলেন যে, সামরিক আদালতের ওইসব মামলা দেখার সুযোগ আমাদের নেই। হাই কোর্টের বিচারপতিদের কথা শুনে ড. কামাল হোসেন এবং ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম নিবেদন করেন, ‘মেনে নিলাম হাই কোর্টের এই ব্রাঞ্চের সামরিক মামলা শোনার এখতিয়ার নেই। তাহলে আমাদের উচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হোক।’ হাই কোর্ট বলেছিলেন, হ্যাঁ আমরা সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার অনুমতি দিতে পারি। মনে হয় একসময় ড. কামাল হোসেন আমেরিকায় গিয়েছিলেন। কিন্তু হাই কোর্ট থেকে সুপ্রিম কোর্টে মামলা উঠলে প্রথম দিন শুধু আমার মামলার জন্যই স্বনামধন্য আইনজ্ঞ ড. কামাল হোসেন দেশে ফিরেছিলেন। আমি সেজন্য তাঁর প্রতি ভীষণ কৃতজ্ঞ। এরপর একটানা প্রায় ১৫ দিন আমার সাজা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে আলোচনা হয়। সেখানে বিচারপতি এম এইচ রহমান, বিচারপতি এ টি এম আফজাল, বিচারপতি মোস্তফা কামাল ও বিচারপতি লতিফুর রহমান ছিলেন। আমার সৌভাগ্য প্রখ্যাত কবি শামসুর রাহমান বেশ কদিন হাজির থেকে সওয়াল-জবাব শুনেছেন। এক বা দুই দিন প্রধান বিচারপতি কবিকে তাঁর চেম্বারে ডেকে নিয়ে কথা বলেছেন, সম্মান দেখিয়েছেন। ১৮ আগস্ট তখনকার পিজি এখনকার বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মুক্তি পেয়েছিলাম। ১৮ আগস্ট গিয়েছিলাম টুঙ্গিপাড়া পিতার কবরে। ১৮ ডিসেম্বর জীবনে প্রথম গিয়েছিলাম টুঙ্গিপাড়া আর কারামুক্ত হয়ে ১৮ আগস্ট সেখানে গিয়েছিলাম। আমার আগেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বোন শেখ হাসিনা টুঙ্গিপাড়ায় গিয়েছিলেন। তখনকার রাস্তা ভাবা যায় না। শতাধিক নেতা-কর্মী নিয়ে সে যাত্রায় টুঙ্গিপাড়ায় গিয়েছিলাম। রাস্তাঘাটে বহু মানুষ নানাভাবে আমাকে, আমার সাথিসঙ্গীদের ভীষণ আদরযত্ন আপ্যায়ন করেছিল।

১৫ আগস্ট এলে বুকের ভিতর থেকে কিছু কান্না, কিছু জিজ্ঞাসা, কিছু উত্তাপ আপনা-আপনিই বেরিয়ে আসে। কিন্তু কোনোমতেই সেসবের কোনো উত্তর খুঁজে পাই না। ইদানীং আবার আরেক মারাত্মক বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছি। মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, পিতার পায়ের কাছে সব অস্ত্র বিছিয়ে দিয়েছিলাম, প্রায় তিন মাসে ৩১৫ ট্রাকে কাদেরিয়া বাহিনীর অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ ক্যান্টনমেন্টে এনে জমা করেছিল। ১৭ হাজার কয়েক শ মুক্তিযোদ্ধার তালিকা দিয়েছিলাম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। স্বাধীন বাংলায় পাকিস্তানের দোসরদের হাতে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা জমা দিতে মনে বড় ক্ষোভ ছিল। কারণ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রায় সবাই পাকিস্তানের সেবাদাস ছিল। তাদের বদলানো হয়নি, শাস্তি দেওয়া হয়নি। সেই পরাজিত প্রশাসনের হাতেই আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা দিয়েছিলাম। বড় কষ্ট ছিল বুকে। তবু কোনো উপায় ছিল না। ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধু সপরিবার নিহত হওয়ার পর যেখানে যাকে পেয়েছে তাকেই নির্যাতন করেছে, কারাগারে পাঠিয়েছে, এমনকি হত্যা করেছে। তাই মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম ছিল তখনকার জন্য এক মস্তবড় অভিশাপ। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সময় তিনি যখন মুক্তিযোদ্ধাদের জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বলে আখ্যায়িত করেন তখন অনেকেই মনোবল ফিরে পায়, অনেকেই তালিকাভুক্ত হতে থাকে। প্রায় সব মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধা সংসদে কাগজপত্র জমা দেয়। সে কাগজ আর কোনো দিন তারা ফেরত পায়নি। কাদেরিয়া বাহিনীর ১৮ হাজারের মতো মুক্তিযোদ্ধার এখন ৯-১০ হাজার তালিকাভুক্ত হয়েছে, ভাতা পাচ্ছে। কিন্তু বাকিরা প্রায় দিনই আসে, যা কাগজপত্র আছে তাই নিয়ে আসে। কিন্তু আমি তেমন কিছু করতে পারি না। বড় এক যন্ত্রণা! আবার ইদানীং বলতে গেলে এ বছর পুরোটাই রাতদিন ’৭৫-এর প্রতিরোধ যোদ্ধারা তাদের কী হলো তাদের কী হবে এসব নিয়ে তোলপাড় করছে। বিগত দিনগুলোয় কয়েকজন অসৎ চরিত্রের প্রতিরোধ যোদ্ধা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে এটাওটা বুঝিয়ে টাকাপয়সা নিয়ে অনেক নয়ছয় করেছে। তাই ’৭৫-এর প্রতিরোধ যোদ্ধাদের চরিত্রহীনদের প্রতি তাদের মোহ কেটে গেছে এবং তারা অনেকটাই স্বাভাবিক হয়েছে। রাতদিন আমাকে এসব নিয়ে লেগে থাকে, তটস্থ করে রাখে। সেদিন এক ঘরোয়া সভায় কয়েকজন প্রতিরোধ যোদ্ধা ভীষণ সোচ্চার হয়ে দাবি জানিয়েছে, হয় বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিরোধ যোদ্ধাদের স্বীকৃতি দেওয়া হোক, সম্মান জানানো হোক অথবা তাদের মোশতাক-জিয়া-এরশাদ-বেগম খালেদা জিয়ার সময়ের মতো দুষ্কৃতকারী হিসেবে ঘোষণা করা হোক। আমি তাদের মতের সঙ্গে দ্বিমত করতে পারিনি। তাদের ন্যায্য দাবি বা ন্যায্য কথা সমর্থন জানানো ছাড়া কোনো উপায়ও ছিল না। কিন্তু কেন যেন বুঝতে পারছি না, বঙ্গবন্ধুর হত্যায় যারা সহযোগিতা করেছে, ভয়ে হোক আর নির্ভয়ে হোক সহযোগিতা করেছে তারা অনেকেই সরকারের কাছ থেকে নানা সুবিধা আদায় করে নিয়েছে। কিন্তু যারা জীবন দিয়েছে, না খেয়ে থেকেছে কষ্ট করেছে তাদের বেলায় কেমন যেন অলসতা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বোন হাসিনার সঙ্গে এ নিয়ে যে একেবারে কথা হয়নি তা নয়। কথা হয়েছে। তিনিও অনেক সময় আমার মতোই অনুভব করেছেন, অনেক কিছু বলার চেষ্টা করেছেন, করারও চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কেন যেন কোথায় জট বেধে থাকে। কোনো কিছুই তেমন দ্রুত তালে কিংবা তালে তালে এগোয় না।

বেশ কয়েক বছর আগে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সম্মানি চেয়েছিলাম। তখন প্রিয় বোনসহ অনেকেই সেটা স্বীকার করেননি। মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, শহীদদের ভাতা এখন সবই হয়েছে। আমি যখন ২ হাজার টাকা সম্মানি চেয়েছিলাম এখন ৫০ হাজার টাকা দিলেও বাজারদরে সেই ২ হাজার টাকার সমান হবে না। বাংলাদেশ সরকার এখন মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা সবার জন্য আলাদা সম্মানি নির্ধারণ করেছে। বছরখানেক এ তিন ক্যাটাগরির সম্মানির যারা খেতাব পেয়েছেন, যুদ্ধাহত হয়েছেন তাদের দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এক রাজাকারের ছেলের ছোট্ট এক নোটে সরকারি সিদ্ধান্ত অমান্য করে বা ভঙ্গ করে যে ভাতা সব থেকে বেশি সেটাই একজন মুক্তিযোদ্ধাকে দেওয়া হচ্ছে। এখানে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার ভাতা বেশি। যে মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধাহত, খেতাবপ্রাপ্ত সে শুধু যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার সম্মানি পাচ্ছেন। কিন্তু তিনি মুক্তিযোদ্ধার সম্মানি পাচ্ছেন না, খেতাবেরও সম্মানি পাচ্ছেন না। কিন্তু বললে কী হবে, অনেকেই অন্ধ এবং বধির। কিছু দেখেন না, শোনেনও না। ’৭৫-এর প্রতিরোধ যোদ্ধারা স্বীকৃতি চায়, সম্মানি চায়। কয়েক হাজার যোদ্ধা। প্রতিরোধ যোদ্ধাদের যদি লাখ টাকাও প্রতি মাসে সম্মানি দেওয়া হয় বড়জোর কয়েক হাজার কোটি টাকা লাগবে। ৭ লাখ ৬৭ হাজার কয়েক শ কোটির বাজেটের এক-দুই শ কোটি টাকা তেমন কী? কিন্তু কোনো উত্তর নেই। জানি না কবে চলে যাব এই হানাহানির জগৎ থেকে। কিন্তু স্বাধীনতাকে নিরাপদ দেখে যেতে পারব কি না জানি না। বঙ্গবন্ধুর কীর্তি অক্ষুণ্ণ থাকবে কি না, আমাদের ভূমিকা সমাদৃত হবে কি না, ১৫ আগস্ট পিতার দুঃখজনক বেদনাদায়ক মৃত্যুর দিনে বারবার সারা দেহমনে কেন যেন একটা উথালপাথাল ভার অনুভব করি। আগামী ২৩-২৪ তারিখ টুঙ্গিপাড়ায় পিতার কবরে যেতে চাই। এই শেষ দেখা হবে কি না তাও বলতে পারি না। কিন্তু বারবার এসব কথা মনে হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় ৫০-৬০ বছরের সব মানুষকে বয়সী মনে হয়েছে, বৃদ্ধ মনে হয়েছে। আমার বয়স তো এখন ৭৭। কখন কী হয় আল্লাহই জানেন। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, বঙ্গবন্ধুকে, তাঁর সঙ্গে নিহত তাঁর পরিবারের সবাইকে বেহেশতবাসী করুন। তাঁর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বোন হাসিনা, রেহানা, ভাগনে জয়-পুতুল ও রেহানার ছেলেমেয়ে ববি-টিউলিপ, অবন্তিসহ অন্য আত্মীয়দের মহান আল্লাহ তাঁর পবিত্র সুশীতল ছায়াতলে নিরাপদে রাখুন।

লেখক : রাজনীতিক

ইমেইল : www.ksjleague.com

সর্বশেষ খবর