রবিবার, ২০ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করতে ঢাকা আসেন র-এর চিফ

নঈম নিজাম

বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করতে ঢাকা আসেন র-এর চিফ

বঙ্গবন্ধু কথা শোনেননি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র-এর প্রধানের। বাঙালি জাতিকে ভালোবেসে আমলে নেননি ইন্দিরা গান্ধীর সতর্কবার্তা। ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুকে আগাম সতর্ক করেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। দিল্লি থেকে ঢাকা ছুটে এসেছিলেন ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র-এর প্রধান। তিনি বঙ্গবন্ধুকে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরের চক্রান্ত নিয়ে সবকিছু খুলে বললেন। তার পরও বঙ্গবন্ধু ভাবতে পারেননি তাঁকে হত্যা করা হবে। বিশ্বাসঘাতকতা করবে চারপাশের মানুষই। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধুকে স্পর্শ করার সাহস পায়নি। বারবার বন্দি করেছিল।  রেখেছিল কারাগারে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় প্রহসনের বিচারের আয়োজন ছিল বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দেওয়ার ষড়যন্ত্র। গণ অভ্যুত্থান ঘটিয়ে বাংলার মানুষ সেই চক্রান্ত নস্যাৎ করে দিয়েছিল। মুক্ত করেছিল বঙ্গবন্ধুকে। রায় দিয়েছিল বাংলাদেশ স্বাধীন করার।

১৫ আগস্টের নিষ্ঠুরতার সময় বাংলাদেশের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান ছিলেন ব্রিগেডিয়ার রউফ। তিনি ছিলেন পাকিস্তানফেরত কর্মকর্তা। তাকে বদলি করা হয়েছিল। কিন্তু ১৫ আগস্ট পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন। এনএসআই-প্রধান ছিলেন ব্রিগেডিয়ার সফদার। তিনিও পাকিস্তানফেরত। তারা কেউই আগাম গোয়েন্দা তথ্য দেননি রাষ্ট্রপতিকে। এমনকি শেষ মুহূর্তে খবর পেয়ে বঙ্গবন্ধুকে রক্ষার কোনো উদ্যোগ ছিল না ব্রিগেডিয়ার রউফের। দেশের রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঠেকানো তাদের দায়িত্ব ছিল, শপথ ছিল। তারা সেই শপথ রক্ষা করেননি। সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রে পুরো ’৭৫ সাল ঢাকার বাতাস ছিল ভারী। পত্রিকা অফিসগুলোও ছিল গুজব-গুঞ্জনে ভারাক্রান্ত। ঢাকার আড্ডায়ও ষড়যন্ত্রের কথা শোনা যেত। মার্কিন দূতাবাস তাদের পাঠানো রিপোর্টে সবকিছুর আভাস দিয়েছিল। ভারত এক বছর ধরেই ছিল উৎকণ্ঠিত। আর বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ছিল ঘুমিয়ে অথবা রহস্যময় ভূমিকায়। দেশের রাষ্ট্রপতি ও জাতির পিতাকে রক্ষায় বাংলাদেশের তখনকার গোয়েন্দা সংস্থার ব্যর্থতা অথবা রহস্যময় ভূমিকার আড়ালের সব কারণ তদন্তের দাবি রাখে।

বঙ্গবন্ধুর খুনি মেজর বজলুল হুদা ১৫ আগস্টের আগে কাজ করেছেন সেনা সদরে সামরিক গোয়েন্দা পরিদফতরে। বজলুল হুদা সে সময় বিভিন্ন কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন। সরকার নিয়ে তাদের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করতেন। সমমনাদের সমর্থন আদায়ে হুদা নীরবে কাজ করেছেন সেনা সদরে বসেই। হুদাই রাষ্ট্রপতির বাসভবনের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত সৈনিকদের তালিকাও শনাক্ত করতেন। রাষ্ট্রপতির বাড়ির নিরাপত্তায় নিয়োজিত ছিল আর্টিলারি ইউনিটের একটি কোম্পানি। এ ইউনিটের সদস্যদের সঙ্গে হুদা ও ডালিমের ছিল বিশেষ সম্পর্ক। তারা রাষ্ট্রপতিকে রক্ষায় নিরাপত্তায় কোনো কাজই করেননি। বরং রাষ্ট্রপতির বাড়ির দায়িত্বে নিয়োজিত সৈনিকরাই কি ফটক খুলে দিয়েছিল খুনি বজলুল হুদাকে- এমন প্রশ্ন রয়েছে। একবারও তারা কোনো প্রশ্ন করল না অস্ত্র হাতে মধ্যরাতে আসা অস্ত্রধারীদের! তারা কী করে অনুমতি দিল ভিতরে প্রবেশ করে তান্ডবলীলা চালাতে। সেদিন পুলিশের দুজন সদস্য আর কর্নেল জামিল ছাড়া কেউই জীবন দেননি দেশের রাষ্ট্রপতির জন্য। বঙ্গবন্ধুর সেনা এডিসি ছিলেন ক্যাপ্টেন শরীফ আজিজ। তার সঙ্গে কথা হয়েছিল আমার। শরীফ আজিজ জানান, সামরিক সচিব ব্রিগেডিয়ার মশহুরুল হক, নৌবাহিনীর এডিসি গোলাম রাব্বানীসহ তিনি সকালে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের কাছাকাছি আসার পর বারবার বাধার মুখে পড়েন। শেষ মুহূর্তে আটকও হন। তাদের দীর্ঘক্ষণ চোখ বেঁধে লেকের তীরে ফেলে রাখা হয়েছিল। তারা এসে দেখলেন বঙ্গবন্ধুর সেনা নিরাপত্তারক্ষীরা খুনিদের সঙ্গে খোশগল্প করছে। তাদের ৭-৮ ঘণ্টা আটক রাখার পর খুনি ফারুক, নূর ও হুদা মুক্ত করেন। সেদিনের জুনিয়র সেনা কর্মকর্তা শরীফ আজিজের মনে প্রশ্ন জেগেছিল তাদের নিরাপত্তারক্ষী সৈন্যরা এত দ্রুত কীভাবে বদলে গেল?

ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বারবার তথ্য পায় ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং, সংক্ষেপে ‘র’। তারা বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দুবার সতর্ক করেন। তখন ভারতীয় গোয়েন্দাপ্রধান ছিলেন রমেশ্বর নাথ কাও। ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত তিনি দায়িত্ব পালন করেন। ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তাকে র-এর দায়িত্ব ছাড়তে হয়েছিল। পরে ইন্দিরা আবার ক্ষমতায় আসার পর তিনি নিরাপত্তা উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন। ১৫ আগস্টের ষড়যন্ত্র নিয়ে পুপুল জয়করের লেখা ইন্দিরা গান্ধীর আত্মজীবনীতে বিস্তারিত আছে। পুপুল ছিলেন ইন্দিরার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ও তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্য। এ নিয়ে র-প্রধান ও পুপুল জয়করের বইয়ের লেখনীতে একই ধরনের তথ্য রয়েছে। ১৯৮৯ সালের ২৯ এপ্রিল ভারতের ইংরেজি সাপ্তাহিক সানডে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে গোয়েন্দা সংস্থা র-এর বিভিন্ন ভূমিকা নিয়ে। পত্রিকাটি র-এর সমালোচনাও করেছিল বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। এ সংবাদের প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে কাও লিখেছেন, বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর একটি ষড়যন্ত্রের তথ্য র আগেই পেয়েছিল। তিনি এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে কথা বলেন। তাঁকে জানান, এ তথ্য আমরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সূত্রে পেয়েছি। তাঁকে আরও জানান, সূত্রের নাম গোপন রাখতে হবে যে কোনোভাবে। কোনোভাবে সূত্রের নাম প্রকাশ করা যাবে না। তিনি আরও লিখেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন নিয়ে ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে ঢাকা যাই। শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। সাক্ষাতের সময় পায়চারি করতে করতে তাঁকে বঙ্গভবনের বাগানে যেতে অনুরোধ করি। সবার অগোচরে নিয়ে তাঁকে জানাই আপনার জীবন হুমকির মুখে রয়েছে। তিনি একটা অনুষ্ঠানে উচ্ছ্বসিত অবস্থায় ছিলেন। আমার কথার জবাবে তিনি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, ওরা আমার নিজের ছেলে। আমাকে আঘাত করবে না। আমি আবারও তাঁকে বললাম, আমাদের প্রাপ্ত তথ্য নির্ভরযোগ্য। সেনাবাহিনীর ভিতরের ষড়যন্ত্রের যেসব তথ্য পেয়েছি তা আপনি চাইলে বিস্তারিত পাঠাতে পারব।’

ঢাকা থেকে মন খারাপ করে দিল্লি ফিরলেন কাও। তিনি আবার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে তিনি তাঁর সাক্ষাৎকারের বিস্তারিত তুলে ধরেন। সব শুনলেন ইন্দিরা গান্ধী। তারপর বাংলাদেশের দিকে সতর্ক চোখ রাখার নির্দেশ দেন কাওকে। কাও বাংলাদেশের ভিতরকার ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আবার খবর পান ১৯৭৫ সালের মার্চে। এবার তিনি আর ঢাকায় এলেন না। সাক্ষাৎ করলেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে। বিভিন্ন লেখনীতে প্রকাশ পেয়েছে, ইন্দিরা তখন নিজেই কথা বলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। তারপর বিস্তারিত বার্তা নিয়ে ঢাকায় এবার পাঠান গোয়েন্দা সংস্থা র-এর বাংলাদেশ ডেস্কের পরিচালককে। ঢাকায় এসে সেই কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের কোনো ধরনের নিরাপত্তা না থাকা দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন। একটা দেশের রাষ্ট্রপতি এভাবে সাদামাটা জীবনযাপন করতে পারেন, তা ছিল তাঁর কাছে এক ধরনের বিস্ময়ের। এই কর্মকর্তা তাঁর বসের আগের বৈঠকের সূত্র ধরে বঙ্গবন্ধুকে জানান, আমাদের কাছে আরও নতুন তথ্য এসেছে। সেনাবাহিনীর দুটি ইউনিট গোলন্দাজ আর্টিলারি ও অশ্বারোহী ক্যাভালরি বাহিনী রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছে। ঢাকায় তারা বৈঠক করছে ঘন ঘন। বঙ্গবন্ধু সব শুনলেন। র-এর কর্মকর্তার কথা বিশ্বাস করতে তাঁর কষ্ট হচ্ছিল। বঙ্গবন্ধু হয়তো ভেবেছিলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাঁকে হত্যার সাহস পায়নি। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী কী করে এত সাহস দেখাবে?

বারবার তথ্য পাওয়ার পরও বঙ্গবন্ধু ভারতীয় গোয়েন্দাদের কথা আমলে নেননি। বাংলাদেশের আকাশ-বাতাসে তখন বাকশালে যোগদানের হিড়িক। সবচেয়ে বেশি এগিয়ে ছিলেন সরকারি কর্মকর্তারা। তারা দল বেঁধে এসে যোগ দিচ্ছিলেন বাকশালে। অন্যদিকে ভারত তখন চিন্তিত বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র নিয়ে। ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত সম্পর্কে র-প্রধান রমেশ্বর নাথ কাওয়ের বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া যায় পুপুল জয়করের লেখা ইন্দিরার আত্মজীবনীতে। ইন্দিরা গান্ধীর ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ও তাঁর সরকারের মন্ত্রী পুপুল জয়করের লেখা বইটির নাম ‘ইন্দিরা গান্ধী বায়োগ্রাফি’। তিনি লিখেছেন, বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করা নিয়ে র-প্রধান কাও সাক্ষাৎ করলেন ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে। কাও ইন্দিরাকে বলেন, ‘১৯৭৪ সালের শুরু থেকেই মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র সম্পর্কে তথ্য পাচ্ছেন। তবে এখন তাঁর কাছে অত্যন্ত গোপনীয় রিপোর্ট আছে। বাংলাদেশি প্রতিরক্ষা বাহিনীর মধ্যে বিদ্রোহ পাকিয়ে তোলা হচ্ছে। তিনি এ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বর্ণনাও দেন।’ পুপুল আরও লিখেছেন, ইন্দিরা গান্ধী ষড়যন্ত্র সম্পর্কে মুজিবকে অবহিত করার জন্য ঢাকায় পাঠান র-প্রধানকে। ফিরে গিয়ে তিনি ইন্দিরাকে জানান, ‘আমরা বাগানের মধ্যে পায়চারি করছিলাম। আমি মুজিবকে বলি, তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আমাদের কাছে তথ্য আছে। কিন্তু তিনি রমরমা অবস্থায় ছিলেন। আমার কথার জবাবে তিনি বলেন, আমার কিছুই হতে পারে না, তারা আমার লোক। আমি সুনির্দিষ্ট তথ্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ তাঁকে দিয়েছিলাম, আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি।’ পুপুল লিখেছেন, ‘১৯৭৫ সালের মার্চে কাওয়ের কাছে আরও খবর পৌঁছে যায়, গোলন্দাজ বাহিনীর ভিতরে মুজিবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। ইন্দিরা দ্রুতবেগে মুজিবকে অবহিত করেন, কিন্তু তিনি বিশ্বাস করতে অসম্মত হন। তিনি তো বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা পিতা, তিনি তাঁর আপন লোকদের দ্বারা গুপ্তহত্যার শিকারে পরিণত হতে পারেন না।’

বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর শুনে ইন্দিরা কীভাবে ভেঙে পড়েছিলেন তাও রয়েছে পুপুলের বইতে। লালকেল্লায় ভারতের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে ঠিকভাবে বক্তব্যও দিতে না পারার বর্ণনা তিনি দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার খবরের প্রভাব ইন্দিরার ওপর পড়েছিল পুরোপুরিভাবে। পুপুল লিখেছেন, ‘আমি আন্দাজ করতে পারি এ সংবাদ ইন্দিরার ওপর কী প্রতিক্রিয়া করবে।’ পুপুল জয়কর ১৫ আগস্ট সন্ধ্যায় ইন্দিরা গান্ধীর বাসভবনে যান। তিনি দেখতে পান চারদিকে আতঙ্ক বিরাজ করছে। সেদিন লালকেল্লায় ভারতের তখনকার সার্বিক পরিস্থিতি মিলিয়ে যতেœর সঙ্গে ভাষণ তৈরি করেছিলেন ইন্দিরা। তিনি ভারতবাসীকে দেশ পরিচালনায় কেন জরুরি অবস্থার দরকার ছিল সেই বার্তা দিতে চেয়েছিলেন। মুজিব হত্যার খবরে সবকিছু গুলিয়ে ফেলেন ইন্দিরা। পুপুল লেখেন, ‘যা তাঁর ঘোষণা করার কথা ছিল তা তাঁর মন থেকে মুছে যায়।’ ইন্দিরা রাতে পুপুল জয়করকে বলেন, ‘মুজিব হত্যা হচ্ছে ষড়যন্ত্রের প্রথম ঘটনা। এটাই উপমহাদেশকে ডুবিয়ে দেবে।’ তিনি লেখেন, ‘মুজিবের ছোট্ট শিশু ছেলে হত্যার সংবাদ সব স্বচ্ছ চিন্তাভাবনা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়। সব ধরনের ভীতি জাগিয়ে দেয়।’ ইন্দিরা গান্ধী পুপুলকে প্রশ্ন করেন, ‘আমি কাকে বিশ্বাস করতে পারি? রাহুল- রাজীবের পুত্র প্রায় মুজিবের পুত্রের সমবয়সী। তারা আমাকে ও আমার পরিবারকে ধ্বংস করতে চায়।’

মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার গোপন নথিতে দেখা যায়, ১৫ আগস্টের আগে তিনবার বঙ্গবন্ধুকে হত্যার চেষ্টা হয়। তার পরও নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণ না করার জন্য সংশ্লিষ্টরা কি দায় এড়াতে পারেন? হত্যাকান্ডে অংশগ্রহণকারী খুনিচক্র চারটি দলে বিভক্ত ছিল। এদের একদল ছিল মেজর হুদার অধীনে বেঙ্গল ল্যান্সারের ফাস্ট আর্মড ডিভিশন। তাদের সঙ্গে ৫৩৫ পদাতিক ডিভিশনের সদস্যরা। তারা ’৭৫ সালের শুরু থেকেই বৈঠক করেন। খুনি ফারুক ও রশীদের স্ত্রী চট্টগ্রামের এক আন্ধা পীরের দোয়া নিয়ে আসেন। তারা জিয়াউর রহমানসহ অনেক সিনিয়র কর্মকর্তাকে আগে থেকে সবকিছু অবহিত করেন। কুমিল্লা বার্ডে মিলিত হয়েছিলেন তারা। মোশতাকের আগামসি লেনের বাড়িতে রশীদ বারবার গেছেন। নিজেদের মধ্যে করেছেন ক্ষমতা পরিবর্তনের আলাপচারিতা। তার পরও বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থার টনক নড়েনি। তারা কোনো খোঁজখবর পায়নি!!! ট্যাংক বের হওয়ার সময়ও সেনানিবাসে তাদের চোখ-কান ছিল বন্ধ!

বুঝি বাংলাদেশের বাস্তব পরিস্থিতি তখন অনেক কঠিন ছিল। সদ্যস্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ। চালচুলা কিছু নেই। দায়িত্ব নিয়ে সবকিছু ঢেলে সাজানো শুরু করলেন বঙ্গবন্ধু। অন্য সবকিছুর মতো আধুনিক সেনাবাহিনী গড়ার চেষ্টায় ছিলেন। রক্ষীবাহিনী কখনো সেনাবাহিনীর প্রতিপক্ষ ছিল না। তাদের কাজ ছিল এখনকার র‌্যাবের মতো। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, সন্ত্রাস, আর চরমপন্থিদের বিরুদ্ধে লড়ছিল রক্ষীবাহিনী। তাদের ঘিরে বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে মিথ্যাচারের শেষ ছিল না ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে। জাসদের গণকণ্ঠ, এনায়েতুল্লাহ খানের সাপ্তাহিক হলিডে, হক কথা কাজগুলো করছিল। ভিত্তিহীন গুজব সেনাবাহিনীর ভিতরে ছড়িয়ে দিতে কাজ করত গণবাহিনীর সেনা ইউনিটের কর্নেল তাহেরের সমর্থকরা। কী আশ্চর্য, যুদ্ধের পর শারীরিক কারণে সেনাবাহিনীতে ফিরতে না পারলেও বঙ্গবন্ধু সরকারি চাকরি দিয়েছিলেন কর্নেল তাহেরকে। তিনি সেখানে বসেই জাসদ করতেন। আর সেনাবাহিনীর ভিতরে সরকারবিরোধী প্রচার চালাতেন। সত্যিই সেলুকাস!

বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়ে রক্ষীবাহিনীর দুই উপপরিচালক আনোয়ারুল আলম শহীদ ও সরোয়ার হোসেন মোল্লার সঙ্গে কথা বলেছি বারবার। কর্নেল (অব.) সরোয়ার মোল্লা বলেছেন, রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার দায়িত্ব ছিল সেনা ইউনিটের ওপর। পুলিশ ও এসবির সদস্যরা ছিল বাড়ির গেটে। রক্ষীবাহিনীর নিয়মিত টহল ছিল ধানমন্ডিতে গণবাহিনী আর সর্বহারার যে কোনো তৎপরতা ঠেকাতে। নিরাপত্তার দায়িত্বে রক্ষীবাহিনীর কোনো ইউনিট ছিল না। তবে অতিরিক্ত টহল ও অবস্থান নিয়ে ’৭৫ সালে একবার ভুল বোঝাবুঝিও হয়েছিল। মণি ভাই আমাদের একবার ভুল বুঝলেন। গণবাহিনী ও সর্বহারার হামলার আগাম খবরে রক্ষীবাহিনী ধানমন্ডি এলাকা কর্ডন করে পাহারা বসিয়েছিল। রাতে টহল দেখতে গিয়েছিলাম ধানমন্ডিতে। শেখ ফজলুল হক মণি আমাদের তার বাড়ির কাছে দেখে ভুল বুঝলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর কাছে অভিযোগ করেন রক্ষীবাহিনী তাঁকে ভয় দেখাতে গিয়েছিল। এরপর রক্ষীবাহিনীর নিজস্ব পাহারা তুলে নিতে হয়েছিল। আমরা শেখ মণির কাছে দুঃখ প্রকাশ করে এসেছিলাম ভুল বোঝাবুঝির জন্য।

বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্র নিয়ে রক্ষীবাহিনীর উপপরিচালক সরোয়ার মোল্লা আমার অনুরোধে একটি লেখা লিখেছেন বাংলাদেশ প্রতিদিনে। পরে তা বই আকারে প্রকাশ হয়েছে। তিনি বলেছেন, ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে সর্বহারা ও গণবাহিনীর হামলার আশঙ্কা করত রক্ষীবাহিনী ও পুলিশ। গণবাহিনীর থানা লুট, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়িতে হামলা, ভারতীয় হাইকমিশনারকে হাইজ্যাকের চেষ্টা, মার্কিন দূতাবাসে হামলাসহ নানা ঘটনায় আমরা উৎকণ্ঠিত ছিলাম। বঙ্গবন্ধুর ওপর তাদের হামলার আশঙ্কায় রক্ষীবাহিনীর তিন কর্মকর্তা সরোয়ার হোসেন মোল্লা, আনোয়ারুল আলম শহীদ, সাবিহ উদ্দিন একবার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তারা বঙ্গবন্ধুকে বললেন তাদের সন্দেহের কথা। এ সময় সাবিহ উদ্দিন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাষ্ট্রপ্রধানদের নিরাপত্তা সংকটে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলির বিভিন্ন ডকুমেন্ট বঙ্গবন্ধুর সামনে তুলে ধরেন। তাঁরা বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করেছিলেন বঙ্গভবন অথবা গণভবনে থাকতে। বঙ্গবন্ধু তাঁদের বলেছেন, দেখি তোদের ভাবির সঙ্গে কথা বলে। বেগম মুজিব ৩২ নম্বর বাড়ি ছাড়তে সম্মত ছিলেন না। পিতার মতো শেখ কামালও মনে করতেন ৩২ নম্বর ছাড়লে বঙ্গবন্ধু সর্বস্তরের মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেন। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে দেশের সাধারণ মানুষের জন্য ২৪ ঘণ্টা প্রবেশের দরজা খোলা থাকত। ইতিহাসের রাখাল রাজার বাড়ি বলে কথা।

ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়ি কোনোভাবে একজন রাষ্ট্রপতির থাকার জন্য নিরাপদ ছিল না। মানুষকে ভালোবেসে তার পরও দেশের রাষ্ট্রপতি থাকতেন ছোট্ট তিন তলা এই অরক্ষিত বাড়িতে। তিনি ভাবতেও পারেননি কোনো বাঙালি খুনি হয়ে এ বাড়িতে প্রবেশ করবে। সবাই অবাধে আসবে জাতির পিতার কাছে। তিনি সবাইকে দেখে রাখবেন। কারণ এ দেশটি প্রতিষ্ঠার জন্য জীবনের ১৪ বছর তিনি কারাগারে ছিলেন। মানুষের অফুরন্ত ভালোবাসা নিয়ে দেশটি স্বাধীন করেছেন। বাংলাদেশের মানুষকে নিয়ে নেতিবাচক চিন্তা জাতির পিতা হিসেবে তিনি কীভাবে করবেন?

নিজের নিরাপত্তায় কোনো নজর দেননি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। একজন রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তায় যে বলয় থাকার কথা ছিল তা করেননি সংশ্লিষ্ট দায়িত্ববানেরা। তারা রাষ্ট্রপতিকে অরক্ষিত রাখলেন। তখন প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্ট ছিল না। রাষ্ট্রপতিকে রক্ষা করতে সেনাবাহিনীর একটি ইউনিটও ছিল। সেই ইউনিট কী করেছিল? নিরাপত্তামূলক কয়েকটি স্থানে তারা অবস্থান নিলে রাতে কারও পক্ষে ৩২ নম্বরে যাওয়া সম্ভব ছিল না। পাল্টা প্রতিরোধের সামান্য ব্যবস্থা থাকলে এ ঘটনা কোনোভাবে ঘটতে পারত না। বেসামরিক নিরাপত্তারক্ষীরা আন্তরিক ছিল। ব্রিগেডিয়ার শরীফ আজিজ আমাকে বলেছেন, তিনি বেসামরিক নিরাপত্তারক্ষীদের কাছেই ঘটনার খবর পান। ফোনে তাকে বলা হয়, স্যার ৩২ নম্বরে হামলা হয়েছে। দেশের রাষ্ট্রপতি ও তাঁর পরিবারকে রক্ষার দায়িত্ব ছিল সেনাবাহিনীর। নিজেদের অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র, চক্রান্তের আগাম তথ্য জানা ও ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব ছিল সেনা গোয়েন্দাদের। সবাই ছিলেন রহস্যময় ভূমিকায়। এ নিয়ে প্রকাশিত বইগুলোতেও অনেক কিছু স্পষ্টভাবে আসেনি। সেনা কর্মকর্তারা লিখেছেন, বলেছেন নিজেকে ও ঘনিষ্ঠ বলয়কে বাঁচিয়ে। বেশির ভাগ লেখাই মনের মাধুরী মেশানো। বিদেশি সাংবাদিকদের লেখাগুলো আশির দশকের বাস্তবতায়। বেশির ভাগ বইতে আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু পরিবারের বিরুদ্ধে রয়েছে কমবেশি নানামুখী সমালোচনা। ইনিয়েবিনিয়ে বলা হয়েছে, তখন ওটা না হলে এটা হতো না। অথচ সেনাশৃঙ্খলা ভঙ্গ, শিশু-নারী হত্যার ভয়াবহ নিষ্ঠুর অপরাধের কথা সেভাবে আসেনি। আসেনি নিজেদের ব্যর্থতার সব কাহিনিও।

 

                লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন

সর্বশেষ খবর