সোমবার, ২১ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

১৫ ও ২১ আগস্টের প্রেক্ষাপট পরিণতি ও আগামীর বাংলাদেশ

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)

১৫ ও ২১ আগস্টের প্রেক্ষাপট পরিণতি ও আগামীর বাংলাদেশ

আজ ২১ আগস্ট। কয়েক দিন আগেই ছিল ১৫ আগস্ট, জাতীয় শোক দিবস। দুটি নৃশংস হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে প্রায় ২৯ বছরের ব্যবধানে। কিন্তু ঘটনা দুটির প্রেক্ষাপট অনেকটাই ভিন্ন হলেও এর সামনের ও পেছনের কুশীলবরা ছিল একই শ্রেণিভুক্ত এবং তারা একই লক্ষ্যে ১৫ ও ২১ আগস্টের ঘটনা ঘটিয়েছে। তবে ২১ আগস্টের ঘটনার মূল টার্গেট শেখ হাসিনা বেঁচে যান এবং গত প্রায় ১৫ বছর টানা সরকারের নেতৃত্বে আছেন। ২০০৪ সালে তিনি ক্ষমতার বাইরে ছিলেন।  তখন পরিস্থিতি ছিল একরকম, ষড়যন্ত্রের কৌশলও ছিল সেই আঙ্গিকে। আর এখন যেহেতু ক্ষমতায় আছেন, তাই ষড়যন্ত্রকারীরা পঁচাত্তরের কৌশলে যেন ষড়যন্ত্রের জাল বিছাতে না পারেন, তার জন্য সবাইকে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। এটা নিশ্চিত করে বলা যায় পঁচাত্তর ও ২০০৪ সালের ষড়যন্ত্রকারীরা বসে নেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্থপতি ও জাতির পিতা, আর শেখ হাসিনা তাঁরই মেয়ে। বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে বাংলাদেশ কোনো দিন স্বাধীন হতো না। আজও বাংলাদেশের মানুষকে পাকিস্তানের গোলাম হয়ে থাকতে হতো এবং আজকে পাকিস্তানের মানুষের যে রকম দুরবস্থা তার থেকেও ভয়াবহ বিপর্যয়কর অবস্থা হতো বাংলাদেশের মানুষের। সুতরাং বাংলাদেশের মানুষের মনে আজ প্রশ্ন জাগা উচিত বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে কেন হত্যা করা হলো, কী দোষ তিনি করেছিলেন, আর এ স্বঘোষিত খুনিদের যারা রাষ্ট্রীয় পদে বসিয়ে পদোন্নতি দিয়ে পুরস্কৃত করলেন, তারা কারা এবং কেনইবা তারা এ কাজটি করলেন। এত বছর পরও কি তাদের দৃষ্টিভঙ্গির কোনো পরিবর্তন হয়েছে, আজকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাদের অবস্থান কী। তারা আজও কেন জাতির পিতার ছবি ও প্রতিকৃতি সামনে পেলেই ক্ষোভের সঙ্গে তা ভাঙচুর করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাদের কী ক্ষতি করেছেন। একমাত্র পাকিস্তানই বলতে পারে বঙ্গবন্ধু তাদের ক্ষতি করেছেন, তাদের ভিতরে ক্ষোভ জিঘাংসা থাকতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে তারা কেন পাকিস্তানিদের মতো ক্ষোভ ও জিঘাংসা পোষণ করছেন। এসব প্রশ্নের মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত কলুষিত রাজনীতির কবল থেকে বাংলাদেশ মুক্ত হতে পারবে না। এটা এখন স্পষ্ট একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যই পাকিস্তান ও তাদের এদেশীয় দোসররা পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট নৃশংস জিঘাংসা নারী, শিশুসহ জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করেছে। বিএনপির মধ্যে যখন এখনো জাতির পিতার প্রতি ক্ষোভ জিঘাংসা দেখা যায় তখন বাংলাদেশের মানুষ তাদের সম্পর্কে কী ধারণা পোষণ করবেন। দলীয় রাজনীতির বাদ-বিবাদ ভিন্ন বিষয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ বলতে যা কিছু বোঝায় তার সবকিছু শেষ করে দেওয়া, যার প্রমাণ  পঁচাত্তরের পরপরই দেখা গেছে। কিন্তু তারা যখন দেখল বঙ্গবন্ধুর বড় মেয়ে শেখ হাসিনা বেঁচে থাকায় তাদের পঁচাত্তরের লক্ষ্য বাস্তবায়ন প্রবল বাধার মুখে পড়েছে তখনই তারা ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা করে। কিন্তু এবারও তিনি ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। পঁচাত্তরের হত্যাকান্ডে যারা নেপথ্যে ও সামনে ছিল তারাই ভিন্ন চেহারায় ২১ আগস্ট ঘটনার নেপথ্যেও সামনে ছিল। ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে জামায়াত-বিএনপি সরকার যখন পঁচাত্তরের খুনিদের কয়েকজনকে আবার চাকরিতে পুনর্বহাল ও পদোন্নতি দিয়ে পুরস্কৃত করল তখনই বোঝা গিয়েছিল তারা সবাই মিলে তাদের পঁচাত্তরের অসমাপ্ত কাজকে সমাপ্ত করার জন্য নতুন মিশন নিয়ে মাঠে নামবে। ২১ আগস্ট তারই প্রতিফলন দেখা গেছে। কিন্তু কথায় আছে রাখে আল্লাহ, মারে কে। গত প্রায় ১৫ বছর ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মূল্যবোধের ওপর রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে বলেই মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ আবার ফিরে এসেছে এবং অপার সম্ভাবনাময় এক দেশের নাম এখন বাংলাদেশ। কিন্তু বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিকে সব সংকট উতরিয়ে একটা স্থিতিশীল ও সম্ভাবনাময় জায়গায় যখন এনেছিলেন তখনই পঁচাত্তরের আঘাতটি করা হয়েছিল।

আজকে বাংলাদেশ যেভাবে এগোচ্ছে সেটা যদি আর কয়েকটি বছর অব্যাহত থাকে তাহলে পঁচাত্তরের পরে আবির্ভূত হওয়া মুক্তিযুদ্ধবিরোধী নব্য রাজনীতির সঙ্গে একাত্তরে পরাজিত এদেশীয় দোসরদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব বাংলাদেশে থাকবে না। সুতরাং প্রাক পঁচাত্তরের মতো ওই ষড়যন্ত্রকারীরা বসে নেই। বরং তারা আজ আরও বেশি মরিয়া। তাই পঁচাত্তরে তারা যেভাবে চূড়ান্ত আঘাত করার আগে প্রেক্ষাপটটি তৈরি করেছিল সেটা যাতে না পারে তার জন্য বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের প্রেক্ষাপটটি সবার উপলব্ধি করা প্রয়োজন।

হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট : লেখার ভূমিকায় বলেছি একাত্তরে পরাজিত বাংলাদেশি পক্ষ এবং পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে প্রেক্ষাপট তৈরি করার কাজটি সুচারুভাবে করতে সক্ষম হয়। তবে রাষ্ট্রের সামরিক-বেসামরিক প্রশাসন যদি ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত না থাকত তাহলে উপরোক্ত পক্ষদ্বয় সহজে সফল হতে পারত না। এ সম্পর্কে দু-একটি তথ্য তুলে ধরি। ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর যারা সহযোগী ও অনুগত ছিলেন তাদের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের বেসামরিক প্রশাসনের ১৪ জন সচিবসহ শুধু অফিসারই ছিলেন ২৬৭ জন। পুলিশের শুধু ডিএসপি থেকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন ১০৪ জন। সশস্ত্র বাহিনীর ছিলেন ৯৫ জন অফিসার, তাদের মধ্যে কয়েকজন বাংলাদেশে ছুটি ভোগ করেছেন। উপরোক্ত সবাই অবাধ সুযোগ থাকা সত্ত্বেও শুধু সুবিধাবাদী ও কাপুরুষোচিত চরিত্রের কারণে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেননি। বিপরীতে ২৪ জন সামরিক অফিসার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। সুতরাং মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তানিদের সহযোগী- এ দুয়ের মনমানসিকতা, চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির বিশাল পার্থক্য হবে সেটাই স্বাভাবিক। বেসামরিক প্রশাসনের সব জায়গাই ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যারা পাকিস্তানের সহযোগী ছিলেন তারাই ১৭ ডিসেম্বর থেকে সব টপ পদ-পদবিতে বসে গেলেন। রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত বিশেষ করে তার বাস্তবায়নের সব ক্ষমতা থাকে তাদের হাতে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের কোনো ভূমিকা থাকে না। ম্যাকিয়েভেলি ‘দ্য প্রিন্স’ গ্রন্থে বলেছেন- সুবিধাভোগী ও কাপুরুষেরা চাটুকারিতা ও তোষামোদীতে পটু এবং কিছুটা করিৎকর্মা হয়। যার কারণে অনেক সময় রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাদের সঠিক চরিত্র ধরতে পারেন না। কাপুরুষোচিত চরিত্রের কারণে তারা সব সময় বীরদের প্রতি চরম ঈর্ষা, হিংসা ও বিদ্বেষ পোষণ করেন। সব সময়ই সুযোগের সন্ধানে থাকেন। সুযোগ পেলেই বীর ও বীরত্বের সবকিছু বিনাশ করতে একটুও দ্বিধা করেন না। ১৯৭৫ সাল ও তারপর বাংলাদেশে সেটাই ঘটেছে। সামরিক বাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধা অফিসাররাই শীর্ষ পদে ছিলেন। কিন্তু তাদের অপরিপক্বতা অনভিজ্ঞতা ও দূরদৃষ্টির অভাব যেমন ছিল তেমনি তারা সবাই ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দর্শনে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। পাকিস্তান রাষ্ট্রের সর্বত্র সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব দেখে তারা অভ্যস্ত, সেখানে সামরিক আমলারা নিজস্ব পেশার গন্ডি পেরিয়ে রাষ্ট্রের সার্বিক পরিচালনার বিষয় নিয়ে চিন্তা-ভাবনায় বেশি সময় ব্যয় করেন, যা মূলত রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাজ। সংগত কারণে বঙ্গবন্ধুর জনগণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক কর্তৃত্বের পরিপূর্ণ অধীনে অনুগত থাকাটাকে মানসিকভাবে কতটুকু তারা মেনে নিতে পেরেছিলেন সে প্রশ্নটা ওঠা স্বাভাবিক। কারণ ১৫ আগস্ট সকালে সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা, যারা প্রায় সবাই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তারা যদি বিদ্রোহী ও রাষ্ট্রপতি হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে তড়িৎ ব্যবস্থা নিতেন তাহলে স্বল্প কয়েকজন বিদ্রোহী অফিসার পালানোর পথ পেত না। এ ব্যবস্থা না নিয়ে তারা সেনা আইন ও নিজেদের শপথ ভঙ্গ করেছেন। ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রের সব শীর্ষ গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ পদে ছিলেন একাত্তরে পাকিস্তানের একান্ত সহযোগী ও পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত অফিসার। দীর্ঘদিন ধরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের প্রেক্ষাপট তৈরি হলো, তারা কেউ কিছু জানতে পারলেন না। সবাই জানেন বঙ্গবন্ধু নিহত হন ১৫ আগস্ট সকাল ৫টা থেকে সাড়ে ৫টার মধ্যে। কিন্তু হত্যাকারীরা বড় বড় ট্যাংক, গোলন্দাজ কামান ও ট্রাকভর্তি গোলাবারুদ নিয়ে ঢাকা সেনানিবাস থেকে শহরের দিকে যেতে থাকে রাত ১২টার পরপর। কিন্তু কোনো গোয়েন্দা সংস্থা কিছু জানলেন না বা বুঝলেন না। সুতরাং যা হওয়ার সেটাই হলো। বাংলাদেশ ভয়াবহ এক কালো অন্ধকারের যুগে প্রবেশ করল। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের প্রেক্ষাপটটি ছিল ভিন্ন। তখন রাষ্ট্রক্ষমতায় জামায়াত-বিএনপি। জামায়াতের মন্ত্রীরা প্রকাশ্যে বললেন, এদেশে কখনোই কোনো মুক্তিযুদ্ধ হয়নি, যার মাধ্যমে বোঝা গেল, তারা মুক্তিযুদ্ধের কোনো চিহ্ন বাংলাদেশে রাখবেন না। সুতরাং তখন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার অর্থে পুষ্ট জঙ্গি গোষ্ঠী বর্তমান সময়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি শেখ হাসিনাকে হত্যা করার জন্য ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড আক্রমণ চালায়। গ্রেনেড আক্রমণে মজিদ ভাট ও আবদুল মালেক নামের দুজন পাকিস্তানি জঙ্গি অংশ নেয়, যারা ফাঁসির দন্ড নিয়ে এখন বাংলাদেশের কারাগারে আছে।

বঙ্গবন্ধু হত্যার পরিণতি : বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পথ ধরেই জেলের অভ্যন্তরে নিহত হলেন চার জাতীয় নেতা। তাতে বাংলাদেশ নেতৃত্বহীন হয়ে যায়। নির্বিচারে বহু বীর মুক্তিযোদ্ধা হত্যার শিকার হলেন। জীবিতরা রাষ্ট্রের সব অঙ্গনে আপাঙক্তেয় হয়ে গেলেন। বঙ্গবন্ধুর রক্তের ওপর পা রেখে ক্ষমতায় আসা প্রথম সামরিক শাসক মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, দর্শন, চিন্তা-চেতনা ইতিহাস ও ঐতিহ্য বলতে যা কিছু বোঝায় তার সবকিছু সামরিক আদেশ দ্বারা সংবিধান থেকে বাতিল করে দিলেন। ফিরে এলো পরিত্যক্ত পরাজিত সবকিছু, যা বর্জন করার জন্যই বাঙালি সংগ্রাম করেছে ২৩ বছর, যুদ্ধ করেছে একাত্তরে। একাত্তরে যারা পাকিস্তানের সহযোগী ছিলেন তারা প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, এমপিসহ রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের সর্বত্র চালকের আসনে অধিষ্ঠিত হলেন। ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি ফিরে এলো। জামায়াত, রাজাকার, আলবদরসহ একাত্তরের ঘাতকরা রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে ফিরে এলেন। মধ্যপ্রাচ্যের পেট্রো ডলারের সহযোগিতায় দেশের শহর, বন্দর, গ্রামগঞ্জে ছোট-বড় মাদরাসার ছদ্মবেশে চরম উগ্রবাদীদের প্রতিপত্তি ও প্রভাবের বিস্তার ঘটতে থাকে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতার শিকার হয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ আবার দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়টি দেওয়াও কঠিন হয়ে পড়ে। রাষ্ট্র, সমাজ ও শিক্ষাঙ্গন থেকে বাঙালি সংস্কৃতি সব কর্মকান্ড প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনি জয় বাংলা রাষ্ট্রীভাবে বর্জিত হয়। রাষ্ট্রের কাছে জাতির পিতা ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র মূল্যহীন হয়ে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে চরমভাবে বিকৃত করা হয়। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ধর্মান্ধ জঙ্গিদের উত্থান ঘটে। বিশ্বের গবেষণা সংস্থা ও মিডিয়া হাউস থেকে বলা হয় পরবর্তী আফগানিস্তান হবে বাংলাদেশ। কালো এক অন্ধকারের মধ্যে পড়ে রাষ্ট্র ভূতের মতো পেছনের দিকে চলতে থাকে। দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়ে। বিশ্বব্যাংক ও দাতাদের দান-অনুদান ব্যতিরেকে বার্ষিক বাজেট প্রণয়ন সম্ভব হয় না। কিন্তু সংগ্রামী বাঙালি একসময়ে রুখে দাঁড়াতে শুরু করে। ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা রাজনীতির হাল ধরায় নতুন প্রজন্ম আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জেগে ওঠে। ২০০৯ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি রাষ্ট্রক্ষমতায় আছে। বড় বড় যুদ্ধাপরাধীর বিচার সম্পন্ন হয়েছে। বিশ্ব অঙ্গনে এখন নতুন সম্ভাবনাময় এক দেশের নাম বাংলাদেশ।

আগামীর বাংলাদেশ : অতীত ও বর্তমানকে বাদ দিয়ে ভবিষ্যৎ গড়া যায় না। গত প্রায় ১৫ বছর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে এবং মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত মূল্যবোধকে ধারণ করে রাষ্ট্র চলছে বলেই বাংলাদেশ আজ বিশ্ব অঙ্গনে মর্যাদাশীল একটি অবস্থানে অধিষ্ঠিত হতে পেরেছে। সারা বিশ্বের নজর এখন বাংলাদেশের দিকে। দারিদ্র্য বিমোচন ও জঙ্গি সন্ত্রাস দমনের রোল মডেল। পরবর্তী আফগানিস্তান নয়, এখন বিশাল এক সম্ভাবনার নাম বাংলাদেশ। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের জন্য সারা বিশ্বের দরজা আজ উন্মুক্ত। জঙ্গি সন্ত্রাস আর উগ্রবাদের অপবাদ কেউ দিতে পারে না। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু টানেল, আকাশে নিজস্ব স্যাটেলাইট বাংলাদেশের জন্য নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছে। মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে মিয়ানমারের সীমান্ত পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন রেল কানেকশন অদূর ভবিষ্যতে সরাসরি পূর্বদিকে মিয়ানমার হয়ে একদিকে চীন, অন্যদিকে থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম এবং পশ্চিমে ভারত, পাকিস্তান, ইরান, তুরস্ক হয়ে ইউরোপ, আর মধ্য এশিয়া হয়ে রাশিয়ার সঙ্গে যে বৈশ্বিক কানেকটিভিটি তৈরি হতে চলেছে তার হাব বা ভরকেন্দ্র হবে বাংলাদেশ। তখন বাংলাদেশের মানুষকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না। পদ্মা সেতুর জন্যই এ বিশাল সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে বিশ্বের ৩৫তম অর্থনীতির দেশ।  চলমান ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে ২৫তম অর্থনীতির দেশ হব আমরা। কিন্তু এসব সম্ভাবনা মোটেই চ্যালেঞ্জমুক্ত হয়। বড় চ্যালেঞ্জে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী রাজনীতি। ধর্মান্ধতা, জামায়াত, হেফাজতের আস্ফালন বাড়ছে বৈ কমছে না। নীতি ও আদর্শ নয়, ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থের অভ্যন্তরে দ্বন্দ্ব মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক পক্ষের বড় দুর্বলতা। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে মোটেই বিশ্বাসী নয় এমন লোক আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরে ঢুকে পড়েছে, যারা সুযোগ পেলেই ভিতরে থেকে আঘাত করবে। তবে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম, নতুন ভোটার যদি সচেতন ও সতর্ক থাকে এবং উপলব্ধি করে তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য কোন ধরনের রাষ্ট্র ও রাজনীতি অপরিহার্য, তাহলে সব শঙ্কা ও চ্যালেঞ্জ উতরিয়ে বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর নির্ধারিত লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে।

 

লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

[email protected]

সর্বশেষ খবর