শিরোনাম
সোমবার, ২১ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

ধর্মীয় ব্যাপারে তর্ক করতে নিষেধ করেছেন ইমাম গাজ্জালি

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

ধর্মীয় ব্যাপারে তর্ক করতে নিষেধ করেছেন ইমাম গাজ্জালি

ঘটনাটি আমার ছাত্রজীবনের। ছোট থেকেই অভ্যাস ছিল ঝামেলা এড়িয়ে চলা। এখনো আমি চেষ্টা করি পারতপক্ষে ঝামেলায় না জড়াতে। আমার দুই বন্ধু ছিল তুখোড় তর্কবাজ। কথায় কথায় তারা তর্ক জুড়ে দিত। তর্কের বেশির ভাগ বিষয়ই ছিল মাসয়ালাগত। মনে করুন দুই বন্ধুর একজন রফিক, অন্যজন শফিক। রফিক যদি বলে এটা এভাবে করতে হবে শফিক কথা শেষ না হতেই বলে এটা এভাবে করার কথা হাদিসে বলা আছে। তাদের তর্ক পুরো মাদরাসায় বিখ্যাত। কিন্তু আমার এসব তর্কাতর্কি ভালো লাগত না। আমার পছন্দ নির্ঝঞ্ঝাট জীবন। কিছুদিন আগে একটা অনুষ্ঠানে তিন বন্ধু একত্রিত হওয়ার সুযোগ হয়। সেখানে দেখলাম ওই দুই তার্কিক বন্ধুর মধ্যে এখন আর কোনো ঝগড়া নেই। কোনো বিষয় নিয়ে তর্ক নেই। ব্যাপারটা আমার কাছে খটকার মতো লাগল। ছাত্রজীবনের তুখোড় তার্কিক দুই বন্ধু কীভাবে তর্ক ছাড়া দুই ঘণ্টা বসে রইল বিষয়টা জানার খুব ইচ্ছা। অনেকটা খোঁচা দেওয়ার উদ্দেশেই বললাম, আচ্ছা শফিক! রফিকের এ কাজটি হাদিস অনুযায়ী কি ঠিক হয়েছে? আমাকে অবাক করে দিয়ে বন্ধু বলল, তার দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী অবশ্যই ঠিক আছে। উত্তরটা প্রচন্ড ধাক্কা দিল আমাকে। জীবনভর তো এ মানসিকতাই লালন করেছি। আসলে যে যাই করে সেটা তার দৃষ্টিভঙ্গি ও জ্ঞানের ফল। আমি বিষয়টা আমার দৃষ্টিভঙ্গি ও জ্ঞানের আলোকে একরকম ভাবছি, অন্যজন অন্যভাবে ভাবছে। দুনিয়ার সবাইকে যে আমার মতো ভাবতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। স্বয়ং আল্লাহ নিজে কোরআনুল কারিমে বলেছেন- ‘আমি চাইলে সব মানুষই পাক্কা ইমানদার হতো, কিন্তু পরীক্ষার উদ্দেশে আমি তোমাদের বিভিন্ন ধর্মে ও গোত্রে ভাগ করে দিয়েছি।’ ভাবনার গভীর থেকে উঠে আসি রফিকের কথায়। ও বলল, ‘আসলে আমরা দুজন ঠিক করেছি জীবনে কখনো মাসআলা নিয়ে তর্ক করব না। আর এ শিক্ষা আমরা পেয়েছি ইমাম গাজ্জালি (রহ.) থেকে।’ কথাটা শুনে আরও ভড়কে গেলাম। ইমাম গাজ্জালি এমন একজন মানুষ যিনি জীবনটা কাটিয়েই দিয়েছেন দার্শনিক ও ধর্মীয় বিষয় নিয়ে তর্কবিতর্ক করে। তখন ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য তিনি জটিল জটিল বিষয়ে তর্কে বসতেন এবং বীরত্বের সঙ্গে জয়ী হতেন। তার তর্কের স্টাইল এবং যুক্তির শক্তির কারণে তৎকালীন উলামা-মাশায়েখরা তাকে ‘হুজ্জাতুল ইসলাম’ উপাধি দেন। আর সে মানুষটা থেকে নাকি তর্ক না করা শিখেছে আমার তুখোড় দুই তার্কিক বন্ধু। ব্যাপারটা আরও খোলাসা করে জানা চাই। এবার শফিক বলল, ‘এটা সত্য ইমাম গাজ্জালি জীবনভর তর্কবিতর্ক করে সময় পার করেছেন। কিন্তু শেষ বয়সে তিনি উপলব্ধি করেছেন এসব তর্কবিতর্কের চেয়ে আমলই আখেরাতের শ্রেষ্ঠ পাথেয়। শেষ বয়সে প্রায়ই বলতেন, হায়! যত বিতর্কে জিতেছি তার চেয়ে যদি নফল ইবাদতে মগ্ন থাকতাম তাহলে আখেরাতে আমার মর্তবা আরও বড় হতো। তিনি তার রিসালা নামক একটি চিঠিতে তার এক ছাত্রকে উপদেশ দিতে গিয়ে জোরালোভাবে একটি কথা বলেছেন- ‘সাবধান! কোনো মাসআলা নিয়ে তর্ক কর না।’ তর্ক না করার হাকিকতও তিনি বলেছেন। তার ভাষ্যে, ‘তর্ক করলে কিছুটা লাভ আছে। জ্ঞান বাড়ে। সত্য প্রতিষ্ঠা হয়। কিন্তু এর ক্ষতির পরিমাণ এসবের চেয়েও মারাত্মক। একজন মানুষ যখন শয়তানের অন্যতম সেরা ফাঁদ ‘তর্ক’ নামক ফাঁদে পা দিয়ে ফেলে তখন তার ভিতর প্রথম মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে রিয়া বা লোক দেখানো মনোভাব। মনে মনে সে ভাবে, বাহ! আমি তো অনেক ভালো কাজ করছি। দুনিয়াবাসী আমাকে বাহবা দিচ্ছে। আমার অনেক ফ্যান-ফলোয়ার বাড়ছে।’ একটা জরুরি ফোন আসায় শফিক উঠে চলে গেল। এই ফাঁকে রফিক বলল, ‘সেই ছাত্রজীবন থেকে শফিকের সঙ্গে আমার তর্কের সম্পর্ক। তর্ক করতে করতে আমরা দুজনেই হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। তর্ক করি কিন্তু মনে শান্তি পাই না। একদিন ইমাম গাজ্জালির রিসালাহ বইটা হাতে আসে। প্রথমে আমি পড়ি। পরে শফিককে পড়তে দিই। অল্প কয়েক পৃষ্ঠার বই। এক বসাতেই পড়ে ফেলা সম্ভব। বইটার শেষ কথাগুলো পড়ে স্তব্ধ হয়ে যাই। ধর্মীয় বিষয়ে তর্কের ফাঁদে পড়ে আমরা আলেমরা কীভাবে আত্মপ্রচারের মতো বীভৎস গুনাহে জড়িয়ে পড়ি তা নিজেরাও টের পাই না। ইমাম গাজ্জালি বলেন, যদি সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য তর্ক করতেই হয় তাহলে সেটা যেন কোনোভাবেই নিজের যোগ্যতা প্রমাণের উদ্দেশ্য না হয় সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।’ ‘কিন্তু এটা তো অনেক কঠিন কাজ’- আমি বললাম। ‘অবশ্যই কঠিন কাজ’- বলল রফিক। সে আরও বলল, ‘কঠিন কাজ হলেও সহজ সমাধান আছে। ইমাম গাজ্জালি বলেছেন, তুমি কি নিজের সুনাম সুখ্যাতি ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বাহাস করছ নাকি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বাহাস করছ দুটি আলামত দেখে তা বোঝা যাবে। তুমি যদি সত্যের খাতিরেই তর্ক করে থাক তাহলে প্রতিপক্ষ যদি সত্য বলে তুমি নির্দ্বিধায় হাসিমুখে তা মেনে নেবে। কিন্তু তুমি যদি শয়তানের ধোঁকায় পড়ে তর্ক কর তাহলে প্রতিপক্ষ সত্য বলছে বোঝার পরও তুমি গায়ের জোরে তর্ক করে যাবে। দ্বিতীয় চিহ্ন হলো, তুমি যদি নিজের নফসের গোলাম না হয়ে থাকো তাহলে তুমি চাইবে এ বাহাস অনুষ্ঠান যেন একান্ত গোপনে হয়ে থাকে। মানুষ জানাজানি না হয়। অন্যদিকে একজন নফসের গোলাম সব সময় চাইবে তার যে কোনো বাহাস জনসমুদ্রে হোক এবং তার বিজয় সবাই দেখে তাকে বাহবা দিক। আমি আর শফিক ভাই কিন্তু এখনো মাসআলাগত বিষয়ে অনেক আলোচনা করি। তবে সেটা এখন আর আপনারা কেউ দেখেন না। আমি আমার ভুল শুধরে নিই, উনার ভুলও উনাকে ধরিয়ে দিলে উনি মেনে নেন।’

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি পীরসাহেব, আউলিয়ানগর

সর্বশেষ খবর