মঙ্গলবার, ২২ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

ভারতের সেই ঢেউ যেন বাংলাদেশে না লাগে

মাকিদ হায়দার

ভারতের সেই ঢেউ যেন বাংলাদেশে না লাগে

কয়েকটি মেজর অপারেশনের পরে দিন আট-নয়, হাসপাতালে ছিলাম। কয়েক লক্ষাধিক টাকার বিনিময়ে বাসায় ফিরলেও দেহের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি মিলছে না কিছুতেই। উপরন্তু প্রচন্ড গরম, আষাঢ়-শ্রাবণ মাসেও বৃষ্টির দেখা তেমন মেলেনি। আমাদের শৈশবে-কৈশোরে দেখেছি বোশেকের প্রচন্ড প্রখর রোদ। বিশেষত কিশোরকালে আমাকে প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করেছিলেন আমাদের অগ্রজ রউফ ভাই (জিয়া হায়দার)।  তখন আমরা থাকতাম পাবনা শহরের জেলাপাড়া মহল্লায়। পিতার বানানো দোতলা বাড়িতে। বাড়ির সামান্য উত্তরে নুরু মিয়ার মক্তব। বড় খেলার মাঠ। ওই প্রাইমারিতে পড়ত আমার ফুফুর ছেলে বাচ্চু। আমার খেলার সাথি সাধন, সাত্তার। প্রাইমারি স্কুলটির সামনে ছিল এখনো আছে একটি বিশাল পুকুর। সুন্দর সেই পুকুরটিতে পাড়ার সবাই, এমনকি পুকুরের পশ্চিমে পাবনা জেলখানার সেপাইরা নিয়মিত গোসল করতেন। পুকুরটির দক্ষিণে এখনো আছে আরও একটি বড় পুকুর। পুকুরটি আমাদের পাবনা শহরের বড় মসজিদের অধীনে। সেই পুকুরে কাউকে গোসল করতে দেওয়া হতো না। শুধু মুসল্লিরা অজু করতে পারতেন। পুকুর দুটি আমাদের বাড়ি থেকে হাঁটাপথে ৬ মিনিটের পথ।

একদিন সকালবেলায় আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তায় আমরা কয়েক বন্ধু কাচের মার্বেল খেলছিলাম। যাদের সঙ্গে খেলছিলাম তারা কেউই-নুরু মিয়ার মক্তবে পড়ত না। সাত্তার, সাধন বিহারি, হাবিব আমরা ছিলাম বন্ধু। মার্বেল খেলায় যখন মত্ত ঠিক তখনই পেছন থেকে এক ভদ্রলোক মাথায় জিন্নাহ টুপি, মুখভর্তি দাড়ি পেছন থেকে আমার মাথার চুল টেনে ধরতেই আমি কে বলে চিৎকার করতেই মার্বেল খেলোয়াড় তিন বন্ধু দৌড়ে পালিয়ে গেলেও জিন্নাহ টুপি পরিহিত ভদ্রলোক হিড়হিড় করে টানতে টানতে বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আমার পিতাকে  উচ্চৈঃস্বরে ডেকে বললেন, দোতলা থেকে নিচে আসুন। পিতা শেখ মোহাম্মদ হাকিম উদ্দিন দ্রুত নেমে আসতেই জিন্নাহ টুপিওয়ালাকে বললেন, সালামালেকুম মাওলানা সাহেব। উনাদের কথার মাঝখানে আমার মাথার চুল ছেড়ে দিয়ে মাওলানা সাহেব বললেন, এই ছেলেটি তো আপনার।

পিতা হ্যাঁ বলতেই জিন্নাহ টুপিওয়ালা বললেন, আগামীকাল পাবনা জিলা স্কুলে আপনার ছেলেকে পাঠিয়ে দেবেন, ক্লাস থ্রিতে ওকে ভর্তি করব। নগদ ২ টাকা দেবেন যার সঙ্গে ওকে পাঠাবেন তার হাতে। তাকিয়ে দেখি আমাদের বাড়ির দেয়ালের পাশে উনার সাইকেল। পিতা বিস্ময় প্রকাশ করে জানতে চাইলেন, ২ টাকা দিয়ে জিলা স্কুলে ভর্তি হওয়া যায়? পিতার প্রশ্নের উত্তরে মাওলানা সাহেব জানালেন, দেড় টাকা ভর্তি ফি আর ৮ আনা সারা মাসের টিফিন ফি। পিতা হেসে দিয়ে উনাকে জানালেন আমাদের জামাই আবুল মুনছুরকে দিয়ে আপনার কাছে পাঠিয়ে দেব। পরের দিন পিতা ভগ্নিপতিকে ২ টাকা দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন জিলা স্কুলে। ওইদিনই ভর্তি হয়ে গেলাম। ক্লাস থ্রির কী কী বই, খাতা-পেনসিল কিনতে হবে ভগ্নিপতিকে জানালেন। ১৯৫৬ সালের জানুয়ারির প্রচন্ড শীতের ভিতরে কুয়াশায় চারদিক ঢেকে গেলেও বেলা ১০টার দিকে কুয়াশা পাতলা হলে স্কুলে যাওয়ার পথে আমার ফুফাত ভাইকে পেলাম ওদের বাড়ির সামনেই। স্কুলের মাঠের দক্ষিণ দিকের একটি একতলা ভবন ছিল তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রদের জন্য। সেখানে গিয়ে দেখি আরও জনাকয়েক বসে আছে। আস্তে আস্তে পরিচয় হলো সাধুপাড়ার তবিবুর, কাচারিপাড়ার বাদশা, রামচন্দ্রপুরের নারায়ণসহ কয়েকজনের সঙ্গে।

প্রতিদিন স্কুল শুরু হওয়ার ঘণ্টাখানেক পরে হেড মাওলানা স্যার এসে দেখতেন আমাদের, আমরা ঠিকমতো পড়ালেখা করছি কি না। জানতে চাইতেন ক্লাসের শিক্ষকের কাছ থেকে। কোনো একসময় সম্ভবত ১৯৫৮ সালে, আমার দাদিমার মৃত্যুর পরে শহরের জিন্দাপাড়ার দোতলা বাড়ি মাত্র ৪০ টাকায় ভাড়া দিয়ে চলে এলেন শহরের পূর্বদিকের দোহারপাড়ায়। সেখান থেকে জিলা স্কুলে পৌঁছে যেতাম হেঁটেই, মাত্র দেড়-দুই মাইল পথ। আমাদের দোহারপাড়ার বাড়িটার এখন বয়স ১৩২ বছর। বাড়ির পেছনে বিশাল পুকুর। ভিতরে কুয়ো, বাইরে পানির কল। জমির পরিমাণ ৫০ বিঘার মতো। পুকুরের চারদিকেই ফলের বাগান, নারিকেল, সুপারির গাছ। একদিন সুপারি পাড়তে গিয়ে গাছ থেকে পড়ে দীর্ঘদিন হাসপাতালে থাকার পরিপ্রেক্ষিতে, জিলা স্কুল থেকে বিদায় নিয়ে এক বছর পরে পাবনা গোপালচন্দ্র ইনস্টিটিউশনে আমাকে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন আমাদের মেজো ভাই রশীদ হায়দার। তিনিও ওই স্কুলের ছাত্র ছিলেন। এমনকি অগ্রজ জিয়া হায়দার ১৯৫২ সালে দ্বিতীয় বিভাগে মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। অনুজ দাউদ, জাহিদ মেজো কাকার ছেলে আনিস, ছোট কাকার ছেলে মোশারফসহ দোহারপাড়ার অনেক ছেলে পড়তাম ওই স্কুলে। জিয়া ভাই আমাদের পরিবারের প্রথম মাধ্যমিক পাস। পরবর্তীতে আমরা কভাই দেশে-বিদেশে পড়ালেখার সুযোগ পেয়েছিলাম স্কলারশিপের সৌজন্যে,  ১৯৬৫ সালে মাধ্যমিক পাস করেই। সংবাদটি প্রথম দিয়েছিলাম আমার প্রিয় শিক্ষক কসিমউদ্দিন আহমদ হেড মাওলানাকে। তাঁর পায়ে সালাম করতেই তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করেছিলেন ভবিষ্যৎ যেন উজ্জ্বল হয়। বললেন লেখাপড়ায় ফাঁকি দিসনে।

তিনি একদিন পাবনা শহরবাসীকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেলেন। যাওয়ার কারণটি হলো- ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে ২৮-৩০ জন পাকিস্তানি আর্মিকে পাবনায় পাঠানো হয় ঢাকা থেকে। তাদের সহযোগিতা দিয়েছিলেন পাবনার জামাই পাঞ্জাবি ক্যাপ্টেন সাঈদী। পাকিস্তানি আর্মিরা থাকত শহরের টেলিফোন ভবনে। ২৬ মার্চের পর থেকে নাপাকেরা আওয়ামী লীগের জনাকয়েক নেতা, সাধারণ মানুষসহ অনেককেই বিনা কারণে হত্যা করেছিল। তারই প্রতিশোধ নেওয়ার নেতৃত্বে ছিলেন হেড মাওলানা জসিমউদ্দিন স্যার।

১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল ছিল রবিবার। সেই রবিবারে পাকিস্তানি সৈনিকেরা আরিচা থেকে নগরবাড়ী পৌঁছেই শুরু করেছিল হত্যাযজ্ঞ। হিন্দু-মুসলমান কেউই রক্ষা পায়নি সেদিন। নগরবাড়ীর ডান পাশের গ্রামগুলো পুড়িয়ে দিয়ে ঢুকেছিল পাবনা শহরে। ১০ এপ্রিলের আগে যে ৩০ জন টেলিফোন ভবনে ছিল সেসব পাকিস্তানি সৈন্যকে শহরবাসীসহ চরাঞ্চলের লোকজন হত্যা করলেও শুধু একজন পাকিস্তানি আর্মি দৌড়ে পালিয়ে গিয়েছিল ঈশ্বরদীতে বিহারিদের কাছে। পাকিস্তানি সৈন্যদের ওপর সেই আক্রমণের নেতৃত্বে ছিলেন ইকবাল হোসেন, বেবী ইসলাম, রফিকুল ইসলাম, বকুলসহ হাজার হাজার মানুষ। তার ভিতরে ছিলেন আমাদের প্রিয় হেড মাওলানা স্যার।

হেড মাওলানা স্যারকে পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন জায়েদের নির্দেশে পাবনার জামায়াতে ইসলামীর মাওলানা আবদুস সোবহান। ১৯৭১ সালের জুন অথবা জুলাই মাসে স্যারকে সাঁথিয়ার একটি গ্রামের বাঁশঝাড়ে নিয়ে হত্যা করেছিল নাপাকেরা। কবরও দেয়নি। আষাঢ় মাসের প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যেও গ্রামের লোকজন বাঁশঝাড়ের নিচে কবর দিয়েছিল। বছর কয়েক আগে আমি গিয়েছিলাম স্যারের কবর দেখতে।

৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জাতির জনকের ১৮ মিনিট ২৪ সেকেন্ডের ভাষণের সময় আমরা যারা ময়দানে ছিলাম দেখলাম মাথার ওপরে হেলিকপ্টার। নাপাকেরা হয়তোবা গুলি চালাতে চেয়েছিল, শেখ মুজিব সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন কি না। যদি সেদিন স্বাধীনতার ঘোষণা দিতেন আমরা যারা ভাষণ শুনতে গিয়েছিলাম তারা হয়তো অনেকেই ঘরে ফিরতে পারতাম না। শেখ মুজিব বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ, সরাসরি না বলে উপস্থিত লাখ লাখ মানুষকে জানিয়ে দিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’। সেদিনের সেই ভাষণ শুনতে অনেকেই রেসকোর্সের পূর্বদিকের বিভিন্ন গাছের ওপর বসেই শুনছিলেন সেই অজেয় কণ্ঠের উদাত্ত আহ্বান। ইতিপূর্বেই ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানরত নাপাক সৈনিকেরা অপেক্ষায় ছিল বড় কর্তাদের হুকুম পেলেই শুরু করবে হত্যাকান্ড।

আমার ধারণা ইয়াহিয়া, ভুট্টো, রাও ফরমান এবং নিয়াজি এরা বাঙালিদের হত্যাযজ্ঞ ২৬ মার্চ শুরু না করে বরং ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ারের পৃথিবী বিখ্যাত উক্তি যদি মনে রাখতেন তাহলে ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করতেন না, পোড়াতেন না ঘরবাড়ি। ভলতেয়ার ছিলেন রুশোর সমসাময়িক।  তিনিও ছিলেন বিখ্যাত ব্যক্তি। দার্শনিক। উভয়েই মানবিক সমাজ গঠনে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। আলোকিত করেছেন।

একবার কিছু লোক ভলতেয়ারকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘মন্ত্রোচ্চারণ করে একপাল ভেড়া মারা যায় কি না? সেই প্রশ্নের উত্তরে ভলতেয়ার বলেছিলেন- ‘যায়, কিন্তু গোড়ায় প্রচুর পরিমাণে সেঁকো বিষ খাইয়ে দিলে আর কোনো সন্দেহই থাকবে না।’ পাকিস্তানি নরখাদকেরা ভুল করেছিল, যেহেতু তারা ভলতেয়ারের দর্শনের কথা কোনো দিন পড়েনি, সম্প্রতি ভারতের একটি রাজ্যে দুই মহিলাকে যেভাবে রাস্তায় কাপড়বিহীন অপমানিত করা হয়েছে, সেটি সত্যিই লজ্জাজনক। আমার শুধু ভয় হয়, সেই ঢেউ যেন বাংলাদেশের নদনদীতে না লাগে।

লেখক : কবি

সর্বশেষ খবর