বৃহস্পতিবার, ২৪ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

ফেলে আসা সেই দিনগুলো

হোসেন আবদুল মান্নান

ফেলে আসা সেই দিনগুলো

জুলাই ২০০৭ সাল। সেনাসমর্থিত ওয়ান-ইলেভেন নামের আলোচিত সরকারের অধীনে দেশ পরিচালিত হচ্ছে। ঢাকাসহ দেশের বড় বড় সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় অবস্থানপূর্বক সেনাবাহিনীর মাঝপর্যায়ের  কর্মকর্তারা প্রচ্ছন্নভাবে দায়িত্ব পালন করছেন। দেশে দলীয় রাজনীতি বা রাজনৈতিক তৎপরতা সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। সরকারি অফিস আদালত চলছে ঘড়ির কাঁটায়। সচিবালয়ের (ইডেন বিল্ডিং) চৌহদ্দির ভিতরেও ফাঁকা ফাঁকা ভাব। চারদিকে আতঙ্ক। গাড়ি-ঘোড়ার আধিক্য চোখে না পড়ার মতো। সচিবালয়ে প্রবেশ করে এমন সুনসান দৃশ্য ইতিপূর্বে কখনো দেখিনি।

আমি তখন চাঁদপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক। সাপ্তাহিক ছুটির সঙ্গে একটি দিন মিলিয়ে ঢাকায় এসেছি। পরিবারের সদস্য আজিমপুরের সরকারি কোয়ার্টারে বাস করে। সন্তানরা সবাই স্কুলপড়ুয়া। তারা যথাক্রমে অগ্রণী বালিকা উচ্চবিদ্যালয় এবং পিলখানার নূর মোহাম্মদ রাইফেলস পাবলিক স্কুলে অধ্যয়নরত। বাসা ছেড়ে দেওয়ার জন্য সরকারি আবাসন পরিদফতর থেকে যত চাপ এর চেয়ে কয়েকগুণ বেশি আসছে পরবর্তী বরাদ্দপ্রাপকের কাছ থেকে। আমি ঢাকার বাইরে থাকি, এটা জানা সত্ত্বেও, হয়তো কোনো এক মধ্য-দুপুরে বা পড়ন্ত বিকালে বেরসিক কর্মকর্তা দরজায় কড়া নাড়িয়ে বলছেন, ‘ম্যাডাম বাসাটি আপনারা কবে ছাড়ছেন? আমরাও তো অনেক দিন থেকে ঘুরছি। দয়া করে স্যারকে একটু বলবেন’- ইত্যাদি ইত্যাদি।

চাঁদপুরে আমি যেখানে যে অবস্থায় থাকি না কেন বিষয়টা আমাকে হুবহু সম্প্রচার করতে আমার স্ত্রী কখনো বিলম্ব করতেন না। শুনে আমিও একই রেকর্ড পুনঃপ্রচার করে দিতাম। ‘শোন বাসা নিয়ে চিন্তা করো না, এই তো চলে আসছি। হঠাৎ শুনবে আমি ঢাকায়। বাচ্চাদের স্কুল নিয়ে আমি ভাবছি না, কারণ তোমার চেয়ে সিরিয়াস মা বিশ্বে ক’জন আছে’!

বেশ কয়েকদিনের জন্য আমি নিশ্চিত থাকলাম। এতে অন্তত আরও পনেরো দিন চলবে।

সেদিন সচিবালয়ে ঢুকে প্রথমেই সাক্ষাৎ করি মাঠপর্যায়ের তরুণ কর্মকর্তাদের বদলি পদায়নে যার হাত সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে, সেই এপিডি মহোদয়ের সঙ্গে। জনাব আবুল কালাম আজাদ তখন ওই আকর্ষণীয় পদে অধিষ্ঠিত। তিনি আমার পূর্বপরিচিত হওয়ায় অনেকটা নিঃসংকোচ এবং নিঃসংশয়ে ভিতরে প্রবেশ করি। আমাকে দেখেই বললেন, ‘ঢাকায় আসতে চাও, বুঝতে পেরেছি, আমিও ভাবছি, অল্প কিছুদিন অপেক্ষা করো। অবশ্যই চলে আসবে’। আমি মূলত আমার বাসার সমস্যার কথা বলেছি। তিনি অত্যন্ত মানবিকতা তথা সংবেদনশীলতা নিয়েই আমাকে আশ্বস্ত করলেন।

সেখানে মিনিট পাঁচেক সময় নিয়ে তাঁর কক্ষ ত্যাগ করলাম। অনেক সাক্ষাৎপ্রার্থী এদিক-ওদিক বিচরণ করছেন। একসময়ে কর্মচারীদের সুখ-দুঃখ এমনকি সংক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া শোনার বা আশ্রয়ের মুখ্য জায়গা ছিল এটা।

আমি করিডোর ধরে আনমনা হয়ে হাঁটছি। আমার পদচারণে চিন্তা-ক্লিষ্ট ভগ্নহৃদয় গতি। গন্তব্য গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। তৃতীয় তলায় সচিবের দফতরে গিয়ে হাজির হলাম। সচিবের নাম জনাব রশিদুল হাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ ও সমকালীন বন্ধুরা তাঁকে শামীম বলে ডাকেন। ইতিপূর্বে তাঁর সঙ্গে আমার অন্তত দুবার চাকরি করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। সচিবের সাক্ষাৎ চাই, বলতেই পুরনো কর্মচারীরা আমাকে লাল সতর্কসংকেত দিলেন।

স্যার, খুব কঠিন কাজ, সহজে কেউ সাক্ষাৎ পাচ্ছেন না। আর এখন তিনি লাঞ্চ করছেন। সম্ভব নয়, অপেক্ষা করতে হবে। ভাবছিলাম, আমি একসময় এখানেই একজন সাবেক সিএসপি সচিবের একান্ত সচিবের দায়িত্বে ছিলাম। এ স্টাফদের প্রায় সবাই আমার সুপরিচিত। তবু তারা বলতে সাহস পাচ্ছে না, দেশে হঠাৎ কী এমন পরিবর্তন ঘটে গেল?

খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে কর্মচারীদের ইচ্ছার বিপরীতে গিয়ে নিজ দায়িত্বে দরজা খুলে অতি সন্তপর্ণে ভিতরে ডান পা-টা রাখলাম। সচিবের মেজাজ মর্জির ওপর নির্ভর করবে আমার দ্বিতীয় পা সঞ্চালনের কাজ। ডাইনিং টেবিল থেকে সরাসরি আমার চোখে তাঁর চোখ পড়ল। তিনি বেশ উচ্চ স্বরেই বললেন, ‘এই কোত্থেকে আসছিস? আয়, ভিতরে আয়’। তাঁর স্নেহাশিষ সম্বোধনে আমি যেন আকস্মিক হাতে আকাশ ছুঁতে পেলাম। তিনি আমাকে বসতে বললেন। তাকিয়ে দেখলাম, তিনি খাচ্ছেন অল্প পরিমাণ ভাত, এক টুকরো ইলিশের ঝোল সঙ্গে সামান্য সবজি। আমি খেয়েছি কি না তা-ও জিজ্ঞেস করলেন। খেতে খেতেই আমার পারিবারিক সমস্যার কথা শুনলেন। জানতে চাইলেন, এডিসি যতদিন হয়েছে তা ডিসি হওয়ার জন্য চলবে কি না ইত্যাদি। তিনি হাত ধুয়ে তাঁর আসনে ফিরে আসলেন। আমি মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসে আছি।

আর কোনো বাক্য ব্যয় না করে সচিব ইন্টারকমে সরাসরি এপিডিকে ধরলেন, ‘আজাদ রাজউকে একজন কর্মকর্তা পদায়নের জন্য দুই দিন আগে আমি একটা ডিও লেটার পাঠিয়েছি। চিঠিটা বের করে ওই নামটা পরিবর্তন করে তার জায়গায় চাঁদপুরের এডিসি মান্নানের নামটা বসিয়ে দাও। রাজউকের জন্য আমি একজন সাহসী কর্মকর্তা খুঁজছিলাম। এখন তাকেই দরকার। আইডি নম্বর সে তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে দেবে’।

আমি এ নাটকীয় দৃশ্যপটের প্রধান কুশীলবের মুগ্ধ কথোপকথনে একজন বিমোহিত রুদ্ধবাক শ্রোতা হয়ে গেলাম। এটাকে কি মেঘের বদলে বৃষ্টি বলব, না আরও বেশি কিছু? বুঝতে পারছিলাম না।

পুনর্বার এপিডির কক্ষে প্রবেশ করতেই জনাব আজাদ বললেন, ‘আমাকে বাঁচালে তুমি। আমারও একটা দায় ছিল তোমাকে ঢাকায় আনার। যাও, আশা করি আগামী সপ্তাহে রাজউকে যোগদান করতে পারবে’।

এক সপ্তাহ পর যথারীতি উপসচিব হিসেবে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে আমার পদায়ন হয়। সেখান থেকে সংযুক্তিতে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পরিচালক (অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস) পদে যোগদান করি। রাজউকের জন্য এটা কখনো লোভনীয় পদবি নয়, কিন্তু আমার ঢাকায় ফিরে আসার কোনো তুলনা হয় না।

কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান তখন জনাব এ কে এম হারুন, রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং ক্যাডারের এক কর্মকর্তা। অমায়িক, মিতভাষী ও বন্ধুবৎসল মানুষ। পরিচয় দিতেই বললেন, ‘আর্মিদের সঙ্গে সম্পর্ক ডেভেলপ করতে হবে। দেখুন, এদের সঙ্গে সব সময় কথা বলুন। আমাকে জানাবেন’। উল্লেখ্য, রাজউকে তখনকার প্রায় সব কর্মকর্তার দরজায় ন্যূনতম একজন করে সেনাসদস্য মোতায়েন ছিল। আমার কাছে বিষয়টি শোভনীয় মনে হচ্ছিল না। গৃহবন্দির মতো অনুভূত হতো। কিছুদিন যেতেই আমি দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার জনৈক লে. কর্নেল মেহেদীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে অনুরোধ করলাম, আমার দরজাটা যেন তিনি মুক্ত করে দেন। চাঁদপুরের মানুষ হওয়ায় তিনি তাৎক্ষণিক আমার প্রতি সদয় হয়েছিলেন। তখন আমিও চাঁদপুর থেকে সদ্য বদলিকৃত। চাকরির দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় রাজউকের সময়টা বেশ অস্বাভাবিক ও শ্বাসরুদ্ধকর ছিল বটে, মনে পড়ে, তবু আমি নির্ভার হয়ে অবাধে বিচরণ করেছিলাম। সেখানে একাধিক দায়িত্বও পালন করেছিলাম। এমনকি পরবর্তী চাকরিজীবনেও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমি সব সময় দারুণ স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করেছি। তাঁদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় কোথাও কখনো কোনো তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হইনি।     

           লেখক : সাবেক সচিব, গল্পকার ও প্রাবন্ধিক

সর্বশেষ খবর