শুক্রবার, ২৫ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

বিপাকে পাকিস্তানি তত্ত্বাবধায়ক সরকার

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

বিপাকে পাকিস্তানি তত্ত্বাবধায়ক সরকার

পৃথিবীর বুকে রাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, সামরিক শাসন, স্বৈরশাসন, খেলাফত প্রভৃতি সরকারব্যবস্থা চালু হলেও দীর্ঘমেয়াদে গণতন্ত্রের চেয়ে ভালো কোনো শাসনব্যবস্থা আজ পর্যন্ত প্রমাণিত হয়নি। গণতন্ত্রেও ত্রুটি রয়েছে, তবে তা অন্যান্য সরকারব্যবস্থার তুলনায় অনেক কম বলেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের অধিকাংশের মতে গণতন্ত্রই রাষ্ট্র পরিচালনার সবচেয়ে আদর্শ শাসনব্যবস্থা। বিশ্বের বুকে বর্তমানে ১৯৫টি দেশ রয়েছে। (সূত্র : ওয়ার্ল্ড অ্যাটলাস)। প্রচলিত নির্বাচনব্যবস্থা, জনগণের স্বাধীনতা, রাজনীতিতে অংশগ্রহণ, সরকারের কর্মকান্ড ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির মতো ৬০টি মানদন্ডে  যাচাই করে প্রতিবছর বিশ্বের প্রায় সব দেশের গণতন্ত্রকে মূল্যায়ন করে এবং বিভিন্ন স্তরে বা ক্যাটাগরিতে সাজায় লন্ডনভিত্তিক ‘ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট’, যা বিশ্বের বহু দেশ, সংস্থা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আদর্শ বা নির্ভরযোগ্য বলে মনে করে।

ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের ২০২২ সালের মূল্যায়নে বিশ্বের ২৪টি দেশে পরিপূর্ণ গণতন্ত্র এবং ৪৮টি দেশে কিছুটা ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র রয়েছে। আর বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৩৬টি দেশে রয়েছে হাইব্রিড ডেমোক্র্যাসি; যাকে বাংলায় শংকর বা দোঁআশলা গণতন্ত্র বলা চলে। অন্যদিকে কর্তৃত্ববাদী শাসনের জাঁতাকলে রয়েছে ৬৯টি দেশ। হাইব্রিড ডেমোক্র্যাসি স্তরের ৩৬টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে বাংলাদেশ, যার বিশ্ব র‌্যাংকিং ৭৩। আর এ স্তরের নিচ থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে অর্থাৎ কর্তৃতবাদী দেশের তালিকায় একটু ওপরে রয়েছে পাকিস্তান, যার বিশ্ব র‌্যাংকিং ১০৭। মজার বিষয় হলো- হাইব্রিড স্তরের সবচেয়ে ভালো বা উচ্চ অবস্থানে থাকা বাংলাদেশ এবং নিচ থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা পাকিস্তানে আজ বহুল আলোচিত ও সমালোচিত বিষয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। গণতান্ত্রিক রীতিতে এমন সরকারের প্রয়োজনীয়তা না থাকলেও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থাহীনতা ও নির্বাচন প্রক্রিয়া পরিচালনার জন্য যোগ্য ও সামর্থ্যবান নির্বাচন কমিশন ও বিচারব্যবস্থাসহ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতার কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দিকে ঝুঁকে পড়ে এ দুই দেশ। বাংলাদেশের ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়কের আবরণে সেনা-সমর্থিত সরকারের আগমন এবং যথাসময়ে নির্বাচন না দিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখা ও দেশকে বিরাজনীতিকরণের দিকে ঠেলে দেওয়ার প্রেক্ষাপটে আইন ও সাংবিধানিকভাবে এ তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি বাতিল করা হয়। তবে তা রয়ে গেছে পাকিস্তানে।

নানা রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ১০ আগস্ট ২০২৩ তারিখে প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের উপদেশ মোতাবেক পাকিস্তান জাতীয় সংসদের বিলুপ্তি ঘোষণা করেন রাষ্ট্রপতি আরিফ আলভি। একই সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয় এবং এ সরকারের প্রধান হন ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে জন্ম নেওয়া আনোয়ারুল হক কাকার। তিনি লেখাপড়া করেছেন সেনাবাহিনী পরিচালিত কোহাত ক্যাডেট কলেজে এবং বেলুচিস্তান বিশ্ববিদ্যালয়ে। বেলুচিস্তান রাজ্য সরকারের একজন শিক্ষিত সংসদ সদস্য হিসেবে তার সুনাম রয়েছে। তা ছাড়াও সেনাবাহিনীর অধীনস্থ ‘ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটিতে’ তিনি নানা বিষয়ে বক্তৃতা প্রদান করার সুবাদে সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন মহলের সঙ্গে তার সখ্যের বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত। তত্ত্বাবধায়ক সরকারই যে সব সমস্যার সমাধান নয়, তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে পাকিস্তান। শপথ গ্রহণের আগের দিনই সরকারপ্রধান আনোয়ারুল হক কাকারকে শুনতে হয় বেলুচিস্তানে গোলাগুলির খবর। সেখানে নিষিদ্ধ ঘোষিত বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মির মজিদ ব্রিগেড গ্রুপ চায়নার অর্থায়নে একটি সমুদ্রবন্দর এবং বন্দরের সঙ্গে সংযোগের জন্য রাস্তা নির্মাণকাজে নিয়োজিত চীনা প্রকৌশলী, কারিগর ও শ্রমিকদের আক্রমণ করে এবং গুলি চালায়। নির্মাণাধীন এ বন্দর ও সংযুক্ত রাস্তা ব্যবহার করে চীনের জিনজিয়াং প্রদেশ যুক্ত হতে চায় আরব সাগরের সঙ্গে, যার ফলে ইরান ও মধ্যপ্রাচ্যের ওপর চীনের প্রভাব বাড়বে। তাই এ আক্রমণে নাখোশ চায়নাকে সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে কাকারের তত্ত্বাবধায়ক সরকার।

জুলাই মাসে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ লাভের চুক্তি করে ঋণখেলাপি হওয়া থেকে অল্পের জন্য বেঁচে যায় পাকিস্তান। সেইসঙ্গে সম্ভাব্য বড় অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়। তবে ভবিষ্যতে কী হবে এমন আশঙ্কা তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অর্থনৈতিকভাবে চাপে রেখেছে। দেশটিকে আগামী চার-পাঁচ বছরের মধ্যে ৮০ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হবে, অর্থাৎ গড়ে বছরে প্রায় ১৫ থেকে ২০ বিলিয়ন ডলার বা মাসে ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি। অথচ আইএমএফ ঋণ দিয়েছে মাত্র ৩ বিলিয়ন। চীন, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ ও স্বল্পমেয়াদি ঋণ দিতে আগ্রহী, তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে সাধারণত কোনো দেশ বা সংস্থা চুক্তিতে আবদ্ধ হতে চায় না।

পাকিস্তানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রেখে একটি নির্বাচন আয়োজনে নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করা। সাংবিধানিকভাবে বিগত সংসদ ভেঙে দেওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে আরেকটি নির্বাচন আয়োজনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে চলতি বছর জুলাই মাসে কোনো এক অদৃশ্য ইশারায় যেন বিদায়ী শাহবাজ সরকার আইন সংশোধন করে নির্বাচনে সহায়তা ও রুটিন ওয়ার্কের বাইরে গিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে যে কোনো বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দিয়েছে। অন্যদিকে মে মাসে এ সরকার নতুন জনসংখ্যা জরিপ অনুমোদন করেছে। এ জরিপ অনুসারে দেশের বহু স্থানে আগের নির্বাচনী এলাকার সীমানা পরিবর্তন প্রয়োজন হয়ে পড়েছে, যা নির্বাচন-পূর্ববর্তী ৯০ দিন বা বর্তমানে তারও কম সময়ে সম্ভব নয়। ফলে এ অজুহাতে নির্বাচন পিছিয়ে যেতে পারে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ বাড়তে পারে বলে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। তবে এ মেয়াদ কত দিন বাড়বে সেটাই প্রশ্ন। পাকিস্তান নির্বাচন কমিশনের একজন সাবেক কর্মকর্তার মতে, ২৪ কোটি ১০ লাখ মানুষের দেশে শত শত জাতীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনর্বিন্যাস করতে কমপক্ষে ছয় মাস সময় প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমান সংবিধানের আলোকে ১০ নভেম্বর তথা ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন দেওয়া ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। এ মুহূর্তে দেখার বিষয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার কোন পথে হাঁটে। তবে গুঞ্জন রয়েছে যে, সেনা সমর্থিত হয়ে এ সরকার তার মেয়াদ দীর্ঘায়িত করবে এবং সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করবে। সে ক্ষেত্রে একদিকে আমেরিকা অন্যদিকে চীনকে কীভাবে জনগণের ম্যান্ডেটবিহীন এ সরকার মোকাবিলা করবে সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।

পাকিস্তানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আরেকটি চ্যালেঞ্জ হলো সে দেশের নতুন রাজনৈতিক প্লাটফরম ‘পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ’ (পিটিআই) প্রধান ও সাবেক ক্রিকেট তারকা ইমরান খানের বিষয়ে যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তাঁর প্রতি সুবিচার নিশ্চিত করা। নির্বাচনে জয়ী হয়ে ১৮ আগস্ট ২০১৮ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী হন। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির শেষে অর্থাৎ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুর দিকে ইমরান খান রাশিয়া সফর করেন, যা রাশিয়াকে কোণঠাসা করতে চাওয়া পশ্চিমারা মেনে নিতে পারেনি। এ সফরের ২ মাসেরও কম সময়ে (১০ এপ্রিল ২০২২) সংসদে আস্থা ভোটে হেরে বিদায় নেন ইমরান। এরপর প্রায় শতাধিক মামলার জালে আটকা পড়েন তিনি। বিদেশি রাষ্ট্র থেকে উপহার হিসেবে প্রাপ্ত মূল্যবান সামগ্রী রাষ্ট্রের তোশাখানায় জমা না দেওয়ার এক মামলায় বন্দি থাকা অবস্থায় তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের গোপনীয় তথ্য ফাঁস করার মামলা তথা রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের করা হয়, যার শাস্তি ১৪ বছরের কারাদন্ড থেকে মৃত্যুদন্ড পর্যন্ত যে কোনো কিছু হতে পারে। এ অভিযোগের প্রেক্ষাপটে জানা যায়, ইমরান খান আমেরিকার পাঠানো একটি গোপনীয় তারবার্তা জনসম্মুখে প্রকাশ করে দেন। অন্যদিকে ইমরান খানের দাবি, রাশিয়া ভ্রমণের পরপরই আমেরিকা পাকিস্তানের সেনা কর্তৃপক্ষকে একটি তারবার্তায় সংসদীয়ভাবে তাকে হটানোর পরামর্শ বা নির্দেশনা দেয়। ফলে এ কথা বলাই যায়, পাকিস্তানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপের ওপর তীক্ষè নজর রাখছে আমেরিকা, রাশিয়া ও চীন, যার মাঝে বন্দি হয়ে ত্রিশংকুল অবস্থায় আছে তারা।

পাকিস্তানের প্রাকৃতিক দুর্যোগ একটি নৈমিত্তিক ঘটনা। ২০২২ সালের বন্যার পর পাকিস্তানের দুর্বল অর্থনীতি আরও দুর্বল হয়ে যায়। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এমনটা ঘটেছে বলে প্রমাণ করতে পারলে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইতে ৩০ ডিসেম্বর ২০২৩ থেকে শুরু হতে যাওয়া ২৮ তম কনফারেন্স অব দ্য পারটিস (সিওপি ২৮) তথা বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন থেকে বড় অংকের ফান্ড পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকায় কে এ সভায় যোগ দেবেন এবং তাদের কথার মূল্যায়ন বিশ্ব নেতারা কীভাবে করবেন সেটাও প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর পশ্চিমারা এ জলবায়ু ফান্ডের মূল জোগানদাতা হওয়ায় তাদের ইচ্ছা- অনিচ্ছার ওপর পাকিস্তান চলছে কি না সেটি যেমন প্রশ্ন তেমনি প্রশ্ন পাকিস্তানে বন্দর ও সড়ক বানিয়ে চীন আরব সাগরের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পথে যেসব বাধা সৃষ্টি হচ্ছে তা নিরসনে পাকিস্তানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কী ভূমিকা পালন করে।

সার্বিক বিচারে বলা চলে ভালো নেই পাকিস্তান, ভালো নেই পাকিস্তানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার। আসলে গণতন্ত্রের বিকল্প কেবল গণতন্ত্রই হতে পারে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা অন্য কিছু নয়। আর গণতন্ত্রের প্রাণ সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে গণতান্ত্রিক সরকারকেই সব করতে হবে, নইলে ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে আমাদের সবাইকে।

শেষ করব দুটি বাণী দিয়ে। ২০১৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি  থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত একটি বিতর্কিত নির্বাচনের প্রেক্ষিতে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক লিখেছিলেন- নির্বাচনেই যদি দুর্নীতি হয় তবে নির্বাচননির্ভর গণতন্ত্র হয় প্রতারণা। অন্যদিকে সক্রেটিস বলেছেন, কোন ধরনের মানুষ ভোট দেয় সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ হলো- কোন ধরনের মানুষ ভোট গণনা করে। 

                   লেখক : গবেষক বিশ্লেষক ও কলামিস্ট।

Email: [email protected]

সর্বশেষ খবর