শনিবার, ২৬ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

ফিলিপিন্সের কৃষি ও কৃষক

শাইখ সিরাজ

ফিলিপিন্সের কৃষি ও কৃষক

কৈশোরে কোথাও পড়েছিলাম ফাঁসির দড়ি তৈরি হয় ম্যানিলা রোপ দিয়ে। ম্যানিলা ফিলিপিন্সের রাজধানী। সেখান থেকে সংগ্রহ করা হয় বলে দড়ির নাম ‘ম্যানিলা’। এই দড়ির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি কোমল অথচ শক্ত। ম্যানিলা দড়ি তৈরি হয় অ্যাবাকা নামক এক ধরনের কলাগাছ জাতীয় গাছের বাকল থেকে প্রস্তুতকৃত তন্তু দিয়ে। শুধু ফাঁসির দড়ি নয়, অ্যাবাকার তন্তু দিয়ে তৈরি হয় কাপড়, বস্তা, কারুপণ্য। এসবের ব্যাপক চাহিদা পৃথিবীজুড়ে। ফিলিপিন্সের অর্থকরী ফসলের একটি অ্যাবাকা। পৃথিবীর মোট চাহিদার শতকরা ৮৬ ভাগ অ্যাবাকার জোগান দেয় ফিলিপিন্স।

কৃষিপ্রধান ফিলিপিন্সের কৃষি ও কৃষকের জীবনমান দেখার সুযোগ হয়েছে একাধিকবার। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা কেন্দ্র ইরির সদর দফতর লাসবানোসে ধান গবেষণার ওপরে একাধিক প্রতিবেদন তুলে ধরেছি। গত বছর আগস্টে আবারও সেখানে যাওয়ার সুযোগ হয়।

অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাহাড়, সমুদ্র আর বনভূমি, তার ফাঁকে ফাঁকে সবুজ সমতল। মোট ৭ হাজার ৬৪৩টি দ্বীপবেষ্টিত দেশ ফিলিপিন্স। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৈরী আবহাওয়া মোকাবিলা করেই ফিলিপিন্সের প্রায় ১২ কোটি মানুষ নিজেদের অর্থনীতিকে এশিয়ার মধ্যে সুসংহত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আমার দেখার আগ্রহ ছিল সে দেশের কৃষি ও কৃষক রাষ্ট্রের কাছ থেকে কতটা সুযোগ পাচ্ছে? কেমন আছেন সেখানকার কৃষক?

রাজধানী ম্যানিলা থেকে ছুটে গেলাম সর্বউত্তরের প্রদেশ ইলোকোস নর্তের পিদিগ জেলায়। গাড়িতে করে চলেছিলাম এক শহর থেকে আরেক শহরে। মাঝেমধ্যে গ্রামে থামছিলাম। সেখানকার কৃষকের সঙ্গে কথা বলছিলাম। পথের দুই পাশজুড়ে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি সৌন্দর্য আর গ্রামীণ অবকাঠামো দেখে বোঝা যায় বৈশ্বিক উন্নয়নের ছোঁয়া ভালো মতোই লেগেছে ওখানকার কৃষকের জীবনেও।

একটা গ্রামে এসে থামলাম আমরা। গ্রামের নাম আবুকায়। মাঠজুড়ে ধান আর ধান। বলে রাখি এ অঞ্চলটি মূলত ধান চাষের জন্য প্রসিদ্ধ। ফসল বৈচিত্র্য খুব একটা চোখে পড়ল না। কৃষকের বর্তমান অবস্থা ও সরকার কর্তৃক কী ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় সেসব বিষয়ে জানতে ফিলিপিন্স ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক মাঠ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হলো। তিনি জানালেন, এ অঞ্চলের মূল সমস্যাই ছিল খরাপ্রবণতা। তাই ইরি আর ফিলরাইস খরাসহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। সেই ধান চাষ করে কৃষক উপকৃত হচ্ছেন।

অ্যালান নামের এক কৃষকের সঙ্গে কথা হলো। বাংলাদেশ থেকে গেছি শুনে আনন্দিত হলো সে। কারণ সে আট বছর ছিল কোরিয়াতে। সে যেখানে কাজ করত তার বস ছিল বাংলাদেশি। জানতে চাইলাম, কৃষি কেমন লাভজনক? বলল, কৃষি লাভজনক। তবে এই অঞ্চল ধান প্রধান। ধানে তেমন লাভ নেই। সরকারের নানা রকম সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কারণে কৃষক ধান চাষ করে। তবে এখানেও কৃষকের লাভ প্রাপ্তির বড় বাধা হচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগী।

আগস্টের প্রচ- গরম। ঘামে ভিজে যাচ্ছি। জানা গেল এই অঞ্চলে এর চেয়েও বেশি গরম পড়ে। ওখানকার আবহাওয়াই ওরকম। বিশ্রাম নেওয়ার জন্য ছায়ায় দাঁড়ালাম। ফিলিপিন্সে মোটরসাইকেলকে বিশেষভাবে অতিরিক্ত একটা চাকা লাগিয়ে ট্রাইসাইকেল বানিয়ে সেটা দিয়ে পরিবহন ও ছোট ব্যবসা-বাণিজ্যের মোবাইল স্টোর হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আমাদের দেশে যেমন ভ্যান। ফিলিপিন্সে তেমনই মটোরাইজড ট্রাইসাইকেল। পণ্য বহনকারী ট্রাইসাইকেলকে বলা হয় ‘গারং’। নানান পদের, হরেক রকমের পণ্যে ভরা একটা গারং এসে দাঁড়াল আমাদের সামনে। বিক্রেতা এক নারী। এলাকার কয়েকজন নারী এসে নানান জিনিস দেখতে শুরু করল। সংসারের নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র। ঝাড়ু থেকে শুরু করে রান্নার পাতিল। আমিও এগিয়ে গেলাম। এক জোড়া স্যান্ডেলের দাম জানতে চাইলাম। বলল, ৫০ পেসো। মানে আমাদের দেশের ১০০ টাকা। একটা ফুলদানির দাম জানতে চাইলাম। বলল, ‘৫০ পেসো। আমার দোকানের যাই কেন না কেন, সবকিছু ৫০ পেসো করেই।’ অর্থাৎ ১০০ টাকার দোকান। কথা বলে জানতে পারলাম, গারংয়ের দাম ৫০ হাজার পেসো, দোকানে পণ্য আছে আরও ৫০ হাজার পেসোর। সব মিলে ২ লাখ টাকা বিনিয়োগ। বেচাবিক্রি ভালো। দিনে লাভ থাকে ১ হাজার টাকা।

আর এক গ্রামের এক ছোট্ট দোকানে গেলাম। মুদি দোকান। দোকানের বেচাকেনা দেখে বোঝার চেষ্টা করলাম সেই এলাকার কৃষকের অর্থনৈতিক অবস্থাটা। দিবা নামের মধ্যবয়সী এক নারী দোকানটি চালান। দোকানটি পণ্যে ঠাসা নয়। আবার কমও বলা যাচ্ছে না। কোল্ড ড্রিংকসের কয়েকটি ক্যারেট আছে। জানতে চাইলাম, দিনে কয়টি কোল্ড ড্রিংকস বিক্রি হয়? জানালেন, হাফ ক্যারেট। মানে বারোটার মতো। খুব একটা বেশি নয়। দিবা বললেন, এ অঞ্চলের বড় ও মাঝারি কৃষক বেশ ভালো আছে। কিন্তু প্রান্তিক কৃষক শুধু কৃষি করে টিকে থাকতে পারছে না। কৃষিকাজের পাশাপাশি শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে হচ্ছে। অথবা ছোটখাটো ব্যবসার ব্যবস্থা করতে হচ্ছে।

অ্যালভিস নামের এক কৃষকের সঙ্গে কথা হলো। তিনি খরাসহিষ্ণু ধান চাষ করেছেন দুই হেক্টর জমিতে। নিজের জমি দেখিয়ে বললেন, দেখুন, এই ধান খেতে এখন পানি আছে। কারণ দুই দিন আগে বৃষ্টি হয়েছে। অথচ এর আগে এক মাস ছিল বৃষ্টিহীন। কিন্তু সেচ ছাড়াই ধানগাছগুলো দিব্যি বেঁচে ছিল। এর আগে অনাবৃষ্টিতে ফসলহানি হতো। তিনিও বললেন, ধানে লাভ নেই। কিন্তু সরকার বীজ দিচ্ছে, সার দিচ্ছে। এমনকি নির্দিষ্ট দামে ফসল কিনেও নিচ্ছে। তাই তারা ধান চাষ করছেন। তবে এখানকার কৃষকের মূল অর্থনৈতিক শক্তি রেমিট্যান্স। প্রত্যেকটি পরিবারের কেউ না কেউ দেশের বাইরে আছে। সেখান থেকে পাঠানো অর্থেই তারা ভালো থাকছেন। তৈরি করছেন পাকা বাড়ি। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে ডিজেলের দাম বেড়েছে। সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে বলে রেহাই।

রাস্তার পাশে সবজির দোকান পেলাম একটা। লোলিটা নামের এক ভদ্রমহিলা বেচাবিক্রি করছেন। দোকানে চিচিঙ্গা, ঝিঙা, লাউ, চালকুমড়া, বরবটি, আলু, পিঁয়াজ, রসুন, আদা বিক্রি করছেন তিনি। কৃষির পাশাপাশি ছোটখাটো দোকানটিই এখন তার আয়ের প্রধান উৎস। কথা বলে জানলাম, একসময় হংকংয়ে কাজ করতেন তিনি। সেই টাকা দিয়ে তার ছেলেকে ম্যানিলা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াচ্ছেন। সব মিলে ভালো আছেন। তবে আরও ভালো থাকার প্রত্যাশা ধরা পড়ে তাদের কণ্ঠে।

কথা হলো টেরেসিটা নামের একজন বর্গাচাষির সঙ্গে। ১ হেক্টর জমিতে খরাসহিষ্ণু ধান চাষ করছেন। তিনি বললেন, ফিল রাইস তাকে বীজ দিয়েছে। একজন নিবন্ধিত কৃষক হওয়ার পরও কখনো ব্যাংক থেকে ঋণ সুবিধা নেননি তিনি। তার লাভের টাকাই আবার তার জমিতে বিনিয়োগ করেন। যদি তিনি ঋণ নিতেনও, তাহলেও তার ০% হারে সুদ হতো। অর্থাৎ ফিলিপিন্সে কৃষককে নানা রকম সুযোগ-সুবিধা দেয় সরকার। তবে তাকে নিবন্ধিত হতে হয়। একজন নিবন্ধিত কৃষককে বিনা সুদে ঋণ দেয়, শস্যবীমার আওতায় আনে, সার-বীজ-কীটনাশক সব ফ্রি। কৃষিবীমার জন্য প্রতি বছর ১০০ পেসো, অর্থাৎ বাংলাদেশি টাকায় মাত্র ১৬৭ টাকা প্রিমিয়াম দিতে হয় তাকে। বিনামূল্যে চিকিৎসা সুবিধাও পাচ্ছেন তিনি।

যা হোক এবার ফেরার পালা। ফেরার পথে আবার দেখা হলো কৃষানি টেরেসিটার সঙ্গে। তিনি অনুরোধ করলেন তার বাড়িতে যাওয়ার। খুব সুন্দর আর গোছানো একটি বাড়ি। ঘরগুলো শহরের বাড়ির মতো আসবাবপত্রে সাজানো। সোফা আছে। ফ্রিজ আর ওয়াশিং মেশিন আছে। ওর কাছে জানতে চাইলাম, দেশের বাইরে কে থাকে আপনার? বললেন, কেউ থাকে না। কৃষিই একমাত্র আয়ের উৎস। বললাম, অন্য কৃষক যে বললেন শুধু কৃষি দিয়ে বাড়ি বানানো সম্ভব না! টেরেসিটা জানালেন, সে তার উৎপাদিত কৃষিপণ্যকে প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে শিল্পপণ্য হিসেবে বিক্রি করে। আমাদের কলার চিপস খেতে দিলেন। তিনি কলা বিক্রি না করে কলার চিপস বিক্রি করেন। তিনি একজন রাষ্ট্রীয় সম্মাননাপ্রাপ্ত কৃষানি। বুঝলাম সৃজনশীল চিন্তার জন্যই হয়তো অন্যদের থেকে কিছুটা ভালো রয়েছেন তিনি।

কৃষানি টেরেসিটা প্রমাণ করেছেন কৃষিতে উৎপাদন ও বিপণন দুই-ই জরুরি। এ বিষয়ে অত্যন্ত সজাগ হতে হবে কৃষককে। তা না হলে আগামী দিনে কৃষিতে টিকে থাকা কঠিন হয়ে উঠবে। তবে ফিলিপিন্স সরকার কৃষককে যেভাবে সুরক্ষা দিয়ে আসছে সেটা অনুসরণীয় হতে পারে আমাদের কৃষকের জন্যও। আগামী দিনে পৃথিবীতে মানুষের খাদ্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা হবে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জের। সেটি জোগানে নিরলস শ্রম ও মেধা বিনিয়োগ করে যাচ্ছে যারা তাদেরই রাখতে হবে রাষ্ট্রের নীতি পরিকল্পনার শীর্ষে।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

[email protected]

সর্বশেষ খবর