শনিবার, ২৬ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

কানাডার স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা

তপন কুমার ঘোষ

কানাডার স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা

শান্তির দেশ কানাডা। আয়তনের দিক দিয়ে কানাডা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম। প্রথম রাশিয়া। কানাডা বাংলাদেশের ৬৭ গুণ। সরকারি সংস্থা ‘পরিসংখ্যান কানাডা’র হিসাব অনুযায়ী কানাডার জনসংখ্যা ৪ কোটি (জুন ২০২৩)। অভিবাসীদের স্বাগত জানায় দেশটি। এ জন্য বলা হয়, কানাডা অভিবাসীদের দেশ। কানাডার তিন দিকে সমুদ্র। পূর্বে আটলান্টিক, পশ্চিমে প্রশান্ত আর উত্তরে আর্কটিক মহাসাগর। কানাডার দক্ষিণে যুক্তরাষ্ট্রের স্থলসীমান্ত। ১০টি প্রদেশ ও ৩টি অঞ্চল নিয়ে কানাডা। শীতের দেশ। দেশটির বেশির ভাগ এলাকা সারা বছর বরফের নিচে ঢাকা থাকে। এখানকার আবহাওয়া খুবই খেয়ালি। মতিগতি বোঝা দায়। এই রোদ, এই বৃষ্টি! স্বপ্নের দেশ কানাডা। এখানে এসে ঘাঁটি গাড়তে পারলেই যেন কেল্লাফতে। কানাডা বহু সংস্কৃতির দেশ। উদার দেশ হিসেবে জগৎজোড়া যার খ্যাতি আছে। ঘৃণা বা বিদ্বেষকে প্রশ্রয় দেয় না দেশটি। সমাজে অপরাধপ্রবণতা কম। সবাই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রচলিত আইন-কানুন পরিপালনে ব্যত্যয় হলে কোনো ছাড় নেই। নারী-পুরুষ স্বাধীনভাবে চলাফেরা করছে। কেউ কারও দিকে ফিরেও তাকায় না। সবাই যার যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার সঙ্গে মানবিক আচরণ করে রাষ্ট্র, এ কথা সর্বজনবিদিত। কিছুটা রক্ষণশীল সামাজিক পরিবেশ থেকে উঠে এসে একেবারে উন্মুক্ত সমাজে প্রবেশ প্রবাসী বাংলাদেশিদের। সম্পূর্ণ ভিন্ন সংস্কৃতি। মানিয়ে নিতে কষ্ট হয়। নতুন পরিবেশে আসার পর কালচারাল শক কাটিয়ে উঠতে একটু সময় লাগে। কিন্তু বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম অনেক স্মার্ট। সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে খুব একটা সময় লেগেছে বলে মনে হয়নি আমার। তবে এর পাশাপাশি যার যার ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ধরে রাখার চেষ্টাও আছে। নইলে ‘আইডেনটিটি’ হারিয়ে যাবে যে-এটা প্রবাসীরা ভালো করেই জানেন।

কানাডা অন্যতম ধনী দেশ। প্রতি বছর লাখ লাখ চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে কানাডায়। এখানে শ্রমের মর্যাদা আছে। পরিশ্রমী লোকের কাজের অভাব হয় না। একটা না একটা কাজ জোগাড় হয়েই যায়। তবে কষ্টার্জিত আয়ের একটা বড় অংশ ট্যাক্স পরিশোধে ব্যয় হয়ে যায়। সব মিলিয়ে ট্যাক্স প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশে গিয়ে দাঁড়ায়। উচ্চ করহার অনেককে পীড়া দেয়। যাক, সে কথা। কানাডার বড় শহরগুলোতে কাজের সুযোগ বেশি। কিন্তু একই সঙ্গে ব্যয়বহুল। বড় শহরগুলোর অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর সীমান্তের কাছাকাছি। জনসংখ্যার বিচারে সবচেয়ে বড় শহর টরন্টো, অন্টারিও প্রদেশের রাজধানী। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে মন্ট্রিয়াল। এটি কুইবেক প্রদেশে। উল্লেখ্য, অটোয়া কানাডার রাজধানী হলেও শীর্ষ তিনে নেই। জীবিকার প্রয়োজনে অনেকে বড় শহর থেকে ছোট শহরে মাইগ্রেট করেছেন। কলরবমুক্ত নিরিবিলি পরিবেশ যারা পছন্দ করেন, তারা ছোট শহর বেছে নিয়েছেন। স্বপ্নের দেশে আশাভঙ্গের বেদনাও আছে। পছন্দের চাকরি পাচ্ছেন না অনেকে। ভালো চাকরি জোগাড় করতে হলে কানাডার ডিগ্রি থাকতে হবে। সেই সঙ্গে থাকতে হবে কানাডিয়ান অভিজ্ঞতা। আর ওয়ার্ক পারমিট না থাকলে তো কোথাও কাজ মিলবে না। ফিবছর জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে। অভিবাসীদের চাপে আবাসন সমস্যা দিনকে দিন প্রকট হচ্ছে। এসব সত্ত্বেও আছে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের স্রোত। জীবনের নিরাপত্তা, উন্নত জীবনমান, বিশ্বমানের শিক্ষাব্যবস্থা, উন্নত স্বাস্থ্যসেবা ও বিবিধ সামাজিক নিরাপত্তা নেটওয়ার্কের হাতছানি আছে।

এবার মূল প্রসঙ্গ। কানাডার স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা। মানুষের মৌলিক পাঁচটি চাহিদার অন্যতম হচ্ছে চিকিৎসা। এ দেশে তিন স্তরের সরকার পদ্ধতি বিদ্যমান- ফেডারেল, প্রাদেশিক ও আঞ্চলিক। স্বাস্থ্যসেবা দেখভালের দায়িত্ব প্রাদেশিক সরকারের। সব প্রদেশের নিয়ম-কানুন আবার এক নয়। হেলথ কার্ড থাকলে হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা ফ্রি। এমনকি ওষুধ ও পথ্যও। কানাডার নাগরিক বা কানাডায় স্থায়ীভাবে বসবাসকারী ইমিগ্র্যান্টরা এই সুবিধা পান। প্রত্যেকের জন্য জেনারেল ফিজিশিয়ান (ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান) নির্দিষ্ট করা আছে। রোগীকে পরীক্ষা করে ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান ব্যবস্থাপত্র দেন। ব্যবস্থাপত্র রোগীর পছন্দের ফার্মেসিতে অনলাইনে চলে যায়। ডায়াগনস্টিক রিপোর্ট ল্যাব থেকে সরাসরি যাবে ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানের কাছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ দরকার হলে ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানই বিশেষজ্ঞের কাছে রেফার করবেন। চিকিৎসার যাবতীয় বিল পরিশোধ করবে প্রাদেশিক সরকার। কেউ গুরুতর অসুস্থ হলে বা রোগীর মৃত্যুর আশঙ্কা থাকলে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া বা ওয়াক-ইন কিননিকে ডাক্তার দেখানোর সুযোগও আছে। ভ্রমণ ভিসায় যারা আসেন তাদের থাকতে হবে স্বাস্থ্যবীমা। এখানে দাঁতের চিকিৎসার খরচ এতটাই বেশি যা শুনলে আপনার চোখ কপালে উঠবে। ওয়ার্ক ইন্স্যুরেন্স বা প্রাইভেট বীমা পলিসি না থাকলে আপনার সঞ্চয় শেষ হওয়ার জোগাড়। এ দেশে শিশুদের অধিকার সবার আগে। একটা উদাহরণ দিই। পৌত্র সায়ন্তন ঘোষের বয়স এক মাস পেরোনোর আগেই কানাডা পোস্টের মাধ্যমে বাসায় পৌঁছে গেছে তার হেলথ কার্ড। শিশু কীভাবে বেড়ে উঠছে তা সরকারি সংস্থা কর্তৃক রুটিন মাফিক ফলোআপ করা হচ্ছে। এবার মুদ্রার অপর পিঠ।

কানাডায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ পেতে বা সার্জিক্যাল অপারেশনের জন্য অপেক্ষা করতে হতে পারে মাসের পর মাস। ওয়েটিং লিস্টে আপনার নাম উঠবে। কবে নাগাদ ডাক পড়বে বলা মুশকিল। আমার পরিচিত একজন বাংলাদেশি-কানাডিয়ানের পাকস্থলীর অস্ত্রোপচারের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে পাঁচ থেকে ছয় মাস। স্পষ্টতই, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও নার্সের স্বল্পতা আছে এ দেশে। এটা কানাডার স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার দুর্বল দিক। এ দিকটায় মনোযোগ দিতে হবে।

(হ্যালিফ্যাক্স, নোভা স্কোশিয়া, কানাডা থেকে)

লেখক : সাবেক পরিচালক পরিচালনা পর্ষদ, বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন

সর্বশেষ খবর