সোমবার, ২৮ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

বাবার স্মৃতি ও আমাদের জীবনে আগস্ট মাস

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান

বাবার স্মৃতি ও আমাদের জীবনে আগস্ট মাস

আমার বাবা কেবল আমার জন্মদাতা বাবা নন। তিনি আমার শিক্ষক, পথপ্রদর্শক এবং পথচলার আদর্শ বন্ধু। আমার জন্মের সময় বাবার কী অনুভূতি ছিল তা আমি জানি না। কোনো সন্তান বোধহয় তা অনুভব করতে পারে কেবল যখন সে নিজে একজন সন্তানের পিতা হয়ে ওঠে। হাঁটি হাঁটি পা পা করে সন্তান যখন শৈশব পেরিয়ে বেড়ে উঠতে থাকে সেই সময়ের বাবা-মার অনেক স্মৃতি সন্তানের মনোজগতে চিরকাল স্থিত থাকে। যে সন্তানদের এসব স্মৃতি কখনো বিস্মৃত হয় না তারা সাধারণত বেশ প্রখর স্মৃতিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে। সময়ের আবর্তে সন্তান বড় হয়ে ওঠার পরও বাবার স্মৃৃতি তার মনে স্থান করে নেয়। আজ বাবাকে নিয়ে কিছু কথা বলব বলেই কলম সচল করছি। কথা বলব কীভাবে আমাদের জীবনের বাবার বেশ কিছু স্মৃতি অবিচ্ছেদ্যভাবে মিশে আছে।

আমি এবং আমরা ভাইবোনেরা বাবা-মার কঠোর অনুশাসনে বড় হয়েছি। আমরা তিন ভাই। তিনজনেরই স্কুলজীবন কেটেছে তখনকার গ্রামীণ শহর মোহনগঞ্জে। এটি নেত্রকোনা জেলার একটি উপজেলা শহর। কলেজজীবন আমার কেটেছে ঢাকা ও ময়মনসিংহে। বিশ্ববিদ্যালয়জীবন ঢাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছোট দুই ভাই সাজ্জাদুল হাসান ও সাইফুল হাসানের কলেজজীবন ঢাকায়। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে সাজ্জাদ ছিল ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আর সাইফুল হাসান ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।

বাবা পেশায় ছিলেন চিকিৎসক। ১৯৬৭ সালের শেষে মেডিকেল অফিসারের পদ থেকে পদত্যাগ করে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। ’৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু আমার বাবা ডা. আখলাকুল হোসাইন আহমেদকে নেত্রকোনার তদানীন্তন মোহনগঞ্জ-বারহাট্টা আসনে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে মনোনয়ন প্রদান করেন। বিপুল ভোটে তিনি নির্বাচনে জয়লাভ করেন। ’৭১-এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর অসহযোগ আন্দোলনে স্থানীয়ভাবে নেতৃত্বদান করেন। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার পর স্থানীয়ভাবে ছাত্র-যুবকদের ট্রেনিংয়ের উদ্যোগ নেন। তারপর পাকসেনাদের আনাগোনা বেড়ে গেলে বিভিন্ন গ্রামগঞ্জে কিছুদিন লুকিয়ে থেকে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে তিনি ভারতের মেঘালয় রাজ্যের তুরা জেলার অন্তর্গত মহেশখলা নামক স্থানে আশ্রয় নেন। সেখানে আরও কয়েকজন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ইয়ুথ অ্যান্ড ফ্রিডম ফাইটার্স ক্যাম্প গড়ে তোলেন।

সপরিবারে আমরা মেঘালয়ে পাড়ি জমাই আগস্ট মাসে। বাবা ১৯৭১-এর আগস্ট মাসের শেষের দিক থেকে দেশ শত্র“মুক্ত হওয়া পর্যন্ত এই ক্যাম্পের ইনচার্জের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১-এর নভেম্বর থেকে আব্বা ময়মনসিংহ ও সিলেটের মোট ১১টি (সম্পূর্ণ এবং আংশিক) থানা নিয়ে গঠিত সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কমিটি অব ইস্টার্ন জোন-২ এর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। ১৬ ডিসেম্বর দেশ শত্র“মুক্ত হলেও আমরা দেশে ফিরি ডিসেম্বরের শেষ দিকে। তবে ২২ ডিসেম্বর আব্বা মোহনগঞ্জে উপস্থিত থেকে স্থানীয় রাজাকারদের বিচারের জন্য সংঘটিত গণআদালতের সভাপতিত্ব করেন। আবার আমাদের নিয়ে আসার জন্য তিনি মেঘালয়ের মহেশখলায় ফিরে যান। তিনি স্বাধীন দেশে রিলিফের কার্যক্রম থেকে শুরু করে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে দেশ গড়ার সব কাজেই ব্যস্ত থাকতেন। ১৯৭২-এর ১৪ ডিসেম্বর গণপরিষদ সদস্য হিসেবে সংবিধানে স্বাক্ষর করেন। ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে আবদুল মমিন সাহেবের আসন ও আব্বার আসন একীভূত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু আব্বাকে মনোনয়ন দিতে পারেননি। তবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘ভবিষ্যতে তোমার বিষয়টি দেখব’।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হলে মোহনগঞ্জে আব্বার নেতৃত্বে প্রতিবাদ মিছিল হয়। স্থানীয় লোহিরার মাঠে পড়েন গায়েবানা জানাজা। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ ও জানাজা পড়ার অপরাধে আব্বাকে সেনাক্যাম্পে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীদের সব দোকানপাট বন্ধ করে রাখার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা নীরব প্রতিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে ও পাইলট স্কুলের শিক্ষকদের প্রতিবাদের মুখে আব্বাকে ছেড়ে দিলেও বাসায় অন্তরিন থাকতে হয় তাঁকে প্রায় ১৫-১৬ দিন। ১৯৭৫ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত যতদিন আব্বা বেঁচেছিলেন ততদিন তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে কখনো বিচ্যুত হননি। তিনি আমাদের সর্বদা আত্মমর্যাদা নিয়ে সৎ জীবনযাপনের তালিম দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও দলীয় প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ আব্বা পাননি। আবদুল মমিন ও পরবর্তীতে তাঁর সহধর্মিণী রেবেকা মমিন দীর্ঘ ৫০ বছর আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেছেন। আমার বাবা ও আমাদের পরিবার সব সময়ই (একবার ছাড়া) জাতীয় নির্বাচনে আবদুল মমিন ও রেবেকা মমিনকে সমর্থন দিয়েছেন। সম্প্রতি রেবেকা মমিনের ইন্তেকালে বাংলাদেশ-১৬০, নেত্রকোনা-৪ সংসদীয় আসনটি শূন্য ঘোষিত হলে আমার ছোট ভাই সাজ্জাদুল হাসান আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চায়। ২১ জুলাই সে মনোনয়নপ্রাপ্ত হয়। মনোনয়ন পেয়ে সাজ্জাদ আমার বাসায় আম¥াকে সালাম করতে এলে আমার মা তাঁর অভিব্যক্তি ব্যক্ত করে বলেছিলেন, ‘৫০ বছর আগে বঙ্গবন্ধু তোমার বাবাকে যে আশ্বাস দিয়েছিলেন দীর্ঘদিন পরে তাঁরই কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে তা পূর্ণতা লাভ করল।’ দেখলাম আম্মা আবেগাপ্লুত হয়ে বঙ্গবন্ধু ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও আব্বার জন্য দুই হাত তুলে দোয়া করলেন। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সাজ্জাদ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে ৬ আগস্ট শপথগ্রহণ করে।

আজ ২৮ আগস্ট আব্বার ১১তম মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি বেঁচে থাকলে হয়তো ছেলের সফলতায় আনন্দিত হতেন। আজ থেকে ১১ বছর আগে ২০১২ সালের এই দিনে আব্বা ঢাকায় আমার বাসায় ইন্তেকাল করেন। আজকের দিনটি আমাদের পারিবারিক শোকের দিন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সপরিবারে শাহাদাতবরণ করেন ১৫ আগস্ট ১৯৭৫। সেদিনটি সমগ্র বাঙালি জাতি জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন করে। মাসব্যাপী দোয়া মাহফিল ও আলোচনা সভার মধ্য দিয়ে শোকের মাস আমরা সবাই পালন করি।

জাতীয় জীবনের পাশাপাশি আগস্ট মাসটি আমাদের পারিবারিক জীবনেও ঘটনাবহুল। আর ঘটনাসমূহ সবই জাতির পিতার আদর্শকেন্দ্রিক। ১৯৭১ সালের ১৪ আগস্ট আমার মা-সহ আমরা চার ভাইবোন আমাদের কৈশোরে ও বাল্যকালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া বাবার সঙ্গে মিলিত হতে ভারতের মেঘালয়ে আশ্রয় নিই।

১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট জাতির পিতার হত্যার প্রতিবাদে বাবা হন নিগৃহীত। গৃহে অন্তরিন থাকতে হয় তাঁকে কিছু সময়ের জন্য।

২০১২ সালের ২৮ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক কর্মী তাঁর আদর্শ সৈনিক আমাদের পিতা ডা. আখলাকুল হোসাইন আহমেদের ইন্তেকালের মধ্য দিয়ে আমরা ভাইবোনেরা পিতৃহীন হয়ে পড়ি।

২০২৩ সালের আগস্ট মাসের ৬ তারিখ জাতির পিতার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একজন কর্মী হিসেবে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে আমার ছোট ভাই সাজ্জাদুল হাসান শপথগ্রহণ করে।

আগস্ট মাস শোকের মাস। এ মাসে বাঙালিরা হারিয়েছে আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। হারিয়েছি বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবসহ বঙ্গবন্ধু পরিবারের ১৮ সদস্যকে। এ মাসেই আমরা ভাইবোনেরা হারিয়েছি আমাদের জন্মদাতা প্রিয় বাবাকে। বাবার কোনো স্মৃতিই বিস্মৃত হইনি।

মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে তাঁর পরিবারের শাহাদাতবরণকারী শহীদদের যেন তিনি বেহেশতের সর্বোচ্চ স্থান নসিব করেন আর আমাদের বাবা ডা. আখলাকুল হোসাইন আহমেদকেও যেন তিনি জান্নাতুল ফেরদাউস নসিব করেন। আমিন।  

    

 লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, আপিল বিভাগ, ঢাকা

সর্বশেষ খবর