মঙ্গলবার, ২৯ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

মধ্যবিত্তের বেহাল জীবন

আমিনুল ইসলাম মিলন

মধ্যবিত্তের বেহাল জীবন

আমার অপরাধ- আমি মধ্যবিত্ত। এক মধ্যবিত্ত পরিবারে আমার জন্ম। আমার পিতাও ছিলেন একজন মধ্যবিত্ত। পেশায় শিক্ষকতা। কিন্তু ৫০-৬০ বছরের ব্যবধানে তাঁর এবং আমার আর্থ-সামাজিক অবস্থানে বিস্তর ফারাক। তাঁর সময়ে ইন্টারনেট ছিল না। ডিশ ছিল না। তাঁর কোনো ল্যান্ডফোন ছিল না। মোবাইল ফোনে প্রতি মাসে রিচার্জ করার বাড়তি খরচও ছিল না। নোয়াখালীর মতো জেলা শহরে তখনো (সত্তর দশকে) বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিলও দিতে হতো না। বাসার সিকিউরিটি গার্ডের বেতন বাবদ কোনো খরচ ছিল না। কিন্তু শহুরে জীবনে এবং বর্তমানে সব উপজেলা, জেলা এমনকি অনেক গ্রামে ও আমাকে এসব বাড়তি খরচ বহন করতে হয়। মধ্যবিত্ত বলে এসব খাতের কোনো ব্যয়ভার থেকেই আমি মুক্ত নই। তবুও এভাবেই মোটামুটি ভালোই চলছিল। কিন্তু কভিড-১৯ সবকিছুই তছনছ করে দেয়, অনিশ্চিত হয়ে পড়ে জীবন-জীবিকা। বেসরকারি চাকরিজীবীরা চাকরি হারায় অথবা বেতন কমে যায়, তার পর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ঢেউ এসে লাগে দেশে। চাপ পড়ে জাতীয় অর্থনীতিতে। সরকার দক্ষতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করে। কভিড-১৯ সফলভাবে সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পৃথিবীর প্রথম পাঁচটি দেশের একটি। এটি নিঃসন্দেহে সরকারের একটি বিরাট সাফল্য। ব্যবসা-বাণিজ্যের বিশেষ করে গার্মেন্ট শিল্পে নামমাত্র সুদে সরকারের দেওয়া প্রণোদনা/অনুদান/ঋণ এ শিল্পকে রক্ষা করে। ফলে তৈরি পোশাক খাতটি যেমন মুখ থুবড়ে পড়েনি তেমনি লাখ লাখ গার্মেন্ট কর্মীরও চাকরি রক্ষা পায়। অন্যদিকে সমাজের নিম্নস্তরের মানুষের জন্য তৈরি খাবার থেকে নানা ধরনের খাদ্য, অর্থ সাহায্য দরিদ্র মানুষদের রক্ষা করে। গত ঈদুল আজহায় সরকার ১ কোটি পরিবারকে বিনামূল্যে খাদ্য সহায়তা প্রদান করে। এ ছাড়া টিসিবির মাধ্যমে হ্রাসকৃত মূল্যে সারা দেশে চাল, ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ করা হয়। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি উদ্যোগ, ক্ষেত্রবিশেষে ব্যক্তি উদ্যোগ করোনার সেই নিদানকালে বাংলাদেশের মানুষের প্রাণ রক্ষায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।

কিন্তু আটকে পড়ে শুধু মধ্যবিত্ত শ্রেণি। বাঙালির একটি বৃহত্তম অংশ মধ্যবিত্ত শ্রেণি। কার্ল মার্কসের শ্রেণি সংগ্রাম তত্ত্বের ধারাবাহিকতায় Sznthesis শ্রেণি হিসেবে এটির আত্মপ্রকাশ ঘটে, যা দরিদ্র ও ধনিক শ্রেণির মাঝে ভারসাম্য শ্রেণি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। সমাজবিজ্ঞানীরা এটাকেই মধ্যবিত্ত শ্রেণি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। যারা সাধারণ আয়ে এবং সামাজিক জীবনে মধ্যবিত্ত পর্যায়ে রয়েছেন। এরা সমাজের আয় কাঠামোর মাঝামাঝি স্তরের অন্তর্র্ভুক্ত। এরা শিক্ষিত ও সচেতন একটি সামাজিক গোষ্ঠী। সামাজিক ক্রমবিন্যাসে মধ্যবিত্ত শ্রেণির অবস্থান বুর্জোয়া ও সর্বহারা শ্রেণির মাঝখানে। সাধারণত সুনির্দিষ্ট শ্রেণি হিসেবে প্রাচীন গ্রিস ও রোমেও এটি স্বীকৃতি লাভ করেছিল। ভারতবর্ষে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ইংরেজ আগমনের পর থেকেই শুরু হয়। ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসন শুরু হওয়ার পর ভারতের রাজভাষা ফারসির বদলে ইংরেজি হয়। ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে গড়ে ওঠে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। অফিস-আদালতে স্বল্প ইংরেজি শিখে ‘কেরানিকুল’ নামে এক নব্য কর্মচারী শ্রেণি গড়ে ওঠে। অন্যদিকে ইংরেজদের আনুকূল্যে গড়ে উঠতে থাকে এক নতুন ধনিক ও বণিক শ্রেণি। এর ফলে ধীরে ধীরে নগরায়ণ বৃদ্ধি পেতে থাকে। ঐতিহাসিক এ এফ পোলারড আধুনিক যুগে মধ্যবিত্তের ভূমিকার গুরুত্ব সম্পর্কে বলেছেন, মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও নগরবাসী না থাকলে আধুনিক যুগের অভ্যুদয় হতো না। এবং মধ্যযুগের সঙ্গে আধুনিক যুগের কোনো পার্থক্য বোঝা যেত না। শিল্প-বাণিজ্যের প্রতিষ্ঠা ও প্রসার না হলে মধ্যবিত্তের অথবা শহর-নগরের বিকাশ হতো না এবং তা না হলে রেনেসাঁস বা রিফর্মেশন কিছুই সম্ভব হতো না। তাই বলা যায়, ইংল্যান্ডের মতো ভারত ও বাংলাদেশের ইতিহাসও মধ্যবিত্তের হাতে গড়া।

বর্তমানে সারা বিশ্বে মধ্যবিত্তের সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ ২৮তম অবস্থানে রয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান হবে ১১তম। আগামী এক দশকে বাংলাদেশের মধ্যবিত্তের আকার ৫ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। (সূত্র : দৈনিক বণিক বার্তা, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১)। আমরা সাধারণত মানুষকে ৩ শ্রেণিতে ভাগ করি। ধনী, মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র। বাংলাদেশে বর্তমানে ধনী বা কোটিপতির সংখ্যা কত তার সঠিক পরিসংখ্যান জানা যায় না। পাকিস্তান আমলে যখন ২২ পরিবার বলা হতো তখন এ স্বাধীন বাংলাদেশে ২০২৩ সালে কত হাজার ২২ পরিবার আছে তার হিসাব কে রাখে। মধ্যবিত্ত শ্রেণি আবার মোটা দাগে চার ভাগে বিভক্ত। উচ্চ মধ্যবিত্ত-মধ্যবিত্ত-মধ্য-মধ্যবিত্ত ও নিম্নœ মধ্যবিত্ত। কোনো কারণে নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণি নিচে নামলে তা দরিদ্র শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে। আবার এ দরিদ্র শ্রেণি যদি আরও পিছিয়ে পড়ে তখন তার অবস্থান হয় দারিদ্র্যসীমার নিচে। সরকার দরিদ্রদের জন্য বহুমুখী কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি বা সোশ্যাল সেফটি নেটওয়ার্কের আওতায় কাজের বিনিময়ে খাদ্য, দুস্থ ভাতা, স্বামী পরিত্যক্তা ভাতা, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, হিজড়া-বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের জন্য ভাতা, দরিদ্র মায়েদের জন্য মাতৃত্বকাল ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতাসহ বিভিন্ন খাতে সরকারি সহায়তা ছিল উল্লেখযোগ্য। কভিড-১৯ এর ক্ষয়ক্ষতির মোকাবিলায় সরকার কর্তৃক ঘোষিত ২৮টি প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় উপকারভোগীর সংখ্যা ৭ কোটি ৬৬ লাখ। এ খাতে স্বল্প সুদে ঋণ/প্রণোদনাসহ বিভিন্ন সহায়তা প্রদানে মোট ব্যয় হয় ২ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া দরিদ্র জনগোষ্ঠী আবহমানকাল থেকেই বিভিন্নভাবে অপেক্ষাকৃত সচ্ছল মানুষ বা ধনীদের কাছ থেকে জাকাত, ফিতরা, সদকাসহ বিভিন্ন উপলক্ষে আর্থিক সহায়তা পেয়ে থাকে। অবস্থা খুবই সঙ্গিন হলে তারা অপরের কাছ থেকে চেয়ে নিতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে মধ্যবিত্ত শ্রেণির। তারা না পারে বলতে না পারে সইতে। এদের একটি বিরাট অংশ অবসরপ্রাপ্ত সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী, সাংবাদিক, ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ী, প্রবাসফেরত অবসর গ্রহণকারী, শিক্ষক, ব্যাংক, বীমা বা অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত সীমিত আয়ের মানুষ। সুনির্দিষ্ট আয়ে সুনিপুণ পরিকল্পনা ও বাজেটে এদের সংসার চলত। এদের মধ্যে অনেকে আবার নতুন সংসার পেতেছে। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চাকরিজীবী। সীমিত আয়ে কষ্টকর জীবনযাপন। সাধ-আহ্লাদ সবই আছে-নেই কেবল অর্থ। ইদানীং মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেকেই সন্তানদের ইংরেজি মিডিয়ামে পড়ান বা উন্নত জীবনের আকাক্সক্ষায় পড়াতে বাধ্য হচ্ছেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে না টিকলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে হয়। বিয়েশাদি, জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী, বেড়াতে যাওয়াসহ নানাবিধ অনুষঙ্গ-অনুষ্ঠানের বাড়তি খরচ জোগাতে মধ্যবিত্তের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। কিন্তু যেহেতু মধ্যবিত্তের আত্মসম্মানবোধ খুবই টনটনে, শিক্ষা-দীক্ষা-রুচিতে মধ্যবিত্ত যেহেতু একটু উন্নততর অবস্থানে, তাই যত কষ্টই হোক এসব আনুষ্ঠানিকতা তাদের পালন করতে হয়। এদের অনেকে ফ্ল্যাটে থাকেন। বেশির ভাগই ভাড়া বাড়িতে। তবে চাকরিজীবীরা অবসর গ্রহণের পর মাথা গোঁজার একটি ব্যবস্থা করেন, যার বেশির ভাগই রাজধানীতে, এরপর বিভাগীয় শহর বা জেলা শহরে। এদের কারও কারও সন্তান বিদেশে পাড়ি জমালে এদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটে। এরা তখন উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে উপনীত হয়। কিন্তু যারা বিদ্যমান অবস্থাও টিকিয়ে রাখতে পারে না তাদের অবনতি ঘটে নিম্নবিত্ত পরিবারে। অনেকে শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যায়। করোনা মহামারির সময় এরকম বহু ঘটনা ঘটেছে। দিন দিন এর সংখ্যা বাড়ছে। মধ্যবিত্তের জন্য সরকারের তেমন কোনো প্রণোদনা নেই। মধ্যবিত্ত সাধারণত পেনশনের টাকা বা সঞ্চিত অর্থে সঞ্চয়পত্র কিনে সংসার চালাত। এরশাদ জমানায় স্থায়ী আমানতে পাঁচ বছরে টাকা দ্বিগুণ হতো। ২০২০ সাল পর্যন্ত সোনালী ব্যাংকে ছয় বছরে টাকা দ্বিগুণ হতো। এখন আর সেসব সুযোগ নেই। সঞ্চয়পত্রের মুনাফা/লভ্যাংশ দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। এর সরাসরি প্রভাব অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবীদের যাদের ৮০% মধ্যবিত্ত, তাদের ওপর পড়ছে। তাই সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার বাড়ানো প্রয়োজন। এ খাতে সঞ্চয়পত্রের ওপর করারোপ বিলোপ বা হ্রাস করা অতি জরুরি। এ ছাড়া মধ্যবিত্তদের জন্য পুনরায় নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য বিশেষ করে চাল, ডাল, পিঁয়াজ, রসুন, আদা, চিনি, আটা, ময়দা, ভোজ্য তেল প্রভৃতি অতিপ্রয়োজনীয় পণ্যের রেশনিং পদ্ধতি চালু করা প্রয়োজন। এখন বাংলাদেশে সবকিছুই ডিজিটালাইজড। ১৯৭২-৭৫ সালের মতো রেশন নিয়ে কেলেঙ্কারি করার সুযোগ নেই। জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী প্রতি পরিবারপিছু মাসে এক/দুবার রেশন প্রদান করা যেতে পারে। এখন যেমন টিসিবি খোলা ট্রাকে করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রি করে, তাকে রেশনিং পদ্ধতিতে আনা হোক। একসময় প্রত্যন্ত গ্রামেও রেশনের ডিলার ছিল। এখন বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে দু-একটি পাকা রাস্তা রয়েছে। সেখানে পাকা রাস্তার ধারে কোনো বাজারে রেশন ডিলার নিয়োগ দেওয়া হোক। ডিজিটাল পরিমাপ যন্ত্র, প্যাকেটজাত পণ্য, কম্পিউটারাইজড হিসাব-নিকাশ করে প্রতি কার্ডধারীর কাছে পণ্য পৌঁছানো কঠিন কিছু নয়। প্রতি উপজেলায় খাদ্য কর্মকর্তা রয়েছে। প্রয়োজনে আরও লোকবল নিয়োগ করা হোক। এতে একদিকে কর্মসংস্থান বাড়বে অন্যদিকে গত দুই বছর বাজারে যে অস্থিরতা তা কিছুটা হলেও লাঘব হবে। প্রতিনিয়ত নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের মূল্য বাড়ছে। জিম্মি হয়ে পড়ছে গোটা জাতি। একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী ও সিন্ডিকেটের হাতে বাজার জিম্মি। বিগত পৌনে ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের যত সাফল্য, বাজার অস্থিরতায় তা ম্লান হয়ে যাচ্ছে। এখনই কঠোর পদক্ষেপ না নিলে এর প্রভাব আগামী নির্বাচনে নেতিবাচকভাবে পড়বে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলসহ শত উন্নয়নের দোহাই দিয়েও জনগণের মনকে শান্ত করা যাবে না। কারণ জনগণ নিজেরা বাজার করে। সরকার জনগণের বাসায় বাজারের থলে পৌঁছে দেয় না। অনেকে হয়তো বলবেন, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে তাই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে সমস্যা হচ্ছে না। এটা একটি ফালতু যুক্তি। সবার ক্রয়ক্ষমতা বাড়েনি। রিকশাচালক, ভ্যানচালক, সিএনজিচালকের ভাড়া হয়তো একটু বেড়েছে। আর বেড়েছে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ভাতা-সুযোগ সুবিধা। কিন্তু তারা মোট জনসংখ্যার কত ভাগ? অন্যদিকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিজীবীদের বেতন প্রতি মাসে বা বছরে বাড়ে না। বিগত দুই বছরে ক্রমাগতভাবে প্রতিটি পণ্য, খাদ্যপণ্য, ভোজ্য তেল, বাড়ি ভাড়া, যাতায়াত ভাড়া, তরিতরকারি, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, ফলমূল, ওষুধসহ প্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি মধ্যবিত্তের জীবনকে বিপন্ন করে তুলেছে। এ অবস্থা থেকে জাতি মুক্তি চায়। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণি।

মধ্যবিত্ত মানব সমাজের এক বিস্ময়কর অংশ। এরা শিক্ষিত, সচেতন, বিপ্লবী, মানবতাবাদী, প্রতিবাদী, আবার আপসকামীও বটে। এদের হাত ধরেই বিগত ২০০ বছরে বাংলাদেশের (ব্রিটিশ বাংলা ও পূর্ব-পাকিস্তানসহ) মানুষের উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে। রাজনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, সংগীত, নৃত্য, ক্রীড়াসহ সব ক্ষেত্রেই মধ্যবিত্তের অংশগ্রহণ ও অবদান ধনিক শ্রেণির চেয়ে বেশি। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তের অংশগ্রহণ ছিল ৯০% এর ওপরে। বঙ্গবন্ধু নিজেও ছিলেন একজন মধ্যবিত্ত।

মধ্যবিত্তের থাকে নানাবিধ যন্ত্রণা-থাকে নিত্যদিনের বহুমুখী গঞ্জনা। অনেক ক্ষেত্রে এতে যোগ হয় লাঞ্ছনার মতো অসহনীয় বেদনা। মধ্যবিত্তের সংসার চলে সুনিপুণ অঙ্ক কষে-বাজারের থলে ও পকেটের টাকার সমন্বয় করতে মধ্যবিত্তকে ব্যয় করতে হয় মেধার এক বিরাট অংশ। মধ্যবিত্তদের বেশির ভাগই চেইনশপ বা নির্দিষ্ট মূল্যের দোকানে বাজার করে না। তারা খোলা বাজারে যায়, মাছ, মুরগি, মাংস তরিতরকারি, সবজিসহ বিভিন্ন পণ্যের মূল্যে দরাদরি করে নেয়, তবুও গৃহিণীর বাজারের তালিকা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। রোগশোক না হলে এ ফলের সিজনে ও ফলফলাদি কেনা মধ্যবিত্তের সংসারে এক ধরনের বিলাসিতা। এই যে কোরবানির ঈদ গেল, কত হাজার হাজার মধ্যবিত্ত-নিম্ন মধ্যবিত্ত শরিকেও কোরবানি দিতে পারেনি। অনেকে গ্রামে চলে গেছেন। গ্রামের বাড়িতে চাচা-জেঠা-দাদা-দাদি আছে, তবুও সন্তানরা ঈদের আনন্দ কিছুটা পাবে। কিন্তু শহরে- এ ইট-পাথরের ফ্ল্যাট বাড়িতে আমরা কজন খবর নিয়েছি প্রতিবেশী কোরবানি দিয়েছে কি না!

স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর থেকে দারিদ্র্য বিমোচনের সঙ্গে সঙ্গে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান হয়েছে। ক্রমান্বয়ে এর ব্যাপ্তি বেড়েছে। দরিদ্রদের ওপরে থাকা নিম্ন মধ্যবিত্ত বা মধ্য-মধ্যবিত্তরা এখন কঠিন সময় পার করছেন। জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে তারা দ্রুত নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। এ শ্রেণিটি এখন দরিদ্রের কাতারে চলে যাচ্ছে। পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে তাতে মধ্যবিত্ত শ্রেণি আর কতদিন টিকে থাকতে পারবে এটিই বিলিয়ন ডলার প্রশ্ন? তবে কি মধ্যবিত্ত বিলীন হয়ে যাবে? ৫ দশক ধরে তিলে তিলে গড়ে উঠতে থাকা মধ্যবিত্ত শ্রেণি কি শেষ হয়ে যাবে? কিন্তু এ মধ্যবিত্ত শ্রেণিই একসময়ে চাহিদা ও জোগান সৃষ্টির মাধ্যমে বাজার অর্থনীতিকে চাঙা করে সামষ্টিক অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রেখেছিল। ১৫ বছরের ধারাবাহিক ক্ষমতার শেষ পাদবিন্দুতে এসে সরকার ও নীতিনির্ধারকদের কাছে আজ এটিই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন- দেশের সাধারণ জনগণের। এখনো চার মাস সময় আছে, কঠোরভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব। শেষ করব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পাওয়া দুটি স্ট্যাটাসের বর্ণনা দিয়ে। রাজধানীর নীলক্ষেত হাইস্কুলের সামনে অন্তত ৩০০ লোকের জটলার মধ্যে সাদা শার্ট, জিন্স প্যান্ট, পায়ে কেডস সু, এক হাতে স্মার্ট ফোন, আরেক হাতে বাজারের থলি নিয়ে দন্ডায়মান এক সুদর্শন যুবকের উপস্থিতি নিয়ে। তিনি বিবিএতে পড়েন। বাবা সরকারি চাকরিজীবী। মায়ের কথায় সাব্বির নামক যুবকটি ওএমএস-এর খোলা ট্রাকের লাইনে দাঁড়িয়েছে। কিছু টাকা সাশ্রয় করতে ভর্তুকি মূল্যে চাল-আটা কিনতে এসেছেন।

দ্বিতীয়টি আরও মর্মান্তিক। রাত ৯টা। গৃহকর্তা ঘরে ফিরেছেন। স্ত্রীকে বললেন, তোমার মেয়েকে ডাক। বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া মেয়ে হাজির। গৃহকর্তা একটি কালো ব্যাগ এগিয়ে দিল মা-মেয়ের দিকে। কী এখানে? স্ত্রীর প্রশ্ন। খুলে দেখ- দুটো বোরকা। কাল সকাল ৭টায় বোরকা দুটি পরে মা-মেয়ে গলির মাথায় লাইনে দাঁড়াবে। টিসিবির ট্রাক আসবে। এ কথা বলে গৃহকর্তা অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে নিজ কক্ষে চলে গেলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় মা-মেয়ে হতবাক। দাঁড়িয়ে আছে নিশ্চল-নিশ্চুপ। দুচোখে তাদের শ্রাবণের ধারা।

 

লেখক : সাবেক প্রধান তথ্য কর্মকর্তা

সর্বশেষ খবর