বৃহস্পতিবার, ৩১ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

আল-কায়েদার জিম্মিদশা থেকে কর্নেল আনামের ঘরে ফেরা

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. বায়েজিদ সরোয়ার, এনডিসি (অব.)

আল-কায়েদার জিম্মিদশা থেকে কর্নেল আনামের ঘরে ফেরা

ইয়েমেন থেকে আবুধাবি বিমানবন্দরে একটি সি-১৩০ বিমান ল্যান্ড করল ৮ আগস্ট সকাল ১০টায়। প্লেনে কর্নেল আনামের পাশে বসেছিলেন আরব আমিরাতের গোয়েন্দা বিভাগ ‘এনআইএস’-এর একজন এজেন্ট। তিনি আনামকে জানালেন প্লেন এখন আবুধাবিতে। বিমান থেকে বের হয়ে ঝলমলে বিমানবন্দরে নিজেকে এখন সত্যিই মুক্ত মনে করলেন আনাম...। বন্যা, ডেঙ্গু, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি আর নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে সুসংবাদ এলো। ইয়েমেনে আল-কায়েদার জিম্মিদশা থেকে জাতিসংঘ কর্মকর্তা অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল এ কে এম সুফিউল আনামকে গত ৮ আগস্ট ২০২৩ উদ্ধার করা হয়। প্রায় দেড় বছর বন্দিদশা থেকে মুক্তির সংবাদে তাঁর পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, সামরিক-কমিউনিটিসহ অনেকের মধ্যে এনেছে সন্তোষ ও স্বস্তির পরশ। ডিওএইচএস মিরপুরের দৃষ্টিনন্দন ‘জ্যোসনা সরোবরের’ কিছুটা দক্ষিণে একটি সুন্দর ইমারতের নাম ‘আনামস’। কয়েক দিনেই দালানটির চারপাশের বৃক্ষলতা ফুলে কী দারুণ সজীবতা! প্রকৃতিও কি মানুষের আনন্দ বেদনার কথা বোঝে?

মানব ইতিহাসের অন্যতম প্রাচীন বসতি ও প্রাচীন সভ্যতার দেশ ইয়েমেন। দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। ইয়েমেনে আজ চরম অরাজকতা। ইয়েমেন গৃহযুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত এক জনপদ। এটি বর্তমানে আরব বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ। জাতিসংঘ মতে, ইয়েমেনে আজ বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবসৃষ্ট বিপর্যয়। তবে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে ২০১৮ সালে যুদ্ধরত দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হয়েছে ও যুদ্ধবিরতি চলছে। ২০১৯ সাল থেকে সেখানে পলিটিক্যাল মিশন চলছে। কর্নেল আনাম ২০১৯ সাল থেকে ইয়েমেনে জাতিসংঘের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা বিভাগের ফিল্ড সিকিউরিটি কো-অর্ডিনেশন অফিসার (প্রধান) হিসেবে এডেনে কর্মরত ছিলেন। উল্লেখ্য, লে. কর্নেল এ কে এম সুফিউল আনাম ১৯৭৭ সালে শর্ট সার্ভিস কমিশন-৪ (এসএসসি-৪) এর সঙ্গে সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। এ চৌকশ কর্মকর্তা ২০০৫ সালে অবসরগ্রহণ করেন ও সেই বছর থেকে তিনি জাতিসংঘের ‘ইন্টারন্যাশনাল সিভিল সার্ভিস কমিশনের’ অধীনে কাজ করে আসছিলেন।

২০২২-এর ১১ ফেব্রুয়ারি লে. কর্নেল আনাম ও তাঁর দল নিরাপত্তা মূল্যায়নের জন্য আবিয়ান প্রদেশে যান। ওই ফিল্ড মিশন শেষে কর্মস্থলে ফেরার পথে আনামসহ আরও পাঁচ কর্মীকে মুদিয়াহ শহর থেকে আল-কায়েদার (আল-কায়েদা ইন আরব পেনিনসুলা) একটি দল অপহরণ করে।

অপহরণের ঘটনার পর পরই ইয়েমেনের জাতিসংঘ কর্তৃপক্ষ জিম্মি উদ্ধারের জন্য চেষ্টা করে। তাদের অনুরোধে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ইয়েমেন সরকারও উদ্ধারে প্রচেষ্টা চালায়। জাতিসংঘ সদর দফতর তৎপর হয়। এক্ষেত্রে জাতিসংঘ সদর দফতরে কর্মরত ইন্টারন্যাশনাল সিভিল সার্ভিস কমিশনের কয়েকজন বাংলাদেশি কর্মকর্তার (অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা) সক্রিয়তা ছিল প্রশংসনীয়। আনামের মুক্তিপণ হিসেবে ৩০ লাখ ডলার ও একই সঙ্গে সরকারি কর্তৃপক্ষের হাতে আটক আল-কায়দা সদস্যের মুক্তি দাবি করেছিল আল-কায়েদা। তবে মুক্তিপণ দিয়ে জিম্মি উদ্ধার জাতিসংঘ নীতিগত অবস্থানের বাইরে। এর ফলে জাতিসংঘের প্রচেষ্টায় আন্তরিকতা থাকলেও ফলাফল দৃশ্যমান হয়নি।

কর্নেল আনামের পরিবারের পক্ষ থেকে তাঁকে উদ্ধারের জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে অনুরোধ করা হয়, বিশেষত সরকার ও সেনাবাহিনীর কাছে। কাজি নাসরিন আনাম জীবনের এ পর্যায়ে এসে জীবনসঙ্গীকে উদ্ধারে এক ধরনের যুদ্ধে নেমে পড়েন। আনামকে মুক্ত করতে গত বছরের ৩ মার্চ তারিখে তাঁর সহধর্মিণী নাসরিন আনাম প্রধানমন্ত্রী ও জাতিসংঘ মহাসচিব বরাবর চিঠি পাঠান। শুরু থেকেই বাংলাদেশ সরকার বিশেষত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘটনাটি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখে আসছিল। অসাধারণ আন্তরিকতা ও উদ্যোগী হয়ে এগিয়ে আসেন কর্নেল আনামের সেনাবাহিনীর কোর্সমেট (এসএসসি-৪) বা সতীর্থ অফিসাররা। যোগাযোগের জন্য তাঁরা ‘ফ্রেন্ডস ফর আনাম’ নামে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ তৈরি করেন। অসাধারণ উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেন সেনাবাহিনী প্রধান। এগিয়ে আসে রাওয়া কর্তৃপক্ষ ও এএফডি। অবসরপ্রাপ্ত সহস্র সামরিক কর্মকর্তাদের ফেসবুকে তাদের প্রিয় সহকর্মীর মুক্তির আকুতি ব্যক্ত হয়।

ঘটনাটি ইয়েমেনে সংঘটিত হওয়ায় জিম্মি উদ্ধারের দায়িত্ব স্বাভাবিকভাবেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন হয়ে যায়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অত্যন্ত দায়িত্বশীলতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে এ কাজ পরিচালনা করে। ১৭ আগস্ট, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ সম্মেলনে কীভাবে সুফিউল আনামকে উদ্ধার করা হলো সে বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হয়। জনকূটনীতি অনুবিভাগের মহাপরিচালক সেহেলী সাবরীন জানান, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মোতাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সভাপতিত্বে একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়।

তিনি বলেন, ‘এ ঘটনার পরই কুয়েতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে (ইয়েমেনে সমবর্তী দায়িত্বপ্রাপ্ত) উদ্ধার তৎপরতা চালানোর নির্দেশ প্রদান করা হয়। পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থিত বাংলাদেশের অন্যান্য দূতাবাসকেও এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধির মাধ্যমে এ বিষয়ে জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট দফতরের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করা হয়।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে উদ্ধার প্রক্রিয়ার বিভিন্ন কর্মকান্ড পরিচালনা করেন।

বিষয়োক্ত স্টিয়ারিং কমিটি জিম্মি উদ্ধারে প্রয়োজনীয় ‘অ্যাকশন প্ল্যান’ তৈরি করে। এমন একটি মিটিং চলাকালে একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা কল্পনাপ্রসূত তাঁর নোটবুকে লিখলেন- ‘অপারেশন এডেন’। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জাতিসংঘ অনুবিভাগের মহাপরিচালক ছিলেন উদ্ধার প্রক্রিয়ার ফোকাল পয়েন্ট।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ওমান, সৌদি আরব, কাতার ও ইয়েমেনে প্রতিনিধি দল প্রেরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে ওমান, ইয়েমেন, কাতার, কুয়েত এবং আবুধাবি সরকারের সহায়তা চেয়ে নোট ভারবাল প্রেরণ করা হয়। ২০২৩-এর ফেব্রুয়ারি মাসে পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দল ওমান, কাতার এবং সৌদি আরব সফর করেন। এ প্রতিনিধি দলে সেনাবাহিনী, ডিজিএফআই, এনএসআই ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা ছিলেন। এ প্রতিনিধি দলের প্রধান ছিলেন কর্নেল কাজি মাহমুদ জাকারিয়া। মধ্যপ্রাচ্য-অভিজ্ঞ প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত শেখ সেকান্দার আলী ছিলেন টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার। এ দলের কর্মকান্ড  জিম্মি উদ্ধার প্রক্রিয়ায় যথেষ্ট অবদান রাখে।

মেজর জেনারেল মো. আশিকুজ্জামান বর্তমানে কুয়েতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত। তিনি রাষ্ট্রদূত হিসেবে ইয়েমেনেও সমবর্তী দায়িত্বপ্রাপ্ত। সার্বিক উদ্ধার প্রক্রিয়ায় এ রাষ্ট্রদূত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।

গোয়েন্দা বাহিনীর সফলতা নিয়ে সাধারণত আলোচনা হয় না। ব্যর্থতা বা ভুলত্রুটি নিয়েই কথা হয়। তবে এ এক ভিন্ন কাহিনি। এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থাকেও (এনএসআই) উদ্ধার বিষয়ে নির্দেশ দেন। মেজর জেনারেল টি এম জোবায়ের এ সংস্থার মহাপরিচালক হিসেবে কাজ করছেন।

৯ আগস্ট সুফিউল আনামের সঙ্গে ঢাকা বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন এনএসআই-এর পরিচালক মোহাম্মদ ইমরুল মাবুদ। তিনি বলেন, ‘কর্নেল সুফিউল আনাম স্যারের অপহরণের পর থেকেই প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ নির্দেশনা আমাদের ওপর ছিল। আমরা দীর্ঘদিন এটা নিয়ে কাজ করেছি। এ কাজের সময় আমাদের ভ্রাতৃপ্রতিম বিভিন্ন দেশ, ভ্রাতৃপ্রতিম সংস্থা এবং বিভিন্ন দেশি-বিদেশি অনেকের কাছ থেকে সহযোগিতা পেয়েছি। ওরা আমাদের কাছে ৩০ লাখ মার্কিন ডলার চেয়েছিল। কিন্তু আমরা স্যারকে কোনো ধরনের মুক্তিপণ ছাড়াই উদ্ধার করতে পেরেছি।’ উদ্ধারের জন্য এনএসআই মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের গোয়েন্দা সংস্থা এনআইএস এ বিষয়ে অসাধারণ ভূমিকা পালন করে। যতদূর জানা যায়, মূলত ইয়েমেনে ‘এনআইএস’-এর এজেন্টের মধ্যস্থতায় আনামকে আল-কায়দা থেকে উদ্ধার করা হয় এবং বিমানযোগে তাকে আবুধাবিতে নিয়ে আসে। পরবর্তীতে এনএসআই-এর তত্ত্বাবধানে আবুধাবি থেকে আনামকে ৯ আগস্ট ঢাকায় আনা হয়। উদ্ধারে অসাধারণ অবদানের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্টের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। দেশে পৌঁছে আনাম বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে বন্দিজীবনের কথা বলেন...‘আমি এতদিন যে পরিবেশে ছিলাম সেটা ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। এগুলো অ্যাকশন মুভিতে দেখা যায়; কিন্তু বাস্তবে এ অভিজ্ঞতা সবচেয়ে কঠিন। আমি ছিলাম পাহাড়ের ভিতর ও মরুভূমির মধ্যে। মাসের পর মাস আমি আকাশ-বাতাস দেখতে পাইনি। পাহাড়ের ভিতর ও মরুভূমির মাঝখানে চলছিল আমার দুর্দশাময় জীবন।’ এ সময় তিনি আরও বলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম আমাকে সবাই ভুলে গেছে। আমি পুরো হতাশাগ্রস্ত একজন মানুষ হয়ে গিয়েছিলাম। অত্যন্ত বিপদসংকুল অবস্থায় আমি সময় পার করেছি। প্রতিটিক্ষণ ছিল আমার সন্ত্রাসীদের ভয়, মৃত্যুর ভয় ও দুর্ঘটনার ভয়।’ ১৮ মাসের বন্দিদশায় সুফিউল আনাম এবং চারজন সহকর্মীকে বিভিন্ন স্থানে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। দিনগুলো ছিল বিভীষিকাময়। অধিকাংশ শেল্টার কক্ষ ছিল চরম অস্বাস্থ্যকর। একটি শেল্টার ছিল পাথর দিয়ে ঘেরা। পাথরের ঘরটি ছিল কোবরা সাপ-বিচ্ছুসহ বিষাক্ত পোকা-মাকড়ে ভর্তি। পুরো যাত্রায় তাঁবুতে থাকা ছিল সবচেয়ে কষ্টের। বালিঝড় ছিল সেখানে থাকাকালীন সবচেয়ে কষ্টকর মুহূর্ত। প্রচ- গরম পড়ত। কখনো তাদের ওপর দিয়ে উড়ত ড্রোন। তাঁবুতে থাকতে তাদের পায়ের গোড়া দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছিল। সেগুলো যুক্ত ছিল বিস্ফোরকের সঙ্গে।

কর্নেল আনাম বলেন, আল-কায়েদার সদস্যরা তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেছে। কোনোরকম নির্যাতন, দুর্ব্যবহার করেনি। তারা আমাদের বলেছিল, তারা আমাদের হত্যা করবে না। জানাত যে, মুক্তির জন্য আলোচনা চলছে। বন্দিদের খাবারের মান ভালো ছিল। সুফিউল আনাম এক সাক্ষাৎকারে বলেন, আমাদের বলা হয়েছিল রমজানের আগে মুক্তি দেওয়া হবে। এরপর বলা হলো ঈদের আগে। এরপর বলা হলো ঈদুল আজহার আগে। কিন্তু মুক্তি আসেনি। তবে তিনি আশা ছাড়েননি। তিনি নিয়মিত নামাজ পড়তেন। ইবাদত বন্দেগিতে দীর্ঘ সময় কাটত। এ সময় ধর্মের মধ্যে আশ্চর্য শক্তি পেয়েছিলেন সুফিউল।

কর্নেল আনাম ও তার সহবন্দিরা দিন গুনতেন। অতীতের সুন্দর স্মৃতিগুলো ছিল শ্রেষ্ঠ এক সম্পদ। কখনো মুক্তির স্বপ্ন, জীবনের সোনালি সময়ের স্মৃতিচারিতা কষ্টের মাঝে তাকে অসামান্য স্বস্তি দিত। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে আনামের মন ইয়েমেনের রুক্ষ প্রকৃতি ছেড়ে পাখির পাখায় উড়াল দিত সবুজ বাংলার দিকে। মনে পড়ত পিতা-মাতা, পুত্র-কন্যা, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু ও জীবনসঙ্গীর প্রিয় মুখশ্রী।

গত জুন মাসে হঠাৎ কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করলেন আনাম। তাদের নিয়ে যাওয়া হলো একজন ইয়েমেনি শেখের বাড়িতে। কিছুটা আরামদায়ক বন্দোবস্ত। অনুমান করলেন মুক্তির বিষয়ে হয়তো অগ্রগতি হয়েছে। অবশেষে একদিন এলো প্রার্থিত সেই মুক্তির সংবাদ...।

৮ আগস্ট ২০২৩। কানাডার টরন্টোতে এখন ভোর। বুকে পৃথিবীর সব দুঃখ অভিমান আর হতাশা নিয়ে ফজরের নামাজ পড়ার জন্য জায়নামাজে বসেছেন কাজি নাসরিন আনাম। বন্দিদশা থেকে জীবনসঙ্গীর মুক্তির জন্য পরম করুণাময় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছেন। এরই মধ্যে হঠাৎ বেজে উঠল তার সেলফোন। অচেনা এক নম্বর থেকে কল। কিন্তু ওপার থেকে ভেসে এলো সেই প্রার্থিত কণ্ঠস্বর। ‘শোন... আমি আনাম বলছি, আমি মুক্তি পেয়েছি।’ আশ্চর্য এক বেহেস্তি আনন্দে মনটা ভরে গেল নাসরিন আনামের। এক লহমায় ব্যাক ইয়ার্ডের মেপল গাছের শ্যামা-সবুজ পাতাগুলো যেন হলুদ-কমলা লাল বর্ণে বর্ণিল হয়ে উঠল। ‘ফল’ এর এ ভোর বেলায় অপূর্ব দৃশ্যময় লেক অন্টারিওর দিকে সানন্দে উড়ে গেল এক ঝাঁক বুনো হাঁস। দি ক্রেনস আর ফ্লাইং...।

কর্নেল আনামকে উদ্ধারে বিশাল এক কর্মযজ্ঞ পরিচালিত হয়েছিল। এটি ছিল কূটনীতিক, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, এনএসআই, সেনাবাহিনী, জাতিসংঘ এবং আরও অনেককে মিলিয়ে একটি চমৎকার সমন্বিত প্রচেষ্টা। স্ব স্ব অবস্থান থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন : প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা ও সভাপতি, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। মিডিয়া তার ভূমিকা পালন করেছে। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল ও আশা জাগানিয়া দিক হলো বিপদে পড়া ব্যক্তির জন্য মানুষের দরদ ও আন্তরিকতা। এ ধরনের উদ্যোগ সমাজে আশা ও প্রেরণা জোগায়। এ ঘটনায় সামরিক পরিসরের ব্যক্তিবর্গের মনোবল বৃদ্ধি পেয়েছে। বিষয়টি সামরিক-কমিউনিটিতে ভ্রাতৃত্ববোধ ও কমরেডশিপকে উজ্জীবিত করেছে। জিম্মি উদ্ধারে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রের ভূমিকা প্রশংসিত হয়েছে। আমরা যেন এভাবে সব সময় একে অন্যের বিপদে পাশে দাঁড়াতে পারি। এ উদ্ধার প্রক্রিয়ায় অবদান রাখা সবাইকে প্রাণঢালা অভিনন্দন। নতুন জীবনে আমাদের কর্নেলকে স্বাগতম। ওয়েলকাম স্যার।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, গবেষক

[email protected]

সর্বশেষ খবর