বৃহস্পতিবার, ৩১ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

মুজিবের রক্তবীজ

আফরোজা পারভীন

মুজিবের রক্তবীজ

এ পৃথিবী যতদিন থাকবে ১৫ আগস্ট ঘুরে ঘুরে আসবে। প্রতি বছর আসবে। এ আসায় কোনো ভাটা পড়বে না। কিন্তু ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে যে ঘটনা ঘটেছিল তা আর কোনো দিন ঘটবে না। কারণ যাঁদের শেষ করার জন্য ঘটনা ঘটেছিল তাঁরা পৃথিবীতে নেই। অকালে ঝরে গেছেন। না কোনো মহামারি নয়, জলোচ্ছ্বাস নয়, যুদ্ধবিগ্রহ নয়, মড়ক নয়; ঘাতকের গুলিতে ঝরে গেল এতগুলো প্রাণ! তাঁর কোনোটা প্রস্ফুটিত হয়েছিল, কোনোটা ছিল কচি, প্রস্ফুটিত হওয়ার অপেক্ষায়। ধানমন্ডির বাড়িটিও এখন বাড়ি নেই, জাদুঘর। জনগণের জন্য উৎসর্গীকৃত। মহান নেতার পদচিহ্ন আর রক্তমাখা বাড়িটি এখন তীর্থস্থান। ধরুন এক সকালে ঘুম থেকে উঠে শুনলেন, আপনি একা, কেউ নেই আপনার, নিঃস্ব হয়ে গেছেন সব হারিয়ে! অথচ আগের রাতে সবাই ছিল। ছিল ঘরভরা আপনজন। যারা আপনার সুখে-দুঃখে আনন্দ-বেদনায় ছিল, যাদের রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে আপনার ধমনিতে! কেমন লাগবে আপনার? আর এ খবর যদি আপনি শোনেন বিদেশের মাটিতে, যদি শোনেন এমন পরিস্থিতিতে যে তাদের মুখটাও শেষবারের মতো দেখার সুযোগ নেই, তাহলে কেমন লাগবে!

না, কোনো রূপকথার গল্প নয়, নয় কোনো বানানো গল্প। ঠিক এমনটাই ঘটেছিল জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার জীবনে। দুই বোন বেড়াতে গিয়েছিলেন বিদেশে। স্বামী ওয়াজেদ মিয়া চেয়েছিলেন বলেই যেতে হয়েছিল। নইলে শেখ হাসিনার যাওয়ার তেমন ইচ্ছা ছিল না। ১৫ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন। পিতা শেখ মুজিব যাবেন সেখানে। তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে। ভিসি ড. আবদুল মতিন চৌধুরী এমএ ক্লাসের ছাত্রী শেখ হাসিনাকে বলেছিলেন সমাবর্তনের পরে যেতে। হাসিনারও সেটাই ইচ্ছা। কিন্তু বিধাতার ইচ্ছা ছিল অন্যরকম। তাই ২৯ জুলাই যেতে হলো। সঙ্গে নিয়ে গেলেন প্রিয় বোন রেহানাকে। গেলেন বলে বেঁচে গেলেন, বোনটাও বাঁচলেন। বাঁচলেন শেখ হাসিনার স্বামী-সন্তানরা। শেখ রাসেলকেও নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কোলের সন্তানকে মা ছাড়তে চাননি। বুক দিয়ে আগলে রাখতেন। আর তাঁর সঙ্গেই অনন্তলোকে পাড়ি জমালেন রাসেল। আহা, যদি হাসু আপার সঙ্গে যেতেন!

১৫ আগস্ট সকালে ব্রাসেলসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সানাউল হকের বাড়িতে ঘুমিয়ে ছিলেন তাঁরা। দিনটি ছিল শুক্রবার। আগের রাতে অনেক খুনসুটি করেছেন রেহানা সানাউল হকের মেয়ের সঙ্গে। তা নিয়ে বকাও দিয়েছেন দুলাভাই ওয়াজেদ মিয়া। বলেছেন, ‘যত হাসি তত কান্না’। উনি যত বলেছেন ততই হেসে গড়িয়ে পড়েছেন রেহানা আর সানাউল হকের মেয়েরা। ওয়াজেদ সাহেব অবশ্য জানতেন না, এই প্রবাদ সকালে ঘুম থেকে উঠেই সত্যি হয়ে যাবে!

জার্মানিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীর আমন্ত্রণে বেড়াতে এসেছেন তাঁরা। প্রেসিডেন্টের মেয়ে। খাতিরযত্ন করলে নেকনজরে থাকা যাবে এটাই বোধহয় ভেবে তাঁদের ব্রাসেলসে আমন্ত্রণ জানান সানাউল হক। বঙ্গবন্ধুই তাঁকে ব্রাসেলসে পদায়ন করেছেন। এটা একটা রাজনৈতিক পদায়ন। প্রেসিডেন্টের মেয়ে, জামাইয়ের জন্য তাঁর আয়োজনের কমতি ছিল না। কিন্তু সবকিছুতে কালি ঢেলে দিল ১৫ আগস্ট সকালে জার্মানি থেকে আসা হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীর একটা ফোন। সানাউল হকের চেহারা বদলে গেল। মুহূর্তের মধ্যে যেন প্রেসিডেন্টের মেয়ে, জামাই তাঁর বোঝা হয়ে গেল। কারণ তাঁরা তখন এক্স প্রেসিডেন্টের মেয়ে। তিনি পারলে প্রেসিডেন্টের মেয়েদের তখনই বাড়ি থেকে বের করে দেন। হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী ওয়াজেদ মিয়াকে জানালেন বাংলাদেশে ক্যু হয়েছে। তিনিও তখন বিস্তারিত জানেন না। ওয়াজেদ মিয়া ঘটনা সম্পর্কে সরাসরি কিছু না বললেও আন্দাজে ভয়ংকর কিছু হয়েছে ভেবে নিয়ে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েন দুই বোন। কাঁদতে থাকেন তাঁরা। তাঁদের প্যারিস যাওয়ার কথা ছিল। হুমায়ূন রশীদের পরামর্শে প্যারিস যাত্রা বাতিল করে জার্মানি যান তাঁরা। সানাউল হক জার্মানি যাওয়ার জন্য একটি গাড়িও দেননি তাঁদের। তখনো কিন্তু তাঁরা সম্পূর্ণ জানতেন না সেদিনের নৃশংসতার ভয়াবহ চিত্র। ধারণা করা হয়েছিল, বেগম মুজিব ও শেখ রাসেল বেঁচে থাকতে পারেন। নানারকম কথা ভাসছিল বাতাসে, বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম বিভিন্ন খবর পরিবেশন করছিল। সেই দুঃসময়ে দেবদূতের মতো দুই হাত মেলে পাশে দাঁড়ান হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী। তিনি তাঁদের টাকা-পয়সা, গরম কাপড় দেন। বিশেষ করে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার ব্যাপারে সহায়তা করেন। আদর, ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে দেন তাঁর স্ত্রী। ওয়াজেদ মিয়া ভারত সরকারের সহায়তা চেয়েছিলেন, চেয়েছিলেন আশ্রয়। পেয়েছিলেন। বহুদিন পর্যন্ত প্রকৃত সংবাদও তাঁরা পাননি। পরিবারের কেউই যে বেঁচে নেই, ছোট ভাই রাসেল, দেশের গৌরব অন্য পরিবারের মেয়ে ক্রীড়াঙ্গনের ব্লু সুলতানা কামাল খুকু পর্যন্ত নেই এটা তাঁরা জেনেছেন ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছ থেকে। এই মহীয়সী তাঁদের পাশে বসিয়ে জড়িয়ে ধরে একান্ত আপনজনের মতো সান্ত¡না দিতে দিতে বলেছিলেন মর্মান্তিক খবরটি। সে সময় শেখ হাসিনা-শেখ রেহানার মানসিক অবস্থা অনুমান করতে পারি। আমি যুদ্ধে ভাই হারিয়েছি। আমার মতো অনেকেই আপনজন হারিয়েছেন। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও কিন্তু একদিনের জন্যও ভাইয়ের মুখ ভুলতে পারিনি। ক্ষমা করতে পারিনি ঘাতকদের। জীবনে এই ব্রত নিয়ে বেঁচে আছি যে, ভাই হত্যার বিচার হবে। তাহলে পুরো পরিবার হারিয়ে শেখ হাসিনা-রেহানার বেদনার ভার কতটা হতে পারে সহজেই অনুমেয়। আমি নির্বাসনে যাইনি। তবে যুদ্ধের সময় দেশের মধ্যেই শরণার্থী ছিলাম। প্রাণভয়ে আজ এক গ্রামে, কাল অন্য গ্রামে পালিয়ে বেড়িয়েছি। রাতে রাতে পাকিস্তানিরা হানা দিলে কখনো কচু ঝোপে, কখনো শ্যাওলা পুকুরে রাত কাটিয়েছি। স্বাধীনতাযুদ্ধকালে যাঁরা দেশে বা বিদেশে শরণার্থীর জীবন কাটিয়েছেন, তাঁরা আমৃত্যু সেই যাতনা আর নিশ্চয়তার কথা ভুলতে পারবেন না। শেখ হাসিনা-শেখ রেহানাকে থাকতে হয়েছে বিদেশের আশ্রয়ে। ভারত সরকার তাঁদের খাবার জুগিয়েছে, নিরাপত্তা জুগিয়েছে। কষ্টে থেকেছেন তাঁরা। বন্দিজীবন কাটিয়েছেন বলা চলে। নিরাপত্তা বিঘিœত হওয়ার ভয়ে কোথাও যেতে পারেননি, কারও সঙ্গে মিশতে পারেননি। আত্মগোপনে থাকতে হয়েছে। শেখ রেহানা শান্তিনিকেতনে ভর্তি হয়েও নিরাপত্তার অভাবে পড়তে পারেননি। লন্ডনে যাওয়ার টিকিটের পয়সা জোগাড় করতে পারেননি বলে অনেক দিন যেতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী সেই টিকিট দিয়েছেন। ১৯৭৭ সালে নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধী পরাজিত হওয়ার পর তাঁদের দিন আরও কঠিন হয়ে যায়। মোরারজি দেশাই সরকারের সঙ্গে তাঁদের জীবন সহজ ছিল না মোটেও। মাথার ওপর একটা নিশ্চিত আশ্রয়ের জন্য অল্প বয়সে বিয়ে করেছেন রেহানা। শেখ হাসিনা পয়সার অভাবে বোনের বিয়েতে লন্ডন যেতে পারেননি। অন্তঃসত্ত্বা বোনকে দেখতে যখন যান তখন কয়েকটি বাচ্চাকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে সেই পয়সায় ফল, খবরের কাগজ, পাউরুটি কিনে বাড়ি ফিরেছেন। শেখ রেহানা সাবলেট থেকেছেন। এমনকি একসময়ের প্রেসিডেন্টের মেয়ে হয়েও রেস্টুরেন্টে কাজ করার কথা ভেবেছেন। লাইব্রেরিতে চাকরি করেছেন। এমন কোনো কষ্ট নেই যা তাঁরা করেননি।

১৫ আগস্টের মাত্র কয়েক দিন আগে দেশ ছেড়েছিলেন হাসিনা-রেহানা। তখন তাঁরা আভাসে ইঙ্গিতেও বোঝেননি এমনটা ঘটতে পারে। যে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে এ দেশের মানুষ ৯ মাস মরণপণ লড়াই করল তাঁকে যে এভাবে জীবন দিতে হবে কারও কল্পনায়ও আসেনি। তবে বেগম মুজিব বোধহয় আন্দাজ করেছিলেন কিছু। তিনি ছিলেন অনমনীয়, দৃঢ়চেতা, আপসহীন। স্বামীর দীর্ঘ কারাবাস আর অনুপস্থিতিকালীন তিনি একাই তো করেছেন সবকিছু। স্বামীর মামলা লড়েছেন, দল দেখেছেন, সন্তানদের একা হাতে মানুষ করেছেন, মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ভেঙে পড়েননি। কিন্তু সেই বেগম মুজিব হাসিনা-রেহানা বিদেশে যাওয়ার সময় কেঁদেছিলেন। এমনকি হাসিনা তাঁকে ব্রাসেলস থেকে ফোন করলে সেদিনও কেঁদেছিলেন। মেয়েকে বলেছিলেন, ‘তুই তাড়াতাড়ি ফিরে আয়। অনেক কথা আছে তোর সঙ্গে।’ মা-মেয়ের বয়সের ব্যবধান তেমন নয়। যেমন তিনি মা তেমনই বন্ধুও ছিলেন শেখ হাসিনার। মায়ের কান্নায় হাসিনা খুব অবাক হয়েছিলেন। কারণ তাঁর মায়ের স্বভাবের সঙ্গে এটা যায় না!

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এখনো সেদিনের কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে যান। বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে কথা বলেন, তারপর নিজেকে সামলান। তাঁর নিশ্চয়ই বারবার মনে পড়ে বাবা-মায়ের কথা বিশেষ করে ছোট ভাই রাসেলের কথা!

এ পৃথিবীতে অনেক সফল রাষ্ট্রনায়ককে বিদায় নিতে হয়েছে নির্মমভাবে। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে এই হত্যাকান্ডের পার্থক্য নানাবিধ। তাঁদের হত্যা করা হয়েছে কোনো সভাস্থল বা চলাচলের স্থলে, বড়জোর বাড়ির মধ্যে। কিন্তু রাতের অন্ধকারে বাড়ি ঘিরে ফেলে ঝাড়ে বংশে এরকম ব্রুটাল হত্যা আর হয়নি। হত্যার ধরন দেখে মনে হয় যেন কতকাল ধরে রাগ পুষে রেখেছিল ঘাতকরা! কেন রাগ, কীসের রাগ! স্ত্রী, ১০ বছরের বাচ্চা, পুত্রবধূরা, অন্তঃসত্ত্বা, আত্মীয় কোনো অপরাধ করেছিল? তাঁরা রাজনীতিবিদ নন, রাষ্ট্রনায়কও নন, ক্ষমতায়ও নেই। তবে কেন এই আক্রোশ?

আসলে ঘাতকরা চেয়েছিল শেখ পরিবারকে নির্মূল করে দিতে, যাতে এ পরিবারের আর কেউ কোনো দিন রাজনীতিতে আসতে না পারে। যাতে কেউ ক্ষমতায় যেতে না পারে, জনগণের কল্যাণ না করতে পারে। তাদের বোধহয় জানা ছিল না শেখ রেহানা আর শেখ হাসিনা দেশে নেই। তাই তাদের মিশন পুরোপুরি সফল হলো না! বিধাতার ইচ্ছা ছিল তাঁদের বাঁচিয়ে রাখা। হত্যার জন্য তাঁরা সে সময়টাই বেছে নিল যখন দুই কন্যা দেশের বাইরে। শত চেষ্টার পরও এ বংশকে নির্মূল করা গেল না। শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ তাঁকে সভানেত্রী নির্বাচিত করল। শেখ রেহানা বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চেয়ে বিশ্বময় প্রচার চালালেন। দীর্ঘ প্রবাস বাস, দুঃখকষ্ট, সংগ্রাম শেষ করে হাসিনা দেশে ফিরলেন বিজয়ীর বেশে। শেখ মুজিবের রক্তবীজ তিনি! সেই রক্তবীজ নির্মূল হওয়ার নয়!

                লেখক : কথাশিল্পী, গবেষক, সাবেক যুগ্মসচিব

সর্বশেষ খবর