সোমবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

এম আবদুর রহিম : সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য

মোজাম্মেল বিশ্বাস

এম আবদুর রহিম : সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য

বাংলাদেশের স্বাধীনতা পূর্ব ও পরবর্তী সময়ে জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে এম আবদুর রহিম (১৯২৭-২০১৬) ছিলেন বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত রাজনৈতিক সহচর। এ সময় তিনি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির ৩৪ জন সদস্যের অন্যতম হিসেবে সংবিধান প্রণয়নে অবদান রাখেন। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাকালীন সংবিধান প্রণয়ন কমিটির কার্যক্রমের দায়িত্ব পালনে তিনি প্রান্তিক দিনাজপুর অঞ্চলের গণমানুষের অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ ও সম্প্রীতির বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক অভিব্যক্তির মতামত প্রকাশের প্রতিনিধিত্ব করেন। মূলত ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর বাংলাদেশ কার্যত একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়। মুজিবনগরস্থ স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার ২২ ডিসেম্বর ঢাকায় আগমন করে দেশের প্রকৃত শাসনভার গ্রহণ করে। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন (১০ জানুয়ারি ১৯৭২) পর্যন্ত বাংলাদেশের শাসন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অনুসারে পরিচালিত হয়েছিল। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরদিন (১১ জানুয়ারি ১৯৭২) রাষ্ট্রপতি হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান ‘বাংলাদেশ অস্থায়ী সংবিধান আদেশ’ জারি করেন। এ আদেশের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার পদ্ধতির পরিবর্তন সাধন করা হয়। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে রাষ্ট্রপতির হাতে পূর্ণ কর্তৃত্ব ন্যস্ত করা হয়েছিল। ১১ জানুয়ারি ১৯৭২ ঘোষিত ‘অস্থায়ী সংবিধান আদেশে’ বাংলাদেশে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। ১২ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী উপাধি সর্বস্ব রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন। একই দিনে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।

বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে সরকার ১৯৭২ সালের ২৩ মার্চ ‘গণপরিষদ আদেশ’ জারি করে। এ আদেশের মাধ্যমে ১৯৭০ সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যগণকে নিয়ে গণপরিষদ গঠন করা হয়। গণপরিষদের একমাত্র দায়িত্ব ছিল বাংলাদেশের জন্য একটি সংবিধান প্রণয়ন করা। এ আদেশ জারির পরপরই সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়। রাষ্ট্রপতি ১০ এপ্রিল ১৯৭২ গণপরিষদের অধিবেশন উদ্বোধন করেন। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ৪১৪ জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন। সংবিধানের খসড়া প্রণয়নের লক্ষ্যে ১১ এপ্রিল একটি কমিটি গঠন করা হয়। ৩৪ সদস্যবিশিষ্ট এ কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন ড. কামাল হোসেন। এ সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত সহযোগী ও দিনাজপুরের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট এম আবদুর রহিম। কমিটিকে পরবর্তী ১০ জুনের (১৯৭২) মধ্যে গণপরিষদে সংবিধানের খসড়া উপস্থাপন করতে বলা হয়। সে অনুযায়ী কমিটি অত্যন্ত দ্রুত সংবিধানের খসড়া প্রণয়নের কাজ শুরু করে। ১৭ এপ্রিল কমিটির প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের কাছ থেকে সংবিধানের রূপকল্প বিষয়ে প্রস্তাব আহ্বান করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কমিটির ঘোষিত শেষ তারিখের (৮ মে ১৯৭২) মধ্যে কমিটি ৯৮টি সুপারিশমালা লাভ করে। পূর্ব নির্ধারিত ১০ জুনের মধ্যে কমিটি সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন করতে সক্ষম হয়।

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানটিকে ত্রুটিমুক্ত করার উদ্দেশ্যে কমিটি একজন ব্রিটিশ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করে। ১৯৭২ সালের ১১ অক্টোবরের মধ্যে কমিটি সংবিধানের খসড়া চূড়ান্তভাবে প্রণয়ন করে। সংবিধানের খসড়া চূড়ান্ত করার আগে ৯ অক্টোবর তা আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠকে উপস্থাপিত ও আলোচিত হয়েছিল। এভাবে প্রণীত চূড়ান্ত খসড়াটি কমিটির সভাপতি এবং দেশের আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন সংবিধানের বিলের আকারে গণপরিষদের অধিবেশনে উপস্থাপন করেন। ১৮ অক্টোবর থেকে গণপরিষদে সংবিধান বিল সম্পর্কে সাধারণ আলোচনা হয় এবং ৩০ অক্টোবর তা সমাপ্ত হয়। ৩১ অক্টোবর থেকে গণপরিষদে খসড়া সংবিধানের ধারাওয়ারি আলোচনা শুরু হয়। ৩ নভেম্বর পর্যন্ত সেই আলোচনা চলে। এ আলোচনা সভায় সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য হিসেবে এম আবদুর রহিম সংসদে উপস্থিত সদস্যদের এক প্রশ্নের জবাবে সংবিধানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িক বিষয়ের পক্ষে তাঁর যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করেন। এভাবে আলোচনাকালে সদস্যগণ কর্তৃক আনীত কতিপয় যৌক্তিক সংশোধনী প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে সংবিধান বিলটি পাস হয়।

বঙ্গবন্ধু তাঁর রাষ্ট্রচিন্তার আলোকেই ১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধানে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র এবং গণতন্ত্রের পাশাপাশি ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। রাষ্ট্রের এসব মূলনীতিকে কেউ কেউ মুজিববাদও বলে থাকেন। বঙ্গবন্ধুর এ ধর্মনিরপেক্ষতা জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠিত করার মহৎ উদ্দেশ্যেই সংবিধানে যাবতীয় সাম্প্রদায়িকতা, কোনো একটি বিশেষ ধর্মের জন্য রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মকে ব্যবহার এবং ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্তি করার অপচেষ্টাকে বিলুপ্ত করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ঐতিহাসিক ৭ মার্চ উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ভাষণদানকালে বলেছিলেন : বাংলাদেশে মুসলমান মুসলমানদের ধর্ম পালন করবে। হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে। খ্রিস্টান তার ধর্ম পালন করবে। বৌদ্ধও তার নিজের ধর্ম পালন করবে। এ মাটিতে ধর্মহীনতা নাই, ধর্মনিরপেক্ষতা আছে। এর একটা মানে আছে। এখানে ধর্মের নামে ব্যবসা করা চলবে না। ধর্মের নামে মানুষকে লুট করে খাওয়া চলবে না। ধর্মের নামে রাজনীতি করে রাজাকার-আলবদর পয়দা করা বাংলার বুকে আর চলবে না। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করতে দেওয়া হবে না। বঙ্গবন্ধু প্রায়ই বিভিন্ন বক্তৃতা-বিবৃতিতে এবং নানান আলাপচারিতায় দেশে-বিদেশে এভাবেই তাঁর ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন।

মূলত বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক সংগঠন। ব্যক্তিগতভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরোধী। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মকে ব্যবহার করা তিনি বরাবরই ঘৃণা করতেন। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অবসান ঘটানোর জন্য তিনি তাই রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে ‘ধর্মনিরপেক্ষ নীতি’ সংযোজন করেন। ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে ধর্ম ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর নানা সমালোচনা ও বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে গণপরিষদসহ বিভিন্ন ভাষণে বঙ্গবন্ধু এ বিষয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন। ৪ নভেম্বর ১৯৭২ গণপরিষদে সংবিধান-বিলের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন : ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে ৭ কোটি মানুষের ধর্ম-কর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করবও না।...মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে- তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা এ রাষ্ট্রে কারও নাই। হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবে- কারও বাধা দেওয়ার ক্ষমতা নাই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে- তাদের কেউ বাধাদান করতে পারবে না। খ্রিস্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে- কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হলো এই যে, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না।

এম আবদুর রহিমসহ সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্যরা ১৯৭২ সালে খসড়া সংবিধান প্রণয়নের প্রেক্ষাপটে সংবিধানের মূল ধারায় ধর্মনিরপেক্ষতাকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। এ বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সহযোদ্ধা এম আবদুর রহিম। তিনি নিজেই ধর্মপ্রাণ পরিবারের অনুগামী ও ধর্মকর্মের নিয়ম-বিধান নিয়মিত অনুসরণ করলেও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ন্যায় রাজনৈতিক ব্যক্তিক চরিত্রের প্রকাশে মানবতাবাদী এম আবদুর রহিম কোনো দিন ধর্মান্ধতায় আচ্ছন্ন ছিলেন না। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের রাজনৈতিক অনুসরণকারী ব্যক্তিত্ব। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, একদিন আবুল মনসুর আহমদের সঙ্গে আলাপচারিতায় এ কে ফজলুল হক সম্পর্কে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বলেছিলেন, ‘ফজলুল হক মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত খাঁটি বাঙালি। সেই সঙ্গে ফজলুল হক মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত খাঁটি মুসলমান। খাঁটি বাঙালিত্বের সাথে খাঁটি মুসলমানত্বের এমন অপূর্ব সমন্বয় আমি আর দেখি নাই। ফজলুল হক আমার ছাত্র বলে বলছি না, সত্য বলেই বলছি। খাঁটি বাঙালিত্ব ও খাঁটি মুসলমানত্বের সমন্বয়ই ভবিষ্যৎ বাঙালির জাতীয়তা’। এই বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা যেমন ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তেমনি তাঁরই রাজনৈতিক আদর্শের উত্তরসূরি অসাম্প্রদায়িক চেতনার অগ্রদূত খাঁটি মুসলমান ও খাঁটি বাঙালি ছিলেন এম আবদুর রহিম। 

আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে (১৯৭২-৭৫) উল্লেখযোগ্য সাফল্য ছিল বাংলাদেশের জন্য একটি সংবিধান প্রণয়ন করা। মাত্র এক বছরের মধ্যে একটি সংবিধান প্রণয়নের জন্য আওয়ামী লীগকে প্রশংসা করতেই হয়। সংবিধানটি ছিল একটি সুলিখিত দলিল। এ সংবিধানে জনগণের তৎকালীন আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন সন্নিবেশিত হয়েছিল। মুক্তি সংগ্রামের সময় আওয়ামী লীগ জাতির সামনে যেসব প্রতিশ্রুতি রেখেছিল এ সংবিধানে সেগুলোর অধিকাংশের বাস্তবায়ন ঘটানোর চেষ্টা হয়েছে। ১৯৭২ সালের এ গণমুখী খসড়া সংবিধান প্রণয়নে দিনাজপুরের জননেতা এম আবদুর রহিম ছিলেন অন্যতম প্রণেতা। যুক্তরাষ্ট্রের যারা প্রথম খসড়া সংবিধান রচনা করেছিলেন তাদের ‘ফাদার ফিগার’ বলা হয়। বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে যাঁরা খসড়া সংবিধান রচনা করেছিলেন দীর্ঘ দিবস-রজনী অতিবাহিত করে তাঁদের রাষ্ট্র কোনো সম্মানে ভূষিত করেছে বলে আমাদের জানা নেই। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশের খসড়া সংবিধান রচনা সমাপ্ত হয়। ওই দিনটি হতে পারত রাষ্ট্রীয়ভাবে সংবিধান দিবস। একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে, রাষ্ট্র পরিচালনায় সংবিধানের মৌলনীতি, নির্দেশনা ও তাৎপর্য হয়তো আমরা এখনো উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হচ্ছি।

জাতীয় সংসদে সংবিধান কমিটি কর্তৃক খসড়া সংবিধানবিষয়ক আলোচনায় সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য এম আবদুর রহিম তাঁর যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করেন। এ প্রসঙ্গে তৎকালীন সংসদ সদস্য ও সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ তাঁর শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদনে এম আবদুর রহিম সম্পর্কে বলেন :

খসড়া সংবিধান রচনায় রাষ্ট্রীয় মূলনীতি, বিশেষ করে ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে খন্দকার মোশতাক কূট প্রশ্ন তুলে বলেছিলেন, ‘মুসলিম দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্রীয় আদর্শ হতে পারে না।’ সে সময় ইসলাম ধর্মের মৌল দিকগুলো অবলীলায় ব্যাখ্যা করে অ্যাডভোকেট এম আবদুর রহিম বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিলেন এবং কোরআন-হাদিসের আলোকে প্রমাণ করেছিলেন, ধর্মনিরপেক্ষতা ইসলামবিরোধী নয়, কোনো ধর্মের বিরুদ্ধে তো নয়ই।

বিষয়টি সুদূরপ্রসারী ও তাৎপর্যপূর্ণ। এখনো চলমান। ধর্মনিরপেক্ষতা তুলে দেওয়ার ফলে আজ রাষ্ট্রের সর্বাঙ্গে জঙ্গিবাদের রক্তাক্ত থাবার উৎস খুঁজে নিতে হবে এখানেই। জাতির পিতাকে হত্যা করার পর সামরিক ফরমান বলে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তন করেন। এর বিরুদ্ধে লক্ষ্য করেছি, সে সময় আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা মাথা ঘামিয়েছেন বলে মনে হয়নি। শ্রদ্ধেয় রহিম ভাই কীভাবে ১৯৭২ সালে রক্তেঅর্জিত সংবিধানকে লন্ডভন্ড করা হয়েছে সে বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ আলাপ করেন। কিন্তু বেশকিছু বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আলোচনার সময় দেখতে পেলেন, সংবিধানের এ পরিবর্তনের ফলে জাতির যে অপূরণীয় ধ্বংসাত্মক ক্ষতি হবে, জাতি যে পুনরায় পাকিস্তানি ভাবধারায় চলে যাবে- এ সম্পর্কে তারা নির্মোহ ও অনাগ্রহী। তখন বাধ্য হয়ে অ্যাডভোকেট এম আবদুর রহিম জাতির পিতার আদর্শ ও দর্শনে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজেই সামরিক ফরমান দ্বারা সংবিধানের কোন কোন অনুচ্ছেদ পরিবর্তন বা সংশোধন হয়েছে তার উদ্ধৃতি দিয়ে পাল্টা ব্যাখ্যা করে বলেন, সামরিক ফরমানে সংবিধান সংশোধন করার অধিকার জনগণ কাউকে দেয়নি।

এম আবদুর রহিম সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদে ধর্মনিরপেক্ষতা, ৩৮ অনুচ্ছেদে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা যাবে না-সহ দালাল আইন বাতিল এবং দালালদের ক্ষমা করে প্রকারান্তরে তাদের রাজনীতি করার যে অধিকার দেওয়া হয়েছিল তার বিরুদ্ধে প্রায় হাজার কপি পুস্তিকা ছাপিয়ে সংসদ সদস্য, নেতৃবৃন্দের হাতে পৌঁছে দেন। পরে ১৯৯১ সালে পার্লামেন্টে যখন সুযোগ পেয়েছেন সামরিক ফরমানে সংশোধিত এসব অশুভ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে সোচ্চার ছিলেন। একজন মানুষ কড়া সামরিক শাসনের মধ্যেও দেশ-জাতির স্বার্থে জাতির পিতার মহান স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষাকে ধারণ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের মৌল চেতনায় যাপিত জীবনকে সমৃদ্ধ করেছেন। স্বকালে হয়তো আমরা গুরুত্ব দিতে পারিনি; কিন্তু আগতকালের ইতিহাস তাঁর সাহস, আদর্শ, দেশপ্রেম ও নিষ্ঠার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাবে তা আমি নিশ্চিত।

আজ তাঁর সপ্তম মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি।

তথ্যসূত্র : বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম, বঙ্গবন্ধু : সংবিধান আইন আদালত ও অন্যান্য, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, মার্চ ২০২১, পূর্বোক্ত, পৃ. ১১০

আতফুল হাই শিবলী : মো. মাহবুবর রহমান, বাংলাদেশের সাংবিধানিক ইতিহাস : ১৭৭৩-১৯৭২, সুবর্ণ প্রকাশন, ঢাকা, জুন ২০১৯, পৃ. ১৫৮

আতফুল হাই শিবলী : মো. মাহবুবর রহমান, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৫৯

আসাদুজ্জামান সম্রাট (সম্পা.), পার্লামেন্ট জার্নাল, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ, ঢাকা, অক্টোবর ২০১৬, পৃ. ৪৫

আতফুল হাই শিবলী : মো. মাহবুবর রহমান, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৬০

মাওলানা এম এ রহমান, বঙ্গবন্ধুর দেশপ্রেম, বিভাস প্রকাশন, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১৭, পৃ. ১২৩

বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম, পূর্বোক্ত, পৃ. ৬০

আবুল মনসুর আহমদ, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, খোশরোজ কিতাব মহল, ঢাকা, জানুয়ারি ২০১৬, পৃ. ১৩৫

গোলাম সারওয়ার, (সম্পা.), দৈনিক সমকাল, ঢাকা, অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ, শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রবন্ধ শিরোনাম : আসব যাব চিরদিনের সেই আমি, প্রকাশ : ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

গোলাম সারওয়ার, (সম্পা.), পূর্বোক্ত, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬।

 

লেখক : অধ্যক্ষ, দিনাজপুর সরকারি সিটি কলেজ, দিনাজপুর

সর্বশেষ খবর