বুধবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

আমাদের নোমান স্যারের কথা

ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন

আমাদের নোমান স্যারের কথা

শিক্ষক ও ছাত্রের সম্পর্কটা মাঝে মধ্যে বাবা-ছেলের বন্ধনে ধরা পড়ে। স্যারের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা এর চেয়ে বেশি বৈ কম ছিল না। প্রাইমারি থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ডিগ্রি পর্যন্ত অধ্যয়নকালে বহু গুণী, জ্ঞানী ও সুনাগরিক শিক্ষকের সান্নিধ্যে আসার সুযোগে আমি ধন্য। তার মধ্যে উজ্জ্বল তারকা হিসেবে আমার মনোদিগন্তে সদা দীপ্যমান যিনি, তাঁর নাম মোহাম্মদ নোমান। প্রফেসর নোমানের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়টা কিন্তু খানিকটা মন কষাকষি দিয়ে শুরু হয়। পঞ্চাশের দশকের শেষাশেষি। স্যার সে সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ বিদ্যায়তনের অন্যতম এমসি কলেজে আমাদের ইংরেজি পড়ান। এমনিতে সদালাপি, অমায়িক, স্নেহপ্রবণ হলেও অধ্যাপক নোমান শ্রেণিকক্ষের শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতায় দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী ছিলেন। শুরুতে এক দিনের ক্লাসে আমার পাশে বসে থাকা সতীর্থ কী যেন একটা দুষ্টুমি করতে গিয়ে নোমান স্যারের হাতে ধরা পড়ে। আর যায় কোথায়। বন্ধুর সঙ্গে আমিও অপরাধের সন্দেহযুক্ত হয়ে থাকলাম। কয়েক মাস পর একটা পরীক্ষা হয়। দুই দিন পর নোমান স্যার ডেকে পাঠালেন। আমার খাতা তার হাতে। পিঠে হাত বোলালেন। বাবা-সোনা বলে ডাকলেন। ম্যাট্রিক পরীক্ষায় ইংরেজিতে সর্বোচ্চ নম্বর পাইনি শুনে অবাক হলেন। ™ি^তীয় সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিলাম জেনে খানিকটা আশ্বস্ত হলেন। নিয়মিত ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকা পড়ার উপদেশ দিলেন স্যার। আইউবশাহীর সামরিক শাসনকাল তখন। কলেজের নির্বাচিত ইউনিয়ন বাতিল। কলেজ কর্তৃপক্ষ নতুন কমিটি নিয়োগ দিল। আমাকে করা হলো সাহিত্য সম্পাদক। অধ্যাপক মোহাম্মদ নোমান ছিলেন উপদেষ্টা। সেই থেকে স্যারের সঙ্গে আত্মার আত্মীয়তা গড়ে ওঠে আমার। ১৯৮৪ সাল থেকে দীর্ঘ ১১ বছর দেশের বাইরে থাকার সময় নোমান স্যারের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগটা কমে যায়; কিন্তু তার আগে নিয়মিত দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে অধ্যাপনার সুযোগ পাওয়ায় যেমনটি খুশি হয়েছিলেন, তার চেয়েও বেশি নিরাশ হয়েছিলেন ওটি ছেড়ে সিভিল সার্ভিসে যোগ দেওয়ার খবর শুনে। তিনি মনে করতেন, আমি বড় অধ্যাপক হব এবং সাহিত্য সাধনায় উৎকর্ষ লাভ আমার জন্য সহজ হবে। জানি না শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রত্যাবর্তনের প্রচেষ্টা আমার এ পরম সুহৃদের বিদেহী আত্মাকে শান্তি দিতে পারবে কি না। নোমান স্যার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের কৃতী ছাত্র ছিলেন। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ওয়েস্ট হাউসে থাকতেন তিনি। তাঁর সমসাময়িক ছাত্রদের মধ্যে অধ্যাপক এম এ হাশিম ও মীর আহমদ জামাল মরহুম নোমানের বিষয়ে বলতে গেলেই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তাঁরা এবং অন্যান্য বন্ধুবান্ধব ও পরিচিত সমসাময়িকদের মতে, মোহাম্মদ নোমান একজন চমৎকার লোক ছিলেন; তাঁর হৃদয়ের উষ্ণতা এবং অনুভূতির গভীরতা তাঁকে সব মহলে আপন করে রেখেছিল। বিশেষ করে দরিদ্র ও বঞ্চিত মানুষের জন্য নোমান স্যারের মমত্ববোধ ছিল অপরিসীম। তিনি বলতেন, পাঠ্যপুস্তকের জ্ঞান মানুষকে আক্ষরিত অর্থে শিক্ষিত করতে পারে। আর সত্যিকারের গুণী লোককে হতে হবে হৃদয়ের ঐশ্বর্যে সমৃদ্ধ। মানুষের জন্য মমতা একজন মানুষকে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে গণ্য হতে সাহায্য করে। ছোটখাটো আকারের মানুষ ছিলেন নোমান স্যার; কিন্তু তাঁর মুখের হাসিটা ছিল বিরাট। গায়ের কালো রং তাঁকে যেন আরও সুশ্রী করে তোলে। কোনোদিন কাউকে ধমক দিয়ে স্যারকে কথা বলতে কেউ শোনেননি। অথচ তাঁর ব্যক্তিত্ব ছিল অত্যন্ত সবল। ছাত্রছাত্রীদের অতি প্রিয় শিক্ষক ছিলেন তিনি। কারণ পড়ানোতে তিনি প্রাণ ঢেলে দিতেন। মূল্যবোধের কথা বলতেন। সৎ পথে থেকে একটা আদর্শ ও লক্ষ্যের ভিত্তিতে পথচলা তিনি পছন্দ করতেন। আমার মনে আছে, টম রামজে ও জর্জ রামজে ভ্রাতৃয়ের গল্প পড়ানোর সময় ফটকাবাজি করে হঠাৎ বড়লোক না হয়ে ‘স্লো অ্যান্ড স্টেডি’ অবস্থায় দৌড়ে জেতার পক্ষে মত দিতেন আমার স্যার। অধ্যক্ষ মোহাম্মদ নোমান একজন বিজ্ঞ চিন্তাবিদ ও নিরলস কর্মী ছিলেন। তাঁর ব্যক্তিত্বের মধ্যে এমন একটি বিশেষত্ব ছিল, যা তার সাহচর্যে আসা ছাত্রছাত্রী, সহকর্মী, অনুরাগী, বিরাগী নির্বিশেষে সবাইকে চমৎকৃত করতে পারত। নোমান স্যারের বিরুদ্ধে কাউকে কোনোদিন কথা বলতে শুনিনি। তাঁর বক্তব্যে অনেক সারবত্তা যেমন থাকত তেমনি তাতে থাকত প্রচুর যুক্তি। তিনি সাধারণত আবেগতাড়িত না হয়ে যুক্তিনির্ভরভাবে সিদ্ধান্তে আসার পক্ষে ছিলেন। নোমান স্যারের মধ্যে একটা প্রচ- ইতিবাচক মোহনীয় আকর্ষণ ছিল, যা তাঁকে মহীয়ান করে রেখেছে। মরহুম শিক্ষাবিদ নোমান আজীবন একটা শিক্ষার পরিবেশে আদর্শ জীবন কাটিয়েছেন। তাঁর সুযোগ্য সহধর্মিণী গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের অধ্যাপিকা ছিলেন। তিন ভাইকে আমি চিনি, তারা হয় প্রত্যক্ষভাবে শিক্ষার সঙ্গে জড়িত অথবা কমপক্ষে শিক্ষা অনুরাগী। শুনেছি নোমান স্যারের বড় দুই মেয়েও শিক্ষকতার মহতী কাজে নিয়োজিত। এই যে পরিবারের সদস্যদের শিক্ষার মাধ্যমে জাতিকে সেবা প্রদানের জন্য অনুপ্রাণিত করা, এতেই নোমান স্যারের মহৎ ও আলোকিত হৃদয়ের নির্ভেজাল মানব ও দেশপ্রীতি প্রকাশ পেয়েছে। নোমান স্যার আজ আমাদের মাঝে নেই। বর্তমানে শিক্ষা ক্ষেত্রে সংকট না হলেও যে সমস্যার বিরাট জাল বিস্তৃতি লাভ করেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এ কঠিন পরীক্ষার সময় নোমান স্যারের মতো একজন যোগ্য, দক্ষ, সৎ, স্বচ্ছ ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী শিক্ষা অন্তপ্রাণ কীর্তিমান পুরুষের উপস্থিতির বড় প্রয়োজন ছিল। কারণ শিক্ষা ক্ষেত্রে বিরাজমান নৈরাজ্য দূর করতে না পারলে জাতি হিসেবে আমাদের বলিষ্ঠ পদচারণা বাধাপ্রাপ্ত হবে- কী উন্নয়ন প্রচেষ্টায় কী আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে।

স্যার আমাদের মধ্যে শারীরিকভাবে উপস্থিত না থাকলেও তাঁর নীতি, আদর্শ ও মূল্যবোধ আমাদের চলার পাথেয় হয়ে থাকবে। নোমান স্যারের সততা, নিষ্ঠা ও মানব প্রেমে অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁর ছাত্রছাত্রীরা এবং অন্য সহচর-অনুরাগীরা যদি শিক্ষা ক্ষেত্রে সর্বোত্তম উৎকর্ষ আনার প্রচেষ্টায় ব্রতী হই তাহলেই তাঁর মহতী আত্মার প্রতি যথোপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করা হবে।

আমি আমার প্রিয় নোমান স্যারের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। তাঁর প্রতি জানাই হƒদয়ের গভীরতম প্রদেশের শ্রদ্ধা ও আনুগত্য।

                লেখক : সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক।

সর্বশেষ খবর