বুধবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

সনাতন ধর্মে কৃষ্ণভাবনা

ফনিন্দ্র সরকার

সনাতন ধর্মে কৃষ্ণভাবনা

সনাতন ধর্মের অনুসারী হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মানুষ্ঠান খুবই বৈচিত্র্যময়। বহুবিধ পূজা অর্চনা ঈশ্বরেরই লীলা বিলাস হিসেবে মনে করা হয়ে থাকে। বহুভাবে মহাশক্তিকে জানার অনবদ্য প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে পূজা পার্বণ অনুষ্ঠিত হয়। ‘একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি, - অর্থাৎ সেই এক সদ্বন্তকে গুণীজন বা ভক্তগণ বহুভাবে জানেন। যুগে যুগে একত্বের বিশ্বাসই স্থাপিত হয়ে আসছে ভিন্ন ভিন্ন আদলে। ঈশ্বরের নৈকট্য লাভে ভক্তগণ ভগবানের সঙ্গে পরম আত্মীয় জ্ঞানে ভক্তিভাবে পূজার আয়োজন করে আসছে। এটা হচ্ছে সনাতন ধর্মের সহজ একটা পন্থা। এ পন্থায় ভক্তি-প্রেমের আবহ সৃষ্টি হয়। পৃথিবীতে মানব কল্যাণে স্বয়ং ভগবান আবির্ভূত হন। সব ধরনের বৈরিতা ও অন্ধকার দূরীকরণে তিনি জন্মগ্রহণ করেন নানা রূপে। পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়ে ভক্তি রসে আপ্লুত করেন লীলা প্রসারণে। এই বিশ্বাসে শান্তির নিঃশ্বাস ফেলেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। এই ধর্মেরই প্রাণপুরুষ হিসেবে খ্যাত শ্রীকৃষ্ণ । ইনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। হিন্দু শাস্ত্রে বর্ণিত আছে- ‘সাধকানাং হিতার্থয় ব্রহ্মণ্যে রূপ কল্পনা’ সাধকের কল্যাণের জন্য তিনি রূপ ধারণ করেন। এই ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্রোহী কবি নজরুল বলেছেন, ‘তুমি বহুরূপী তুমি রূপহীন, তব লীলা হেরি অন্তবিহীন।’ এ জগতে শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব ঘটেছে দুষ্টের দমন ও সৃষ্টের পালন উদ্দেশ্যে। শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, যেটি গীতায় উল্লিখিত-

‘যদা যদাহি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।

অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাতøানং সৃজামাহম’॥

অর্থাৎ যখন ধর্মের গ্লানি এবং অধর্মের প্রাদুর্ভাব ঘটে তখন ধর্ম রক্ষার্থে আমি নিজেকে সৃজন করি। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্ম বা আবির্ভাব এ অবস্থারই ফলশ্রুতি।

মহাসাধক বিবেকানন্দ বলেছেন, “যে আত্মা জীবাত্মারূপে আবির্ভূত হয়েছেন, তাঁর মহিমা, কোনো গ্রন্থ, কোনো শাস্ত্র, কোনো বিজ্ঞান কল্পনাও করতে পারে না।’ এ এক লক্ষণীয় সত্য। সাধারণভাবে আমরা সীমিত তেজসম্পন্ন জীববিশিষ্ট একটি ব্যক্তিসত্তা মাত্র। আমাদের স্বতঃস্ফূর্ত ধারণা, প্রত্যেক মানবসত্তার অন্তরে কিছু নিগূঢ় বস্তু রয়েছে। এই ধারণাই এক আশ্চর্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, যখন নর বা নারী সত্যকে বুঝতে চেষ্টা করে। পরে তাই হয়ে ওঠে উপলব্ধ বস্তু। শ্রীকৃষ্ণ সে রকমই উপলব্ধ বিষয়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফরাসি দার্শনিক ও মরমি সাধক প্যাসক্যাল বলেছিলেন, ‘অন্তরীক্ষে বিশ্ব আমাকে ঘিরে থাকে, আর আমি একটি বিন্দুতে পরিণত হই। কিন্তু মনের সাহায্যে আমি সেই বিশ্বকে বুঝি।’ মানুষের যথার্থ মাত্রাটা কী? মানুষ কি একটি ধূলিকণা মাত্র? এমন প্রশ্ন জাগতে পারে। না, ওই ধূূলিকণার অন্তরে রয়েছে মহতী ‘দীপ্তি-। সেটা হচ্ছে আত্মা, যা বিস্ময় সৃষ্টি করে। যদি ইন্দ্রিয় মাধ্যমে প্রাপ্ত জাগতিক অভিজ্ঞতা বিস্ময় সৃষ্টি করে, তবে অন্তরে ‘অবরুদ্ধ, আত্মা সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা হলে লক্ষ লক্ষ গুণ বেশি বিস্ময়কর। সেই প্রগাঢ় সত্যটি শতাব্দীর পর শতাব্দী মানব মনকে মুগ্ধ করে রেখেছে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সেই মুগ্ধতার প্রতীক হিসেবে জগতে বিরাজমান। কেননা কাহিনি অনুসারে শ্রীকৃষ্ণ ধরাধামে ১২৫ বছর মানবদেহে বিচরণ করেছেন। এর মধ্যে তিনি ১২ বছর বৃন্দাবনে লীলা করেছেন। মহাভারতে কুরুক্ষেত্রে বর্ণিত যুদ্ধ অলৌকিকতায় ভরপুর হলেও লৌকিক আচারে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। সেই যুদ্ধ শেষে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকা নগরী শাসন করেছেন অনেক বছর। শ্রীকৃষ্ণের দাদা বলরাম গহিন বনে যোগবলে দেহত্যাগ করেন। জগতের লীলা সাঙ্গ করে শ্রীকৃষ্ণও অন্তর্হিত হন তমাল বৃক্ষের নিচে ভক্ত ব্যাধের শরাঘাতে। এটাই নিয়তি। ভগবানের তো কখনো মৃত্যু হতে পারে না। তাহলে কেন এই মৃত্যু। আসলে জীবাত্মার অবসান। পরমাত্মার কখনো মৃত্যু হয় না। তবে জীবাত্মা পরমাত্মারই অংশ। সনাতন ধর্মের এক মহা অনুষ্ঠান শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমী। ভাদ্র মাসের রোহিণী নক্ষত্রযোগে কৃষ্ণা অষ্টমী তিথিতে এ অনুষ্ঠান উদযাপিত হয় মহা আড়ম্বরে। কৃষ্ণমূর্তিতে পূজা অর্চনা করা হয়। আশ্চর্যের বিষয়, কাল্পনিক যে অবয়বটি তৈরি করা হয় সেটি তারুণ্যদীপ্ত। অনেকের জিজ্ঞাসা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যেখানে ১২৫ বছর বেঁচেছেন সেখানে বার্ধক্যের মূর্তি বানিয়ে পূজা করা হয় না কেন? এর উত্তরে এটাই প্রণিধানযোগ্য, শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং ঈশ্বরের প্রতিভূ। মহাশক্তির প্রতীক। মহাশক্তি ক্ষয়িষ্ণু নয়। সদা সর্ব তারুণ্যে উজ্জ্বীবিত। তাই বার্ধক্যের মূর্তি কল্পনা করা হয় না। শক্তির ভাবনায় শ্রীকৃষ্ণ জগতে আলোকময়।

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময় শ্রীকৃষ্ণ তার সারথী অর্জুনকে বলেছিলেন, ‘হে অর্জুন তোমাকে সব জীবের জন্য দুঃখ করতে হবে না।’ যিনি মানবদেহে বাস করেন যাকে, কেউ কখনো বধ করতে পারে না।’ এটা হচ্ছে অনন্ত সত্যের প্রকৃতি।’ এই দেহী (জীবাত্মা) হলেন অবধ্য। হে অর্জুন-‘তস্মাৎ সর্বাণি ভূ তানি ন ত্বং শোচিতুম অহসি, অতএব এ জগতের কোনো কিছুর জন্য কোনো জীবের জন্য তোমাকে শোক করতে হবে না। মানবের গঠনতন্ত্রের প্রকৃত মাত্রাটিকে তুমি কোনো দিনই স্পর্শ করতে পারবে না।’ কাজেই জীবকে শিক্ষার জন্য যে বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছেন শ্রীকৃষ্ণ, তা-ই প্রকৃত ধর্ম।

 

শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন-

‘যে যথা মাং প্রপদন্তে তাং স্তথৈব ভজামহ্যম।

মম বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যঃ পার্থ সর্বশঃ॥

অর্থাৎ হে পার্থ, যে যেভাবে আন্তরিক হয়ে আমাকে ভজনা করে আমি তাকে সে ভাবেই দর্শন দিয়ে থাকি। বিষয়াসক্তি ঈশ্বর প্রাপ্তির অন্তরায়, কিন্তু অনাসক্ত বিষয়ভোগ অন্তরায় নয়। এভাবে জগতে আনন্দ স্বরূপের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। শ্রীকৃষ্ণের শিক্ষার পেছনে মানবের অন্তর্নিহিত দেবত্বের ধারণাই ব্যক্ত হয়েছে।

                লেখক : কলাম লেখক।     

সর্বশেষ খবর