বৃহস্পতিবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

কৃষিকে গৌরবান্বিত করার প্রয়াসে নিবেদিত যিনি

ড. আবদুুর রাজ্জাক

কৃষিকে গৌরবান্বিত করার প্রয়াসে নিবেদিত যিনি

শাইখ সিরাজ সম্পর্কে কিছু লিখতে গিয়ে আজ অনেক কথাই মনে পড়ছে। কোনটা রেখে কোনটা দিয়ে শুরু করব, এটা এক বড় মধুর দ্বন্দ্ব। বাংলাদেশের একজন অত্যন্ত সফল উন্নয়ন সাংবাদিক, কৃষি এবং গ্রামীণ জনপদের উন্নয়নে অসাধারণ ভূমিকা রেখে চলেছেন তিনি। এরই মধ্যে আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা আর সম্মানের জায়গায় আসন করে নিয়েছেন কৃষি উন্নয়ন কর্মী শাইখ সিরাজ। তার জন্মদিন উপলক্ষ করে লেখাটা। বিপুল এ পৃথিবী, বিশাল বড় এ পৃথিবীতে কিছু কিছু মানুষ তার নিজ কাজে অম্লান হয়ে থাকে, সমাজে আলাদাভাবে জায়গা করে নেয়। যেটি অনেক মানুষের জন্য, বিশেষ করে আগামী প্রজন্মের জন্য অনুসরণীয় হয়ে থাকে। আমি বলব যে শাইখ সিরাজ সাংবাদিক হিসেবে এমন অনন্য কাজ করেছেন, এমন সফলভাবে তিনি তার লক্ষ্যকে সামনে নিয়ে চলেছেন যার প্রশংসা না করে পারা যায় না। তার সঙ্গে আমার পরিচয় দীর্ঘ বছরের। আমি প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে আসি ২০০১ সালে, বিরোধী দলের এমপি তখন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলাম। তখন এত বেশি চ্যানেল ছিল না, সে সময় চ্যানেল আইয়ের অনেক অনুষ্ঠানে যেতাম। ওই সময়ে তার সঙ্গে আমার অনেক মতবিনিময় করার সুযোগ হয়েছে। তারও আগে আমি যখন সরকারি চাকরি করি একজন বিজ্ঞানী হিসেবে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলে। গাজীপুরে তখন কেবল ভুট্টার চাষ জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে। ভুট্টার চাষকে সারা দেশে জনপ্রিয় করার জন্য শাইখ সিরাজ অনেক কাজ করেছেন। তখনই তার সঙ্গে আমি প্রথম কথা বলি, একজন বিজ্ঞানী হিসেবে। বিটিভিতে মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানে আমার বক্তব্য প্রচার হয়েছিল। তারপর তার সঙ্গে খুব বেশি যোগাযোগ ছিল না। ২০০৮ সালে আমি খাদ্য, ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ছিলাম। তখন থেকেই অনেক ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছি। তিনি একজন কঠোর পরিশ্রমী মানুষ, তার দায়িত্ব এবং কর্মে অত্যন্ত নিষ্ঠাবান, সৎ এবং প্রজ্ঞাবান মানুষ। একই সঙ্গে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং তার সবচেয়ে বড় গুণ, তিনি দারুণ ইনোভেটিভ। সব সময় নতুন নতুন চিন্তা-চেতনা নিয়ে কাজ করে চলেছেন। সেসব আইডিয়া অনুষ্ঠানে বাস্তবায়ন করে দেশের মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন। যে বিশেষ কারণে তিনি আজ সবার কাছে শ্রদ্ধার পাত্র হয়েছেন, সবার কাছে সম্মান পাচ্ছেন তা হলো কৃষি উন্নয়নে তার অবদান। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। আমরা জানি বাংলাদেশের ৬০ থেকে ৭০ ভাগ মানুষ কোনো না কোনোভাবে কৃষির সঙ্গে জড়িত। প্রায় ৩৮ ভাগ মানুষের জীবিকা আসে কৃষি থেকে। এটি আগে আরও অনেক বেশি ছিল। আস্তে আস্তে জিডিপিতে কৃষির অবদান কমছে। কিন্তু যে ৬০-৭০ ভাগ মানুষ গ্রামে বাস করে, কেউ হয়তো নিজে সরকারি চাকরি বা অন্য কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য করে, তবে তারা সবাই কোনো না কোনোভাবে কৃষির সঙ্গে জড়িত। কাজেই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষির গুরুত্ব অপরিসীম। আর এটি চিন্তা করলে কৃষি খাতে উন্নয়নের জন্য শাইখ সিরাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। আমরা জানি, বাংলাদেশ আদি তথা সনাতন কৃষি পদ্ধতি থেকে সরে গিয়ে এখন আধুনিক যন্ত্রনির্ভর কৃষি ব্যবস্থাপনার দিকে ঝুঁকেছে। আজকে বিঘাপ্রতি ফসলের উৎপাদন বেড়েছে, আজকে নতুন নতুন ফসল এসেছে, নতুন নতুন প্রযুক্তি এসেছে। এখন বাংলাদেশের মানুষ চিন্তা করছে যে তারা আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করবে। তারা এরই মধ্যে রোবট ব্যবহার করে ফেলেছে। তবে এটা সত্য যে- জাপান, কোরিয়াসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, আমেরিকা, কানাডার কৃষির তুলনায় যান্ত্রিকীকরণে আমরা যোজন যোজন দূরে। বর্তমান সরকার কৃষির উন্নয়নের জন্য, যান্ত্রিকীকরণের জন্য উদ্যোগ নিয়েছে। এই যে আধুনিক কৃষি, নতুন নতুন উন্নত জাত, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির প্রক্রিয়া, সব খানে কাজ করছে সরকার। এমনকি ইদানীং শ্রমিকের ঘাটতির প্রেক্ষাপটে আমরা ধান কাটার মেশিন ব্যবহার শুরু করেছি। কৃষিতে আরও বেশি উৎপাদনশীলতা, আরও বেশি ফলন পাওয়াসহ সরকারি সব কর্মসূচিতে শাইখ সিরাজ নির্মোহভাবে মতামত দেন, আমাদের ভালো-মন্দ দিকগুলো প্রচার করেন। আমাদের বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে যেসব উদ্ভাবন করেন তা মাঠের কৃষকদের কাছে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তিনি অসাধারণ ভূমিকা রাখছেন। এটার কোনো তুলনা হয় না। কারণ একটি প্রযুক্তি কৃষকের কাছে যেতে অনেক সময় লাগে। তা ছাড়া নতুন প্রযুক্তি কৃষক চট করে নিতেও চায় না অনেক সময়। নতুন ফসল ফলাতে ঝুঁকি মনে করে। এক্ষেত্রে শাইখ সিরাজের কৃষকের সঙ্গে যে বোঝাপড়া তা আমাদের দারুণ কাজে দেয়। আমি মনে করি, যে সরকারই আসুক না কেন কৃষির জন্য শাইখ সিরাজকে তাদের প্রয়োজন হবে।

টেলিভিশনে অনুষ্ঠান নির্মাণের পাশাপাশি তিনি পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করেন। আমি যতদূর জানি তিনি বিভিন্ন সামাজিক কাজেও সময় দেন। আমি দেখেছি বহু ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার তারাও শাইখ সিরাজের অনুষ্ঠানগুলো দারুণ আগ্রহ নিয়ে দেখেন, কথা বলেন দীর্ঘদিন যাবৎ। তার আরেকটি কর্মসূচি কৃষি বাজেট, কৃষকের বাজেট। কৃষক কীভাবে সার, যন্ত্র, নীতি সহায়তা পেতে পারে সেটি তিনি কৃষককে জানান, সরকারকে জানান। ক্রপ ক্যালেন্ডার ধরে ধরে কোন ফসল কখন উৎপাদন করলে রপ্তানি বাড়বে, আমদানি কমবে এগুলোও তিনি জানান। কৃষকদের জন্য সরকারের কী নীতি-সহায়তা নিতে হবে সেটিও জানান এ আয়োজনের মধ্য দিয়ে। একটা কথা আছে, যার ঘা ব্যথাও তার। কৃষিকাজ করতে গিয়ে কী কী সমস্যা, ঋণের সমস্যা, প্রযুক্তির সমস্যা, কৃষির উপকরণ নিয়ে কৃষকের কী সমস্যা- সব তিনি তুলে ধরেন। আমিও অনেক প্রোগ্রামে গেছি, বলা যায় প্রায় প্রতি বছরই তার এ কর্মসূচিতে যাই। তিনি প্রকারান্তরে এ কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারকে প্রভাবিত করেন সেটা হলো কৃষিতে ভালো কিছু করা। আমি মনে করি শাইখ সিরাজ সারা জাতির পক্ষে একটা রাজনৈতিক দল ও নেতার মতো কাজ করছেন। হৃদয়ে মাটি ও মানুষ এবং কৃষি বাজেট, কৃষকের বাজেট- এ দুটি অনুষ্ঠান আমি নিয়মিত দেখি, ভীষণভাবে উপকৃত হই। এ কর্মসূচিগুলো সবার কাছে জনপ্রিয়, সবার স্বার্থ সংরক্ষণ হয় এর মাধ্যমে।

আমি জানি কৃষিকাজ অত্যন্ত কঠিন। কাঠফাটা রোদ, বৃষ্টি উপেক্ষা করে কৃষক পরম মমতায় মাঠে সোনালি ফসল ফলান। ধান লাগানো, ধান কাটা, পাট লাগানো, আঁশ ছাড়ানো সবই কষ্টের। কৃষি এবং কৃষকের হাসি-কান্নার সবদিক শাইখ সিরাজ তুলে ধরেন। বলা যায়, তিনি এ কাজে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। অস্থির একটা সময় পার করছি আমরা। চারদিকে  এত সমস্যার মধ্যেও তিনি কৃষির উন্নতিতে কাজ করে চলেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও তিনি দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করেছেন বলা যায়। আর সে জন্যই শাইখ সিরাজ গণভবনের কৃষিকাজ দেখার সুযোগ পেয়েছেন, তার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সারা দেশের মানুষ দেখেছে কৃষির প্রতি বঙ্গবন্ধুকন্যার কী অসীম মমতা। ‘গণভবনে আঙিনা কৃষি’ অনুষ্ঠানটি এক ধরনের কাব্যময় কর্মসূচি বলতে পারি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে। শাইখ সিরাজ এটিকে যেভাবে উপস্থাপন করেছেন তা সত্যিই প্রশংসনীয়। কৃষিবান্ধব প্রধানমন্ত্রীর মমতা সারা দেশের কৃষককে দারুণভাবে উদ্বুদ্ধ করেছে নিঃসন্দেহে। পেশা হিসেবে কৃষিকে গৌরবান্বিত করার নিরন্তর প্রয়াসে শাইখ সিরাজ তার কাজ অব্যাহত রাখবেন সেই প্রত্যাশা।

    ♦  লেখক : কৃষিমন্ত্রী

 

সর্বশেষ খবর