বৃহস্পতিবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা : সহানুভূতি বনাম সমানুভূতি

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা : সহানুভূতি বনাম সমানুভূতি

স্বাস্থ্যসেবা যিনি দেবেন এবং নেবেন উভয় পক্ষের মধ্যে পারস্পরিক উপলব্ধি ও অনুসরণ বা পরিপালনীয় বিষয়গুলোকে শনাক্তকরণ, হৃদয়ঙ্গম করা, ধাতস্থ হওয়ার মধ্যেই নিহিত স্বাস্থ্যসেবার যথার্থতা। জাতীয় অধ্যাপক ইব্রাহিম (১৯১১-১৯৬৯) তাঁর বাল্যশিক্ষাকাল থেকেই একটা আদর্শের অনুরক্ত অনুসারী হয়েছিলেন তা হলো মানব সেবা। তিনি তাঁর অভিজ্ঞতার আলোকে স্বাস্থ্যসেবার মূল দর্শন বা মর্মবাণী এটিই সাব্যস্ত করে গিয়েছেন যে, রোগীকে, রোগীর সমস্যাকে না বুঝলে তাকে সেবা দেওয়া পুরোপুরি সার্থক করে তোলা যাবে না বা পাওয়া যাবে না। ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে পারস্পরিক আদর্শবোধের সমন্বয় সম্মিলন যদি না ঘটে তা হলে ওই বিদ্যাচর্চায় উভয়ের আগ্রহ ও অবদান অর্থবহ হয় না। কেননা সব মানুষের মধ্যে পরার্থপরতার লক্ষ্য না থাকলে তার জীবনযাপন এবং জীবনধারণ নিছক রুটিনওয়ার্কে পরিণত হয়। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যেনতেন উপায়ে সময় কাটানোর মধ্যে বাহাদুরি তো নেই-ই, বরং সেটি সৃষ্টিকর্তার মানুষ সৃষ্টির নিয়ত ও উদ্দেশ্যের বরখেলাপ। কোরআনে (২ সংখ্যক সুরা বাকারা, আয়াত ৩০) বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ পৃথিবীতে মানুষকে তাঁর প্রতিনিধি (খলিফাতুন) হিসেবে পাঠাবার ইচ্ছা পরিকল্পনা প্রকাশ করলেন তখন ফেরেশতারা বললেন তার আর দরকার কী আমরাই তো আপনার ইবাদত বন্দেগি করি, মানুষ পৃথিবীতে হাঙ্গামা সৃষ্টি করে বেড়াবে। আল্লাহ বলেছিলেন, আমি যা জানি তা তোমরা জান না। মানুষ সৃষ্টিতে আল্লাহর উদ্দেশ্য হলো মানুষ তার নিজ সমাজ, অন্যান্য প্রাণী এবং প্রকৃতির প্রতি সৃষ্টিকর্তার প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর পক্ষে সেবা ও কল্যাণ কামনায় নিরন্তর নিয়োজিত থাকবে এবং তাদের ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পথ থেকে রক্ষা করবে। সৃষ্টির সেবাই হবে স্রষ্টার ইবাদত।’

নিজের পেশা চিকিৎসা তথা স্বাস্থ্যসেবক হিসেবে তিনি মানতেন, ‘মানসিক তৃপ্তিই চিকিৎসকের জীবনে সবচেয়ে বড় পুরস্কার।’ তাঁর উপলব্ধি, সমানুভূতি (Empathy) না থাকলে চিকিৎসার পেশা হবে প্রাণহীনভাবে অর্থ উপার্জনের একটা পথ। সে ক্ষেত্রে এই মহান পেশার মানবিক দিকটা লাঞ্ছিত হবে, অপমানিত হবে, সাধারণ মানুষের চোখে তা প্রতিভাত হবে নিতান্তই কদর্যরূপে।’ তাঁর অভিমত, ‘একজন ব্যবসায়ীর অর্থ উপার্জনের নেশা আর একজন চিকিৎসকের অর্থ উপার্জন এক হলে তা অবশ্যই সমাজের জন্য চরম দুর্ভাগ্যের কথা।’ তাঁর বিশ্বাস, ‘চিকিৎসক সেবাধর্মী পেশা, আর সেবার মাধ্যমেই স্রষ্টার নৈকট্য ও রহমত পাওয়া যায়।’ তিনি এ উপলব্ধি, অভিমত ও বিশ্বাসকে আজীবন সযত্নে লালন করেছেন। তাঁর স্বগোতোক্তি- ‘আমি জানি মানুষের জীবনের পরিধি সসীম এবং কর্মের পরিধি অসীম। অবশ্যই এই কর্মটা খাঁটি হতে হবে, জনকল্যাণমূলক হতে হবে।’ রোগ ভালো না করে টাকা নেওয়া ডা. ইব্রাহিমের কাছে লজ্জাবোধ হতো। সে জন্যই ভালো করা যায় না এমন রোগ ডায়াবেটিসের জন্য তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন বিনা পয়সার চিকিৎসালয় খুলতে। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির পথ ও পন্থা ঠিক করেছিলেন ‘No diabetic shall die unfed, untreated and unemployed even if poor’ রোগীর পরীক্ষা ও রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ডাক্তার ইব্রাহিম ছিলেন নৈপুণ্য ও সূক্ষ্মতার প্রতি অচঞ্চল; এর মধ্যেই তিনি তাঁর শিক্ষার্থী সহকর্মীদের শিখিয়ে ও বুঝিয়ে দিতেন রোগীর রোগ পরীক্ষণ ও নির্ণয় বিষয়টি কত নিখুঁত ও সূক্ষ্ম হওয়া উচিত এবং তিনি কীভাবে তা চান। তিনি ছিলেন প্রকৃতই একজন হাতে-কলমে শিক্ষাদাতা এবং একাধারে তাঁর চিকিৎসা দর্শনের মর্মসাধক- ‘আমি নিজে একটা কথা আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করি এবং আমার সহকর্মীদের এ কথাটা আমি সব সময় বলি যে, আমরা জনগণের খাদেম, এ মনোভাব নিয়ে সেবা করব; তাদের প্রভু এ মানসিকতা নিয়ে নয়। কারণ নিজেকে খাদেম মনে করলেই সেবাটা আন্তরিক হয়, মনের মধ্যে বিনয় আসে আর মানুষের প্রতি একটা মানবিক সহমর্মিতা জেগে ওঠে। আর এই সহমর্মিতা বা সমানুভূতি একজন রোগীর দুঃখ-কষ্ট যদি হৃদয়ঙ্গম না করি, তবে তো আমার সেবাটা হবে অনেকটা দায়সারা গোছের। কিন্তু আমি যদি চিন্তা করি, এ রোগীর জায়গায় আমি থাকলে কী হতো তাহলে দেখা যাবে আমার চিকিৎসার ধ্যান-ধারণাই বদলে গেছে। আমি নিজে যেমন এ মনোভাবের অনুবর্তী সে রকম অন্যদেরও এটা অনুসরণ করার জন্য অনুরোধ জানিয়ে থাকি। আর একটা কথা আমাদের ভুললে চলবে না, তা হলো আমাদের এই জনগণ হলো স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের জনগণ। এরা ১৯৪৭ সালের আগের ব্রিটিশদের গোলাম জনগণ নয়। এরা ১৯৭১ সালের আগের জনগণ নয়, যখন এ দেশকে বলা হতো কালোনি। এরা এখন স্বাধীন-সার্বভৌম একটি দেশের জনগণ।

ডা. ইব্রাহিম চিকিৎসার ক্ষেত্রে ‘ইম্পেথি’ শব্দটির ওপর অত্যধিক গুরুত্বারোপ করতেন। ইংরেজি ‘ইম্পেথি’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো স্বীয় সত্তা অন্যের সত্তায় বিলীন করে দিয়ে, অন্যের শোক, দুঃখ ও ব্যথার অভিজ্ঞতা কল্পনায় নিজে অনুভব করার শক্তি। আর ‘সিম্পেথি’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো অন্যের শোক-দুঃখের সঙ্গে সমবেদনা বা সমব্যথিত হওয়া। অন্যের শোক-দুঃখ এবং অন্যান্য অভিজ্ঞতা মনে না করলে যেমন দুঃখী বা আর্তপীড়িতের গভীরে যাওয়া যাবে না ঠিক, তেমনি তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠানের সহকর্মী সব ডাক্তার, সেবাকর্মী, কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের তিনি সব সময় বলতেন, ‘ইম্পেথি’ শব্দটির অন্তর্নিহিত ভাবকে নিজের মনে প্রতিফলিত করে সেবাদানে মনোনিবেশ করতে। এরূপ মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে যখন কোনো সেবাদানকারী কোনো আর্তপীড়িতের সেবায় নিজেকে প্রয়োগ করবে সেই সেবাদানকারীই আর্তপীড়িতের সত্তার সঙ্গে বিলীন হতে পারবে আর সেবাদান তখনই পূর্ণাঙ্গ হবে। এভাবেই কোনো সেবাদানকারী সেবা গ্রহণকারীর গভীরে প্রবেশ করতে পারবে, আর যখন সেবাদানকারী মনে করবে আমি যদি এই আর্তপীড়িত লোকটির মতো হতাম, যে আমার কাছে তার আর্তপীড়ার উপশম চাইতে আসছে এবং আর্তপীড়িতটি যদি আমার জায়গায় হতো, যার কাছ থেকে আমি পীড়িত হয়ে সেবা গ্রহণ করতে এসেছি। তাঁর প্রিয় প্রতিষ্ঠান বারডেমে সকাল বেলা যখন সব ডায়াবেটিস রোগী এসে একত্রিত হতেন তখন তিনি তাঁদের বলতেন : ‘আপনারা যে এসেছেন এ জন্য আমরা আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ। কারণ আপনারা এখানে এসে আমাদের সেবা করার সুযোগ দিচ্ছেন। আমরা আপনাদের পঁচিশ বছর ধরে চিকিৎসা করছি এবং সেটা কোনো অর্থের বিনিময়ে নয়। আর এ দীর্ঘকাল আপনারা আমাদের সেবা করার সুযোগ দিয়ে ধন্য করেছেন। আপনারা যদি না আসতেন তবে আমাদের সেবা করার এ সদিচ্ছাটা বিফলে যেত। সুতরাং আপনারা আমার আন্তরিক ধন্যবাদ গ্রহণ করুন। আর একটা অনুরোধও আমি আপনাদের করব। বারডেমের ভিতরে পা রাখার পর আপনারা সবাই সুশৃঙ্খলভাবে থাকবেন। এ জন্যই আমি হাসপাতালের বহু স্থানে লিখিয়ে রেখেছি, ‘শৃঙ্খলাই জীবন’। আর সত্যি বলতে এটাই ডায়াবেটিস রোগীর জীবনের অন্যতম প্রধান অবলম্বন।

তিনি নিজে বয়স্ক, বিশেষ করে বুড়ো মানুষদের, সে যত সাধারণই হোক না কেন, মন-প্রাণ দিয়ে সম্মান করতেন। কোনো একজন বুড়ো মানুষ তাঁর চেম্বারে ঢুকলে তিনি নিজের চেয়ার থেকে উঠে যেতেন। তার কথা শুনতেন, আবার প্রয়োজন হলে নিজেই হাত ধরে চেয়ারে বসাতেন। বহির্বিভাগ বা ভিতর বিভাগে পরিদর্শনরত অবস্থায় এরূপ কোনো ব্যক্তিকে ইতস্তত ঘুরতে দেখলে সঙ্গে সঙ্গে তার খবর নিতেন। তিনি শুধু পীড়িতদের পীড়ার কারণ শুনেই ক্ষান্ত হতেন না, তাদের জীবনের সমস্ত কথা-কাহিনি, রোগীর পিতা-মাতা, সমাজ-সংসার সব ব্যাপারেই খোঁজখবর নিতেন। এর ফলে প্রত্যেক রোগীই হয়ে উঠতেন তাঁর আত্মার আত্মীয়। রোগীরা তখন আর তাঁকে কেবল একজন ডাক্তার বলে মনে করতেন না, মনে করতেন একজন পরম আত্মীয়। রোগী ও ডাক্তারের মধ্যকার এরূপ প্রত্যক্ষ, ঘনিষ্ঠ ও স্নেহ-শ্রদ্ধার সম্পর্ক সত্যি বিরল। সত্যিকার অর্থে ভালোবাসা বড় কঠিন- সেই প্রীতি ও মমতাকে কাজে লাগানোর জন্য সংবেদনশীল হৃদয় দরকার।

        ♦  লেখক : সরকারের সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির ন্যাশনাল কাউন্সিল সদস্য

 

সর্বশেষ খবর