রবিবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

দেশ কি আসলেই এগিয়েছে

খায়রুল কবীর খোকন

দেশ কি আসলেই এগিয়েছে

আমাদের ক্ষমতাবান আওয়ামী লীগ সরকারের ততোধিক ক্ষমতাধর তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বক্তৃতা-বিবৃতি-ভাষণে যথেষ্ট সক্রিয় সদা, হয়তো তাঁর বিদ্যাবুদ্ধির প্রবল জোর আছে বলেই। তিনি রাজনীতি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে প্রচুর বক্তব্য দেন এবং সরকারের প্রধান মুখপাত্র প্রমাণে সদাব্যস্ত থাকেন সেটা সহজবোধ্য। সম্প্রতি একটি প্রধান বাংলা দৈনিকের ভিতরের পৃষ্ঠায় গুরুত্বসহকারে একটি রিপোর্ট ছাপা হয়েছে তথ্যমন্ত্রীর বক্তৃতা কেন্দ্র করে। শিরোনামটাও বেশ আকর্ষণীয় ‘সরকারের ভুল থাকবে, দেখতে হবে দেশটা এগিয়ে গেছে কি না’।

চট্টগ্রাম শহরে এলজিইডি ভবনের কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী মিলনায়তনে রাঙ্গুনিয়া সমিতি আয়োজিত সুধীসমাবেশে রাজধানী ঢাকা নগরীর বাসা থেকে অনলাইনে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন তথ্যমন্ত্রী। তিনি সেখানে বলেন, সরকার পরিচালনা করতে গিয়ে নিশ্চয়ই আমাদের ভুলত্রুটি থাকবে, ভুলত্রুটি মানুষেরই হয়। পৃথিবীর কোনো সরকারই নির্র্ভুল কিছু করতে পারে না। ৫০০ বছর অতীতের সরকারেরও ভুল ছিল, আগামী ৫০০ বছর পরের সরকারেরও ভুল থাকবে। তবে দেখতে হবে সরকার দেশটা এগিয়ে নিয়ে গেছে কি না। কেউ স্বীকার করুক বা না করুক, গত সাড়ে ১৪ বছরে দেশ এগিয়ে গেছে।

তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছানের বক্তব্যটা যথেষ্ট যুক্তিসংগত এবং রসবোধও আছে তাতে। এখন কথা হচ্ছে, বড় বড় বিশাল বিশাল প্রকল্প বা মেগা প্রকল্প নিয়ে অপব্যয় করার অভিযোগ এ সরকারের প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে। প্রতিটি প্রকল্পের প্রতিটি কাজে, নির্মাণকাজে, সরকারি কেনাকাটায়। বেশি দামে কেনা হয়েছে, বাড়তি ব্যয়ে সাধারণ রাস্তা, সড়ক, মহাসড়ক, সেতু, কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে এমন অভিযোগ প্রকট। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, সড়কে নিম্নমানের বিটুমিন, বাজে ধরনের সিমেন্ট ও অন্যান্য নির্মাণসামগ্রী ব্যবহারের ফলে ও সড়ক-মহাসড়কগুলো ভেঙেচুরে, ক্ষয়ে ক্ষয়ে এখন ডোবানালার পর্যায়ে চলে গেছে কয়েক মাস যেতে না যেতেই। এ দুর্নীতি একটি-দুটি কাজের বেলায় নয়, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই ঘটেছে। আমাদের বন্ধুরাষ্ট্রের সহায়তায় বিভিন্ন প্রকল্পে নির্মাণকাজে দস্তুরমতো জালিয়াতি হয়েছে। ফলে অপব্যয় ও অপচয় বেড়েছে আরও ব্যাপকভাবে। এমনিতেই আমাদের দেশের রাজনীতিবিদ ও আমলাদের প্রকল্প-লুণ্ঠনের মনোবৃত্তি সবারই জানা। তার ওপরে বন্ধুরাষ্ট্রের সহায়তার নামে যদি অবকাঠামো নির্মাণকাজে এভাবে অর্থ অপচয় চলে তাহলে রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি তো ‘শ্বেতহস্তী’ হয়ে যাওয়ার কথা।

তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান যে যুক্তিবোধের কথা উচ্চারণ করেছেন, আসল পরিস্থিতি তার চেয়ে খারাপ। বর্তমান সরকারের সাফল্যের অগ্রযাত্রার বিপরীতে ব্যর্থতার কথা গণনা করলে কোন দিকে পাল্লা ভারী হবে? অবশ্যই ব্যর্থতার।

কয়েকটি প্রধান ক্ষেত্রে এ সরকারের অসাফল্যের প্রমাণ মেলে যার কোনো তুলনা নেই। ১. এ সরকারের আমলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি খুবই সামান্য। সারা দেশে নারী ও শিশু হত্যা, নারী ধর্ষণ, শিশু-কিশোরী ধর্ষণ, কিশো বলাৎকার বেড়ে চলেছে। চুরি, ডাকাতি, দস্যুতা, ছিনতাই, প্রতারণা, ইভ টিজিং, কিশোর গ্যাং কালচার, মস্তানতন্ত্র, পর্নগ্রাফি, নানানরকম জুয়া খেলা, মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার বাড়ছে। জমিজমা নিয়ে মারামারি, খুনোখুনি, নদী ও চর দখল, রাষ্ট্রীয় ভূমি দখল, অমুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষকে ভিটেমাটিছাড়া করে বাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য করা প্রভৃতি অপরাধ কোনটা কমেছে?

২. শিক্ষার মান নেমেছে মারাত্মকভাবে, স্কুল-কলেজ নতুন নতুন প্রতিষ্ঠা পাওয়া দৃশ্যমান হলেও সেসবের মধ্যে প্রকৃত শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্য আছে কটার? শিক্ষক সম্প্রদায়ের মধ্যে টিউশনিবাণিজ্য আদৌ কমেছে কি? শিক্ষাপ্রশাসন দুর্নীতিমুক্ত হওয়ার পথে এক ইঞ্চিও এগিয়েছে কি? চাকরির ইন্টারভিউ থেকে এমন কোনো পাবলিক পরীক্ষা নেই যেখানে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অপচেষ্টা বন্ধ হয়েছে। এখন সরকারের মন্ত্রীরা এ অভিযোগগুলো শুনলেই অকাতরে বলে দেবেন-এসব ঢালাও অভিযোগ। রাজনৈতিক বিরোধী পক্ষের মনগড়া অভিযোগ সব, স্রেফ ঈর্ষাকাতরতা এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বহিঃপ্রকাশ। না, ক্ষমতাসীন পক্ষ যা বলবে তা মোটেই গ্রহণযোগ্য বা যুক্তিসংগত নয়। এ অভিযোগগুলোর কোনোটা মিথ্যা বা মনগড়া নয়। বরং সারা দেশে অপরাধীদের দৌরাত্ম্যে নিরীহ গণমানুষ দিশাহারা। অপরাধ দমনে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নীতি-নৈতিকতার উন্নতির লক্ষণ একেবারেই দৃশ্যমান নয়। সরকারি প্রশাসনে এবং অন্যসব ক্ষমতাধর আমলা ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতিষ্ঠানে ঘুষ-দুর্নীতি দিন দিন বেড়ে চলেছে। প্রতিকার নেই। এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের সাড়ে ৫ হাজার বর্গমাইলের ভূখন্ডে অশান্ত পরিবেশের আধা-শতকের আমলেও শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারেনি কোনো সরকারই। আওয়ামী লীগ সরকার তো তার আমলেই শান্তিচুক্তি করেছিল অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে। পার্বত্য শান্তিচুক্তির পরও সেই পার্বত্য তিন জেলায় সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনীগুলোর মারামারিতে অন্তত ৭০০ লোক খুন হয়েছে এবং ইতোমধ্যে নাথান বম নামে এক সন্ত্রাসী বাহিনী প্রধান বম-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী যুদ্ধ শুরু করেছে ‘কুকি-চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট’-এর ব্যানারে। এখন তাদের সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের হাতে একের পর এক হামলার ঘটনায় নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন নিহত হচ্ছে। অথচ এ সরকার এই সন্ত্রাসী সংগঠনটির উত্থান দেখেও চোখ বন্ধ করে ছিল দীর্ঘ দশককালের বেশি। বিগত সাড়ে ১৪ বছরে যে পার্বত্য এলাকাটিতেও শান্তি আনা গেল না এর দায় কার? দায়িত্ব কে নেবে?

মোদ্দা কথা, আমাদের রাষ্ট্রের সাধারণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা থেকে শুরু করে ‘উন্নততর জননিরাপত্তা’ ব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি রোধ, সমাজে নারী-শিশু, কিশোর-কিশোরীসহ সব নারীর তথা প্রত্যেক নাগরিকের নিরাপত্তাবিধান এবং সার্বিক সুশাসন কায়েমে কিংবা দ্রব্য গণমানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে সাড়ে ১৪ বছরে বর্তমান সরকারের অবদান কি যুক্তিসংগত পর্যায়ের? অবশ্যই নয়, কারণ অপচয়, অপব্যয়ের উন্নয়ন কার্যক্রম অবকাঠামোর কিছু দৃশ্যমান উন্নয়ন প্রদর্শন করতে পারলেও গণমানুষকে সার্বিক শান্তি ও স্বস্তি দিতে সক্ষম হয়নি। গরিব মানুষ ধুঁকে ধুঁকে মরছে। জনগণের ভোটের অধিকার উবে গেছে, ফলে আসেনি গণতন্ত্র। তাই আমাদের ঝানু রাজনীতিক তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের আপ্তবাক্য ‘দেশ এগিয়েছে’ এটা মেনে নেওয়া গেল না। দুঃখিত আমরা সবাই।

♦ লেখক : বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব, সাবেক সংসদ সদস্য ও ডাকসু সাধারণ সম্পাদক

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর