রবিবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

কাজী সাহেবের কাজী পেয়ারা

ড. এম মেসবাহউদ্দিন সরকার

কাজী সাহেবের কাজী পেয়ারা

ফল ও সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের জুড়ি নেই। ক্রমবর্ধমান মানুষের চাহিদার সঙ্গে সমন্বয় রেখে এক ফসলের জায়গায় দুই ফসল, তিন ফসল, ইরি ধান, চিকন ও মোটা চাল উৎপাদনে কৃষক এখন বারো মাস ব্যস্ত থাকে। বছরব্যাপী লালশাক, পুঁইশাক, মুলাশাক, কাঁচা মরিচ, ধনেপাতা ইত্যাদি উৎপাদনে বৈজ্ঞানিক বিপ্লব ঘটে চলেছে বাংলাদেশে। আপেলের মতো কুল (বরই), তালের সাইজে বেগুন, জাম্বুরার মতো লেবু, ঢোলের মতো মিষ্টিকুমড়া, মধুর মতো মিষ্টি তরমুজ, বরবটি, ফুলকপি, শিম, লাউ, মুলা, গাজর, শালগম, করোলা ইত্যাদি ভিটামিনসমৃদ্ধ সবুজ তরকারি দেশের চাহিদা মিটিয়ে বহু বছর ধরে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। ছাদবাগানের সাফল্য শাইখ সিরাজের ‘মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেশবাসী বেশ উপভোগ করছে কয়েক যুগ ধরে। ট্রাক ও ভ্যান ভর্তি কাজী পেয়ারা, সবরি, চাম্পা, সাগর ও বাংলা কলার দৃশ্য রাস্তায় নামলেই দেখা যায়। সুস্বাদু ও রসালো কাজী পেয়ারার কথা কি আর নতুন করে বলার কিছু আছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে গুঁড়া মরিচ ও বিটলবণে মেশানো কাজী পেয়ারা খাওয়ার দৃশ্য গ্রীষ্মকালে নতুন এক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। ক্লান্ত মানুষ ঝাল মেশানো কাজী পেয়ারা খেয়ে কী যে তৃপ্ত হয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অনেকে বাড়িতেও নিয়ে যায় পরিবার-পরিজনসহ খাওয়ার জন্য। আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়ানোর সময় বিভিন্ন ফলের সঙ্গে কাজী পেয়ারা এখন থাকছেই। অফিস-আদালতে, মিটিংয়ে, এমনকি ভদ্রসমাজে বিস্কুট-চানাচুরের পরিবর্তে কাজী পেয়ারা খাওয়া একটি রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। তাহলে এবার আলোচনা করা যাক এই কাজী পেয়ারার আবিষ্কারক স্বনামধন্য কৃষিবিজ্ঞানী কাজী এম বদরুদ্দোজার কথা। তিনি ১৯২৭ সালের ১ জানুয়ারি বগুড়ায় মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃকনিবাস গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায়। তিনি ১৯৪২ সালে গোবিন্দগঞ্জ হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৪৪ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ১৯৪৫ সালে ভর্তি হন ঢাকার তেজগাঁওয়ে অবস্থিত ইংল্যান্ডের রিডিং ইউনিভার্সিটির সিলেবাস অনুসারে পরিচালিত তৎকালীন বেঙ্গল কৃষি ইনস্টিটিউট (বর্তমানে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়) এবং ১৯৪৮ সালে বিএজি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসসি এবং ১৯৫৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানা থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। পাট ও গম আবাদ বিষয়ে জ্ঞান লাভসহ জেনেটিক্সের ওপর ডিপ্লোমা লাভ করেন সুইডেনের বিশ্বখ্যাত স্তালভ গবেষণা কেন্দ্র থেকে। বাংলাদেশে ভুট্টার বাণিজ্যিক আবাদ তাঁর হাত দিয়ে শুরু। ভুট্টা থেকে তেল উদ্ভাবন এবং তা পোলট্রিশিল্পের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার শুরুর ধারণাটিও তাঁর কাছ থেকে আসা। ছত্রাকের গন ‘কাজিবোলেটাস’-এর নামকরণও তাঁর নাম থেকেই। একপর্যায়ে তাঁর এই ব্যবহারিক জ্ঞান তিনি পেয়ারার ওপর প্রয়োগ করেন, সফলও হন। আর এ সফলতাই আজকের দিনের ‘কাজী পেয়ারা’, যা তাঁর নামানুসারে হয়েছে। কর্মজীবনে তিনি পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশনের অধীন পাকিস্তান রিসার্চ কাউন্সিলের ল্যাবরেটরিতে রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট পদে প্রথম নিয়োগ পান। পরে ওই প্রতিষ্ঠানে পরিচালক ও নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৭ সালে তিনি ইকোনমিক বোটানিস্ট (ফাইবার) পদ লাভ করেন। এ সময় তিনিই প্রথম উচ্চফলনশীল গম চাষ প্রবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাঁর এ উদ্ভাবনী শক্তিস্বরূপ তাঁকে পাকিস্তান আমলে তমঘা-ই-পাকিস্তান ও তঘমা-ই-ইমতিয়াজ খেতাবে ভূষিত করে। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে তিনি পাকিস্তান কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালকের পদ পরিত্যাগ করে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রথমে পরিচালক ও পরে মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশ একাডেমি অব এগ্রিকালচারের সভাপতি ও বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। গবেষণার স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশেও তাঁকে অনেক পুরস্কারে পুরস্কৃত করা হয়। ১৯৮২ সালে তিনি লাভ করেন বেগম জেবুন্নেসা ও কাজী মাহবুব উল্লাহ কল্যাণ ট্রাস্ট সম্মাননা। ১৯৮৫ সালে তিনি ন্যাশনাল সায়েন্টিস্ট পদে আসীন হন। ১৯৯৯ সালে বিশ্ব কৃষি গবেষণা সংস্থা যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে তাঁকে সম্মাননা প্রদান করে। এ ছাড়া কৃষি ক্ষেত্রে অসাধারণ অবদানের জন্য ২০১২ সালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ প্রদান করা হয়। ফল, ফসল ও কৃষিজাত খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের মডেল। এ দেশের মাটি খুবই উর্বর, আবহাওয়াও খাদ্যদ্রব্য উৎপাদনে সহায়ক। দেশের মাটিতে এখন সুস্বাদু ড্রাগন, রসালো মাল্টা, নারকেল, মরু খেজুরসহ অনেক বিদেশি ফল প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হয়। কারও না কারও ব্যক্তিগত সহায়তায় বিদেশ থেকে এগুলো বাংলাদেশে চাষাবাদ শুরু হলেও এখন বাণিজ্যিকভাবে হচ্ছে। এসব কাজ লাভজনক হওয়ায় অনেকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন এ কাজ। এসব উদ্যোক্তার নাম আমাদের অনেকেরই জানা নেই। কাজী পেয়ারার উদ্যোক্তার কথাও আমরা অনেকেই জানি না। ৩০ আগস্ট, ২০২৩ বিকাল ৪টায় বার্ধক্যজনিত অসুস্থতার কারণে মহান এই কৃষিবিজ্ঞানী, ন্যাশনাল ইমেরিটাস সায়েন্টিস্ট ও স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত ড. কাজী এম বদরুদ্দোজা ইন্তেকাল করেন। আর তখনই বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচারিত হয় ড. কাজী বদরুদ্দোজা আর নেই। আমরা মহান এই ব্যক্তির আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। মানুষ তাঁর কর্মের জন্যই অমর হয়ে থাকে এ পৃথিবীতে, মানুষের অন্তরে।

♦ লেখক : অধ্যাপক, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সর্বশেষ খবর