শিরোনাম
সোমবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

আকবর আলি খান : একজন আমলা শিক্ষাবিদ

হোসেন আবদুল মান্নান

আকবর আলি খান : একজন আমলা শিক্ষাবিদ

মানুষ যা চায় সকলে তা পায় না, আবার যা পায় তা-ও নাকি ভুল করে পায়। এটি কোনো আপ্তবাক্য নয়। মনে হয়, কথার কথা। প্রয়াত সিএসপি কর্মকর্তা, লেখক ও গবেষক ড. আকবর আলি খান তাঁর অসংখ্য লেখায় এবং স্মৃতিচারণায় উল্লেখ করেছেন, তিনি মনেপ্রাণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে চেয়েছিলেন। শেষ জীবনে এসে আত্মজীবনীমূলক বই ‘পুরানো সেই দিনের কথা’য় এসব সবিস্তারে উল্লেখ আছে। স্নাতক (অনার্স) এবং স্নাতকোত্তর উভয় শ্রেণিতে প্রথম স্থান পাওয়া অর্থাৎ কাক্সিক্ষত রেজাল্ট থাকা সত্ত্বেও তাঁকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নোংরা শিক্ষক রাজনীতির শিকার হয়ে তখনকার ছাত্র ইউনিয়নের এক নিভৃতচারী মেধাবী সমর্থকের শিক্ষক হওয়ার লালিত স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। যিনি পরবর্তীতে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। ১৯৬৭ সালের ব্যাচে তিনি বাঙালিদের মধ্যে পঞ্চম স্থান অধিকার করেছিলেন। তাঁর বাঙালি ব্যাচমেটদের মধ্যে ড. মীজানুর রহমান শেলী, কথাসাহিত্যিক ও গবেষক আবদুশ শাকুর, ড. শাহ মোহাম্মদ ফরিদ, খসরুজ্জামান চৌধুরী, কাজী রকিবউদ্দিন, মামুনুর রশীদ প্রমুখের নাম রয়েছে।

বিস্ময়কর হলো, সিভিল সার্ভিস করতে গিয়ে পাকিস্তানে এবং স্বাধীন বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া সামান্য ছোটখাটো বিষয়ও তাঁর নজর এড়ায়নি। এমনটা অন্য কারও বেলায় এত নিবিড় অভিনিবেশে দেখা যায় না। তিনি সবকিছুকে দেখেছেন একজন সার্বক্ষণিক শিক্ষক ও গবেষকের দৃষ্টি দিয়ে। নিত্যদিনের ঘটনাবলির ডায়েরির পাতা মেলে ধরা ছাড়া ষাটোর্ধ্ব বছরের স্মৃতি এভাবে কারও চোখের আলোয় উদ্ভাসিত হতে পারে না।

১. শেষ পর্যন্ত তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছিলেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পর মুজিবনগর সরকারের আদেশে প্রথমেই মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে ১৭টি জেলায় জেলা প্রশাসক নিয়োগ করা হয়। তাঁকে দেওয়া হলো সিলেটের দায়িত্ব। কিন্তু তাঁর ভাষ্য মতে, সিলেটের তখনকার দুই প্রভাবশালী নেতা আবদুস সামাদ আজাদ এবং দেওয়ান ফরিদ গাজীর মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও মতবিরোধের কারণে তিনি সিলেটের জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগদান করেননি। পরে ১৯৭৩ সালের আগস্ট মাসে সিভিল সার্ভিস থেকে ছুটি নিয়ে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁকে এমন নজিরবিহীন সুযোগ করে দিয়েছিলেন স্বয়ং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর নথিতে তিনি লিখে দিলেন, ‘অনুমোদন করা হলো। তবে তিন বৎসরের মধ্যে ফিরে আসতে হবে। দেশ গড়ার কাজে তার বিশেষ ভূমিকা আছে।’

সেখান থেকেই তিনি স্কলারশিপ নিয়ে কানাডার কুইন্স ইউনিভার্সিটিতে চলে যান এবং অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। তাঁর আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধুর প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছেন। তিনি বলেছেন, সেদিন বঙ্গবন্ধু এমন সুযোগ না করে দিলে পরবর্তী জীবনে তাঁর পক্ষে চেয়ারম্যান, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, অর্থসচিব ও মন্ত্রিপরিষদ সচিব হওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিল না।

২. তাঁর বইগুলো পড়তে পড়তে মনে হবে, এতে রয়েছে অফুরন্ত তথ্যের ভান্ডার, নানা হাস্যরসের উপাখ্যান আর মহান ব্যক্তিত্বদের বিচিত্র সব উদ্ধৃতির অভিধান। তাঁর বিখ্যাত রচনাবলির মধ্যে বাংলাদেশের সত্তার অন্বেষা (Discovery of Bangladesh), Gresham's Law Szndrome and Beyond, পরার্থপরতার অর্থনীতি, আজব ও জবর আজব অর্থনীতি, বাংলাদেশে বাজেট : অর্থনীতি ও রাজনীতি, অবাক বাংলাদেশ : বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি, দারিদ্র্যের অর্থনীতি : অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ, অন্ধকারের উৎস হতে, দুর্ভাবনা এবং ভাবনা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে, চাবিকাঠির খোঁজে, পুরানো সেই দিনের কথা এবং সর্বশেষ মৃত্যুর পরে প্রকাশিত মুজিবনগর সরকার ও বর্তমান বাংলাদেশ ইত্যাদি। উল্লেখ্য, রাষ্ট্র এবং সরকারের অতীব গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল থেকেই তিনি এসব বইয়ের বেশকটি রচনা করেছেন। আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাসমূহের নানাবিধ শর্তারোপের বিরুদ্ধে গল্পের ছলে তিনি কঠিন সমালোচনা করেছেন। ২০০০ সালের আগস্ট মাসে ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’। তখন তিনি বাংলাদেশ সরকারের অর্থসচিব। বইটির মোড়ক উন্মোচন করেছিলেন বাংলাদেশের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া।

৩. আকবর আলি খান একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ১৯৬৯ সালে তিনি হবিগঞ্জের এসডিও হিসেবে নিয়োগ পান। ১৯৭১ সালের শুরুতে সেখান থেকেই মহান স্বাধিকারের সংগ্রামে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন। অত্যন্ত আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে এবং চাকরি তথা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ট্রেজারি থেকে সরকারি অস্ত্র তুলে দিয়েছিলেন স্বাধীনতাকামী তরুণ মুক্তিসেনাদের হাতে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তিনি তাঁর বইয়ে লিখেছেন,

‘স্বাধীনতা একটা জাতির জন্য সবচেয়ে বড় সম্পদ। সব প্রজন্মের লোক স্বাধীনতা রক্ষার সুযোগ পান না। আমরা এই সুযোগ পেয়েছি, এই সুযোগের সদ্ব্যবহার না করলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে দায়ী থাকব। আমরা যদি আমাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে লড়াই না করি, তাহলে আমরা কোনো দিন মুখ দেখাতে পারব না। স্বাধীনতা-সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছি বলেই আজ আমরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারি।’ সরকারি চাকরিতে থেকে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ নেওয়ার অপরাধে পাকিস্তান সরকার তাঁকে ১৪ বছরের কারাদন্ড দিয়েছিল। যুদ্ধ সময়ে মুজিবনগর সরকারের জন্য বিপুল অর্থ জোগান করেও প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন। একজন তরুণ কর্মকর্তা হয়ে সে সময় তিনি অসাধারণ দায়িত্ব পালন করেন। যা পরবর্তীতে তাঁকে জাতীয় ব্যক্তিত্বের এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেয়।

৪. বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রের সততা, দক্ষতা ও নিরপেক্ষ পেশাদারিত্ব নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে তাঁর কণ্ঠে বরাবরই হতাশার করুণ সুর বেজে উঠতে দেখা গেছে। যদিও তিনি নিজে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের পদ বা দেশের আমলাতন্ত্রের সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

পরবর্তীতে অবসরে গিয়ে তিনি তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ‘আমলাতন্ত্রের রাজনীতিকরণের প্রভূত প্রভাব দেখা গিয়েছিল বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থার ওপর। এটা সরকারি কর্মচারীদের নিরপেক্ষতার পরিমন্ডলকে তছনছ করে ফেলেছিল। তাদের আর নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নিরপেক্ষ আম্পায়ার মনে করা হয় না। আমলাতন্ত্রের রাজনীতিকরণ দুর্নীতির সুযোগ প্রসারিত করেছে। সরকারি কর্মচারীদের নৈতিক বল পুনঃপ্রতিষ্ঠার বাইরে চলে গেছে। জনগণকে সর্বোত্তম সেবা প্রদানের জন্য আমলাতন্ত্র আর যোগ্য থাকছে না।’ তাঁর পরার্থপরতার অর্থনীতি বইয়ে সন্নিবেশিত প্রবন্ধ ‘শুয়োরের বাচ্চাদের’ অর্থনীতিতে (পৃ. ১৫, ১৭) অর্থনীতিবিদদের উদ্ধৃতি চিহ্নিত করে সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতিকে তিনি অনির্ভরযোগ্য (unpredictable) দুর্নীতি বলেছেন। যারা ঘুষ নিয়েও মানুষের কাজ করে দেয় না। তিনি বলেছেন, প্রশাসনে দুর্নীতিপরায়ণ কর্মচারীরা সৎ কর্মচারীদের শান্তিতে থাকতে দেবে না। তিনি মুদ্রার জগতের গ্রেশামস থিওরির সঙ্গে মিলিয়ে আরও বলেছেন, খারাপ মুদ্রা যেমন ভালো মুদ্রাকে তাড়িয়ে দেয়, প্রশাসনেও একই প্রবণতা দেখা যায়। দুর্নীতিপরায়ণ কর্মচারীরা সৎদের তাড়িয়ে বেড়ায়।’

বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে উল্লেখ করা যায় যে, লেখালেখি বা সাহিত্য-সংস্কৃতি করা কর্মকর্তাদের খুব মুষ্টিমেয় দু-একজনই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদাধিকারী হতে পেরেছেন। মেধাবী ও একাডেমিক রেজাল্ট বিবেচনায় প্রথম স্থানে থাকা কর্মচারীও লেখালেখির ভাবুক জগতে ডুবে থাকা এবং লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা প্রাপ্তির মোহে পড়ে অনেকেই তাঁর সম্ভাব্য কাক্সিক্ষত আসন থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। সাহিত্যকর্মকে কোনো সরকারই কখনো গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি। এদিক থেকে আকবর আলি খান নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান এবং বিরল এক ব্যক্তিত্ব ছিলেন।

৫. আকবর আলি খান ইতিহাসের তুখোড় ছাত্র ও ধ্রুপদী অর্থনীতির প্রাজ্ঞজন দার্শনিক হলেও বিশ্বসাহিত্যেরও রস আস্বাদন করেছিলেন। তাঁর বহুমাত্রিক, সৃজনশীল ও মননশীল লেখালেখিতে বারবার এসেছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ। রবিঠাকুরের গান, ছোটগল্প বা কবিতার প্রতি তাঁর আমৃত্যু পক্ষপাতিত্ব ছিল বলে সহজেই অনুধাবন করা যায়। তাঁর আত্মজীবনীর নাম ‘পুরানো সেই দিনের কথা’ তা থেকেও এটা বোঝা যায়। তিনি বলেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ বাঙালি জীবনে শুধু একজন মহাকবি নন, মহাকবিদের চেয়ে অনেক উঁচুতে তাঁর স্থান। যেসব প্রশ্নে তাঁর সমালোচনা করা হয়েছে এর বেশির ভাগই ভিত্তিহীন, অসার’। তবে তিনি বস্তুনিষ্ঠ ও নির্মোহ সমালোচনার বিরুদ্ধে নন বরং রবীন্দ্র অনুরাগীদের অতিরঞ্জনের জন্য রবীন্দ্রনাথকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা যাচ্ছে না বলে মনে করতেন।

 

লেখক : গল্পকার ও প্রাবন্ধিক

সর্বশেষ খবর