বুধবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

রবীন্দ্রচিন্তায় দারিদ্র্য ও ড. আতিউর রহমান

অধ্যাপক মালেকা আক্তার চৌধুরী

রবীন্দ্রচিন্তায় দারিদ্র্য ও ড. আতিউর রহমান

৫ আগস্ট শনিবার  বেলা ১১টায় উন্নয়ন সমন্বয়ের অফিসে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ‘রবীন্দ্রচিন্তায় দারিদ্র্য ও প্রগতি’র সংশোধিত প্রথম সংস্করণের মোড়ক উন্মোচন হলো। আমার সহকর্মী বড় ভাই অধ্যাপক ড. মিয়া ইনামুল হক (রতন সিদ্দিকী)-এর আমন্ত্রণেই  মূলত আমার আগমন। তিনি অনুষ্ঠানের মূল আলোচক। আমি অত্যন্ত আনন্দিত এবং গর্বিত এজন্য যে, ড. আতিউর রহমান আমার এলাকার বড় ভাই। জানাশোনা আগেই হয়েছিল এবং সেই সূত্রে সামান্য সৌজন্য সাক্ষাৎ অসামান্য এই মানুষটির সঙ্গে। ড. আতিউর রহমান দেশবরেণ্য অর্থনীতিবিদ, সৃজনশীল লেখক, সবুজ অর্থনীতিবিদ হিসেবে সর্বজনবিদিত। তিনি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিষয়ক গবেষণায় এক ভিন্নমাত্রিক ধারা সৃজন করেছেন এবং তা অব্যাহত রেখেছেন। এ ছাড়া আর্থসামাজিক উন্নয়নে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ন্যায্য অধিকার নিশ্চিতকরণে সামাজিক পিরামিডের পাটাতনে অবস্থানকারী নিরন্ন মানুষের কল্যাণে নিরলস কাজ করে চলেছেন। তিনি উন্নয়নের বহুমাত্রিকতা বিবেচনায় অর্থনীতির মূল ধারণাটির সঙ্গে ধারাবাহিক ইতিহাস-ঐতিহ্য, সাহিত্য-সংস্কৃতির সংযোগ ঘটিয়ে এর ফলপ্রসূতা তুলে আনার চেষ্টাই শুধু নয়, বাস্তবায়নও করে চলেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি রবীন্দ্রনাথকে পূর্বসূরি হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আজীবন লড়াই-সংগ্রামকে নিত্য অনুপ্রেরণার অংশ হিসেবে ধারণ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের গল্প, কবিতা, সংগীত, সাহিত্য, নাটকের সঙ্গে সাধারণ মানুষের ব্যাপক পরিচিতি থাকলেও এই একই রবীন্দ্রনাথ যে বাংলার নিরন্ন মানুষের ভাগ্যবদলের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়েছিলেন, এ কথা জনসমাজে অল্পবিস্তরই প্রকাশিত হয়েছে। ড. আতিউর রহমান রবীন্দ্রনাথের এ অনাবিষ্কৃত দিকটিকে সযতেœ তুলে এনে জনসম্মুখে মেলে ধরেছেন। গ্রন্থটিতে তিনি নয়টি প্রবন্ধ সংযোজিত করেছেন। প্রতিটি প্রবন্ধের শিরোনামই বলে দেয় এর পূর্বাপর প্রাসঙ্গিকতা। যেমন ‘রবীন্দ্রভাবনায় দারিদ্র্য নিরসন’, ‘রবীন্দ্রনাথের লোকহিত চিন্তা ও সমকালীন সমাজবাস্তবতা’; তেমন অন্যদের মধ্যে ‘রবীন্দ্রনাথের পতিসর’ প্রবন্ধটি অন্যতম। আলোচ্য প্রবন্ধটিতে ড. আতিউর রহমান আমাদের জানাচ্ছেন, ‘পতিসর আমাদের আবহমান বাংলার অন্য গ্রামগুলোর মতোই একটি রূপময় গ্রাম। যে গ্রামে বসবাস সাধারণ মানুষের। যে গ্রামে সকাল হলে পাখি কিচিরমিচির ডাকে। সন্ধ্যায় বাঁশঝাড়ে জোনাক পোকারা উড়ে বেড়ায়। যে গ্রামে ধান, পিঁয়াজ, মরিচ, শর্ষে উৎপাদিত হয়। যে গ্রামে রাস্তার দুই পাশে ফোটে অজানা-অচেনা হরেকরকম ফুল। যে গ্রামের শিশুরা নাগর নদে গোসল করতে ছুটে চলে।’ চিরায়ত গ্রাম বাংলার চিরচেনা এ রূপ বর্ণনার পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ যে এ গ্রামের প্রাণপ্রকৃতির গভীরে প্রবেশ করে গরিব কৃষক প্রজাদের সঙ্গে একাত্ম হতে পেরেছিলেন তারই সাক্ষাৎ মেলে রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্রাবলির ১১১ সংখ্যক চিঠিতে। তিনি লিখেছেন, ‘কোথায় প্যারিসের আর্টিস্ট সম্প্রদায়ের উদ্দাম উন্মত্ততা আর কোথায় আমার কালীগ্রামের সরল চাষি প্রজাদের দুঃখ দৈন্য নিবেদন! এদের অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং এদের অসহ্য কষ্ট দেখলে আমার চোখে জল আসে। বাস্তবিক এরা যেন আমার একটি দেশজোড়া বৃহৎ পরিবারের লোক।’ রবীন্দ্রনাথের অন্তর ছুঁয়ে বাস্তবতা উপলব্ধির জায়গাটিতে আসন নিতে পেরেছিল পতিসরের দারিদ্র্যপীড়িত প্রান্তিক মানুষ। যেখানে কৃষিকাজ, মাছ ধরা আর প্রকৃতির দানই ছিল প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বেঁচে থাকার প্রধান উপায়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবনবোধ সব দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোকে আলোকিত জীবনদানের লক্ষ্যে পতিসরের উন্নয়ন ভাবনা তাঁকে বিচলিত করে তোলে। তিনি উপলব্ধি করেন, এতদাঞ্চলের প্রজা চাষিদের দুর্দশার মূল কারণ অশিক্ষা। রবীন্দ্রচিন্তায় দারিদ্র্য ও প্রগতি গ্রন্থে ড. আতিউর রহমান লিখলেন, ‘সেই উপলব্ধি থেকে প্রায় ২০০ গ্রামে অবৈতনিক পাঠশালা এবং তিনটি উচ্চবিদ্যালয় স্থাপনের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ এ অঞ্চলের শিক্ষাব্যবস্থার গোড়া পত্তন করেন।’ স্বাস্থ্যসেবা সহজীকরণের লক্ষ্যে পতিসরে দাতব্য চিকিৎসালয়, আধুনিক কৃষিব্যবস্থা, কৃষি সমবায় ব্যাংক স্থাপনের মাধ্যমে সমাজ সংস্কারমূলক কাজেও তিনি হাত দিয়েছিলেন। প্রশান্ত কুমার পাল রচিত রবীন্দ্রজীবনীর ৪৬২ পৃষ্ঠার উদ্ধৃতি দিয়ে গ্রন্থ লেখক ড. আতিউর জানাচ্ছেন, ‘১৯০৫ সালে পতিসরে কৃষি ব্যাংক স্থাপন করার পর কৃষকদের মধ্যে ব্যাংক এতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে, তাঁদের ঋণের চাহিদা মেটানো স্বল্প শক্তির এ ব্যাংকের পক্ষে সম্ভব ছিল না। অবশ্য সমস্যার কিছুটা সমাধান হয় নোবেল পুরস্কারের টাকা ১৯১৪ সালের প্রথম দিকে কৃষি ব্যাংকে জমা হওয়ার পর।’ নোবেল পুরস্কারের টাকা দিয়ে ব্যাংকিং সেবা সহজ করাই শুধু নয়, তিনি হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছেন, কান পেতে শুনেছেন পতিসরের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কান্না, হৃদয়ের অন্তিম আকুতি। ড. আতিউর রহমানের ভাষ্যে তাই উঠে আসে, তিনি গ্রাম বাংলার জীবনাচার, লোকাচার, অর্থনীতি সম্পর্কেও ভালো জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। আর এ কারণেই তাই পরবর্তীতে প্রজাসাধারণের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নিজেকে নিবেদন করেছিলেন। কৃষিতে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার, ব্যাংকে মূলধন বৃদ্ধি এসব কর্মকান্ড ছিল রবীন্দ্রনাথের স্বদেশি সমাজ-ভাবনার পূর্বাপর লক্ষ্য। তিনি পুত্র ও জামাতাকে কৃষিতে উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন। চিঠিতে তাঁদের লিখেছেন, ‘তোমরা দুর্ভিক্ষপীড়িত প্রজার অন্ন গ্রাসের অংশ নিয়ে বিদেশে কৃষি শিখতে গেছ। ফিরে এসে এই হতভাগ্যদের অন্ন গ্রাস কিছু পরিমাণেও যদি বাড়িয়ে দিতে পার তাহলে মনে সান্ত্বনা পাবো।’ (পৃ. ১১৮-১১৯)।

লেখক : দর্শন বিভাগ ও সম্পাদক শিক্ষক পরিষদ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা

 

সর্বশেষ খবর