বৃহস্পতিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

খসড়া সংবিধান প্রণয়ন ভিতর-বাহির

অধ্যাপক ডক্টর আবু সাইয়িদ

খসড়া সংবিধান প্রণয়ন ভিতর-বাহির

পাকিস্তানের মৃত্যুগুহা থেকে ফিরে এসে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির পরিবর্তে সংসদীয় গণতন্ত্রের ঘোষণা দিলেন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী রাষ্ট্রপতি, বঙ্গবন্ধু হলেন প্রধানমন্ত্রী। ২৭ মার্চ ১৯৭২ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ১০ এপ্রিল সকাল ১০টায় তেজগাঁওয়ে গণপরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। ৯ এপ্রিল পার্লামেন্টারি পার্টির বৈঠক বসে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপনেতা নির্বাচিত হন। পার্লামেন্টারি পার্টিতে বঙ্গবন্ধুকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সর্বময় ক্ষমতা প্রদান করা হয়। তিনি জাতিকে একটি গণমুখী শাসনতন্ত্র প্রদানের আশ্বাস দেন। তিনি বলেন, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের আলোকে সংবিধান রচিত হবে। ১১ এপ্রিল বাংলাদেশ সংবিধান প্রণয়নের জন্য ৩৪ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। ১৭ এপ্রিল সংবিধান প্রণয়ন কমিটির প্রথম বৈঠক বসে। আমরা ছিলাম আবেগাপ্লুত। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত মহৎ আদর্শগুলো সংবিধানে কীভাবে শব্দ, বাক্যে, অনুচ্ছেদে লিপিবদ্ধ করা যায় তা ছিল বিরাট চ্যালেঞ্জ। খসড়া সংবিধান প্রণয়ন করতে গিয়ে আমাদের সামনে কতিপয় বহুবিধ প্রস্তাব চলে আসে। সেসব অপ্রকাশিত প্রস্তাব-বিতর্ক নিয়ে এ সংক্ষিপ্ত লেখা।

১. রাষ্ট্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা : সংবিধানের প্রস্তাবনার শীর্ষে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ স্থাপনে খন্দকার মোশতাক আহমেদ প্রস্তাব উত্থাপন করেন। সঙ্গে সঙ্গেই তাজউদ্দীন আহমদ বিরোধিতা করে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ভিতর দিয়ে আমরা যে স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছি তার অন্যতম মূল স্তম্ভ হলো ধর্মনিরপেক্ষতা। ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে বিশেষ রাজনৈতিক মর্যাদা দেবে না। মাননীয় সদস্য এ এইচ এম কামারুজ্জামান (হেনা ভাই) বলেন, পাকিস্তান আমলেও কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রমুখ কোনো রাজনৈতিক নেতা বক্তৃতার আগে ‘বিসমিল্লাহ’ উচ্চারণ করতেন না। এটি লিখিত হলে ধর্মনিরপেক্ষতার চরিত্র বিনষ্ট হবে। এ সময় সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, তাহলে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সব ধর্মের স্তোত্র লিখিত হোক। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ঘোরতর আপত্তি করেন। তিনি বলেন, ১০ এপ্রিল ’৭১ সালে স্বাধীনতা সনদে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার আমরা গ্রহণ করেছি। ধর্মের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রকে কবর দিয়েই জন্ম হয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, সংবিধানে প্রস্তাবনার ওপরে এসব থাকা ‘অনাবশ্যক’ ও ‘অবান্তর’। এম আবদুর রহিম পবিত্র কোরআনের সুরা ও হাদিস উল্লেখ করে বলেন, ধর্মনিরপেক্ষতা ইসলামবিরোধী নয়। কমিটির সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে অধ্যাপক আবু সাইয়িদ অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বললেন, ২৩ নভেম্বর ১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধকালীন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বীকৃতি চেয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বরাবর যে কূটনৈতিক পত্র প্রেরণ করা হয়, সেখানেই ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছিল। ভারতের এসব মূলনীতির ভিত্তিতে ৬ ডিসেম্বর স্বীকৃতি পায়। ধর্মনিরপেক্ষতা একটি মূল স্তম্ভ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, রাষ্ট্র সবার, ধর্ম যার যার। ধর্মনিরপেক্ষতা অর্থ ধর্মহীনতা নয়। অনেক সদস্যই বক্তব্য দেন, যার মর্মকথা সংবিধানে একটি বিশেষ ধর্মকে প্রাধান্য দেওয়া সাম্প্রদায়িক ভাবধারা। ’৭২-এর সংবিধানে প্রস্তাবনার ওপরে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ ছিল না। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করে খুনি খন্দকার মোশতাক আহমেদ অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে জাতির উদ্দেশে প্রথম যে ভাষণ দেন সেই ভাষণের শুরুতেই ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ দিয়ে তিনি শুরু করেন। তার ধারাবাহিকতায় আজ পর্যন্ত সংবিধানের প্রস্তাবনার ওপরে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ বহাল আছে।

২. গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র : সমাজতন্ত্র সম্পর্কে কথা উঠতেই সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, কার্ল মার্কস-লেনিনের সমাজতন্ত্র হলো প্রকৃত সমাজতন্ত্র। অর্থাৎ সবকিছু রাষ্ট্রের মালিকানায় থাকবে। আবদুর রহিম সাহেব প্রশ্ন তোলেন সবকিছুকেই বলতে ব্যক্তি, ঘরবাড়ি, সম্পত্তির অধিকার, জমিজমার মালিকানা এগুলোও কি জাতীয়করণ করতে চান? সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বললেন, সমাজতন্ত্রের সঙ্গে গণতন্ত্রের গোঁজামিল দেওয়া যাবে না। গণতান্ত্রিক অধিকার থাকলে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে না। সৈয়দ নজরুল ইসলাম রাশভারী মানুষ। কথা কম বলেন। তিনি দেখলেন পরিবেশ ভারী হয়ে উঠেছে, যে কোনো সময় তিক্ত বিতর্ক শুরু হবে। পরিবেশকে হালকা করার জন্য তিনি হাসতে হাসতে বললেন, সুরঞ্জিত বাবু কি চান আমাদের বউদের জাতীয়করণ করা হবে? আমরা সবাই হেসে উঠলাম। তিনি বলেন, রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক মালিকানার ক্ষেত্র হবে রাষ্ট্র খাত। সোভিয়েত রাশিয়াতেও সমবায় খাতের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। আর ব্যক্তিমালিকানা থাকবে, ভূমির অধিকার থাকবে। শোষণ বৈষম্য থাকবে না, মানবাধিকার থাকবে। বঙ্গবন্ধু ৪ নভেম্বর গণপরিষদ অধিবেশনে বললেন, ‘যে দেশে গণতন্ত্র পুঁজিপতিদের প্রটেকশনের জন্য কাজ করে, সেখানে শোষকদের রক্ষা করার জন্য গণতন্ত্র ব্যবহার করা হয়। সে গণতন্ত্রে আমি বিশ্বাস করি না। আমি চাই শোষিতের গণতন্ত্র। যেখানে শোষিতদের সর্বপ্রকার প্রটেকশন ও সুবিধা দেওয়া হবে।’

৩. সদস্য পদ থাকা না থাকা : কমিটির সামনে বিরাট প্রশ্ন হয়ে আসে- একটি হলো দল থেকে পদত্যাগ বা দলের বিপক্ষে ভোট দিলে সংসদ সদস্য পদ থাকবে কি না? এটা হলো সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের একটি দীর্ঘ ইতিহাস ও ঐতিহ্য আছে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচন হলো। পূর্ববঙ্গের সংসদের আসন সংখ্যা ছিল ৩০৯। যুক্তফ্রন্ট বিজয়ী হয়। কিন্তু কেন্দ্রে যুক্তফ্রন্ট সদস্য ও দলসুদ্ধ কেনাবেচা হয়। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান নিহত হলে খাজা নাজিমউদ্দিন প্রধানমন্ত্রী হন। তাকে হটিয়ে মোহাম্মদ আলী, তাকে সরিয়ে চৌধুরী মোহাম্মদ আলী, তাকে বাদ দিয়ে সোহরাওয়ার্দী, সোহরাওয়ার্দীকে হটিয়ে আইআই চূন্ডীগড়। আওয়ামী লীগের সমর্থনে ফিরোজ খান নুন প্রধানমন্ত্রী হন। সাতজন প্রধানমন্ত্রীর সময়কাল ছিল মাত্র ১৪ বছর। জেনারেল মির্জাকে হটিয়ে প্রধান সেনাপতি আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করেন। সামরিক শাসন জারি হলো। সংসদ ভেঙে গেল। নেতাদের গ্রেফতার করা হলো। রাজনীতি নিষিদ্ধ। তারপর চলল আইয়ুব খানের লৌহ শাসন। চালু করলেন মৌলিক গণতন্ত্র। সংসদীয় গণতন্ত্রের পরিবর্তে প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির সরকার চালু হলো। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রস্তাব করেন, ‘কোনো রাজনৈতিক দল যদি কোনো পরিষদ সদস্যকে বহিষ্কার করতে চায় তাহলে সেটা তার ওয়ার্কিং কমিটি করতে পারে এবং একমাত্র ওয়ার্কিং কমিটিরই তা করা উচিত।’ ড. কামাল হোসেন জবাবে বলেন, ‘গণতন্ত্র চর্চা এবং গণতন্ত্র ধারাবাহিকতার জন্য এটা করা হয়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের পার্লামেন্টের সদস্যরা পার্টি থেকে নির্বাচিত হওয়ার পর সেই পার্টির বিরুদ্ধে ভোট দিলে তিনি পদত্যাগ করেন। এটি না থাকলে সংসদ হবে সদস্যদের কেনাবেচার হাট। সিরাজুল হক বলেন, আবু হোসেন সরকারের আমলে সকালে এক সরকার, বিকালে ফ্লোর ক্রসিং করে অন্য সরকার। এক সপ্তাহে তিনবার সরকার গঠন ও সরকার পতন। আবদুল মুক্তাকীম চৌধুরী, আসাদুজ্জামান খান, মোশাররফ হোসেন আকন্দ ও হাফেজ হাবিবুর রহমান তারা এ মর্মে আপত্তি করেন যে, এর ফলে সংসদ সদস্যরা দলের বশংবদে পরিণত হবেন। আবদুল মুক্তাকীম চৌধুরী সুপারিশ করেন, যদি কোনো সদস্য তার দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভোট প্রদান করেন তখন কেবল তার সদস্য পদ বাতিল হবে।

৪. শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষানীতি : শিক্ষাব্যবস্থা ও পদ্ধতি কেমন হবে এ প্রশ্ন তুললেন অধ্যাপক খোরশেদ আলম। তিনি বলেন, আমাদের দেশে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা ইংরেজ আমল থেকে উ™ূ¢ত এবং যা এ দেশকে কলোনি করে রাখার উদ্দেশে তদানীন্তন ব্রিটিশ শাসকদের মস্তিষ্ক উদ্ভাবিত। অধ্যাপক আবু সাইয়িদ বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশে শিক্ষানীতির একটা মৌলিক রূপায়ণের প্রয়োজন আছে। কমিটি একমত হলেন। একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা, বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদান, সমাজের প্রয়োজনের সঙ্গে শিক্ষাকে সংগতিপূর্ণ করা, যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছা প্রণোদিত মানবসম্পদ সৃষ্টির জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা নেবে। খন্দকার মোশতাক আহমেদ প্রশ্ন তোলেন তাহলে কি মক্তব, মাদরাসা থাকবে না? তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, যে কোনো নাগরিক ধর্ম পালন, ধর্ম অবলম্বন, ধর্ম প্রচার করতে পারবে, এমনকি ধর্মীয় সম্প্রদায় ও উপ-সম্প্রদায়ের নিজস্ব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপন, রক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা অধিকার থাকবে।

৫. দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট : আওয়ামী লীগের হাফেজ হাবিবুর রহমান প্রস্তাব রাখেন- ৬০ সদস্যবিশিষ্ট উচ্চকক্ষ থাকা উচিত। তিনি বলেন, বাংলাদেশে জনসংখ্যা অনুপাতে এক কক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট জনস্বার্থবিরোধী আইন যাতে না করতে পারে সে জন্য চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স থাকা প্রয়োজন। জবাবে ড. কামাল হোসেন বলেন, বাংলাদেশ একটি একক (ইউনিটারি) স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। এ দেশ ফেডারেল পদ্ধতির নয়।

৬. নির্বাচনকালীন সরকার : সুরঞ্জিত সেন প্রস্তাব রাখেন, গণপরিষদ ভেঙে গেলে মন্ত্রিপরিষদ ভেঙে দেওয়া উচিত। তিনি প্রস্তাব করেন, এ সংবিধান প্রবর্তনের তারিখ থেকে বর্তমান মন্ত্রিসভা ভেঙে যাবে এবং নতুন প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত না হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি স্বাধীনতা-সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে প্রতিনিধি মনোনয়ন করে তত্ত্বাবধায়ক মন্ত্রিসভা নিযুক্ত করবেন। ড. কামাল হোসেন বলেন, আমরা ব্রিটিশ মডেল অনুসরণ করছি অর্থাৎ সংসদ ভেঙে যাবে, প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করবেন। কেবল রাজপ্রাসাদের নির্দেশে তিনি রুটিন ওয়ার্ক চালিয়ে যাবেন।

৭. বিচার বিভাগ : পাকিস্তান আমলে বিশেষ করে আইয়ুব খানের আমলে একব্যক্তির হাতে সব ক্ষমতা অর্পিত ছিল। বাংলাদেশ সংবিধানে বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন করা হবে এটা ছিল নির্বাচনের অঙ্গীকার। খসড়া সংবিধানে বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণ স্বাধীন করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির জেলা জজসহ অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়োগ, পদোন্নতি, ছুটি মঞ্জুর, বেতন-ভাতা ইত্যাদির বিষয়ে রাষ্ট্রপতি বরাবর সুপারিশ করবেন।

৮. ন্যায়পাল : ড. কামাল হোসেন সংবিধানে ন্যায়পাল পদের প্রস্তাব করেন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, আগামীতে পার্লামেন্ট হাউসের যারা সদস্য হবেন সেই সদস্যবৃন্দ দেশের সাংবিধানিক ব্যবস্থা ও এ সম্পর্কিত বিষয়ে অবগত হবেন। অধ্যাপক আবু সাইয়িদ বলেন, ন্যায়পালকে এমন ক্ষমতা দেওয়া দরকার যাতে তারা পার্লামেন্টে মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিতে মতামত রাখতে এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারেন। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম বলেন, সংবিধানে সংসদ আইনের দ্বারা ন্যায়পালকে কোনো মন্ত্রণালয়, সরকারি কর্মচারী বা সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষের যে কোনো কাজ সম্পর্কে তদন্ত পরিচালনার ক্ষমতাসহ যেরূপ ক্ষমতা কিংবা যেরূপ দায়িত্ব প্রদান করবেন, ন্যায়পাল সেইরূপ ক্ষমতা প্রয়োগ ও দায়িত্ব পালন করবেন।

৯. প্রধানমন্ত্রী : রাষ্ট্রপতি- সংসদীয় গণতন্ত্রে রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের প্রধান। তাকে শো-বয় করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর হাতে ‘অলৌকিক ক্ষমতা’ দেওয়া হয়েছে বলে মন্তব্য করেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। এ অবস্থায় আসাদুজ্জামান খান প্রস্তাব করেন, রাষ্ট্রপতি আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও বিদেশনীতিসহ যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মন্ত্রিসভায় বিবেচনার জন্য পেশ করতে পারবেন।

১০. কমিটির মিটিং-কত দিন কীভাবে : ১৭ এপ্রিল থেকে ২৯ তারিখ পর্যন্ত কমিটির ১৩টি ও মে মাসের ১০-২৫ তারিখ পর্যন্ত ১৬টি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ২৯টি বৈঠকে প্রতিটি খসড়া বিধান নিয়ে আলোচনা এবং বিভিন্ন দেশের সংবিধান পর্যালোচনা করা হয়। ১৯৭২ এর মে মাসের ২৫ তারিখে অনুষ্ঠিত কমিটি সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, খসড়া বিধানাবলি নিয়ে সদস্যরা যেসব সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন তার ভিত্তিতে সংবিধানের একটি পূর্ণাঙ্গ খসড়া প্রস্তুত করা হবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একটি পূর্ণাঙ্গ খসড়া প্রস্তুত করা হয় এবং জুনের ৩ তারিখ কমিটি বৈঠকে তা উপস্থাপন করা হয়। কমিটির এ খসড়াটি দফাওয়ারি পর্যালোচনা করে জুনের ১০ তারিখ কমিটি কর্তৃক খসড়া সংবিধান প্রাথমিকভাবে অনুমোদিত হয়। এরপর খসড়া সংবিধানের আইনগত খসড়া রচনাকারীদের এবং বাংলা ভাষার পন্ডিতদের নিয়ে পরীক্ষা করানো হয় এবং তাদের পরামর্শ অনুযায়ী পরিমার্জিত খসড়া সংবিধানের একটি পার্ট আগস্টের ১০ তারিখ কমিটি বৈঠকে উপস্থিত করা হয়। আগস্টের ১০ তারিখ থেকে সেপ্টেম্বরের ১ তারিখ এবং সেপ্টেম্বরের ৯ থেকে অক্টোবরের ১১ তারিখ পর্যন্ত কমিটি পুনরায় এ পাঠের পর্যালোচনা করেন। কোনো কোনো বিষয়ে কমিটির ছয়জন সদস্য সংখ্যাগরিষ্ঠ মত সমর্থন করেননি এবং মতানৈক্যমূলক মন্তব্য সংযোজন করার অভিপ্রায় জ্ঞাপন করেন। এ ছয়জনের মধ্যে পাঁচজন ছিলেন আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। আওয়ামী লীগের ক্ষিতিশ চন্দ্র মন্ডল প্রস্তাব করেন, তফসিলি সম্প্রদায় ও উপজাতিদের শিক্ষাসংক্রান্ত অর্থনৈতিক বিষয়ে বিশেষ ব্যবস্থাক্রমে দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। চূড়ান্তরূপে গ্রহণ করার জন্য কমিটি এ বিষয়ে মতানৈক্যমূলক মন্তব্য সংযোজনসহ একটি রিপোর্ট প্রস্তুত করে ও খসড়াটি বাংলাদেশ গণপরিষদে পেশ করার সিদ্ধান্ত নেয়। খন্দকার মোশতাক কমিটির সংরক্ষিত অনুচ্ছেদগুলো পূর্ণাঙ্গ গণপরিষদে আলোচনার প্রস্তাব করেন। কমিটি ৭৪টি বৈঠক ও ৩০০ ঘণ্টা সময় ব্যয় করে। ১২ জনের উপস্থিতিতে ফোরাম হতো।

খসড়া সংবিধান রচনাকালে যেসব প্রস্তাব কমিটির সভায় উপস্থাপিত হয়েছিল সেসব বিষয়ে অক্টোবর মাস থেকে শুরু হওয়া পূর্ণাঙ্গ গণপরিষদে আলোচিত হয়। তবে বিনয়ের সঙ্গে বলতে পারি, চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতিভিত্তিক সংবিধানে প্রতিটি অনুচ্ছেদে, বর্ণে, শব্দে ও ভাষায় বর্ণিত; যা ছিল গণআকাক্সক্ষার প্রতিফলন। 

                লেখক : ’৭২ খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য ও সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী

সর্বশেষ খবর