বৃহস্পতিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

হাদিস সংরক্ষণে ইমাম বুখারি (রহ.)

এম এ মান্নান

হাদিস সংরক্ষণে ইমাম বুখারি (রহ.)

ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় হাদিস ও সুন্নাহর গুরুত্ব অপরিসীম। হাদিস হচ্ছে কোরআনের সঠিক ব্যাখ্যা। ইসলামের মহা মনীষীদের অক্লান্ত ত্যাগ ও সাধনায় ইসলামী জ্ঞানের এ অমূল্য সম্পদ সংরক্ষিত রয়েছে। হাদিস বেত্তারা হাদিস সংগ্রহ ও সংকলনে যে নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন তার কোনো তুলনা নেই।

পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘হে ইমানদারগণ! আনুগত্য কর আল্লাহর, আনুগত্য কর রসুলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা ক্ষমতার অধিকারী তাদের, অতঃপর যদি তোমরা কোনো বিষয়ে বিবাদে প্রবৃত্ত হয়ে পড় তাহলে তা আল্লাহ ও তাঁর রসুলের প্রতি প্রত্যর্পণ কর। যদি তোমরা আল্লাহ ও কিয়ামত দিবসের ওপর বিশ্বাসী হয়ে থাক।’ (সুরা নিসা-৫৯)।

পবিত্র কোরআনে আরও ইরশাদ হয়েছে, রসুল তোমাদের যা দিয়েছেন তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাক এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা (সুরা : হাশর-০৭)।

জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি বিষয়ে সঠিকভাবে চলার উপায় হচ্ছে হাদিসে রসুল তথা রসুল (সা.) -এর জীবনাদর্শ। হাদিস ও সুন্নাহর পবিত্র আমানতকে যারা সংরক্ষণ ও সংকলন করে মুসলিম উম্মাহর মাঝে প্রচার প্রসারে ভূমিকা রেখেছেন তাদের অন্যতম ইমাম বুখারি (রহ.)। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রসুলে করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তার জীবন সমুজ্জ্বল করুক যারা আমার বাণী শ্রবণ করে তা মুখস্থ করল তা সঠিকরূপে স্মরণে রাখল তাকে পূর্ণরূপে হেফাজত করল এবং অন্যের নিকট তা পৌঁছে দিল। অনেক জ্ঞানের বাহক এমন ব্যক্তির নিকট তা পৌঁছে দেয় যিনি তার চেয়ে অধিক জ্ঞানী ও বিজ্ঞ (বায়হাকি)।

রসুল (সা.) আরও ইরশাদ করেছেন, ‘আমার উম্মতের যে ব্যক্তি দীন সম্পর্কে ৪০টি হাদিস সংরক্ষণ করবে আল্লাহতায়ালা তাকে ফকিহ (আইনজ্ঞ) বানাবেন এবং কিয়ামত দিবসে আমি তার জন্য শাফায়াতকারী ও সাক্ষী হব।’ (মিশকাতুল মাসাবিহ)।

রসুল (সা.) এর হাদিস সংগ্রহ ও সংরক্ষণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন ইমাম বুখারি (রহ)। ইমাম বুখারি (রহ.) ১৯৪ হিজরির ১৩ শাওয়াল বুখারায় জন্মগ্রহণ করেন। ইমাম বুখারি শিশু অবস্থায় তাঁর পিতা ইন্তেকাল করেন। পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়ে মাতৃকোলে লালিত-পালিত হন। বাল্যবয়সেই তিনি দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন, অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের শত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও দৃষ্টিশক্তি ফিরে আসেনি। তাঁর মহীয়সী মা ছিলেন অত্যন্ত পরহেজগার। ছেলের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে পাওয়ার জন্য প্রায়ই রাতভর আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করতেন ও কান্নাকাটি করতেন। তাঁর মা এক রাতে হজরত ইব্রাহিম (আ.)-কে স্বপ্নে দেখেন। তিনি বলেন, আল্লাহতায়ালা তোমার দোয়ার বদৌলতে স্বীয় অনুগ্রহে তোমার ছেলের দৃষ্টিশক্তি দিয়ে দিয়েছেন, সকালে দেখতে পান ছেলে দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেয়েছেন। (শামসুদ্দীন, আয-যাহাবি, সিয়ারু আলামিন নুবালা, খ.-১২ পৃ.-৩৯৭, জামিউল আহাদিস, মুকাদ্দিমা, পৃ: ৩২১ কৃতঃ ইমাম আহমদ রেযা)।

মায়ের তত্ত্বাবধানে ইমাম বুখারির প্রাথমিক শিক্ষার সূচনা হয়। প্রথম থেকেই তাঁর অন্তরে ইলমে হাদিস অর্জনের বাসনা জাগ্রত হয়। পাঁচ বছর বয়সে তিনি বুখারার একটি মাদরাসায় ভর্তি হন। ছয় বছর বয়সে তিনি পবিত্র কোরআনের হাফেজ হন। তিনি তীক্ষè স্মরণশক্তি ও অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী ছিলেন।

রসুল (সা.)-এর হাদিসের বিশাল সম্পদ সংগ্রহের জন্য ইমাম বুখারি (রহ.) পৃথিবীর দূর-দূরান্তে বিভিন্ন দেশ সফর করেন। বুখারি শরিফের ব্যাখ্যাকার আল্লামা কিরমানির বর্ণনা মতে, ইমাম বুখারি (রহ.) বিভিন্ন দেশের ১ হাজার আশিজন হাদিস বিশারদ থেকে হাদিস লিপিবদ্ধ করেছেন। আল্লামা ইবনুল জাওজির বর্ণনা মতে, ইমাম বুখারি (রহ.) ইলমে হাদিস সংগ্রহ ও অনুসন্ধানের জন্য বিভিন্ন দেশের খ্যাতিমান মুহাদ্দিসগণের সান্নিধ্যে গমন করেন, তিনি খোরাসানের জিবাল, ইরাকের সব শহরে, হিজাজ, মিসর ও সিরিয়া সফর করে অসংখ্য হাদিস লিপিবদ্ধ করেছেন। ইমাম বুখারি (রহ.) ১৮ বছর বয়সে মা ও বড় ভাই আহমদ ইবনে ইসমাইলের সঙ্গে হজ পালন করেন। হজ শেষে তিনি মক্কা মুকাররমায় থেকে যান। এ সময় হাদিস সংগ্রহে তিনি সর্বক্ষণ ব্যস্ত থাকেন। ১৮ বছর বয়সেই ২১২ হিজরিতে তিনি সাহাবি ও তাবিয়িগণের ফয়সালাবিষয়ক ‘কিতাবু কাদইয়াস সাহাবা ওয়াত তাবিয়িন’ নামক গ্রন্থটি রচনা করেন। এ ছাড়াও রসুল (সা.)-এর রওজা মুবারকের পাশে বসে চাঁদনি রাতে তিনি ‘আৎ তারিখুল কবির’ নামক চল্লিশ হাজার হাদিস বর্ণনাকারীদের জীবনীবিষয়ক এক বিশাল কিতাব রচনা করেন। (ইবন হাজর আসকালিনি, হাদিয়ুস সারি, জামিউল আহাদিস, মুকাদ্দিসা, পৃ: ৩২২)। ইমাম বুখারি (রহ.) একজন অদ্বিতীয় আশেকে রসুল ছিলেন। তাঁর কাছে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চুল মুবারক সংরক্ষিত ছিল। তিনি তা তাঁর পরিধেয় পোশাকের সঙ্গে রাখতেন। (হাদিয়ুস সারি, পৃ: ৪৮১)।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আমেনা খাতুন হাফেজিয়া কোরআন রিসার্চ অ্যান্ড ক্যাডেট ইনস্টিটিউট, কটিয়াদী, কিশোরগঞ্জ

সর্বশেষ খবর