শুক্রবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

পাগলা হাওয়ার তোড়ে

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

পাগলা হাওয়ার তোড়ে

আজ থেকে ৯৪ বছর আগে (২৯ আগস্ট, ১৯২৯) কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রকৃতি পর্বের একটি অসাধারণ গানে বর্ষার আকাশ ও মানবমনের অন্ত্যমিল তুলে ধরেন। গানের শুরুতে কবি লেখেন, ‘মোর ভাবনারে কি হাওয়ায় মাতালো- দোলে মন দোলে অকারণ হরষে’। রচনার ৯৪ বছর পর ৩১ আগস্ট, ২০২৩ বর্ষণমুখর সকালে এ গান শুনতে শুনতে পত্রিকার পাতা খুলতেই এক খবর- বাদল দিনের পাগলা হাওয়ার মতো সব দুর্ভাবনাকে এলোমেলো করে দিয়ে মনে হরষ বা আনন্দ জাগিয়ে দিল। তবে অকারণে নয়, কারণে। কারণ বাংলাদেশের অদম্য তরুণ, হতদরিদ্র পথশিশুদের বন্ধু ও জগৎখ্যাত জাগো ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা করভি রাখসান্দ (জন্ম ১৯ আগস্ট, ১৯৮৫) এশিয়ার নোবেল খ্যাত র‌্যামোন ম্যাগসাইসাই অ্যাওয়ার্ড লাভ করেছেন। ২২ বছর বয়স থেকে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে ৩৮ বছর বয়সে এসে এ সম্মান লাভ মোবাইল আর ল্যাপটপে বুঁদ হয়ে থাকা অনেক তরুণকেই জীবনের সঠিক পথ দেখাবে এমন একটা সুখানুভূতি নিয়ে হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে থাকার পঞ্চম দিনের মাথায় হরষে বিষাদ ঢেলে দেয় আরেক সংবাদ। ৫ আগস্ট, ২০২৩-এর ওই সংবাদের শিরোনাম ‘হাওয়ায় হচ্ছে ১৩ ব্রিজ’। এ সংবাদে বলা হয়, দেশের দক্ষিণাঞ্চলে আয়রন ব্রিজ পুনর্র্নির্মাণ বা পুনর্বাসন (আইপিআরপি) প্রকল্পের আওতায় পটুয়াখালী সদর উপজেলায় ১৩টি ব্রিজ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি)। ২০২০ সালের মার্চে অনুমোদিত এসব ব্রিজের নির্মাণকাজে নানা ধরনের অনিয়ম আমলে নিয়ে এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী সব কাজ বাতিল এবং ঠিকাদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ প্রদান করেন। তবে নথি থেকে এ নির্দেশনার অংশটুকু সুকৌশলে মুছে ফেলে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সব দফতরে ফাইল পাঠানো হয়। এর ফলে বাস্তবে এসব ব্রিজের অস্তিত্ব না থাকলেও জুন শেষের অগ্রগতি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব ব্রিজের কাজ চলমান। এভাবেই প্রকল্প পরিচালক সৈয়দ সাহেবের ব্রিজ কেতাবে থাকলেও বাস্তবে তা হওয়াতেই হচ্ছে। দেশের প্রাচীন এক সংবাদপত্রে সম্প্রতি প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায়, ২০২১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি এক বছরের মধ্যে নির্মাণ শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে শুরু হয় টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার কাঁকড়ার জোড়া ব্রিজের কাজ। কিন্তু দু-তিন মাসের মধ্যে কাজ ফেলে হাওয়া হয়ে যান ঠিকাদার।

দুই বছর ধরে ব্রিজ হওয়ার আশায় দিন গুনছে এলাকাবাসী। এ ব্রিজ নির্মিত না হলেও মানিকগঞ্জ সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের সামনে নির্মিত আজব এক ব্রিজের সংবাদ ছাপায় ৬ সেপ্টেম্বরের আরেক পত্রিকা। ৪০ ফুট উচ্চতার এ সেতু দিয়ে ১২ বছরে কেউ পারাপার হয়নি। কারণ ব্রিজের দুই পাশে হাওয়া প্রবাহিত হয়, কোনো রাস্তা নেই। সারা দেশে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় কর্তৃক নির্মিত দুই পাশে রাস্তাবিহীন এমন শতাধিক ব্রিজের সচিত্র প্রতিবেদন বিভিন্ন সময়ে সামনে এনেছে সংবাদমাধ্যম। এসব ব্রিজে কেউ নেশা করে, কেউ ধান-পাট শুকায়, কেউ ঘর বানিয়ে মাছের ঘের পাহারা দেয় আবার কেউ কেউ বিকালে ব্রিজে বসে সেলফি তুলে ও হাওয়া খায়। আর যারা জনগণের টাকার এমন অপচয় ঘটালেন তারা জবাবদিহিতার অভাবে দিব্যি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়ান। এ হাওয়া যদি বৈদ্যুতিক পাখার হয় তবে অবশ্যই যে-কাউকে বিদ্যুৎ বিল দিতে হয়। কিন্তু দক্ষিণাঞ্চলের একজন মন্ত্রীর বাড়িতে কেবল বৈদ্যুতিক পাখায়ই নয়; ফ্রিজ, টিভি, এসি এবং সেচ পাম্পের ব্যাপক ব্যবহারের পরও ২০২২ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি এবং ২০২৩ সালের জুন ও জুলাই এ চার মাসের বিদ্যুৎ বিল ‘শূন্য’ ছিল মর্মে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে একাধিক পত্রিকায়। অর্থাৎ বৈদ্যুতিক পাখার হাওয়ার সঙ্গে হাওয়া হয়ে গেছে বিদ্যুৎ বিলও। এ বছর এপ্রিল, মে, জুন ও জুলাই এ চার মাসে বিদ্যুৎ বিল হয়েছে ৩৭ টাকা হারে! একটি কলেজে শিক্ষকতায় যুক্ত মন্ত্রিপুত্রের বাড়িতে প্রথম ছয় মাস সর্বনিম্ন ৭২ টাকা ও সর্বোচ্চ ৫১২ টাকা বিল দিতে হয়েছে (গড়ে মাসিক ২১১ টাকা)। মন্ত্রীর ভাই মৃত বাবার সংযোগ ব্যবহার করে হাওয়া খেলেও সেখানে চার মাসের মধ্যে প্রতি মাসে বিল উঠেছে ৬৩ থেকে ২৯৪ টাকার মধ্যে। এভাবে বৈদ্যুতিক হাওয়া খেয়েও বিদ্যুৎ বিল দেওয়ার ভাগ্য সবার নসিবে হয় না।

আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা বিবিসিসহ দেশের প্রায় সব প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার গত কয়েকদিনের গরম খবর, ৪৫ কোটি টাকা মূল্যের ৫৫ কেজি স্বর্ণ হাওয়া হয়ে গেছে ঢাকা বিমানবন্দরে থাকা কাস্টমস বিভাগের লকার থেকে। বর্তমান বাস্তবতায় মানুষ রান্নাঘরে বুয়ার কাজ তদারকি করতেও সিসি ক্যামেরা ব্যবহার করে। কিন্তু গুদামের ভিতরে কোনো সিসি ক্যামেরা ছিল না। ফলে স্বর্ণ হাওয়া করে দেওয়া কাউকেই ধরা যাচ্ছে না। যেমনটি ধরা যাচ্ছে না বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকাসহ বিভিন্ন ব্যাংকের টাকা, খনির কয়লা ও পাথর, ম্যাপের নদীনালা, অরণ্য, পাহাড়, তথ্যভান্ডারের তথ্য, রাজউকের লকারের ফাইল কিংবা বাজারের তেল, পিঁয়াজ, ডিম ও ডলার হাওয়া করে দেওয়া নেপথ্য কুশীলবদের। প্রস্তরযুগ, লৌহযুগ, তাম্রযুগ, এমনকি সামরিক একনায়কতন্ত্রে চলা ভিত্তিপ্রস্তর যুগের পর এখন যেন শুরু হয়েছে হাওয়ার যুগ।

কেবল মানুষই নয়, এ দেশে হাওয়া হয়ে যায় কোম্পানিও। বেশকিছু সংবাদপত্রে ৫ আগস্ট প্রকাশিত হয় ১০টি কোম্পানির নাম, যাদের আদৌ কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাচ্ছে না সরকারের নানা সংস্থা ও বাহিনী। কয়েক বছর ধরে এ কোম্পানিগুলো সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, কাতার, সৌদি আরব ও নাইজেরিয়ায় প্রায় ৩০০ কোটি টাকার তৈরি পোশাক রপ্তানির কাগজপত্র তৈরি করে জমা করলেও এ বাবদ কেউ কোনো ডলার ফেরত আনেনি। অন্যদিকে বস্ত্র ও কৃষিপণ্য রপ্তানির নকল নথিপত্র জমা দিয়ে সরকারি টাকা তুলে নেওয়ার খবর বছরের পর বছর প্রকাশ করেছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম। তবে সেই বস্ত্র বা কৃষিপণ্য অন্য কোনো দেশে নয়, রপ্তানি হয়েছে হাওয়ায়, মনে মনে। ঋণের জন্য ব্যাংকে আবেদনকারীদের ঠিকানা যাচাইবাছাই করেন ব্যাংকার বাবুরা, তবে ঋণগ্রহীতারা হাওয়া হয়ে গেলে সেই ঠিকানা ভুয়া প্রমাণিত হয়। তবে ব্যাংকারদের কিছু হয় না, তারা হাওয়াই মিঠাই খেয়ে দিব্বি ঘুরে বেড়ান।

চলতি সেপ্টেম্বর শুরুর দিনে আরেক বাংলা সংবাদপত্রে শিরোনাম ‘৬১৯ কোটি টাকার সার খেয়েও নবাবি হালে নবাব’। ২০২১ সালের শুরুর দিকে তৎকালীন ৬১৯ কোটি ৯৮ লাখ ৩৯ হাজার ৪১৯ টাকায় আমদানিকৃত ৬৪ হাজার মেট্রিক টন সার চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর থেকে দেশের বিভিন্ন সারের গুদামে পৌঁছানোর দায়িত্ব পায় জনৈক নবাব খানের মালিকানাধীন ‘নবাব অ্যান্ড কোম্পানি’। যথারীতি সারবাহী ট্রাকের বহর বন্দর থেকে সার নিয়ে বের হয়েও আসে। এরপর হাওয়া! দুই বছর ধরে তদন্ত ও মামলা চললেও নবাবের হাওয়া খাওয়া কমে না। এমন মিষ্টি হাওয়ার স্বাদ এর আগে পেয়েছিলেন আরেক খানসাহেব। তিনি নরসিংদী-২ আসনের সাবেক এমপি কামরুল আশরাফ খান পোটন। ১০ জানুয়ারি, ২০২৩-এর সংবাদমতে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের ১ লাখ ৭৯ হাজার টন ও বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের ৭২ হাজার টন, সব মিলিয়ে ১ হাজার ৩৮২ কোটি টাকার ২ লাখ ৫১ হাজার টন সার পরিবহনের নামে হাওয়া করে দিয়েছেন এই খান তথা পোটন সাহেব। এর আগে একই প্রতিষ্ঠান একইভাবে সার হাওয়া করে দিলেও হাওয়াই কারণে তাকেই বারবার সার পরিবহনের দায়িত্ব দেওয়া হতো। কুষ্টিয়া ট্রেডার্স নামে আরেক প্রতিষ্ঠান হাওয়া করেছে ৮-১০ হাজার টন টিএসপি সার। জামালপুরের সরিষাকান্দিতে অবস্থিত যমুনা সার কারখানার ১ নম্বর গুদাম থেকে হাওয়া হয়েছে ১৯ হাজার ১৩৩ দশমিক ১৩ মেট্রিক টন সার, যার বাজারমূল্য ৩০ কোটি ২৬ লাখ ৬৩৬ টাকা। চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত একটি বাংলা সংবাদপত্রে শিরোনাম ছিল ‘এক বছরে ৭ হাজার ট্রাক সার গায়েব’। কেবল সার কারখানার গুদামই নয়, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের গুদাম, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের গুদাম এবং ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের (বাফা) গুদাম থেকেও বছরের পর বছর পাল্লা দিয়ে হাওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে কৃষকের সার। অথচ নিজেদের পালে দিব্যি হাওয়া লাগিয়ে এগিয়ে চলেছেন সংশ্লিষ্ট সবাই। এ ক্ষেত্রে সবাই একাট্টা।

২০২৩ সালের ৩১ আগস্ট একটি ইংরেজি সংবাদপত্রের অনুসন্ধানী রিপোর্টে দেখা যায়, ২০০৬ থেকে ২০২১- এ ১৫ বছরে ই-কমার্স, এমএলএমসহ নানা কায়দায় হাওয়া হয়েছে নিরীহ জনগণের ২১ হাজার কোটি টাকা। সর্বশেষ দুবাইভিত্তিক অনলাইন অ্যাপ মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ (এমটিএফই) গ্রুপ এ দেশের সাধারণ মানুষের বিপুল অঙ্কের টাকা নিয়ে হাওয়া হয়ে গেছে। হাওয়া হয়ে যাওয়া মোট অঙ্কের সঠিক পরিসংখ্যান কেউ দিতে পারছে না, দিচ্ছে শুধু ভুক্তভোগীদের গুমরে গুমরে কাঁদার খবর।

ভুল নকশা ও ভুল পরিকল্পনার কারণেও হাওয়া হয় জনগণের টাকা। তবে আশার কথা, ৫ সেপ্টেম্বর একনেকের সভায় এমন ভুলের জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এক মন্ত্রীকে ধরার কথাও বলেছেন। তাঁর সাহসী উচ্চারণ আশার প্রদীপ জ্বালালেও চারদিকে পাগলা হাওয়ার দাপটে সেই প্রদীপ কতক্ষণ জ্বলে থাকবে, সেই প্রশ্ন মনকে এলোমেলো করে দেয়। এলোমেলো মনে রাজীব আহমেদের লেখা ও নগরবাউল জেমসের গাওয়া গান শুনতে ইচ্ছা করে- ‘পাগলা হাওয়ার তোড়ে, মাটির পিদিম নিভুনিভু করে... মাটির পিদিম নিভে গেলে, বন্ধুরে দেখব কী করে’।

পুনশ্চ : লেখাটি শেষ করার পর দেশের প্রাচীন এক সংবাদপত্রের একটি খবরে চোখ আটকে গেল। খবরটিতে বলা হয়েছে, হাওয়া হয়ে যাওয়া এ দেশের সম্পদ ও জনগণের টাকার একটি অংশ পাগলা হাওয়ার তোড়ে উড়ে চলে গেছে যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে ২৫২টি বাড়ি কিনেছেন আমলা ও পুলিশের কর্মকর্তারা, যাদের তালিকা সরকারি শীর্ষ মহলে জমা দিয়েছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা। দুনিয়ার টানে মত্ত এই মানুষেরা কি সাঁইজির এ গানটা শুনবেন- ‘পাখি কখন জানি উড়ে যায়, একটা বদ হাওয়া লেগে খাঁচায়। খাঁচার আড়া প’লো ধসে, পাখি আর দাঁড়াবে কীসে, ওই ভাবনা ভাবছি বসে, চমকজ্বরা বইছে গায়’।

লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

email : [email protected]

সর্বশেষ খবর