শনিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

আবাদযোগ্য জমির হালহকিকত

লাকী আক্তার

আবাদযোগ্য জমির হালহকিকত

নদী, ফসলি সবুজ বিস্তীর্ণ মাঠ এবং আঁকাবাঁকা মেঠো পথের জনপদ হচ্ছে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চল। প্রশ্ন উঠছে, প্রশান্তির এ গ্রামের চিত্র আগামী ৫০ বছর পরও অক্ষুণ থাকবে নাকি সমস্ত সবুজ হারিয়ে যাবে অপরিকল্পিত স্থাপনার ভিড়ে? বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতি এখন পর্যন্ত কৃষিজমির ওপর নির্ভরশীল হওয়া সত্ত্বেও মোট আবাদি জমির ব্যাপারে সরকারি পরিসংখ্যানের মধ্য দিয়েও সরকারের কৃষি এবং কৃষিজমি রক্ষা নিয়ে উদাসীনতা চোখে পড়ার মতো।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) কৃষিশুমারি, ২০১৯-এর তথ্যানুসারে, ১১ বছরে তুলনামূলক নিট আবাদি জমির পরিমাণ কমেছে ৪ লাখ ১৬ হাজার একর। ২০১৩ সাল পর্যন্ত সরকারের বিভিন্ন ডকুমেন্টে ১ শতাংশ হারে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ কমছে বলা হলেও বর্তমানে সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, আবাদি জমির পরিমাণ কমছে শূন্য দশমিক ০২ শতাংশ হারে। সরকার নিয়মমাফিক ঘোষণা দিয়ে ফসল উৎপাদন বাড়ানোর কথা বললেও আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ কমে যে কৃষিজমি হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে তা নিয়ে সরকারের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।

বাংলাদেশ সরকারি কৃষিতথ্য সার্ভিসের (এআইএস) তথ্য বলছে, ‘রাস্তাঘাট, কলকারখানা, অপরিকল্পিত বাড়িঘর ইত্যাদি অবকাঠামো তৈরিতে চাষযোগ্য জমি থেকে প্রতিদিন ২২০ হেক্টর হিসেবে প্রতি বছর হারিয়ে যাচ্ছে প্রায় ৮০ হাজার ৩০০ হেক্টর জমি।’ এর পরও আবাদি জমি নিয়ে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের যে আন্তসম্পর্ক এবং সমন্বয় প্রয়োজন, কোনো ক্ষেত্রেই তার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় না।

সংবিধানের ১৮ (ক)-তে বলা আছে, ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন’, যদিও বাস্তব চিত্র পুরোপুরি ভিন্ন। মোট জনসংখ্যার শতকরা ৮০ ও মোট শ্রমশক্তির ৬০ ভাগ কৃষি খাতে নিয়োজিত থাকলেও আবাদযোগ্য জমি সংরক্ষণে রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের নাগরিকরা কারোই যেন কোনো উদ্বেগ নেই।

জলাধার এবং বন রক্ষায় আইন ও নীতিমালা থাকলেও কার্যত তার কোনো প্রয়োগ নেই। একদিকে যেমন মোট কৃষিজমির বড় একটি অংশ তার উর্বরতা হারাচ্ছে, অন্যদিকে বিপুল পরিমাণ আবাদযোগ্য জমি অকৃষি খাতে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ বিষয়ে খোদ ভূমি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট কারণ হিসেবে বলছে, ‘অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে নগরায়ণের প্রবণতা, শিল্পায়নের পরিধি, রাস্তাঘাট, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্রমাগত সম্প্রসারণের ফলে মাথাপিছু জমির পরিমাণ ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে।’

দেশব্যাপী বিভিন্ন এলাকার কৃষকের সঙ্গে আলাপ করে জেনেছি, কৃষিজমি হারানোর পেছনে তারা জনসংখ্যা বৃদ্ধি, নগরায়ণ ও শিল্পায়ন, যত্রতত্র অবকাঠামো নির্মাণ, অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ, নদী ভাঙন, কলকারখানা স্থাপন, জমি ভরাট, বাগানবাড়ি, রিসোর্ট, হাউজিং কোম্পানি, রাস্তাঘাট উন্নয়ন, ইটভাটা স্থাপন, ফসলি জমির মাটি বিক্রি, পুকুর খনন, জলাবদ্ধতা, ঘেরে চিংড়ি চাষ, ভূগর্ভস্থ পানির যথেচ্ছ ব্যবহার, অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার এসব কারণকে দায়ী করছেন। পাশাপাশি একান্নবর্তী পরিবারের ভাঙনকেও কৃষিজমির পরিমাণ হ্রাসের জন্য দায়ী করছেন তারা।

কৃষিজমি রক্ষায় ‘কৃষিজমি (যথাযথ ব্যবহার ও সংরক্ষণ) আইন, ২০২২’ নামে একটি বেসরকারি বিল ৩১ মার্চ, ২০২২ জাতীয় সংসদে গ্রহণ করা হলেও তা এখনো আইনে পরিণত হয়নি। ফলে আবাদযোগ্য জমি রক্ষায় এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান ও কার্যকর কোনো আইন বা নীতি প্রণীত হয়নি। এদিকে কৃষিজমি (যথাযথ ব্যবহার ও সংরক্ষণ) বিলে বলা হয়েছে, আইন কার্যকর হওয়ার পর দেশের কোনো আবাদযোগ্য জমি কৃষিকাজ ছাড়া কোনো কারণে ব্যবহার, অন্য কোনো কাজের জন্য ভাড়া বা ইজারা এবং কোনোভাবে হস্তান্তর করা যাবে না; যদিও এর বাস্তবিক কোনো প্রয়োগ এখনো দেখা যায় না।

হাইব্রিড ও উচ্চফলনশীল ধান উৎপাদনে অতিরিক্ত কীটনাশক এবং যথেচ্ছভাবে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের ফলে ভূমি তার স্বাভাবিক উর্বরতা হারাচ্ছে। নদী ও খালবিলের স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা তো আছেই। তার ওপর অধিক লোভের দরুন খুলনা অঞ্চলের মোট কৃষিজমির একটি বড় অংশ চিংড়ি ঘেরে রূপান্তরিত হচ্ছে। আবার কোনো কোনো এলাকায় সারা বছর জলাবদ্ধতা থাকছে, বাড়িঘরে পানি উঠছে। যার ফলে সেখানকার কৃষিব্যবস্থা ধ্বংস তো হচ্ছেই, পাশাপাশি পরিবেশ-প্রতিবেশ ও মনুষ্য বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। এ ছাড়া দেখা যাচ্ছে, কৃষিজমিতে অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ কমাতে পারছে না সরকার, বরং যত্রতত্র জমি ভরাট করে হোটেল, রিসোর্ট, ইটভাটা স্থাপনের ছাড়পত্র দিচ্ছে। এগুলো দেখে প্রশ্ন জাগে- সরকার আদতে আবাদযোগ্য জমি, জমির উর্বরতা, নদী এবং খালবিল রক্ষা করতে আগ্রহী কি না? কৃষিজমি রক্ষায় দ্রুততার সঙ্গে সমন্বিত নীতিমালা গ্রহণ করা প্রয়োজন।

সবার আগে নদী ও খালগুলোর স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় দেশের সব ধরনের কৃষিজমি রক্ষা ও সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে একটি সুনির্দিষ্ট সর্বজনীন গ্রহণযোগ্য ‘কৃষিজমি রক্ষায় প্রস্তাবিত আইন ও নীতিমালা’ দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। দেশের মোট আবাদযোগ্য জমি রক্ষার মূল দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। এ ব্যাপারে কৃষি মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ অধিদফতরকে কার্যকর ভূমিকা- রাখতে হবে। সর্বোপরি, কৃষিজমি রক্ষার ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ ও সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি।

লেখক : কেন্দ্রীয় সদস্য বাংলাদেশ কৃষক সমিতি

সর্বশেষ খবর