রবিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

রক্ষীবাহিনীর ব্যর্থতায় কঠিন বাস্তবতা

নঈম নিজাম

রক্ষীবাহিনীর ব্যর্থতায় কঠিন বাস্তবতা

একটা ব্যর্থতার গ্লানি এখনো বয়ে বেড়াতে হচ্ছে রক্ষীবাহিনীর ১২ হাজার সদস্যকে। বাংলাদেশের জাতির পিতাকে রক্ষা করতে পারেননি রক্ষীবাহিনীর সদস্যরা। ব্যর্থতা ছিল খুনিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তোলায়ও। সেনাবাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি সংঘাতে না জড়ানোর অনুরোধ অথবা নির্দেশ এসেছিল সেনা হেডকোয়ার্টার থেকে। কারা দিয়েছিলেন সেই নির্দেশ? কেন দিয়েছিলেন? আড়ালের ষড়যন্ত্র কী ছিল? এখনো অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। রক্ষীবাহিনী প্রধান কর্নেল নুরুজ্জামান দেশে ছিলেন না। ১৯৭৫ সালের ১২ আগস্ট তিনি ঢাকা ছাড়েন। গন্তব্যস্থল ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন।  উচ্চতর প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য বিষয়ে আলোচনার জন্য তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমন্ত্রণ পান। অধ্যাপক আবু সাইয়িদ বইতে লিখেছেন, এ আমন্ত্রণ ছিল সিআইএ থেকে পাওয়া। রক্ষীবাহিনীর তখনকার অনেক কর্মকর্তা বলেছেন অন্য কথা। তাঁরা বলেছেন, আমন্ত্রণ সিআইএ থেকে সরাসরি ছিল না। আমন্ত্রণপত্র ছিল যুক্তরাষ্ট্র সরকার থেকে। রাষ্ট্রপতির অনুমতি নিয়ে তিনি ঢাকা ছাড়েন। যাওয়ার আগে ভারপ্রাপ্ত পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব দেন লে. কর্নেল আবুল হাসান খানকে। ১৫ আগস্ট কর্নেল নুরুজ্জামান ছিলেন লন্ডনে যাত্রাবিরতিতে। জাতির পিতার হত্যাকান্ডের খবর তিনি যখন পান তখন বাংলাদেশ সময় দুপুর। রক্ষীবাহিনীর দুই কর্মকর্তা আনোয়ারুল আলম শহীদ ও সরোয়ার মোল্লা তাঁকে ফোনে পাওয়ার চেষ্টা করেন ভোর থেকে। তিনি ছিলেন ঘুমিয়ে। লন্ডন সময় সকালে যখন ফোনে পান তখন বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিয়েছেন খুনি মোশতাক। অন্য বাহিনীর মতো রক্ষীবাহিনীও নির্বিকার।

নুরুজ্জামান হত্যাকান্ডের খবরে ঢাকায় সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ভূমিকার খবর নেন। তিনি তাদের অবস্থানে বিস্ময় প্রকাশ করেন। তারপর রক্ষীবাহিনীর ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ও দুই উপপরিচালককে নির্দেশ দেন খালেদ মোশাররফ ও রংপুর ব্রিগেডের কর্নেল হুদার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে। খুনিরা বঙ্গভবনে বসে ঢাকা ফেরায় নুরুজ্জামানকে বাধা দেন। নুরুজ্জামান যুক্তরাষ্ট্রে আর যাননি। লন্ডনে অবস্থান নেন। এ সময় রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কর্নেল নুরুজ্জামানের যোগাযোগ ছিল। কোনো ধরনের বার্তা বা অ্যাকশনের নির্দেশ রংপুর থেকে কর্নেল হুদা রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তাদের দেননি। তারা এ বিষয়ে কথা বললে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে বলেন। পাশাপাশি অনুরোধ করেন খালেদ মোশাররফের নির্দেশ মানতে।

১৫ আগস্ট রক্ষীবাহিনীর অবস্থান ছিল দিশাহারার মতো। ভোরে রক্ষীবাহিনীর দুই কর্মকর্তা আনোয়ারুল আলম শহীদ ও সরোয়ার হোসেন মোল্লা অফিসে ছুটে আসেন। তাঁদের পর আসেন ভারপ্রাপ্ত পরিচালক আবুল হাসান খানও। তাঁরা দেখেন তাঁদের অফিসের সামনে সেনা ট্যাংক মোতায়েন। সব ট্যাংকের নল রক্ষীবাহিনীর সদর দফতরের দিকে তাক করানো। তাঁরা জানতেন না এর মধ্যে কোনো গোলা নেই। শুধু সক্রিয় ছিল মেশিনগান। তাঁরা ট্যাংক উপেক্ষা করে ভিতরে প্রবেশ করেন। তারপর সবাই চারদিকে যোগাযোগ শুরু করেন। টহল দলের এক গ্রুপকে পাঠানো হয় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের দিকে। খুনি দলের সদস্য ও বঙ্গবন্ধুকে রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত আঁতাতকারী সেনা সদস্যদের যৌথ বাধায় তাঁরা ৩২ নম্বরে যেতে পারলেন না। এই সময়ে প্রধানমন্ত্রী মনসুর আলীর ফোন পেয়ে রক্ষীবাহিনীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে টহলরত গ্রুপ যায় শাহবাগ বেতারে। মনসুর আলী রক্ষীবাহিনীকে জানান, শাহবাগ কেউ দখল করে উল্টাপাল্টা কথা বলছে বলে তিনি খবর পেয়েছেন। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের ঘটনা তিনি তখনো হয়তো জানতেন না। শাহবাগে রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের দেখে ক্ষুব্ধ হন মেজর ডালিম। সেনা সদস্যদের তিনি নির্দেশ দেন ব্যবস্থা নিতে। তারা রক্ষীবাহিনীর একজন লিডারসহ পুরো টিমকে হ্যান্ডসআপ করিয়ে অস্ত্র কেড়ে নেয়। তাঁদের আটক করে লাইন ধরে দাঁড় করে রাখে দুপুর পর্যন্ত। তাঁদের গাড়ির ব্যাটারি দিয়ে চালু করে বেতারের জেনারেটর। রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের পরে ছাড়া হয় খালেদ মোশাররফের নির্দেশে। ছাড়া পেয়ে তাঁরা রিপোর্ট করেন হেডকোয়ার্টারে।

রক্ষীবাহিনীর প্রায় সব কর্মকর্তা ও সদস্য ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। জাতির পিতার প্রতি তাঁদের অঙ্গীকার ১৯৭১ সালে অর্জিত। রক্ষীবাহিনীর পরিচালক ছিলেন ব্রিগেডিয়ার এএনএম নুরুজ্জামান বীরউত্তম। উপপরিচালক প্রশাসন ছিলেন লে. কর্নেল আবুল হাসান খান, উপপরিচালক অপারেশন সরোয়ার হোসেন মোল্লা (পরে কর্নেল, রাষ্ট্রদূত, সচিব), উপপরিচালক প্রশিক্ষণ আনোয়ারুল আলম শহীদ (পরে কর্নেল, রাষ্ট্রদূত, সচিব), উপপরিচালক সিগন্যাল সাবিহ উদ্দিন আহমেদ (পরে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল), চট্টগ্রাম জোনাল কমান্ডার ছিলেন এ কে এম আজিজুল ইসলাম (পরে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল), উপপরিচালক মেডিকেল ছিলেন লে. কর্নেল এ এম খান। এ ছাড়া সহকারী পরিচালক ছিলেন মেজর সালাহ উদ্দিন, এম এ হাসনাত, ফকির মোহাম্মদ ও তৈয়বুর রহমান। লিডার হিসেবে সারা দেশে দায়িত্ব পালন করেছেন ২১২ কর্মকর্তা। সাভারে প্রশিক্ষণে ছিলেন আরও কিছু কর্মকর্তা। তাঁরা অপেক্ষায় ছিলেন লিডার হিসেবে নতুন দায়িত্বের। মোট সদস্য সংখ্যা ছিল ১২ হাজার। ১৫টি ব্যাটালিয়নের ১২টি ছিল নিয়মিত, আর তিনটি প্রশিক্ষণের। সাধারণ সদস্যরাও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এ কারণে রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের প্রতি একটা আশাবাদ ছিল মানুষের।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর একটা প্রতিরোধ যুদ্ধে রক্ষীবাহিনী যেতে পারত। তারা তা পারেনি। কেন পারেনি? ১৫ আগস্ট রাতে পাঁচ শীর্ষ কর্মকর্তা একসঙ্গে বৈঠক করেন। তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন সব ইউনিটকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেবেন। তাঁরা তা-ই করলেন। রেশন পাঠানোর সময় মেশিনগানসহ কিছু অস্ত্র পাঠালেন ঢাকার বাইরে। সবাইকে বললেন নির্দেশ দেওয়া মাত্র স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের নিয়ে গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে। সে নির্দেশ কার্যকর হয়নি। কেন হয়নি? রক্ষীবাহিনীর উপপরিচালক সরোয়ার মোল্লা বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার দায়িত্ব রক্ষীবাহিনীর ওপর ছিল না। তার পরও অস্বীকার করার উপায় নেই একটা ব্যর্থতার গ্লানি আমাদের সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, রক্ষীবাহিনী ছিল প্যারা মিলিশিয়া বাহিনী। দায়িত্ব ছিল দেশের আইনশৃঙ্খলা ঠিক রাখা। জাসদের গণবাহিনী, সর্বহারাসহ উগ্রপন্থিদের হামলা বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। সদ্যস্বাধীন দেশের অস্ত্র উদ্ধার, চোরাচালান, কালোবাজারি বন্ধ, অস্থিতিশীলতা প্রতিরোধে রক্ষীবাহিনী কাজ করত। এখন র‌্যাব যা করছে রক্ষীবাহিনীও তখন তা করত। এ নিয়ে সেনাবাহিনীর ভিতরে জাসদের কর্নেল তাহের ও বাম উগ্রপন্থি চিন্তার কর্নেল জিয়াউদ্দিন ও পাকিস্তানপ্রত্যাগতদের প্রচারণা ছিল পুরোটাই মিথ্যাচার। খুনি ফারুক-রশীদও একই ধরনের প্রচারণা চালাত বঙ্গবন্ধু সরকারকে বিব্রত করতে। মিথ্যাচার আর গুজবের কারখানা বানানো হয়েছিল সেনানিবাসকে। বাস্তবে রক্ষীবাহিনীর কোনো ভারী অস্ত্র ছিল না। ঢাকায় তাদের নিজস্ব কোনো অস্ত্রাগার ছিল না। সব অস্ত্র রাতে রাখা হতো পিলখানায় বিডিআরের অস্ত্রাগারে। সকালে সেই অস্ত্র নিয়ে আসা হতো রক্ষীবাহিনীর হেডকোয়ার্টারে। ১৫ আগস্ট সকালে অস্ত্র আনতে গিয়েছিলেন রক্ষীবাহিনীর একজন লিডার। সেই অস্ত্র দেননি বিডিআরপ্রধান ব্রিগেডিয়ার খলিলুর রহমান। অন্যদিকে ১৭ আগস্ট অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল কর্নেল মইনুল হোসেন চৌধুরী রক্ষীবাহিনী অফিসে যান। তিনি সবাইকে শান্ত থাকার অনুরোধ করেন। আর কর্নেল আমিন আহমেদ চৌধুরী ১৫ আগস্ট যান সাভার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। তিনি ভারতীয় একজন প্রশিক্ষককে নিয়ে আসেন। পরে তাঁকে পাঠিয়ে দেন ভারতীয় হাইকমিশনে।

রক্ষীবাহিনীর ভিতরে একটা চাপা কষ্ট ও ক্ষোভ ১৫ আগস্ট সকালেই ভর করে। সাভারে রক্ষীবাহিনীর দুজন সদস্য সকাল থেকেই চিৎকার করতে থাকেন সবাইকে বেরিয়ে পড়তে। অন্যরা ওপরের নির্দেশের অপেক্ষার কথা বলার কারণে এ দুই সদস্য আত্মহত্যা করেন। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, রক্ষীবাহিনীকে সিদ্ধান্তহীন করতে বাহিনীপ্রধানকে পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। পুরো বিষয় কাকতালীয় মনে করার কারণ নেই। সবকিছুই ছিল দেশি ও আন্তর্জাতিকভাবে গোছানো একটা নিষ্ঠুর ছক। সেই ছকে আটকা পড়েন রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তারা। সব শেষ হওয়ার পর তাঁদের করার কিছু ছিল না। এ বাহিনীর দুই কর্মকর্তা সরোয়ার মোল্লা ও আনোয়ারুল আলম শহীদকে ১৫ আগস্ট ৪৬ ব্রিগেডে নিয়ে যাওয়া ছিল পরিকল্পনার ধারাবাহিকতা। শাফায়াত জামিল ও খালেদ মোশাররফ রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তাদের শান্ত থাকার অনুরোধ করেন। সেই অনুরোধ রক্ষায় রক্ষীবাহিনীর উপপরিচালকদের বেতার ভবনে যেতে বাধ্য করা হয় খুনি মোশতাকের শপথ অনুষ্ঠানে। খালেদ মোশাররফ শপথে গিয়েছিলেন সিভিল পোশাকে। তিনি বারবার সিগারেট খাচ্ছিলেন। তাঁর মেজাজ ছিল খারাপ। জিয়াউর রহমান ছিলেন সামরিক পোশাকে। কালো চশমার আড়ালে ঢাকা ছিল তাঁর প্রতিক্রিয়া। তিন বাহিনী প্রধান ছিলেন অনেকটা বিব্রতকর অবস্থায়। তাঁদের কেউ মানছিলেন না। তাঁদের অবস্থান ছিল যাত্রা টিমের নিরীহ সেপাইয়ের মতো।

খুনিরা শুরু থেকেই টেনশনে ছিল রক্ষীবাহিনী নিয়ে। বাহিনীপ্রধান নুরুজ্জামান ’৭১ সালের বীরউত্তম খেতাব পাওয়া যোদ্ধা। বাকিরা ছাত্রলীগ করা। এ কারণে রক্ষীবাহিনীর সঙ্গে সরাসরি লড়াইয়ের দায়িত্ব নিজের কাছেই রাখলেন খুনি ফারুক। ১৫ আগস্ট ২৮টি ট্যাংকের গোলা ছিল না। ৩৫০ জন সৈনিককে ফারুক নিজের সঙ্গে রাখলেন রক্ষীবাহিনীর সঙ্গে লড়াই করতে। ১২টি ট্রাকে এই সৈনিকদের ওঠানো হলো। তাদের প্রতি নির্দেশ দেওয়া হলো রক্ষীবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ প্রস্তুতির। আর রশীদের দায়িত্ব ছিল সব কাজ শেষ করে পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দেওয়া। সমস্ত ঘটনাই ঘটেছিল আর্মি ইন্টেলিজেন্স অফিসের পাশে। শাফায়াত জামিলের বাসা ও তাঁর ইউনিটের পাশ ঘেঁষেই ট্যাংকগুলো এগিয়ে চলছিল সামনে। ট্যাংকগুলোর ব্যারেল ছিল রক্ষীবাহিনী হেডকোয়ার্টারের দিকে তাক করা। রক্ষীবাহিনীর অফিসাররা জানতেন না এ ট্যাংকে গোলা নেই। তাঁরা নিজেদের অস্ত্রও আনতে পারেননি বিডিআর সদর দফতর থেকে। বিডিআরের ডিজি খলিল রক্ষীবাহিনীর রক্ষিত অস্ত্র ১৫ আগস্ট ফেরত দেননি। ডিরেক্টর মিলিটারি অপারেশন ছিলেন কর্নেল নুরুদ্দিন। রক্ষীবাহিনী অফিসে কর্নেল ফারুক গিয়েছিলেন। তিনি ভারপ্রাপ্ত পরিচালক কর্নেল হাসানকে ফোনে মিলিয়ে দিলেন কর্নেল নুরুদ্দিনকে। এর আগে ফোন করলেন সিজিএস খালেদ মোশাররফ ও ৪৬ ব্রিগেডের শাফায়াত জামিলকে। ফারুক নিজে রক্ষীবাহিনী অফিসে প্রবেশ করে ভারপ্রাপ্ত পরিচালক হাসানকে হুমকি দেন। তাঁকে বলেন, সব উড়িয়ে দেব মুহূর্তে। ভয়াবহ যুদ্ধ করে ধ্বংস করা হবে রক্ষীবাহিনী।

বেতার ভবনে রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের আটক করার খবরের প্রভাব অন্যখানেও পড়ে। তার পরও তাঁরা অপেক্ষায় ছিলেন সেনাবাহিনীতে বঙ্গবন্ধুর সমর্থক কর্মকর্তারা বেরিয়ে আসার। তাঁরা ভেবেছিলেন রক্ষীবাহিনী তাঁদের সঙ্গে যোগ দেবে। কোথাও থেকে কেউ এলো না। রক্ষীবাহিনীর তখনকার কর্মকর্তারা এখন বলছেন, বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করা ও হত্যাকান্ডের পর প্রতিরোধ করতে না পারা পুরোটাই রাজনৈতিক ও সামরিক ব্যর্থতা। এ ব্যর্থতার দায় শুধু রক্ষীবাহিনীর একার নয়, তৎকালীন ক্ষমতাবান সব বাহিনীকে নিতে হবে। সত্য কেউ এড়াতে পারেন না। রক্ষীবাহিনীও না। রক্ষীবাহিনীকে সেনাবাহিনীতে বিলুপ্ত করার আগ পর্যন্ত একটা অস্বস্তি ছিল সেনাবাহিনীর ভিতরে। রক্ষীবাহিনীর সব সদস্যই মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক ছাত্রলীগ হওয়ার কারণে এমন হয়েছিল। রক্ষীবাহিনীকে সেনাবাহিনীতে বিলুপ্ত করতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখেন ব্রিগেডিয়ার মঞ্জুর। তিনি ছিলেন দিল্লি হাইকমিশনে সামরিক অ্যাটাশে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের খবর পেয়ে তিনি ঢাকায় ছুটে আসেন ১২ ঘণ্টার মধ্যে। এত দ্রুত কীভাবে এলেন, কেন এলেন, কার অনুমতি নিয়ে এলেন তা এখনো বের হয়নি।

পুরো ঘটনা নিয়ে সরোয়ার মোল্লা বলেছেন, ১৯৭৫ সালের এপ্রিলের একদিন সন্ধ্যার পর এসবির ডিআইজি ই এ চৌধুরী রক্ষীবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ে যান। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ঢাকার পুলিশপ্রধান এসপি মাহবুব উদ্দিন আহমদ। পরিচালক কর্নেল নুরুজ্জামান, উপপরিচারক আনোয়ারুল আলম শহীদ ও সরোয়ার হোসেন মোল্লা পরিচালকের রুমে ছিলেন। ই এ চৌধুরী তাঁদের জানান, বঙ্গবন্ধুর ওপর আজ রাতে হামলার খবর তিনি পাচ্ছেন। ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। সিদ্ধান্ত হয় ধানমন্ডি ৩২ নম্বর ঘিরে রক্ষীবাহিনী ও পুলিশ ব্যবস্থা নেবে। স্পটে থাকবেন এসপি মাহবুব এবং রক্ষীবাহিনীর দুই উপপরিচালক সরোয়ার ও শহীদ। সারা এলাকা ঘিরতে গিয়ে শেখ মণির বাড়ির পাশেও রক্ষীবাহিনীর সদস্যরা ছিলেন। রাতে বাংলার বাণী অফিস থেকে ফেরার সময় তাঁদের এভাবে দেখে ক্ষুব্ধ হন শেখ মণি। এ নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হয়। শেখ মণি মনে করেছিলেন কারও প্ররোচনায় রক্ষীবাহিনী তাঁকে ভয় দেখাতে গেছে। বিচার বঙ্গবন্ধুর কাছে যায়। সরোয়ার হোসেন মোল্লা বলেছেন, তাঁরা সবকিছু স্বাভাবিক করতে পরে বাংলার বাণী অফিসে গিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছেন শেখ মণির কাছে। তাঁর কাছে আসল ঘটনার বর্ণনা দিয়েছিলেন, কেন সে রাতে গিয়েছিলেন। সিদ্ধান্ত ছিল বঙ্গবন্ধুর বাসভবন ও ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রাতে ঘিরে রাখার। রাজনৈতিক ভুল বোঝাবুঝির কারণে রক্ষীবাহিনী আর যেতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির নিরাপত্তা পুলিশের এসবি ও সেনা ইউনিটের ওপর ছিল। ১৫ আগস্ট পুলিশ সক্রিয় থাকলেও সেনা ইউনিট মুহূর্তে যোগ দেয় খুনিদের সঙ্গে। তারা উল্লাস করে।

সরোয়ার মোল্লা বলেছেন, ৩২ নম্বরের নিরাপত্তা নিয়ে কর্নেল নুরুজ্জামানের নেতৃত্বে তিনি, শহীদ ও সাবিহ উদ্দিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সাবিহ উদ্দিন ‘অ্যা ম্যান অন হর্স ব্ল্যাক’ নামে একটি বই নিয়ে যান সঙ্গে। এ বইতে দুনিয়াজুড়ে তখনকার সামরিক ক্যুর কথা ছিল। তাঁরা বঙ্গবন্ধুকে বোঝানোর চেষ্টা করেন ৩২ নম্বরের বাড়ি নিরাপত্তাহীন। এ বাড়িতে থাকা ঠিক হবে না। ১৫ আগস্টের অনেক কিছুই ছিল রহস্যময়। এনএসআই-প্রধান এ বি এম সফদার ছিলেন পাকিস্তানপ্রত্যাগত ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা। তাঁর সহযোগী ছিলেন পুলিশের আরেক কর্মকর্তা ডিআইজি এস এ হাকিম। ১৯৭১ সালে সফদার ছিলেন পাকিস্তানের পক্ষে। তিনি চাকরি করেছেন পাকিস্তানিদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে, তাদের সহযোগিতা করে। তাঁর বিষয়ে কানাঘুষা ছিল তিনি সিআইএ’র সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খুনি মোশতাক সরকার পদোন্নতি দিয়েছিল সফদারকে। এটা কীসের পুরস্কার ছিল আজও বের হয়নি। স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডিআইজি ছিলেন ই এ চৌধুরী। তিনিও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না। তবে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁর আনুগত্য ছিল বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রতি। তিনি কয়েক দফা রক্ষীবাহিনীকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করেছিলেন।

ডিজিএফআই-প্রধান ছিলেন ব্রিগেডিয়ার আবদুর রউফ। তিনি ছিলেন পাকিস্তানপ্রত্যাগত সেনা কর্মকর্তা। ১৫ আগস্টের কয়েকদিন আগে তাঁকে সরিয়ে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল কর্নেল জামিলকে। একমাত্র সেনা কর্মকর্তা জামিলই তাঁর শপথ রক্ষা করে রাষ্ট্রপতিকে রক্ষায় জীবন দিয়েছিলেন। জামিলকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে বিলম্ব করছিলেন ব্রিগেডিয়ার রউফ। কেন করেছিলেন আজও বের হয়নি। সে রাতে খবর পেয়ে কেন ব্যবস্থা নেননি সামরিক গোয়েন্দাপ্রধান তা-ও বের হয়নি। অন্যদিকে প্রেসিডেন্টের সামরিক সচিব হিসেবে আগস্টে নিয়োগ পেয়েছিলেন ব্রিগেডিয়ার মাশহুরুল হক। তিনিও পাকিস্তানপ্রত্যাগত কর্মকর্তা। সরোয়ার মোল্লা বলেছেন, পাকিস্তানপ্রত্যাগত অফিসাররা ছিলেন বেশির ভাগ সিনিয়র পদে। মুক্তিযোদ্ধা অফিসাররা ছিলেন জুনিয়র। এ কারণে তাঁদের নিয়োগ দেওয়া হতো না। চারদিকে ছিল পাকিস্তানপ্রত্যাগতরা।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন ইতিহাসের রাখাল রাজা। যেমন ছিল তাঁর উচ্চতা, তেমন হৃদয়। পাকিস্তানপ্রত্যাগতদের কাছে প্রত্যাশা ছিল তাঁরা পেশাদারি নিয়ে কাজ করবেন। কেউ তা করেননি। বঙ্গবন্ধু ধানমন্ডির বাড়ি ছাড়েননি গণমানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার আশঙ্কায়। ৩২ নম্বর বাড়ির দরজা ছিল সবার জন্য খোলা। মানুষ অবাধে প্রবেশ করতে পারত। আটকাত না কেউ। এমনকি প্রশ্নও করত না। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার একজন পরিচালক এ বাড়ির নিরাপত্তা দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন।  তিনি বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন, বাংলাদেশ তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন। কোনো বাঙালি তাঁকে  হত্যা করবে না।

বঙ্গবন্ধু ভুলে গিয়েছিলেন, বাঙালির পরতে পরতে বেইমানির রক্ত প্রবহমান। এই বাঙালি নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করতে ইংরেজ বাহিনীকে সহায়তা করেছিল। সিরাজের সেনাপ্রধানসহ ঊর্ধ্বতনদের বেইমানি ও বিশ্বাসঘাতকতায় স্বাধীনতার সূর্য নিভে গিয়েছিল পলাশীর আম্রকাননে। আবার স্বাধীনতার সূর্য যিনি এনে দিয়েছিলেন, ১৯৭৫ সালে তাঁকেও পরিবারসহ হত্যা করা হয় একই নিষ্ঠুরতা নিয়ে। সেই রাতে ও পর দিন বঙ্গবন্ধুর পাশে কেউ ছিল না।  কেউ না। চারদিকে শুধুই ব্যর্থতার ইতিহাস।

                লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন

সর্বশেষ খবর