সোমবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

বরিশালে সাংবাদিকদের ওপর হামলা এবং...

আলম রায়হান

বরিশালে সাংবাদিকদের ওপর হামলা এবং...

বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজে সম্প্রতি সাত সাংবাদিককে পেটানো হয়েছে। যা বিশেষ ইঙ্গিতবহ। পাশাপাশি প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে সাংবাদিক সমাজের দৈন্যতা, ডাক্তারদের নগ্ন চরিত্র এবং চিকিৎসাব্যবস্থায় চরম বিশৃঙ্খলা ও অদক্ষতা। উল্লেখ্য, সাংবাদিক  পেটানোর ঘটনার খলনায়ক দুজন সহযোগী অধ্যাপক। নিশ্চয়ই তারা ডাক্তার হিসেবে রোগীদের চিকিৎসাও দিয়ে থাকেন। কিন্তু তারা আসলে চিকিৎসার নামে কী করেন? এ প্রশ্ন উঠতেই পারে। এদিকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কোন ধরনের চিকিৎসা দেওয়া হয় তার বহু নমুনা আছে। এর মধ্যে সাম্প্রতিক ঘটনা হচ্ছে ঘাড়ে সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া শিশুর তলপেটে ‘সফল’ অপারেশন করা। এই শ্রেণির ডাক্তাররা সাংবাদিক পেটালে তাকে খুব বড় কোনো অঘটন হিসেবে বিবেচনা করা যায় কি না সেটিও একটি বড় প্রশ্ন হিসেবে বিবেচিত হতেই পারে। 

কেবল বরিশাল বলে কথা নয়, সারা দেশেই সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনা বেড়েছে। বরিশালের প্রবচন অনুসারে ‘আলে গোনে কলে গেলে’ অথবা প্রচলিত প্রবচন, পান থেকে চুন খষলেই ‘পিটা সাংবাদিক।’ এ ধারায় নেতা-পাতা-ছাতা-আমলা-কামলা-ডাক্তার-মোক্তার-চাকর-বাকর, সবাই শামিল। একাট্টা, এক জোট। একেবারে হরিহর আত্মা। আর সাংবাদিক  পেটানো, হত্যা করা, গুলি করে চিরতরে পঙ্গু করে দেওয়া- এসব চলে আসছে লাগাতারভাবে, বহু আগে থেকে। যত দিন যায় ততই বাড়ছে এর তীব্রতা। সঙ্গে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন মাত্রা এবং বাড়ছে সাংবাদিক সমাজ ও সাংবাদিক নেতাদের নীরবতা। তাঁরা যেন মূক ও বধির। অথবা নির্বাক চলচ্চিত্রের একেকটি চরিত্র। অথবা পেশাগত প্রাচীনকালের খোজা। এদিকে কারও কারও ধারণা, সাংবাদিকরা বোবা প্রাণী হয়ে গেছে। মাঠে কেউ গরু পেটালে মুরব্বিরা বলেন, ‘এই তুমি বোবা প্রাণীটা মারো কেন!’ কিন্তু সাংবাদিকদের বিষয়ে এমনটা বলারও যেন কেউ নেই। কেউ কিছু বলে না। তবে সাংবাদিক নেতাদের ব্যাপারে অনেক কথাই বলা হয়। যা সবার ব্যাপারে সত্য না হলেও কারও কারও ব্যাপারে নিশ্চয়ই সত্য। ওই যেমন কথা আছে না, ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’। তেমনই সাংবাদিক নেতাদের কেউ কেউ যত না সাংবাদিক তার চেয়ে অনেক বেশি অন্য কিছু। যে মানুষগুলো সাংবাদিক নেতার জার্সি পরে আছেন। এদের কারণে দূষিত হতে হতে গণমাধ্যম সংকটের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। আর এই দূষণের জন্য যারা দায়ী তাদের মধ্যে এমন ব্যক্তিও আছেন, যাদের সাগরে চুবিয়ে মারলে খুন মামলার আগে হয়তো হবে সাগর দূষণের মামলা।

ওপরে-নিচে-ভিতরে দূষণের ফলে পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যাতে গণমাধ্যম এখন প্রায় ফোকলা। এর নানান ধরনের কুফলের মধ্যে একটি হচ্ছে সাংবাদিক পেটানোর বিষয়টি খুবই মামুলি ব্যাপার হয়ে যাওয়া এবং এর কোনো কার্যকর প্রতিবাদ নেই। চলমান দৈন্যদশার সূচনা হয়েছে এই সেক্টরে ইঁদুর চরিত্রের কতিপয় মালিকের অনুপ্রবেশ এবং কতিপয় অসাংবাদিকের সাংবাদিক নেতা হয়ে ওঠার ফলশ্রুতিতে। এদিকে পেশাদার সাংবাদিকরা অনেকটা লাজুক পান্ডার মতো গুটিয়ে থাকার অবস্থায় আছে। তারা একেকজন বিচ্ছিন্ন দীপ। যে বিষয়টি আর একবার প্রমাণিত হলো ২৬ আগস্ট বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুই সহযোগী অধ্যাপকের সক্রিয় অংশগ্রহণে সাত সাংবাদিকের ওপর হামলার ঘটনায়। তবে রহস্যজনকভাবে সমস্যার ‘মিটমাট’ হয়ে গেছে ঘটনাস্থলেই। এ হামলার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কর্তৃপক্ষ মৌখিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করেছে। আর এটি মেনে নিয়েছে বরিশালের সাংবাদিক সমাজ। এর আগে ঘটনাস্থলে বরিশালে সাংবাদিক নেতা হিসেবে পরিচিত দুজন টেলিভিশনে ব্যক্ত করেছেন সাবধানী প্রতিক্রিয়া। আর সাংবাদিকদের ওপর হামলার পাঁচ দিনের মাথায় ৩০ আগস্ট নগরীর মহাত্মা অশ্বিনী কুমার টাউন হলের সামনে সুশীল মানববন্ধন করেছে বরিশাল সাংবাদিক ইউনিয়ন। যা কারও কারও বিবেচনায় দাফনের পর জানাজা পড়ার মতো বিষয়। এরপরও স্বপন খন্দকারকে অনেকেই ধন্যবাদ দিতে চান। কারণ কাকস্নানের মতো হলেও তিনি একটা প্রতিবাদের আয়োজন করেছেন। এ মানববন্ধনে অন্যান্য সাংবাদিক সংগঠনের পরিচিত মুখগুলো দেখা গেছে। তাও যেন দূরসম্পর্কের কারও জানাজায় অংশগ্রহণ করার মতো। উল্লেখিত মানববন্ধন থেকে বিচার চেয়ে ১০ দিনের আলটিমেটামের আওয়াজ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই আলটিমেটামের ফলাফল কারও বুঝতে আর বাকি থাকার কথা নয়। আর এও বোঝা গেছে, সাংবাদিক পেটালে কার্যকর প্রতিবাদ করার মতো এখন আর কেউ নেই। এ কারণেই হয়তো অকাল মৃত্যুর অর্ধযুগ পেরিয়েও কথায় কথায় বরিশালের সাংবাদিকরা এখনো লিটন বাশারকে স্মরণ করেন। কিন্তু এই স্মরণের চেতনা ধারণ করার মতো সাংবাদিক নেতা হয়তো বরিশালে কমে গেছে। অথবা আকাল চলছে। এদিকে কেউ কেউ বলেন, ছোটখাটো ক্ষমতা কেন্দ্রের অবিচারের প্রতিবাদ করার ক্ষমতা এখন আর বরিশালের সাংবাদিক নেতাদের নেই। অথচ বছর দশেক আগেও বরিশালের দৃশ্যপট ভিন্ন ছিল। এ ব্যাপারে একটি ঘটনা এখনো অনেকেরই স্মরণে আছে।

বরিশাল মেট্রেপলিটন পুলিশের একজন ‘সেই রকম’ কমিশনার ছিলেন! যিনি এতটাই দুর্নীতিবাজ ছিলেন যে, তার শেভ করার ব্লেডও নাকি ওসিদের কিনে দিতে হতো। এই পুলিশ কমিশনারকে বিদ্রƒপ করা হতো ‘গরুর ডাক্তার’ হিসেবে। যদিও তিনি গরুর ডাক্তার ছিলেন না। তাঁর বিষয় দৈনিক আজকের পরিবর্তনে রিপোর্ট হলো। ব্যাস! পুলিশ কমিশনার মহা খাপ্পা হলেন। তখন পত্রিকাটির মালিক ও সম্পাদক ছিলেন সৈয়দ দুলাল এবং রিপোর্টার লিটন বাশার। এ অবস্থায় সম্পাদক শক্তভাবে রিপোর্টারের পক্ষে দাঁড়ালেন। কিন্তু পুলিশ কমিশনারও হাল ছাড়ার বস্তু নন। এক পুলিশ কর্মকর্তার মাধ্যমে রিপোর্টার লিটন বাশারকে দেখা করার জন্য হাইড্রোলিক প্রেসার দেওয়া শুরু হলো। এই পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন লিটন বাশারের কাজিন। প্রথমে খালাতো ভাই হিসেবে অনুনয়-বিনয়, পরে পুলিশি হুমকি-ধমকি। কিন্তু কোনো কিছুতেই পত্রিকার সম্পাদক সৈয়দ দুলাল অথবা রিপোর্টার লিটন বাশার একটুও টলেননি। এদিকে বরিশালে সাংবাদিকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে গেলেন। অবস্থা বেগতিক দেখে শেষতক পুলিশ কমিশনারকেই রণে ভঙ্গ দিতে হয়েছে। শুধু তাই নয়, তাকে আরও মূল্য দিতে হয়েছে। তাঁকে বরিশাল প্রেস ক্লাবে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছিল। অথচ এ ঘটনার বছর কয়েক পরে বরিশালে সাংবাদিকদের সঙ্গে এক পুলিশ কমিশনারের মতবিনিময় অনুষ্ঠানে একজন মাননীয় সম্পাদক বিনয়ের অবতার হয়ে বলেছিলেন, ‘স্যার আপনার রুমে একটি লাঠি রাখবেন, আমরা কোনো অপরাধ করলে আপনি আমাদের বিচার করবেন।’

সম্পাদকের দশাই যদি এমন হয় তাহলে আর কি কিছু বাকি থাকে! এ ব্যাপারে বরিশালের সাবেক ডিসি হাবিবুর রহমান একবার আলাপচারিতায় বলেছিলেন, ‘এ কোন প্রাচ্যের ভেনিসে আসলাম, মুরগির ব্যাপারিও দেখি পত্রিকার মালিক। আবার সম্পাদকও!’ সব মালিক অথবা সম্পাদক এমন, তা কিন্তু নয়। হয়তো গুটি কয়েক এ রকম। কিন্তু পারসেপশন ও পরিবেশ খারাপ করতে বেশি লোকের প্রয়োজন হয় না। এই দুর্দশা কেবল বরিশালে নয়। ঢাকা বা অন্য জেলাগুলোর অবস্থাও তথৈবচ। এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, কোথায় কতজন মালিক-সম্পাদক মানসম্পন্ন? কতজন সাংবাদিক নেতা সত্যের পক্ষে দাঁড়াবার সাহস রাখেন? কোথায় নিরাপদ সাংবাদিকরা! কিন্তু এই দুর্দশা তো সাংবাদিকদের ছিল না।

প্রসঙ্গক্রমে আজকের কাগজের সম্পাদক সদ্যপ্রয়াত কাজী শাহেদের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। তিনি ছিলেন মালিক সম্পাদক। এরপরও তাঁর পত্রিকার সাংবাদিকের পক্ষে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে পেরেছিলেন। তাও আবার মোহাম্মদ নাসিমের মতো মাথা গরম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখোমুখি হয়ে। যিনি মাটির নিচ থেকে সন্ত্রাসী ধরার হুঙ্কার দেওয়ার জন্য বিশেষভাবে খ্যাত। একসময়ে একটি দৈনিকে আমার কলিগ ও ঘনিষ্ঠজন দৈনিক আমাদের সময়-এ এখন চিফ রিপোর্টার শাজাহান আকন্দ শুভর একটি স্মৃতিচারণামূলক লেখা প্রকাশিত হয়েছে তাঁর পত্রিকায়, ৩১ আগস্ট। এ লেখা থেকে জানা গেছে, ২০০০ সালে দৈনিক আজকের কাগজে লিড নিউজের শিরোনাম ছিল ‘পুলিশে দুই বান্ধবীর ৪ কোটি টাকার মিশন’। দুই বান্ধবী পুলিশের নিয়োগ, পদোন্নতি ও বদলি পেছন থেকে নিয়ন্ত্রণ করতেন। ওই নিউজ প্রকাশের পর হইচই পড়ে যায়। এদিকে তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠেন তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তখন তিনি ছিলেন লন্ডন সফরে। দৈনিক আজকের কাগজের সম্পাদক কাজী শাহেদ আহমেদকে ফোন করে বলেন, ‘কে এই রিপোর্টার, কী তার পরিচয়? ওই কুত্তার বাচ্চাকে আমি দেখে নেব।’ মন্ত্রীর এই হুমকিতে সম্পাদক কাজী শাহেদ আহমেদ মোটেই টলেননি। বরং আরও শক্ত হলেন, সরাসরি অবস্থান নিলেন রিপোর্টার আমিনুর রহমান তাজের পক্ষে। মন্ত্রীর হুমকির তীব্র প্রতিবাদ করলেন লেখনীর মাধ্যমে। দৈনিক আজকের কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় তিন কলামে কাজী শাহেদ আহমেদ একটি বিশেষ লেখা প্রকাশ করেন। লেখাটির শিরোনাম ছিল ‘লন্ডন থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ফোন, ওই কুত্তার বাচ্চাকে আমি দেখে নেব’। এই লেখায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশ কমিশনার আরও ক্ষেপে গেলেন। তৎকালীন এসি (পিআর) মোর্শেদের (বিসিএস-১৫ ব্যাচ) মাধ্যমে ডিবি অফিসে ডেকে নিয়ে আমিনুর রহমান তাজকে গ্রেফতার দেখানো হয়। এ ঘটনায় সাংবাদিকরা প্রতিবাদী হয়ে উঠলেন। প্রেস ক্লাবের সামনের সড়ক অবরোধ করা হয়। এদিকে খবর পৌঁছে যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে। তিনি বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ডেকে পাঠান। এরপর ঘটনা খুবই সংক্ষিপ্ত! ওই দিন দুপুরে এজলাসে তোলার পরই বিচারক সাংবাদিক তাজকে জামিনে মুক্তি দেন। ফুলের মালা গলায় দিয়ে আদালত থেকে সরাসরি আমিনুর রহমান তাজকে নেওয়া হয় প্রেস ক্লাবে।

কাজী শাহেদ আহমেদের প্রসঙ্গে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে আরেক সাংবাদিক আনিস আলমগীর ২৯ আগস্ট বাংলা ট্রিবিউনে ‘দেশের শেষ সাহসী সম্পাদকের বিদায়’ শিরোনামে লিখেছেন, “বুকে হাত দিয়ে বলেন, বাংলাদেশে এমন সাহসী সম্পাদকের জন্ম কবে দেখেছেন আপনি আর আমি!

বলা বাহুল্য, উল্লিখিত বিষয়টি সম্ভব হয়েছিল দৈনিক আজকের কাগজের মালিক-সম্পাদক কাজী শাহেদের দৃঢ়তা এবং সাংবাদিকদের ইস্পাতসম কঠোর ঐক্যের কারণে। কিন্তু সেই দৃঢ়চেতা মালিক এবং সাংবাদিকদের ঐক্য কী আছে? নেই। ফলে বরিশালে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক কেন, কিছুদিন পর হয়তো সহযোগী সুইপাররাও সাংবাদিকদের পেটাবে!                       

লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

সর্বশেষ খবর