বুধবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

আলতুফালতু ইমোশনের কোনো দাম নেই!

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

আলতুফালতু ইমোশনের কোনো দাম নেই!

এক. তোমার চারপাশে জীবনের এত উৎসব, এত আনন্দ, এত উন্মাদনা অথচ সেখানে তুমি নেই। কারণ উৎসব, আনন্দ, উন্মাদনা উদযাপনের জন্য তোমার জন্ম হয়নি, তোমার জন্মই হয়েছে উৎসবের জন্ম দিতে, তোমার জন্মই হয়েছে আনন্দের বারতা ছড়িয়ে দিতে, তোমার জন্মই হয়েছে সৃষ্টির উন্মাদনায় মানুষকে মাতিয়ে তুলতে। খুব বড় কেউ নও তুমি, কেউ হয়তো তোমাকে  চেনেও না, তোমার মতো একজন মানুষ পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছে তা হয়তো কেউ জানেও না। মনে রেখ, তুমি তুমিই, এই তোমার তুমিটাই তোমার শক্তি, যে নিজে নিজেই হাসে, নিজে নিজেই কাঁদে, যে নিজে নিজেই নিজের পথটা খুঁজে নেয় কিন্তু নিজেকে কখনো অন্যের কাছে বিকিয়ে দেয় না। তুমি টেসলার সিইও ইলন মাস্ক, অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস, মাইক্রোসফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস, গুগলের সহপ্রতিষ্ঠাতা ল্যারি পেজ, ফেসবুকের সিইও মার্ক জাকারবার্গের মতো ব্যবসা-বাণিজ্য আর টাকার অঙ্কে বড় নও, তার পরও তুমি তাদের থেকে অনেক বেশি ধনী। তোমার তাদের মতো এত টাকা-পয়সা, সম্পদ নেই, তোমার একটা মন আছে। যে মন টাকা-পয়সা, সম্পদের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান। সুখ সম্পদে আসে না, সুখ আসে মনে, সে মন ধনী নয়, যে মন খুব দরিদ্র।

তুমি ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে দুই মুঠো খাদ্য তুলে দাও, লুকিয়ে লুকিয়ে ওদের হাসিটা দেখো, সেই হাসিটাই উৎসবের জন্ম দেয়, আনন্দের জন্ম দেয়, উন্মাদনার জন্ম দেয়। তুমি ডাস্টবিনে পড়ে থাকা পরিচয়হীন নিষ্পাপ শিশুটির দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে উৎসব, আনন্দ, উন্মাদনার জন্ম দাও। তোমার নিজের কোনো উৎসব নেই, আনন্দ নেই, উন্মাদনা নেই, নিজেকে তিলে তিলে মানুষের জন্য ক্ষয় করার সুখ আছে। কারণ তুমি এখন জানো, উৎসব, আনন্দ, উন্মাদনা খুব দ্রুত জন্ম নেয়, খুব দ্রুত মরে যায়, সুখ বেঁচে থাকে চিরকাল। ছোট ছোট ত্যাগে যে উৎসব, আনন্দ ও উন্মাদনার জন্ম হয়, বড় বড় লোক দেখানো কৃত্রিম উৎসব, আনন্দ ও উন্মাদনায় সে সুখ মরে যায়। তুমি এখন মানুষের উৎসব, আনন্দ ও উন্মাদনা সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে সুখের সমীকরণটা মেলানোর চেষ্টা করছ। কারণ সুখ না থাকলে আর সবকিছু অর্থহীন। সুখে কান্না থাকে, কষ্ট থাকে, অভাব থাকে, যখন সুখের ভিতর এগুলো থাকে না তখন সেটা সুখ নয়, সুখের অভিনয়। গানটা ভেসে আসছে কানে, ‘সুখেরই পৃথিবী, সুখেরই অভিনয় যত আড়াল রাখো, আসলে কেউ সুখী নয়।’

কী মনে হচ্ছে তোমার, সুখের আড়ালে না-পাওয়ার দুঃখ তো তোমার থাকার কথা নয়। গানটা কি সত্য বলছে, না মিথ্যা বলছে, সেটা তুমি ছাড়া যেন আর কেউ না জানে! কখনো কখনো লেখাগুলো লেখাগুলোকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে, বিব্রত করে, গুলিয়ে ফেলে, যেমন মানুষ তোমার তুমিটাকে কুয়াশায় ঝাপসা হওয়া কাচের ভিতরে দেখে চমকে ওঠে। কাচে গড়িয়ে পড়া পানিগুলো কুয়াশার, নাকি তোমার চোখের...?

দুই. একদিন তুমি সবার আগে ছিলে, এখন তুমি সবার পেছনে। মনে রেখো, তুমি এগিয়ে থেকে যা দেখতে পাওনি, পেছনে থেকে এখন তা দেখতে পাচ্ছ। এ দেখাটাই জীবনের বাস্তবতাকে চেনাতে পারে। তুমি পেছনে আছো বলেই একটা কাচের আয়না হতে পেরেছ, যে আয়নায় এগিয়ে থাকা মানুষের অভিনয়গুলো দেখতে পাচ্ছ। এখন তুমি মুখ দেখেই বলে দিতে পারো কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যা, কোনটা বাস্তব, কোনটা অভিনয়। মিছিলের পেছনে সাধারণ মানুষই দাঁড়াতে পারে, তুমি বুক ফুলিয়ে গর্ব করতে পারো এখন তুমি সাধারণ মানুষের কাতারে। যারা জীবনের দুঃখের সঙ্গে লড়ে, কখনো হেরে গিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে, কখনো জিতে গিয়ে বোকার মতো হাসে। হয়তো করপোরেট দুনিয়ায় এসব আলতুফালতু ইমোশনের দাম নেই, কিন্তু তুমি জানো, নিজের চোখে নিজের ছোট ছোট জয় দেখার সুখ কতটুকু। সে জয় হয়তো তোমার নয়, তোমার ত্যাগে অন্যের জয়। যে জয়ে সুখ থাকে, অসুখ থাকে না। সুখ বাজার থেকে কেনা যায় না, বিক্রি করা যায় না, সুখ নিজের ভিতরে  চুপ করে বসে থাকা আরেকটা মানুষ, যে মানুষটা তোমার তুমিকে চিনিয়ে দিয়ে আবার হারিয়ে যায়, অনেকটা বৃষ্টিতে ভেজানোর পর আকাশে ওঠা রংধনুর মতো। যা হারিয়ে যায়, তা সব সময় মূল্যবান হয়। যারা এগিয়েছে তারা সিঁড়ির পর সিঁড়ি পেরিয়েছে, তুমি সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারছ, সব এগিয়ে যাওয়ার মধ্যে সততা নেই, নিজের অর্জন নেই, নিজের যোগ্যতা নেই, বেশির ভাগ এগিয়ে যাওয়া হচ্ছে নিজেকে বিক্রি করা কিংবা অন্যের কাছ থেকে নিজের ওপরে ওঠার সিঁড়িটা দরদাম করে কিনে নেওয়া। এভাবে এগিয়ে যাওয়ায় হয়তো ক্ষমতার মিথ্যে স্বাদ পাওয়া যায়, নিজের বড়ত্ব প্রমাণের মিথ্যা খেলায় ডুবে থাকা যায়, চারপাশের স্বার্থপর মানুষের মিথ্যা প্রশংসায় ভেসে যাওয়া যায়। কিন্তু নিজের ভিতরের পলাতক আসামিটার অস্থিরতা বয়ে বেড়াতে হয়, যেখানে মানুষটা জানে, যে মানুষটা একদিন তার ভিতরে ছিল, সে মানুষটা এখন তার ভিতরে   নেই। কী দাম আছে ওই মানুষটার, যে সবাইকে দেখায় সে অনেক বড় মাপের মানুষ হয়েছে অথচ সে মানুষ নয়। খুব   বেশি হলে সে একটা ১০ টাকায় কেনা কাগজের মুখোশ।  হয়তো পৃথিবী তোমার পিছিয়ে পড়া নিয়ে হাসবে, ব্যঙ্গবিদ্রƒপ করবে, তোমাকে যেভাবে আঘাত করা যায় করবে, তুমি এসবে কান দিও না, ভেঙে পোড়ো না। তুমি পিছিয়ে পড়লেও আলোচনায় আছো। কারণ মানুষ জানে খাঁটি সোনাকে সোনা বলেই স্বীকার করে নিতে হয়, টাকার পতন ঘটলেও সোনা সব সময় মূল্যবান থাকে। তুমি তোমার নিজের পৃথিবীর রাজা     হও, প্রজা হও, যেখানে তুমি তোমার মন যা বলে সেভাবেই চলতে পারবে, কেউ তোমাকে দাবার ঘুঁটি বানিয়ে খেলার সুযোগ পাবে না।

তিন. তুমি ভাবছ সবাই তোমাকে ভালোবাসছে, না রে বোকা, সবাই তোমাকে নিয়ে খেলছে। তাদের কাছে তুমি মানুষ নও, তুমি একটা খেলনা। তোমার ভিতরে যে তুমি ছিলে, সেই তুমিটাকে তারা আস্তে আস্তে গিলে ফেলছে, অথচ তুমি ভাবছ তারা তোমাকে আগলে রেখেছে। মনে রেখো, সবটাই তাদের অভিনয়, তুমি যাতে তোমাকে চিনতে না পারো, তুমি যাতে একা দাঁড়িয়ে লড়তে না পারো, তুমি যাতে কখনো আত্মবিশ্বাস নিয়ে নিজেকে পরখ করতে না পারো, সেটা ভেঙে ফেলাই তাদের লক্ষ্য। ভালোবাসা সব সময় মন থেকে হয় না, ভালোবাসা কখনো কখনো আত্মঘাতী হয়। ভালোবাসি বললেই ভালোবাসা হয় না, ভালোবাসা খুব কঠিন বিষয়, বইয়ের পাতায় লেখা ভালোবাসা আর বাস্তবের ভালোবাসা এক নয়। ভালোবাসায় কখনো গলে যেতে নেই, তুমি গলে গেলে ভেসে যাবে, তারা তখন মাটিতে দাঁড়িয়ে আরেক ভালোবাসার খোঁজে নেমে পড়বে, ভালোবাসায় আগাছা জন্মালে আসল গাছটাই খুঁজে পাওয়া যায় না। সবটাই স্বার্থের খেলা, যতক্ষণ তাদের স্বার্থের পক্ষে তুমি থাকবে ততক্ষণ ভালোবাসার জয়ধ্বনি তোমাকে ঘিরে রাখবে, স্বার্থ ফুরোলে ভালোবাসাও বাতাস হয়ে উড়ে যাবে। স্বার্থের ভালোবাসা এত বেশি হয়, সে ভালোবাসায় চোখ অন্ধ হয়ে যায়, মনের শরীর চাদরে ঢেকে যায়, তোমার মতো সরল মনের মানুষই তখন ঠকে বেশি। যারা ভালোবাসতে জানে তারা ভালোবাসা কখনো প্রকাশ করে না, প্রচার করে না। হয়তো ভালোবাসে, তারা ভালোবাসি বলতে পারে না, কারণ সেটা তারা অন্তরে ধারণ করে, সেটা তারা বিশ্বাস করে। বিশ্বাস কখনো দেখা যায় না, যারা বিশ্বাস দেখানোর ভন্ডামি করে তারাই বিশ্বাস ভেঙে দেয়, যেদিকে বৃষ্টি হয় সেদিকে ছাতা ধরে। অন্তরের ভিতরটা দেখানো যায় না, যারা অন্তর দেখানোর প্রতারণা করে, তারা অন্তর ভেঙে দেওয়ার মতো অপরাধ করে। যেদিন তুমি বুঝতে পারবে, যারা ভালোবাসা নামের আবেগ দিয়ে তোমার মন নিয়ে খেলেছে, সেদিন হয়তো অনেক দেরি হয়ে যাবে। এতদিন ভালোবাসার আওয়াজ তুলে যারা তোমাকে বুঝিয়েছিল, তারাই তোমার শক্তি, হয়তো সেদিন তাদের আর কাউকেই সঙ্গে পাবে না। একটা বিশাল মাঠের মাঝখানে তুমি, চারপাশের সেই মানুষেরা কেউ নেই। খুব একা লাগছে তোমাকে, মনে পড়ছে সেই মানুষগুলোর কথা, যারা মুখ ফুটে বলেনি ‘ভালোবাসি’, কিন্তু তোমাকে সব সময় ভালোবেসেছে। একবার ওদের ডাক দাও, ওরা তোমার ডাকের অপেক্ষায় আছে। ওরা তোমার ক্ষমতাকে ভালোবাসেনি, তোমাকেই ভালোবেসেছে, ওরা তোমার অর্থসম্পদ, বিত্তবৈভবকে ভালোবাসেনি, তোমাকেই ভালোবেসেছে। ওদের কোনো স্বার্থ নেই, ভালো মানুষের ভালোবাসাই ওদের ধর্ম। তোমার দুর্দিনে তাদের তুমি সঙ্গে পাবে। সবাই ভালোবাসতে না জানলেও কেউ কেউ শর্তহীন ভালোবেসে যায় আজীবন। সেদিন যদি তাদেরও দেখা না পাও, তবে ভেঙে পোড়ো না, বেদনায় মুষড়ে পোড়োনা, তুমি তোমাকে খোঁজার মতো সাহসটা মনের ভিতর রেখো। মনে রেখো, এ পৃথিবীটা অনেক বড়, কোথাও না কোথাও তোমার জন্য এক টুকরো মাটি এখনো আছে। সেই মাটির ওপর খালি পায়ে দাঁড়াও, যেদিকে অনেক পথ আছে সেদিকে পা ফেলো না, যেদিকে পথ নেই, সেদিকে পা ফেলো। তুমি যদি সেদিকে পা ফেলতে পারো, সেদিকে নতুন পথ তৈরি হবে। সেই পথগুলো যতই তুমি পেরোতে থাকবে ততই তোমার জন্য ভালোবাসার আরও অনেক নতুন পথ তৈরি হবে। তোমাকে কে ভালোবাসল কিংবা ভালোবাসল না, সেদিন সেটা তোমার কাছে মূল্যবান মনে হবে না, বরং তুমি নিজে ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়ে মানুষকে ভালোবাসতে পারো সেই ইতিহাস সৃষ্টি হবে। সবাই ইতিহাস ভাঙতে পারে, নতুন ইতিহাস কেবল সাহসীরাই গড়তে পারে। ঘুরে দাঁড়াও, পৃথিবী বদলে দাও।

চার. যতই হাঁটছি ততই পথ হারাচ্ছি। মানুষ যতক্ষণ পথ চিনে চিনে চলে ততক্ষণ নিজেকে একটা গন্ডির মধ্যে অবরুদ্ধ করে রাখে। খুব অদ্ভুত একটা বিষয় হলো, মানুষ পথ হারালেই গন্ডির বাইরে এসে নতুন নতুন পথ খুঁজে পাওয়ার সাহস দেখাতে পারে। চেনাপথ মানুষের নিজের ভিতরে লুকিয়ে থাকা একজন অচেনা মানুষকে চেনাতে পারে না, অচেনা পথ মানুষকে অসহায় করে তার ভিতরে লুকিয়ে থাকা মানুষটাকে চিনিয়ে দেয়। অসহায়ত্ব কখনো কখনো মানুষের শক্তি হয়, অসহায় হলেই মানুষ সেখান থেকে নিজেকে টেনে তোলার পথগুলো অনুসন্ধান করতে থাকে। পরিস্থিতি অনুকূল থাকলে মানুষ থামতে থামতে স্থবির হয়ে যায়, প্রতিকূল হলে মানুষ যেখানে এসে থেমে যায় সেখান থেকেই নতুন করে যাত্রা করে। পথ চললেই গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে তা নয়, বরং যতক্ষণ মানুষ গন্তব্য ছাড়া চলতে পারবে ততক্ষণ এক একটা গন্তব্য পেরিয়ে আরও নতুন নতুন গন্তব্যের দিকে ধাবিত হতে পারবে।

একজন কবি যদি ভাবেন তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতাটা তিনি লিখে ফেলেছেন, তবে তাঁর সৃষ্টিকর্মের যাত্রা সেখানেই থেমে যাবে। একজন বিজ্ঞানী যদি ভাবেন তাঁর মৌলিক আবিষ্কারের মাধ্যমে শ্রেষ্ঠ গবেষণাকর্মটি করে ফেলেছেন, তবে আরও নতুন নতুন আবিষ্কারের সম্ভাবনা সেখানেই মুখ থুবড়ে পড়বে। একজন চিত্রকর যদি ভাবেন তিনি তাঁর শ্রেষ্ঠ চিত্রকর্মটি এঁকে ফেলেছেন, তবে যে চিত্রকর্মগুলো আরও অনেক বেশি বিস্ময় ছড়িয়ে মানুষকে মোহিত করতে পারত, সেগুলোর হয়তো আর কখনো জন্মই হবে না। জীবনের সিঁড়িগুলো পার হতে হতে মাথা নিচু করে যখন মানুষ বলতে পারে, পৃথিবীতে যত মানুষ আছে তাদের চেয়ে আমি অনেক পিছিয়ে আছি, তখন তার এমন ভাবনা তাকে এগিয়ে নিতে পারে। দার্শনিক সক্রেটিস নিজেকে মাছির মতো, খুব নগণ্য পতঙ্গের মতো ভেবেছিলেন বলেই হয়তো সত্যের জন্য মরতে পেরেছিলেন। তাঁর দেহের মৃত্যু ঘটেছে, আত্মাও দেহ থেকে বেরিয়ে গেছে কিন্তু তাঁর চিন্তা আজও মানুষের চিন্তার ভিতর দিয়ে বড় হতে হতে আকাশ ছাড়িয়ে গেছে। হয়তো সক্রেটিস নামের মানুষটা আর নেই কিন্তু তাঁর জ্ঞান আজও বেঁচে আছে। মানুষের মৃত্যু আছে, জ্ঞানের মৃত্যু নেই।

সাধারণ মানুষের জীবনগুলোও এমন হতে পারে। মানুষ সাধারণ হলেই তার ভিতরের অসাধারণ মানুষগুলো অন্ধকারে আলো ফেলতে ফেলতে সূর্যের মতো বেরিয়ে আসতে পারে। সাধারণ মানুষ চেনাপথে হাঁটে না, অচেনা পথেই হাঁটে। অচেনা পথে অভাব থাকে, পাওয়া-না পাওয়ার অসহায়ত্ব থাকে, জীবনের অলিগলিতে ক্লান্তিতে ভেঙে পড়া একটা শরীর থাকে, এমন অপূর্ণতা থাকে বলেই সুখকে ধরব ধরব করে সুখের ভিতর দিয়ে চলতে চলতে সুখকে খোঁজার আনন্দ থাকে। ছোট ছোট আনন্দ, বেদনার মধ্যে যে আবেগ থাকে, ভালোবাসার শক্তি থাকে তা আর অন্য কিছুতেই নেই। যারা সুখের বিলাসে ভাসে, তাদের অভিনয় করে কাঁদতে হয়, যারা দুঃখের ভিতরের ছোট ছোট ছিদ্র দিয়ে সুখ খুঁজতে খুঁজতে চলতে থাকে তারা মন খুলে কাঁদতে পারে। সবাই এখন আর সত্যি সত্যি কাঁদতে পারে না, মিথ্যা মিথ্যা কাঁদতে পারে। মানুষের কান্নাটা তখন মানুষের নিজের হয় যখন মানুষ সবার অগোচরে কাঁদতে পারে, সবাই যখন সামনে থাকে তখন নিজের কান্না লুকিয়ে রেখে সবার মতো করে হাসতে পারে। চোখ গড়িয়ে পানি পড়লেই কান্না হয় না, অনেক সময় যাদের আমরা হাসতে দেখি তারা হাসির ভিতর দিয়ে কাঁদে। সবাই সেটাকে হয়তো হাসি ভেবে ভুল করে বসে, তবে কান্না লুকানো এমন হাসির তুলনা আর কোনো কিছুর সঙ্গে হয় না। কান্নাকে ভিতরে ভিতরে জাগিয়ে রেখে যে মানুষটা চলতে চলতে বারবার হারিয়ে যায়, হেরে যায়, সেই মানুষটাই বারবার নিজেকে খুঁজে নিতে পারে, একটা জয়ের পর আরেকটা জয়ের দিকে এগিয়ে যেতে পারে।  তবে ব্যথার ভারে ন্যুয়ে পড়া পা-টা তখনো স্বপ্ন, বিশ্বাস, ভালোবাসা নিয়ে অচেনার ভিতর দিয়ে চলতে চলতে অচেনাকেই আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকে অনন্তকাল। কেউ মনে রাখবে কি রাখবে না, সেটা সেই মানুষগুলোর কাছে গৌণ, বরং নিজেকে সময়ের গর্ভে হারিয়ে ফেলে তাদের রেখে যাওয়া অচেনা পদচিহ্নগুলো তাদের কাছে মুখ্য।

লেখক : শিক্ষাবিদ, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

সর্বশেষ খবর