বৃহস্পতিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

উল্টে গেছে পাশা

আফরোজা পারভীন

উল্টে গেছে পাশা

ফেসবুকে একটা ছবি কদিন ধরে ভেসে বেড়াচ্ছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে কথা বলছেন। সবাই তাঁকে ধন্য ধন্য করছে। কারণ এটাই ভারতীয় সংস্কৃতি, শিক্ষা, শিষ্টাচার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বয়সে তাঁর বড়, মাতৃসমতুল্য। ঋষি সাহেব বেশ লম্বা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে কথা বললে তাঁকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর দিকে মাথা উঁচু করে তাকিয়ে কথা বলতে হবে। সেটা ঠিক নয়।  আমাদের দেশে চিরকাল শেখানো হয়েছে গুরুজনকে সম্মান করতে হয়। তিনি সেটাই করেছেন। তাই তিনি বাহবা পাচ্ছেন!

ব্রিটিশরা আত্মম্ভরী জাতি। তাদের নাক বড় উঁচু। কারও সঙ্গে সহজে মিশতে চায় না, কথা বলতে চায় না। একসময় সারা পৃথিবী শাসন করেছে সেটা বোধহয় আজও ভুলতে পারেনি। রাজা রাজা ভাবটা রয়েই গেছে। আমেরিকানরা ঠিক তার উল্টো। মিশুক, পরোপকারী, অকপট। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ব্রিটিশ নাগরিক হলেও তিনি ভারতীয় বংশোদ্ভূত। তিনিই প্রথম এশিয়ান যিনি ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। আর ভারতীয় বংশোদ্ভূত বলেই তাঁর এই শিষ্টাচার, এটাই বলছে সবাই।

গুরুজনকে মান্য করা, শিক্ষককে সম্মান করার শিক্ষা আমাদের জীবনের শুরুতেই দেওয়া হয়েছে। বাবা-মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত, এটা আমরা বিশ্বাস করি। তাই বাবা-মা বা গুরুজনের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে আমরা দ্বিধা করি না। যদিও আজকাল অনেকেই সমালোচনা করে বলেন, সৃষ্টিকর্তা ব্যতীত অন্যের সামনে মাথা নত করা, পায়ে হাত দেওয়া ঠিক নয়। এটা মাথা নত করা নয়, সম্মান করা। আর বাবা-মা, গুরুজন, শিক্ষককে পায়ে হাত দিলে জাত যাওয়ার বা আত্মসম্মান হারানোর কিছু আছে বলে মনে করি না। বাবা-মা জন্ম না দিলে আমরা এই পৃথিবীর আলো দেখতাম না। জন্মের পর মানবসন্তান প্রচ- অসহায় থাকে। খাইয়ে না দিলে খেতে পারে না, হাত ধরে হাঁটা না শেখালে হাঁটতে পারে না, পরিষ্কার করে না দিলে পরিষ্কার হয় না। জীবনের প্রতিটি পদে তার বাবা-মায়ের সাহায্য লাগে। সেই বাবা-মায়ের পায়ে হাত দিলে অসুবিধা কী? সৃষ্টিকর্তা অপার অসীম। তিনি আছেন তাঁর জায়গায়। এর সঙ্গে মাথা নত করার বিষয়টা টেনে আনাই বা কেন? শিক্ষক একজন মানুষের জ্ঞানচক্ষু উন্মোচিত করেন। তাই বাবা-মায়ের মতোই উঁচুতে শিক্ষকের স্থান।

এটা ঠিক, সন্তান যেমন বাবা-মা, গুরুজনদের মান্য করবে তাঁদের কাজ সন্তানদের সঠিক পথ দেখানো। তাদের যথোপযুক্ত শিক্ষা দেওয়া। তাদের ভালোবাসা, তাদের কাজকে সম্মান আর মূল্যায়ন করা। তাদের ভুল হলে শুধরে দেওয়া, ভালো করলে উচ্চ স্বরে প্রশংসা করা, বাহবা দেওয়া। একজন দাঁড়িয়ে কথা বললে অন্যেরও দাঁড়িয়ে কথা বলা শিষ্টাচার। সবাই দাঁড়িয়ে থাকলে একজনের বসে থাকা সমীচীন নয়। সমষ্টির প্রতি সম্মান দেখানো নিয়ম।

আমরা একটা জিনিস ভুলে যাই, শিষ্টাচার দিয়ে, ব্যবহার দিয়ে, হাসিমুখ দিয়ে যা করা যায়, টাকা-ক্ষমতা-বাহুবল দিয়ে তা করা যায় না। মানুষের স্নেহ-ভালোবাসা দোয়া পাওয়ার জন্য টাকা-পয়সা নয়, শিষ্টাচার জরুরি। বাদশা আলমগীর তাঁর সন্তানকে ভালো শিক্ষা দিয়েছিলেন। বাদশার পুত্র হয়েও তাঁর ছেলে নিজ হাতে পানি ঢেলে শিক্ষাগুরুর পা ধুইয়ে দিয়েছিলেন। বাস্তবে এটা ঘটেছিল কি না জানি না। কিন্তু কবি কাজী কাদের নেওয়াজের কবিতার শেষ দুই চরণ, ‘আজ হতে চির উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির/ সত্যই তুমি মহান উদার বাদশা আলমগীর’। এই কবিতা বাদশা আলমগীরকে অমর করে রেখেছে।

অথচ এই বাদশা আলমগীর অর্থাৎ সম্রাট আওরঙ্গজেব পিতা শাহজাহানকে বন্দি করে রেখেছিলেন। তিন ভাইকে হত্যা করেছিলেন। সেকালে মুঘল সম্রাটদের এটাই ছিল নিয়ম। বড় পুত্র সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হতো বলে আপনজনদের রক্তে হাত রাঙা হতো শাহজাদাদের হাত। সেসব ছাপিয়েও কিন্তু বাদশা আলমগীর এই কবিতার জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন।

ভালো ব্যবহার করতে পয়সা খরচ হয় না। কিন্তু মাঝে মাঝে নিজেদের দেখে মনে হয় সত্যিই বুঝি ভালো ব্যবহার করতে, হাসতে পয়সা লাগে। হাসিমুখে দুটো কথা বললে অনেক সময় অনেকের উপকার হয়। আমরা সেটুকু করতেও নারাজ। দিন দিন যেন আমরা গুটিয়ে যাচ্ছি, শামুকের খোলের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছি, নিজেদের সংকুচিত করে ফেলছি। নিজের কথা ছাড়া কিছুই বুঝি না আমরা। আমরা ভালো গান শুনে, অভিনয় দেখে হাততালি দিই না। কেউ কুশল জিজ্ঞাসা করলে উত্তর না দিতে পারলে বেঁচে যাই। যদি উত্তর দিতেই হয় ‘ভালো’ বলে উল্টো তার কুশল জানতে চাই না। যেন সরে আসতে পারলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। অথচ আগের দিনের মানুষের হাজার রকম বিনোদন ছিল না। কথা বলা, মানুষের সঙ্গে মেশাটাই ছিল তাদের অন্যতম বিনোদন।

সম্প্রতি আমেরিকায় গিয়েছিলাম। সেদিন আমরা মেমোরিয়াল টাওয়ার দেখতে যাব। ৫২তলা ভবনের ওপর থেকে ডালাস শহর দেখব। দেখব মাইক্রোসকোপিক ভিউ। ট্রেনে চড়েছি। নামার সময় হয়ে গেছে। এমন সময় একটু দূরে সিটে বসা একজন কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা আমার মেয়েকে ডাকলেন। মেয়ে কাছে গেলে তার কাছে পানি খেতে চাইলেন। মেয়ে পানির বোতল নিয়ে পানি খাওয়াতে গেল। আমি ভয় পেলাম। ট্রেন স্টেশনে ঢুকছে। কোনো কোনো স্টেশনে মাত্র এক দুই মিনিট দাঁড়ায়। এখন পানি খাওয়াতে গেল, স্টেশন ছেড়ে যাবে না তো ট্রেন! বাস্তবে ঠিক সেটাই ঘটল। ট্রেন স্টেশনে ঢুকল। মাত্র দেড় থেকে দুই মিনিট দাঁড়াল। পানি খাইয়ে আমরা গেট দিয়ে নামার চেষ্টা করলাম। ততক্ষণে নিচ থেকে যাত্রীরা উঠছে। ট্রেন ছেড়ে দিল। মেয়ে ট্রেন থামানোর জন্য বেশ কয়েকবার বেল টিপল। থামল না। আমি ভীষণ ভয় পেলাম। এখন কী হবে। আমরা পথঘাট তেমন চিনি না। মেয়ে চলাচল করে গুগলের ওপর নির্ভর করে। কোথায় চলেছি কে জানে। যিনি পানি খেয়েছেন তিনি বিব্রতভাবে বললেন, নেক্সট স্টেশনে নেমে যাও। নেক্সট নয় আরও অনেক দূরে গিয়ে নামতে হলো আমাদের। তাতে চেনা পথ অচেনা হয়ে গেল। কীভাবে যাব জানি না। মেয়ে পথ খুঁজে বের করল। আগের ট্রেন থেকে নেমে বাসে ওঠার কথা ছিল। বাস স্টপেজ পাশেই ছিল। এখন আরও দুটো বাস বদলাতে হবে। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, আমাদের ট্রেনটা মিস করিয়ে দিল। মেয়ে বলল, ‘ওনার পানির দরকার ছিল। ভাগ্যিস পানিটা সঙ্গে ছিল। আর পথও বাড়েনি। এখন বরং সুবিধা হয়েছে। হাঁটতে হবে কম’। মনে মনে নিজেকে ধিক্কার দিলাম। সেদিন মেয়ের কাছে শিখলাম অনেক কিছু।

আগেরবার শিকাগো এয়ারপোর্টে শ্রীলঙ্কার একজন সরকারি কর্মকর্তার মোবাইল খুঁজে দিয়েছিলাম। উনি দুটো মোবাইল আর চশমা সিটে ফেলে চলে গিয়েছিলেন। আমি চোখে চোখে রেখেছিলাম ওগুলো। ওনাকে চিনি না কিন্তু কাউকে ঘোরাফেরা করতে দেখলেই খেয়াল করছিলাম কিছু খুঁজছে কি না। কয়েক ঘণ্টা চলে যাওয়ার পর পাশের এয়ারলাইনসে জানিয়েছিলাম। তারা মাইকিং করেছিল। সাড়া মেলেনি। জিনিস দুটো নিয়ে জিম্মায় রেখেছিল। আরও কিছুক্ষণ পর সে লোক এসে পাগলের মতো খুঁজছিল। আমি তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, কী খুঁজছে। বলেছিল। আমি নিশ্চিত হওয়ার পর এয়ারলাইনসে খবর দিয়েছিলাম। তিনি মোবাইল দুটো আর চশমা উদ্ধার করেছিলেন। কৃতজ্ঞতায় নতজানু হয়েছিলেন আমার প্রতি। বলেছিলেন ওই মোবাইল হারালে তাঁর ভয়ানক ক্ষতি হতো। তিনি একটা কনফারেন্সে এসেছেন। সব ডকুমেন্ট ছিল ওই মোবাইলে। সেই থেকে ওই ভদ্রলোক আমার বন্ধু। আর এবার আসার পথে পেয়েছিলাম পশ্চিম বাংলার এক প্রবীণ জুটি। বৃদ্ধ লোকটি ডায়াবেটিসের পেশেন্ট। তিনি এটেনডেন্টদের বোঝাতে পারছিলেন না টয়লেটে যেতে চান। আমি ওদের বুঝিয়ে দিয়েছিলাম। ভদ্রলোকের স্ত্রী আমার হাত চেপে ধরেছিলেন। যতক্ষণ ছিলাম পাশে বসিয়ে রেখেছিলেন। এটা ওটা খাওয়ানোর চেষ্টা করছিলেন। যাওয়ার সময় ফিরে ফিরে তাকাচ্ছিলেন। এসব গল্প নিজের ঢাক পেটানোর জন্য করছি না। রাস্তাঘাটে আমি নিজেও অনেকের অকুণ্ঠ সহযোগিতা পেয়েছি। বারদুয়েক লিফটে অজ্ঞান হয়েছি। একবার হয়েছি এয়ারপোর্টে। অজানা-অচেনা মানুষেরা আমার সেবা করেছে, পানি খাইয়েছে, বাতাস করেছে, বাসায় পৌঁছে দিয়েছে। তাদের ঋণ আমি কীভাবে শুধব। মনে আছে একবার এক অনুষ্ঠানে এক অল্পবয়সী মেয়ের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছিল। প্রায় যায় যায় অবস্থা। আমি দ্রুত ব্যাগ থেকে ইনহেলার বের করে দিয়েছিলাম। ওই মুহূর্তে ইনহেলারটা ওর জীবনরক্ষাকারী হয়ে উঠেছিল। আমার কাছে ছিল বলে দিতে পেরেছিলাম। না থাকলে পারতাম না। অনেকে থাকলেও দেয় না এটা নিজের জীবন দিয়ে দেখেছি। আবার অনেককে দেখেছি নিজের কথা না ভেবে, নিজের জন্য কিছু না রেখে মানুষকে বিলিয়ে দিতে। এটাই স্বাতন্ত্র্য! এটাই মনুষ্য জীবনের বিউটি!

পৃথিবীর কোনো কোনো দেশের মানুষ ইংরেজি শেখে না। এমনকি দোভাষী পর্যন্ত রাখে না। ভাবখানা এমন যেন, আমার দেশে এসেছ আমি কী বলছি বুঝে নেওয়া তোমার দায়িত্ব। বুঝলে বোঝ না বুঝলে তোমার সমস্যা। এই অহেতুক ভাবনার কোনো কারণ দেখি না। ভাষা শেখা দোষণীয় কিছু নয়। ভাষা শিখলে বরং মানুষ সমৃদ্ধ হয়। নিজের ভাষা ছাড়া অন্য ভাষা জানা বাড়তি যোগ্যতা। মানুষকে সম্মান করা, শ্রদ্ধা করা, ভালোবাসা, উপকার করা, পাশে দাঁড়ানো, তাদের বিপদে ব্যথিত হওয়া, সুখে আনন্দ করা, দুর্নীতি না করা, চরিত্র ভালো রাখা এসব আমাদের মৌলিক শিক্ষা। সেই শিক্ষা এখন অনেকটাই বিলীয়মান। আজকের ছেলেমেয়েরা এর কমই মেনে থাকে।  বাবা-মায়ের একাংশ শিশুদের ক্যারিয়ার গড়নে যতটা মনোনিবেশ করেন ততটা করেন না তাদের মানবিক শিক্ষা দিতে। সে কারণে ব্যক্তি জীবনে সফল ব্যক্তিরা অনেকেই আচরণগতভাবে সুশীল নন। মানুষ যত বড় হন তত তার বিনয় হওয়ার কথা। সে কারণেই বড় বৃক্ষ নুয়ে পড়ে। মহৎ মানুষের জীবন পর্যালোচনা করলে তাদের বিনয় আমাদের মুগ্ধ করে। আজকাল এসবের চর্চা তেমন হয় না। না পরিবারে, না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।  এখন পাশা উল্টে গেছে। তাই কেউ সৎ থাকলে খবর হয়। অথচ অসৎ হওয়াটাই অস্বাভাবিক, সততাটাই স্বাভাবিক। ভেজাল না থাকলে খবর হয়। অথচ ভেজাল না থাকাটাই স্বাভাবিক। থাকাটা অস্বাভাবিক। কেউ গুরুজনকে সম্মান জানালে সেটা আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে, অথচ ওটাই স্বাভাবিক।

                লেখক : কথাশিল্পী, গবেষক, সাবেক যুগ্মসচিব

সর্বশেষ খবর