উন্নত বিশ্বের একটি দেশ কানাডা। আমার আগের এক লেখায় উল্লেখ করেছিলাম কানাডায় তিন স্তরের সরকার পদ্ধতি বিদ্যমান- ফেডারেল, প্রাদেশিক ও আঞ্চলিক। দেশজুড়ে আছে মাকড়সার জালের মতো বিস্তৃত হাইওয়ে নেটওয়ার্ক। মহাসড়কগুলো দেখভালের দায়িত্ব মুখ্যত প্রাদেশিক সরকারগুলোর। ১০টি প্রদেশ ও তিনটি অঞ্চল নিয়ে কানাডা। আঞ্চলিক সড়কগুলোর দায়িত্ব স্ব স্ব মিউনিসিপ্যালিটির। এখানকার সড়কগুলো ঝকঝকে তকতকে। ধুলাবালি নেই। শব্দদূষণ নেই। ড্রাইভিং সিট গাড়ির বাঁ দিকে হওয়ায় রাস্তার ডান দিক দিয়ে সব যানবাহন চলাচল করে। হাইওয়েতে পিঁপড়ার সারির মতো হাজার হাজার গাড়ি চলছে নির্ধারিত গতিসীমা মেনে। কোথাও ট্রাফিক পুলিশ দাঁড়িয়ে নেই। কিন্তু ট্রাফিক আইন মেনে চলছে সবাই। আইনের প্রতি সবাই শ্রদ্ধাশীল। এখানে কেউ অকারণে গাড়ির হর্ন বাজায় না। তবে অ্যাম্বুলেন্স বা ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি সাইরেন বাজিয়ে ছুটে চলে। কেউ যদি ট্রাফিক আইনের চুল পরিমাণ ব্যত্যয় ঘটায়, হর্ন বাজিয়ে তাকে সতর্ক করে দেয় পেছনের গাড়ি। তবে এমন ঘটনা কদাচিৎ ঘটে। সাধারণের যাতায়াতের জন্য আছে সুন্দর পাবলিক ট্রান্সপোর্টেশন বা গণপরিবহন ব্যবস্থা। স্থানীয় সরকারের মালিকানাধীন গণপরিবহন কোম্পানিগুলো একেক শহরে একেক নামে সেবা দিচ্ছে। কানাডার সবচেয়ে বড় শহর টরন্টোয় আছে টরন্টো ট্রানজিট কমিশন। মন্ট্রিয়ালে আছে মন্ট্রিয়াল ট্রানজিট করপোরেশন। ক্যালগেরি সিটিতে ক্যালগেরি ট্রানজিট। হ্যালিফ্যাক্সে আছে হ্যালিফ্যাক্স ট্রানজিট। লক্ষণীয়, ঢাকা শহরের মতো এখানে একাধিক গণপরিবহন কোম্পানি অপারেট করে না। পাবলিক বাসগুলো সময় মেনে চলে। ঘন ঘন বাসস্টপ। হাঁটাদূরত্বে। পিক আওয়ার ছাড়া যাত্রীর তেমন ভিড় নেই। গুগল ম্যাপের মাধ্যমে জানা যাবে বাস কখন নির্দিষ্ট স্টপে পৌঁছাবে। বাসে ওঠার পর নির্দিষ্ট পরিমাণ নগদ কয়েন নির্দিষ্ট বক্সে জমা দিয়ে অপারেটরের (ড্রাইভার) কাছ থেকে টিকিট সংগ্রহ করতে হবে। বক্সে অতিরিক্ত অর্থ জমা দিলে ফেরত পাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। যে কোনো দূরত্বের জন্য একই ভাড়া। চাইলে বাসের টিকিট অগ্রিমও কেনা যাবে নির্দিষ্ট স্টোর বা সার্ভিস সেন্টার থেকে। যারা নিত্যদিন বাসে বা মেট্রোরেলে যাতায়াত করেন তাদের জন্য আছে মান্থলি ট্রানজিট পাস। টিকিটের ট্রান্সফার নিয়ে নেটওয়ার্কের যে কোনো রুটের বাসে ভ্রমণ করা যাবে বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে। নতুন করে টিকিট কেনার প্রয়োজন হবে না। এ সীমা ক্ষেত্রমতে ৯০, ১২০ মিনিট বা এরও বেশি সময়ের জন্য হতে পারে। প্রায় সব সিটিতেই আছে একই ধরনের পাবলিক ট্রান্সপোর্টেশন ব্যবস্থা। উল্লেখ্য, একই টিকিটে আপনি বাস ও মেট্রোরেলে (সাবওয়ে) ভ্রমণ করতে পারবেন। তবে টিকিটে বেঁধে দেওয়া নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আপনাকে বাস বা মেট্রোয় উঠতে হবে। প্রসঙ্গত, একই কোম্পানি বাস ও মেট্রোয় সমন্বিত সেবা দিচ্ছে। মেট্রোরেল একেক শহরে একেক নামে পরিচিত। টরন্টো সিটিতে এর নাম টরন্টো সাবওয়ে সিস্টেম। ভ্যাঙ্কুভারে স্কাইট্রেন। ক্যালগেরিতে পরিচিত সিট্রেন নামে। জেব্রা ক্রসিং দিয়ে রাস্তা পার হওয়ার সময় দুই পাশের সব গাড়ি নিরাপদ দূরত্বে থেমে যায়। বাসে বা মেট্রোরেলে ওঠানামার সময় কোনো হুড়োহুড়ি বা ধাক্কাধাক্কি নেই। প্রবীণ, শারীরিকভাবে অক্ষম ও অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের জন্য বাস ও ট্রেনে আসন সংরক্ষিত আছে।
কানাডায় মোটরগাড়ি কেনার ঋণ সহজলভ্য। এ ক্ষেত্রে যা দেখা হয় তা হচ্ছে আবেদনকারীর আয়ের উৎস। নিয়মিত আয় থাকলে ঋণ পেতে বেগ পেতে হয় না। এ দেশে ব্যক্তিগত গাড়িই বেশি। একাধিক গাড়ি আছে অনেক পরিবারেই। স্বল্প অভিজ্ঞতার আলোকে স্বল্প পরিসরে কানাডার উন্নত সড়ক পরিবহন ব্যবস্থার ছিটেফোঁটা উপস্থাপন করা হলো। অনেকে বলেন, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের উন্নত সড়ক পরিবহন ব্যবস্থার গল্প শুনে আমাদের কী লাভ? এ থেকে আমরা সত্যিই কি কিছু শিখব? তাদের অভিমত, অবকাঠামোর প্রভূত উন্নতি হয়েছে, এটা সত্য; তা সত্ত্বেও সড়কে শৃঙ্খলা ফেরেনি। অনেকটা হতাশার সুরে তারা বলেন, ‘একেকটা মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর দিনকয়েক খুব হইচই হয়। পত্রপত্রিকা, টেলিভিশন ও সমাজমাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। নানা সুপারিশ করা হয়। কিছুদিন পর সব থিতিয়ে যায়।’ ভুক্তভোগীরা মনে করেন, সড়কে নৈরাজ্যের অবসান সহসা হওয়ার নয়।
প্রবাদ আছে- কেউ দেখে শেখে, কেউ ঠেকে শেখে। তবে শেখার আগ্রহ থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ। ইতিবাচক পরিবর্তন রাতারাতি হয় না, এটা ঠিক। এক দিনে সবকিছু গড়ে উঠবে না। তবে শুরুটা তো হওয়া দরকার। কোনো কাজ শেষ করার প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে শুরু করা। শুরু না করলে শেষ হবে কীভাবে? আমাদের স্বপ্ন থাকতে হবে। স্বপ্ন মনের মধ্যে সযতেœ লালন করতে হবে। আর স্বপ্ন সত্যে পরিণত করার জন্য আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ়তার সঙ্গে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের স্বপ্নের কথা আমাদের শুনিয়েছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যে কথা সেই কাজ। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো একটা বিশাল প্রকল্প সফলভাবে বাস্তবায়নের পর অবাক হয়েছে বিশ্ববাসী। বাংলাদেশের জয়গান গেয়েছে গোটা বিশ্ব। দেশের মধ্যেও সমালোচকদের মুখ চূর্ণ হয়েছে। বিগত বছরগুলোয় বাংলাদেশে সড়ক অবকাঠামোর বিস্ময়কর উন্নতি হয়েছে। এখন আড়াই ঘণ্টায় রাজধানী ঢাকা থেকে আমার নিজ জেলা শহর নড়াইলে নির্বিঘ্নে পৌঁছে যাওয়া যায়। ভাবা যায়! ঢাকা মেট্রোরেল, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বদলে দিয়েছে ঢাকার চিরচেনা রূপ। ঢাকা শহর ধীরে ধীরে উন্নত বিশ্বের রূপ নিচ্ছে। আমরা স্বপ্ন দেখি, একদিন আমরাও...।
লেখক : সাবেক পরিচালক পরিচালনা পর্ষদ, বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন