সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

জাতীয় মাছ ইলিশ তবে...

ড. এম মেসবাহউদ্দিন সরকার

জাতীয় মাছ ইলিশ তবে...

‘মাছের রাজা ইলিশ আর বাত্তির রাজা ফিলিপস’ ৯০ দশকের সেই জনপ্রিয় বিজ্ঞাপনটি এখনো হয়তো অনেকের মনে আছে। বর্ষাকালের এ সময়ে মাছের বাজারে ইলিশে থাকে সয়লাব। পদ্মার রুপালি ইলিশ এবং চাঁদপুর ঘাটের ঝকঝকে ইলিশের কথা মনে এলেই জিব্বায় পানি আসে। গরম ভাতের সঙ্গে সুস্বাদু ইলিশ ভাজা যেন অমৃত। মহল্লায় ইলিশ মাছ রান্না করলেই আশপাশ থেকে টের পাওয়া যেত- রান্নাঘরের আশপাশে বিড়ালের মিউ মিউ শোনা যেত। ছোটবেলায় দেখেছি বাজার করে বাড়ি ফেরার পথে ধনী-গরিব সবার হাতেই ইলিশ মাছ দেখা যেত। গরম ভাতের সঙ্গে এক টুকরা ইলিশ ভাজা, সঙ্গে ইলিশের তেল আর কাঁচামরিচ হলেই খাওয়া শেষ হতো। স্বাদ ও সাধ্যের মধ্যে ছিল বলেই হয়তো ইলিশকে মাছের রাজা বলা হতো। ইলিশের সেই স্বাদ এখনো বিদ্যমান, কিন্তু ভোগ করার সামর্থ্য নেই অধিকাংশের। কারণ গরিব ও মধ্যবিত্তের আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সমীকরণে আজ বিস্তর ফারাক। সুস্বাদু ইলিশ সব প্রজার সাধ্যের মধ্যে থাকার কারণেই হয়তো একদিন রাজার খেতাব পেয়েছিল, পেয়েছে জাতীয় মাছের মর্যাদা। কিন্তু বর্তমানে এর দাম সাধারণ মানুষের ধরাছোয়ার বাইরে। ৬০০ থেকে ৯০০ গ্রামের ইলিশের কেজি সাইজ ভেদে দাম ৯০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা। এক কেজি ওজনের একটি ইলিশের দাম ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা। ১ হাজার ২০০ গ্রাম থেকে দেড় কেজি ওজনের একটি ইলিশের দাম ১ হাজার ৭০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা। পদ্মা নদীর তীরে প্রতি কেজি ইলিশের মূল্য আরও অনেক বেশি (২ হাজার ২০০-২ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত)। এই দাম দিয়ে একজন দিনমজুর তো নয়ই, একজন সরকারি চাকরিজীবীরও একবেলা ইলিশ খাওয়ার সাধ্য নেই। অর্থাৎ অগণিত প্রজাই (প্রায় ৯৫ শতাংশ) বঞ্চিত হচ্ছে ইলিশ মাছ খাওয়া থেকে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রপ্তানি আয় ইত্যাদি কারণে মৎস্য অধিদফতর ও সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে ইলিশের প্রজনন ও উৎপাদন ক্ষমতা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনে ইলিশের অবদান প্রায় ১২ দশমিক ২২ শতাংশ, যার বাজারমূল্য ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি। জিডিপিতে ইলিশের অবদান এক শতাংশের অধিক। ইলিশ উৎপাদনকারী ১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম। বাংলাদেশের ইলিশ পেয়েছে জিআই পণ্যের মর্যাদা। প্রায় পাঁচ লাখ লোক সরাসরি ইলিশ আহরণে নিয়োজিত। মৎস্য অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, ১০ বছর আগে দেশের ২১টি উপজেলার নদনদীতে ইলিশ পাওয়া যেত। বর্তমানে ১২৫ থেকে ১৩০টি উপজেলার নদনদীতে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। দেশে প্রায় ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটারজুড়ে রয়েছে ইলিশের অভয়াশ্রম। মা ইলিশ ও জাটকা সংরক্ষণে অভয়াশ্রম ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রায় ২৪৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০২০ সালে একটি প্রকল্প হাতে নেয় যা শেষ হবে আগামী ২০২৪ সালের জুনে। তখন ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে ৬ দশমিক ২০ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত হবে। মৎস্য অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী গত এক দশকে দেশে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে ২ লাখ মেট্রিক টনের বেশি। ২০০৬-০৭ অর্থবছরে দেশে ইলিশের উৎপাদন ছিল মাত্র ২ লাখ ৭৯ হাজার ১৮৯ মেট্রিক টন, ২০১১-১২ সালে দেশে বেড়ে তা হয়েছিল ৩ লাখ ৪৭ হাজার মেট্রিক টন। আর সর্বশেষ ২০২০-২১ সালে উৎপাদন হয়েছে ৫ দশমিক ৬৫ লাখ মেট্রিক টন এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে তা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৫ লাখ ৬৬ হাজার ৫৯৩ মেট্রিক টন। এ সময়ে উৎপাদন বেড়েছে ২ লাখ ৮৭ হাজার ৪০৪ মেট্রিক টন বা ১০২ শতাংশ। অর্থাৎ ২০১০ থেকে ২০২২ সাল এ ১২ বছরে ইলিশ উৎপাদন বেড়েছে ৪৬ শতাংশ। আমিষ সরবরাহে ইলিশের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই দেশে-বিদেশে ইলিশ মাছের চাহিদা বাড়ছে দিন দিন। কিন্তু এত উদ্যোগ, এত উৎপাদন অথচ দাম কমছে না। পয়লা বৈশাখে পান্তা ইলিশের রেওয়াজও আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে। তাহলে সাধারণ মানুষ কি তাদের প্রিয় ইলিশ মাছ আর খেতে পারবে না? ভবিষ্যতে কি মানুষ বাজার থেকে এক-দুই টুকরা কিনে খাবে? নাকি শপিং মলের কৌটায় পাওয়া যাবে প্রসেস করা এক টুকরা ইলিশ মাছ? তা-ই যদি হয়, তাহলে এ ইলিশ মাছ আর সাধারণ মানুষের জন্য থাকবে না। আর তখন এটিকে মাছের রাজা কিংবা জাতীয় মাছ হিসেবে কেউ মনে করবে না। ইতোমধ্যেই পাঙাশকে (কৃত্রিমভাবে পুকুরে চাষ করা) জাতীয় মাছ হিসেবে এ প্রজন্মের শিশুরা মনে করতে শুরু করেছে। ফেসবুকে জনৈক শিশুকে জাতীয় মাছ কী এই প্রশ্ন করলে জবাবে সে বলেছে পাঙাশ মাছের কথা। কারণ জন্ম থেকেই সে দেখছে গরিব ও সাধারণ মানুষেরা পাঙাশ মাছ খাচ্ছে। এর সরবরাহও বাজারের স্বাভাবিক এবং সাধারণ মানুষের সাধ্যের মধ্যে। অথচ ইলিশ মাছ ঘাস খায় না, খড় খায় না, খৈল-ভুসি কিছুই খায় না। ইলিশের জন্য চিকিৎসা খরচও নেই, চাষে দিনমজুরও লাগে না। ইলিশ ইউক্রেন-রাশিয়া থেকেও আসে না। প্রাকৃতিকভাবে নদী বা সমুদ্র থেকে জাল টেনে ধরা হয়। তাহলে ইলিশের দাম গরু, ছাগলের মাংসের চেয়েও বেশি হয় কী করে? এ বেশি দাম কি জেলেরা পায়? তাহলে কি সবকিছুই সিন্ডিকেট? সাধারণ মানুষ মৌসুমের সময়ও যদি দু-একটি ইলিশ খেতে না পারে তাহলে এর জাতীয় মর্যাদা কীভাবে থাকে? মৎস্য বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে হারিয়ে যাওয়া অনেক মাছকে ফিরিয়ে এনেছে, চাষ করছে পুকুর ও জলাশয়ে। কিন্তু ইলিশ সামুদ্রিক মাছ হওয়ায় এখনো তা পুকুর কিংবা জলাশয়ে চাষ করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে কোনোকিছুই অসাধ্য নয়। ইলিশবঞ্চিত গরিব মানুষগুলোর ইচ্ছার কথা ভেবে এ ব্যাপারে সফলতা আনতেই হবে। আর তাহলে হয়তো একদিন বঞ্চিত মানুষগুলো ইলিশের স্বাদ গ্রহণ করতে পারবে। ইলিশও মর্যাদা পাবে জাতীয় মাছ হিসেবে, মাছের রাজা হিসেবে।

লেখক : অধ্যাপক, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সর্বশেষ খবর