মঙ্গলবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

যা কোনো দিন বলতে বা লিখতে চাইনি

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

যা কোনো দিন বলতে বা লিখতে চাইনি

গতকাল সরিষাবাড়ীর বারইপটল ছিল মুক্তিযুদ্ধের এক বেদনাদায়ক দিন। হাতে পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে ২৩ আগস্ট ’৭১ ভারত সীমান্তে গিয়েছিলাম। আবার দেশে পা দিয়েছিলাম ১৫ সেপ্টেম্বর। প্রথম দেশে প্রবেশ করেছিল হাবিবুল হক বেনুর কোম্পানি। আমার আগে আগে এক দারুণ কমান্ডার বেতুয়ার লোকমান হোসেন, তারপর আমি। আমার পেছনে ছিল বীরপ্রতীক আবদুল হাকিমের কোম্পানি। ভারতে যাওয়ার পথে জাহাজমারা কমান্ডার মেজর হাবিবের কোম্পানির প্রায় ১২-১৫ জন শহীদ হয়েছিল গোপালপুরের পানকাতায়। অন্যদিকে ঝাওয়াইল ভেঙ্গুলার পাশে এক গ্রাম থেকে হুমায়ুন বাঙালের হনুমান কোম্পানির প্রায় সমস্ত অস্ত্র-গোলাবারুদ পাকিস্তানি হানাদাররা দখল করে নিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে এটাই ছিল আমাদের জন্য বিস্ময়! সব জায়গায় আমরা হানাদারদের অস্ত্র দখল করেছি। কিন্তু সেপ্টেম্বরে একবারই হানাদাররা আমাদের একটা কোম্পানির সব অস্ত্র-গোলাবারুদ দখল করে নিয়েছিল। আমার পেছনে পেছনে আসছিল আবদুল হাকিম বীরপ্রতীকের কোম্পানি। হাবিবুর রহমান বীরবিক্রম ও আবদুল হাকিম বীরপ্রতীক সেনাবাহিনীর সদস্য ছিল। সরিষাবাড়ীর বারইপটল যুদ্ধে শহীদ হয় আমিনুর রহমান মেদু, শাজাহান, বাদশা, হাফিজ ও জহুরুল। সেই ভূমিতে আবদুল হাকিম বীরপ্রতীকের নেতৃত্বে প্রতি বছরই স্মরণসভা হয়, আলোচনা হয়। অথচ এ বছর আওয়ামী লীগে যোগদান করা হাইব্রিড নেতারা বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাকিম বীরপ্রতীককে সেই অনুষ্ঠানে কোনো পাত্তাই দেয়নি। এই হলো মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সরকার সমর্থিত হাইব্রিডদের চিন্তা-চেতনা। দেশের এক শ্রেষ্ঠ জননন্দিত গণসংগীত শিল্পী এবং অভাবনীয় মেধার অধিকারী, কথায় কথায় গান রচনা যার নিত্যদিনের কর্ম, লাখো দর্শক-শ্রোতার সামনে তাৎক্ষণিক রচনা করা গান গেয়ে লাখো মানুষকে মাতোয়ারা করে তোলা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জন্য নিবেদিত বিখ্যাত শিল্পী, যন্ত্রশিল্পী, সুরকার, গীতিকার ও সংগীত পরিচালক নকুল কুমার বিশ্বাস কৃষক শ্রমিক জনতা লীগে যোগদান করার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই জরুরি সভা করে সিদ্ধান্ত নেব।

যা হয়তো কোনো দিনই লেখার প্রয়োজন ছিল না, এমন না হলে হয়তো কোনো দিন লেখাও হতো না। কিন্তু এক বুক ব্যথা নিয়ে যা লিখতে চাইনি তা-ই লিখতে বাধ্য হচ্ছি। আমরা দুই মায়ের ১৫ ভাই-বোন। ছেলেবেলায় খুব একটা বুঝতাম না সৎ-মা কাকে বলে। আমাদের ছোট বা নতুন মাকে একটা সময় পর্যন্ত মার বোন বলেই ভেবেছি। মায়েদের মধ্যে কখনো তেমন কলহ দেখিনি। আমরা ভাই-বোনেরা দীর্ঘ সময় ছিলাম এক প্রাণ এক আত্মার মতো। বাবা ছিলেন খুবই মেজাজি মানুষ। কিন্তু মারাত্মক নীতিমান। হঠাৎ করে দাদু আলাউদ্দিন সিদ্দিকী পরপারে চলে গেলে অপ্রাপ্তবয়স্ক বাবাকে দারুণ কষ্ট করতে হয়েছে। যে কারণে অনেকাংশেই ছিল তাঁর তিরিক্ষি মেজাজ। কিন্তু প্রায় সব সময়ই বাবাকে দেখতাম বিপদে আমাদের ছায়া হয়ে দাঁড়াতে। বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী আইয়ুব-মোনেমের আমলে বারবার জেলে যেতেন। বাবাও জেলে গেছেন বেশ কয়েকবার। তখন সংসার একেবারে ভেসে যাওয়ার মতো হতো। কিন্তু যেই বাবা জেল থেকে বেরোতেন সঙ্গে সঙ্গেই রাজরাজড়ার মতো খানাপিনা- এটা আমরা বড়রা দেখেছি। আজাদ-মুরাদ-শাহানা খুব একটা বুঝতে পারেনি। কিন্তু শুশু-বেলাল-বাবুল-মুন্নু-রহিমা-আমি-বড় ভাই সবাই বুঝেছি। দাদু আলাউদ্দিন সিদ্দিকী অকালে চলে যাওয়ার পর আমরা ছিলাম একেবারে এতিমের মতো। টাঙ্গাইল এসেছিলাম ১৯৪৮ সালে। কেউ আমাদের জিজ্ঞেসও করত না। মোক্তারি পরীক্ষায় পাস করে আমীর আলী খান মোক্তারের সহযোগী হিসেবে বাবা কাজ করতেন। দিনে ২-৩-৪ টাকার বেশি পেতেন না। তাতেই চলত। ১-২ টাকার লবণ-মরিচ-পিঁয়াজ-রসুন-শাকসবজি-মাছ-মাংস কিনলে ৩০-৪০ জন খাওয়া যেত। গ্রামের বাড়ির পুকুরে সব সময় মাছ থাকত, আলু-পিঁয়াজ-রসুন -ডাল-চাল-সরিষা সব ছিল গোলাভরা। তার পরও কষ্ট। একসময় হঠাৎই লতিফ ভাইকে বক্তৃতা করতে দেখলাম। তারপর সারা টাঙ্গাইলে তাঁর নাম। তিনি বক্তৃতা করলে শরীর গরম হয়ে যায়। ’৬২-এর শিক্ষা কমিশন আন্দোলনে টাঙ্গাইলের শওকত আলী তালুকদার হাঙ্গার স্ট্রাইক করেছিলেন। হাঙ্গার স্ট্রাইক কাকে বলে জানতাম না, বুঝতাম না। জেলখানার পাশে টাঙ্গাইল হসপিটালে হাঙ্গার স্ট্রাইক দেখার অনেক চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু দেখতে পাইনি। শুধু দেখেছিলাম, একজন মোটাসোটা লোক শুয়ে আছেন। অনেকে হাতপাখায় বাতাস করছে, কেউ কেউ আবার হাত-পা-মাথা টিপছে। সেই আন্দোলনের সময় টাঙ্গাইল পার্কের পাশে আনসার ক্যাম্পের সামনে আমতলে এক ছাত্রছাত্রী সমাবেশ হয়েছিল। ৫-৬ হাজারের কম সমাগম হবে না। সর্বজনাব ফজলুল করিম মিঠু, ফজলুর রহমান ফারুক, আল মুজাহিদী, লতিফ সিদ্দিকী আরও কে কে যেন বক্তৃতা করেছিলেন। শাজাহান সিরাজের তখনো কোনো নামগন্ধ ছিল না। তিনি এসেছেন ’৬৪-৬৫ এর দিকে। সে সময় কুমুদিনী কলেজের এক নেত্রীর অসাধারণ বক্তৃতা শুনেছিলাম। বেনজির ভুট্টো, ইন্দিরা গান্ধী, মাভো বন্দরনায়েক, ইসরায়েলের গোল্ডা মায়ার, আমার বোন শেখ হাসিনা, বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া কারও বক্তৃতায় সেই মেয়েটির মতো অত স্পষ্ট অত হৃদয়কাড়া সব অস্তিত্বে স্পর্শ করা মনে হয় না। হ্যাঁ, বঙ্গবন্ধুর পিঠের চামড়া দিয়ে জুতো বানানো ডুগডুগি বাজানো মতিয়া চৌধুরীর বক্তৃতা ছিল আলাদা।

আমি ছিলাম আমার পরিবারের সব থেকে অপদার্থ অকর্মণ্য। যে কারণে আমাকে মির্জাপুরের বরাটি নরদানা পাকিস্তান হাইস্কুলে শায়েস্তা করতে পাঠানো হয়েছিল। সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন দুখীরাম রাজবংশী। রাজবংশী মানে জেলে। তিনি বিয়ে করেছিলেন এক মুচির মেয়েকে। তিনিও ষাটের দশকে এক বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান ছিলেন। বরাটিতে আমার জীবন ছিল যেমন ঝঞ্ঝার তেমন আনন্দে ভরপুর। শিক্ষাগুরু দুখীরাম রাজবংশী আমাকে এক দিনের জন্যও পড়াতে পারেননি। তিনি ইংরেজি পড়াতেন। চার বছরে এক দিনও তিনি আমাকে ক্লাসে পাননি। রাত ১১টা পর্যন্ত জাগতে হতো। ১১টার ২-৪ মিনিট আগেও ঝিমুনি দিলে কানের লতিতে বেতের আঘাতে আগুন জ্বলত। কী করে যে ৬০-৭০ জন হোস্টেলবাসী আমাদের মতো অপদার্থদের স্যার সামাল দিতেন তা একমাত্র আল্লাহই জানেন। সেখান থেকে ভর্তি হয়েছিলাম দানেশ স্যারের শিবনাথ স্কুলে। তারপর পালিয়ে গিয়েছিলাম সেনাবাহিনীতে। সেনাবাহিনীতে গিয়েই ’৬৫-এর যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলাম। ’৬৫-এর যুদ্ধে ১ নম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভীষণ সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিল। বিআরবে খালের ওপর আমাদের পজিশন ছিল। ৭০-৮০ ফুট উঁচু এক-দেড় শ ফুট পাশে এক বালুর বাঁধ। তার ওপর ছিল আমাদের পজিশন। তখন ১ নম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্টের এ অথবা সি কোম্পানির কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমান। আমি ছিলাম বি কোম্পানিতে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ফেরার পথে লাহোর থেকে করাচি ১১০০-১২০০ মাইল। সাধারণ মরু এলাকায় রাস্তার পাশে তেমন মানুষজন না থাকলেও শহর এলাকার রাস্তার দুই পাশে প্রচুর মানুষ ছিল। কীভাবে তারা খবর পেয়েছিল বেঙ্গল রেজিমেন্ট যাচ্ছে। এখন সেনাবাহিনীর প্রতি অনেকেরই তেমন আগ্রহ বা ভালোবাসা নেই। কিন্তু ’৬৫--এর যুদ্ধের পর সেনাবাহিনীর প্রতি মানুষের ভালোবাসা সন্তানের বাবা-মার প্রতি, বাবা-মার সন্তানের প্রতি যেমন তেমনটা মনে হতো। আমাদের বহরে প্রায় দেড়-দুই শ গাড়ির মধ্যে ১০-১২টি ট্রাক, ৩ টনি খালি পিকআপ ছিল। রাস্তার দুই পাশের মানুষজন কাপড়-চোপড়, সাবান, তেল, সুগন্ধি, ফলফলারি, খাবারদাবার যে যেভাবে পেরেছে দুই দিক থেকে খালি ট্রাকে ছুড়ে মেরেছে। আমার মনে হয় ১০-১২টি ট্রাক ভরে গিয়েছিল। তাতে সাধারণ মানুষের ভালোবাসার দান ৩০-৪০ টনের কম হবে না। আমরা চলে এসেছিলাম প্রথম চট্টগ্রামে, তারপর কুমিল্লায়। পরের বছর শীতের মহড়া। পার্বত্য চট্টগ্রামের হায়াকু ধুমঘাটের কাছাকাছি কোথাও আমাদের ব্যাটালিয়ন শীতকালীন মহড়ায় ছিল। সে সময় বড়ভাই লতিফ সিদ্দিকী সেখানে গিয়েছিলেন। তখন মানবতা ছিল, ভালোবাসা ছিল, সম্মান ছিল। সেপাইদের কোথাও কোনো মূল্য নেই। কিন্তু তবু জেসিওরা বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তাঁবুর মধ্যে খাবারে চেয়ার-টেবিল যতটা সম্ভব সংগ্রহ করে বসতে দিয়েছিলেন। সকালে গিয়ে বিকালে ফেরার সময় তিনি বলেছিলেন, ‘বজ্র, লেখাপড়া শেষ না করে বাড়ি থেকে রাগ করে পালিয়ে এসেছিস। এ নিয়ে তোকে কিছু বলতে চাই না। এখন হয়তো তুই বুঝবি না। কিন্তু ১০-১৫ বছর পর আমি যখন আরও বড় হব, বড় কিছু করব তোর ছোট বোন রহিমা বিএ, এমএ পাস করে সমাজে সম্মানি হবে, আজাদ-মুরাদ-শাহানা-শুশু-বাবুল-বেলাল-মুন্নু ওরা যখন বড় বড় স্থানে থাকবে তুই তখন বিব্রত হবি। তোর খারাপ লাগবে।’

কীভাবে কীভাবে যেন তার এক বছর পর সেনাবাহিনী থেকে ফিরে এসে প্রাইভেটে ম্যাট্রিক দিয়ে করটিয়া কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। সে নিয়ে অনেক ঘটনা। কিন্তু আমি যখন কুমিল্লার লালমাই ক্যান্টনমেন্টের পাঞ্জাব লাইনে তখন কুমিল্লায় আওয়ামী লীগের এক বিশাল সভা হয়েছিল। প্রধান অতিথি ছিলেন চাঁদপুরের মিজানুর রহমান চৌধুরী, ছাত্রনেতা লতিফ সিদ্দিকী প্রধান বক্তা। মাঠে অসংখ্য লোকের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। পুলিশ, সেনাবাহিনীর লোক চলাফেরা এবং চুলকাটা দেখলেই বোঝা যায়। লতিফ সিদ্দিকীর বক্তৃতার সময় হাজারো লোক হাততালি দিয়েছিল। মাঠ ছিল উদ্বেল উত্তাল। এর পরে কুমিল্লায় গেলে শুধু লতিফ সিদ্দিকী আর লতিফ সিদ্দিকী। কুমিল্লার আফজল, বাহার, পাখিরা তখনো নেতা হননি। সে সময়ের কোনো একদিন ভৈরব কলেজের নবীনবরণ ছিল। লতিফ সিদ্দিকী প্রধান অতিথি, অন্য কয়েকজন ছাত্রনেতা বিশেষ অতিথি, আমাদের সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান সেখানে সাধারণ বক্তা। হলভর্তি ছাত্রছাত্রী। দরজার ফাঁক দিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে বক্তৃতা শুনেছিলাম। ওসব অনেকেরই জানার কথা নয়। টুঙ্গিপাড়া শেখ লুৎফর রহমানের ছেলে শেখ মুজিবুর রহমান আসমান থেকে বোঁটা ছিঁড়ে পড়া ছিলেন না। ষাটের দশকে শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, ওবায়দুর রহমান, শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, ’৬৯-এর মহানায়ক তোফায়েল আহমেদ, আ স ম আবদুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখন, শাজাহান সিরাজ, নূরে আলম সিদ্দিকী, টাঙ্গাইলের লতিফ সিদ্দিকী, ফজলুর রহমান ফারুক, আল মুজাহিদী... দেশব্যাপী এমন আরও কয়েক শ টগবগে যুবকের রক্তদান, শ্রম-ঘামে বঙ্গবন্ধু হয়েছিলেন। আমি কাদের সিদ্দিকী, আমার তো রিকশাওয়ালার চাইতে বড় কোনো যোগ্যতা ছিল না। বাড়ি পালিয়ে আমি তো রিকশাও চালিয়েছি। পড়ার চাইতে বেতকার তোমেজের সঙ্গে গরু চরাতে ভালো লাগত। সেই অপদার্থ বজ্রকে কত মানুষ ভালোবাসে, দোয়া করে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর রক্তের না হলেও রাজনীতির সন্তান হিসেবে যত্ন করেন। এটা তো লতিফ সিদ্দিকীর কারণেই। তাঁকে দেখে আমি বঙ্গবন্ধুকে পেয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধুকে পেয়ে আমি দেশকে চিনেছি, দেশের মাটিকে চিনেছি। ‘জননী জন্মভূমি স্বর্গাদপি গরীয়সী’ বুঝতে শিখেছি। দীর্ঘ সময় নির্বাসনের পর দেশে ফিরে ঢাকা বিমানবন্দরে পা রাখতে পারিনি। তপ্ত রোদে বুকে হেঁটেছিলাম। আজ আমার কাছে মা যেমন, মাটি তেমন। গাছপালা-তরুলতা-পশুপাখি, সন্তানসন্ততি আকুল করে রাখে। অথচ ছোটকালে কোনো নারীর রঙিন চোখ আমার হৃদয়ে দাগ কাটেনি। কুশিমণির একটি বিড়ালের চোখ আজ যেমন লাগে, দীপের কুকুরের চোখে যে মায়া খুঁজে পাই কেন যেন আমি সবার মধ্যে ওই একই রকম দেখি। এটা দোষের হলে আমার দোষ, গুণ হলে গুণ। আমার দেখা মতে একজন রিকশা-ওয়ালার গুরুকেও কেউ ভোলে না। রাজমিস্ত্রি, কাঠমিস্ত্রি, নাচগান সবখানে ওস্তাদের বা গুরুর মূল্য আছে, হৃদয়জুড়ে থাকে। শুধু রাজনীতি এমন একটা বিষয় মনে হয় সেখানে গুরু মারা কারবার। অনেক বয়স হয়েছে। আমি গুরু মারার দলে পড়তে চাই না। সেজন্য রাজনৈতিক নেতা হিসেবে বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীকে কখনো ছোট করতে পারি না। উনি আমাকে পড়াতে গিয়ে মারধর করেছেন, গালাগাল করেছেন। এমনকি স্বাধীনতার পর যখন আমার গায়ে একটা মাছি বসার সুযোগ ছিল না তখন ৫ জানুয়ারি ’৭২ হামিদুল হক মোহনকে নিয়ে তিনি আমাকে অবাঞ্ছিত কুকুর-বিড়ালের চাইতে খারাপ ভাষায় গালাগাল করেছিলেন। ১২০-৩০ জন যোদ্ধা আমাকে ঘিরে ছিল। যাদের দেখলে একসময় পাকিস্তানিদের কাপড় নষ্ট হয়ে যেত। তারা কিছু করতে পারেনি। শুধু মাথা নত করে নীরবে দাঁড়িয়েছিল। এসবই আল্লাহর দান, তাঁর মহিমা। আল্লাহ আমাকে দয়া করেছিলেন। সেদিন যদি গুলি চলত পিতার মতো বড় ভাইকে হারিয়ে ফেলতাম। কোনো অন্যায় না করেই স্বাধীন দেশে কত গালাগাল শুনেছি। আর সত্যিই এমন হলে কী হতো? আমি যত বড়ই হই, যত মহানই হই পিতার মতো বড় ভাইয়ের সঙ্গে বেআদবি অথবা তাঁর প্রাণের জন্য ইতিহাস কি আমাকে দায়ী করত না? যেমনটা আওরঙ্গজেবকে করা হয়। সম্রাট শাজাহানের চার ছেলে- দারা, মুরাদ, সুজা ও আওরঙ্গজেব। তিনি কিন্তু দারা, মুরাদ, সুজাকে হত্যা করেছিলেন। ধৈর্য আণবিক শক্তির চাইতেও শক্তিশালী। বড় ভাইয়ের গালাগালিতে আমার হৃদয়মন উতালা হয়ে গিয়েছিল। অঝরে চোখের পানি পড়ছিল। মার কাছে ছুটে গিয়েছিলাম। আমাদের তখন ঘরবাড়ি ছিল না। টিনের ছাপড়া তুলে আমার মা-বাবা সন্তানসন্ততি নিয়ে থাকতেন। চোখে পানি দেখে মা মাথায় এবং কাঁধে হাত দিয়ে বলেছিলেন, ‘বজ্র, আল্লাহ তোকে কত বড় করেছেন। বড় ভাই গালাগাল করেছে বুকে লেগেছে তাই চোখে পানি!’ বলেছিলাম, বাড়িতে তো কত মারধর করেছেন, গালাগাল করেছেন আরও করতেন। মা অবাক হয়ে বলেছিলেন, ‘বাড়িতে করলে তোর খারাপ লাগত না, হাজার লোকের সামনে করেছে তাই বুকফাটা কান্না? ঘরে বকলে আল্লাহ দেখত না?’ বলেছিলাম, নিশ্চয়ই দেখত। ‘বাইরে গালাগাল করেছে আল্লাহ দেখেননি?’ হ্যাঁ অবশ্যই দেখেছেন। ‘তাহলে কান্না কেন? ওঃ কিছু মানুষ তোমাকে গালাগাল করতে দেখেছে তাই কানছো? আল্লাহ দেখার জন্য কোনো কান্নাকাটি নেই? লোকজনের জন্য কান্না? তাহলে দয়ালু আল্লাহ কিছু না?’ মার কথায় আমার বুকের ওপর হিমালয়ের মতো চাপ নিমেষেই হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিল। আজ ৫৩ বছর কোনো চাপ নেই। যে কারণে আজও সুস্থ আছি, হাসিমুখে মানুষের কাছে যাই, পাশে দাঁড়াই, মানুষের দুঃখে দুঃখী হই, আনন্দে হাসি।

আমার হৃদয়মন বেদনায় মারাত্মক ভারাক্রান্ত। বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে ছিন্নভিন্ন হৃদয়ে কোনোরকম বেঁচে থাকার মতো অবস্থায় মা-বাবা যখন চলে যান তখন আরও কাতর হয়ে পড়েছিলাম। আকাশবাতাস থেকে কুশিমণি এসে আমার ভাঙা হৃদয়, শুধু আমার বলি কেন, আমার পুরো পরিবারের হৃদয়ে শান্তির সুবাতাস বইয়ে দিয়েছে। আনন্দের অথই সাগরে আমরা প্রতিনিয়ত হাবুডুবু খাই। এরকম একটি সময় সখিপুরে হতেয়ার দুটি বাচ্চা মেয়ে পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার খবর পেয়ে গিয়েছিলাম। বড় বেদনাদায়ক। আমার শুধু বোঝার প্রয়োজন ছিল বাচ্চাগুলোকে কি কেউ মেরেছে, না তারা পানিতে ডুবে মরেছে। দুঃখী দরিদ্র মানুষের ভালোবাসা সে যে কত গভীর যারা দেখেনি তারা বুঝতে পারবে না। গরিব মা-বাবার বুকফাটা কান্নায় কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছিল। এর আগে দাড়িয়াপুরের জাইলার মাঠে গিয়েছিলাম। সামিয়া নামে নয় বছরের তৃতীয় শ্রেণির একটি বাচ্চাকে অপহরণ করে মুক্তিপণ চেয়ে না পেয়ে মেরে ফেলেছে। এই যখন দেশের অবস্থা তখন দাড়িয়াপুরের সংগ্রামপুর জীবনে প্রথম একটি বিপুল সমাগমে সভা করেছি। বুক ভরে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম অভিযান ছিল এই সংগ্রামপুরে।

সেদিন বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী আটিয়া মাজার জিয়ারতে গিয়েছিলেন। সেখানে আমার ছোট ভাই মুরাদ সিদ্দিকী কয়েকজন লোক নিয়ে বাধা দিয়েছিল। হায়রে কপাল! যে লতিফ সিদ্দিকীর সামনে আইয়ুব-মোনেমের প্রশাসন টেকেনি, তাদের গুন্ডাবাহিনী ছাত্র সংগঠন এনএসএফ টেকেনি, সেখানে একই বাপের ঔরসজাত সন্তান, একই মায়ের গর্বজাত! শেষের দিক থেকে মুরাদ ২ নম্বর। আজাদ সব থেকে ছোট, মুরাদ তার বড়। ওপর থেকে আমি ২ নম্বর। বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী, তারপর আমি। যদিও আমার ওপর বড় এক বোন এক ভাই ছিল। সন্তানের মতো আমার তিনটে ছোট বোন আছে। কিন্তু মায়ের মতো কোনো বড় বোন ছিল না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে অভাব পূরণ করেছেন। তাই সব দিক থেকে আমি তৃপ্ত। কিন্তু এটা কী! লতিফ সিদ্দিকীকে বাধা কেন? তাও আবার মুরাদের! সেদিন আমার বাড়িতে বিখ্যাত শিল্পী নকুল এসেছিল। হঠাৎই সে বলে বসেছিল, ‘যার দল নাই তার বল নাই।’ আমি কতজনকে কত জ্ঞান দিই, কত কথা শোনাই, কত কথা শুনি। কিন্তু এভাবে জোড়া লাগিয়ে ‘যার দল নাই তার বল নাই’ কখনো বলিনি, বলতে পারিনি। আমি সেদিন মুরাদকে ডেকেছিলাম। বিকাল ৫টায় আসতে বলেছিলাম। কাজ ছিল বলে রাত ৯টায় এসেছিল। অনেক সাক্ষাৎপ্রার্থী ছিল বলে কেবলই খেতে বসেছিলাম। খাওয়া শেষ হওয়ার আগেই অনেকটা রূঢ়ভাবে বলেছিল, ছোট ভাই কী বলবেন বলেন? আমি খাওয়াকে খুব মান্য করি। আহারকে আমি আল্লাহর নেয়ামত মনে করি। খুব যত্ন নিয়ে খাবার চেষ্টা করি। খাবার সময় অন্য খেয়াল রাখি না। কিন্তু তবু ওর কাজ ছিল বলে রূঢ় ভাষায় দু-চারটি কথা বলে চলে যায়। লতিফ ভাইকে যেদিন আটিয়াতে বাধা দিতে গিয়েছিল সেদিন ওর সঙ্গে আমার চার-পাঁচ বার কথা হয়। একবারও ভালো কথা ছিল না। আমার ভাই মৌলভী মুহাম্মদ আবদুল আলী সিদ্দিকীর ছেলে, মা লতিফা সিদ্দিকী। আমার জীবনে আমি অমন ধৈর্যশীল সোনার মানুষ দেখিনি তার সন্তানের ওরকম আচরণ শোভা পায়? পায় না। ওর সঙ্গে ফোনে বেশ কয়েকবার কথা হয়। ও বলে, ‘আপনি আমাদের পরিবারের মাথার মুকুট। কিন্তু লতিফ সিদ্দিকীকে টাঙ্গাইল ঢুকতে দেব না, কালিহাতীতে ঢুকতে দেব না।’ এটা কেন? স্বাধীন দেশ, এখনো আমরা বেঁচে আছি। স্বাধীনতার কারিগরকে সে স্বাধীন দেশে থাকতে চলতে দেবে না এটা কেমন কথা? কেউ কেউ বলছে কারও কারও উসকানিতে নাকি মুরাদ এসব করছে। হতে পারে। সে কার উসকানি? কেউ বলছে টাঙ্গাইল আওয়ামী লীগের মাননীয় সংসদ সদস্য জোয়াহের। হতেই পারে। জোয়াহেরকে আমি কোলে নিইনি, কিন্তু আমাদের নেতা আরজু ভাইয়ের যে বোনকে জোয়াহের বিয়ে করেছে তাকে তো কোলে নিয়েছি। কেউ বলছে, ফারুক ভাই এখন রিং লিডার। হতেও পারে। ফারুক ভাই ভুলে গেলেও আমি তো ভুলিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় চরম ঝুঁকি নিয়ে তার বাড়িতে টাকা পাঠিয়েছি। কোনো দিন বড়দের আগে চেয়ারে বসিনি। মন্ত্রী থাকতে লতিফ ভাইও তার চিকিৎসার জন্য বহুকিছু করেছেন। শুনছি ঢাকা থেকেও নাকি কোনো কোনো নেতা ওকে উসকানি দেয়। নেতাদের সবাইকে চিনি। তারা আগেও যেমন দাদা বলে পরম শ্রদ্ধা করত, এখনো করে। তারা অনেকেই যখন পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে তাদের সালামের মূল্য তো আমাকে দিতেই হয়। কী আর বলতে পারি, মুরাদের সঙ্গে এসব যারা করে তাদেরও বলছি, সীমা লঙ্ঘনকারীদের আল্লাহ বরদাশত করেন না। আল্লাহর বান্দারা কী করেন? তারাও করেন না। এই দুঃখজনক ঘটনার পর অনেকেই ফোন করেছিল। ব্যক্তিগতভাবেও আওয়ামী লীগের বহু নেতা দেখা করে কথা বলেছে। কেউ বলেছে স্যার, কেউ বলেছে দাদা, ‘পিতার মতো বড় ভাইকে যে এমনভাবে হেনস্তা করতে পারে সে তো দলে ঢুকলে আমাদের পাছায় লাথি মেরে দুই দিনেই বের করে দেবে।’ কথাটা যে একেবারে যুক্তিহীন তা বলি কী করে? ২৯ সেপ্টেম্বর শুক্রবার পিতার মতো বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীর সঙ্গে আমরা পরিবারের সবাই ছাতিহাটি যাব। তোমাকেও আহ্বান করছি, মুরাদ সিদ্দিকী। সন্তানের মতো ভাই হিসেবে তুমিও আমাদের পাশে বাবা-মার কবরের সামনে দাঁড়িয়ে সমস্ত ভুলত্রুটি ভুলে দেশের সেবা, জনগণের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়বে- এটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা।

লেখক : রাজনীতিক

www.ksjleague.com

সর্বশেষ খবর